Sunday, July 8, 2018

শ্রীরামচন্দ্র দত্ত

রামচন্দ্র দত্ত ১২৫৮ সালে কলিকাতার পূর্বভাগে নারিকেলডাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম নৃসিংহপ্রসাদ দত্ত, মাতার নাম তুলসীমণি। অল্প বয়সেই রামচন্দ্রের মাতৃবিয়োগ হয়। মাতৃহীন শিশুকে আত্মীয়েরা লালন-পালন করিতে থাকেন।

নৃসিংহপ্রসাদ প্রভূত ধনসম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। কিন্তু দৈবদুর্বিপাকে সে সকলই নষ্ট হইয়া যাওয়ায়, তিনি বিশ্বনাথ দত্তের (গ্রন্থকারের পিতার) শিমলার বাটীতে আসিয়া বাস করেন। নৃসিংহপ্রসাদ সম্পর্কে বিশ্বনাথ দত্তের সহধর্মিণী ভুবনেশ্বরী দেবীর দাদামহাশয় ছিলেন। বিশ্বনাথ ও তাঁহার সহধর্মিণী রামচন্দ্রকে আপনাদের ছেলের মতো মানুষ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের ছেলেমেয়েরাও রামচন্দ্রকে বড় ভাই-এর মতো দেখিতেন ও তাঁহাকে 'রামদাদা' বলিয়া ডাকিতেন। রামচন্দ্র গ্রন্থকারকে 'চনি' বলিয়া ডাকিতেন।

রামচন্দ্র ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল হইতে ডাক্তারি পাস করেন। পরে, তিনি বাংলা সরকারের রাসায়নিক পরীক্ষকের প্রধান সহকারী হইয়াছিলেন। অধ্যবসায়গুণে তিনি রসায়ন শাস্ত্রে সুনাম অর্জন করিয়াছিলেন। রসায়ন সম্বন্ধে ও অন্যান্য বিষয়ে তিনি কয়েকখানি গ্রন্থ ও প্রবন্ধাদিও রচনা করিয়াছিলেন। তিনি প্রভূত অর্থও উপার্জন করিয়াছিলেন।

রামচন্দ্র দয়া, পরোপকার প্রভৃতি বিবিধ সদ্গুণে ভূষিত ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে ও সংস্রবে রামচন্দ্রের ধর্মজীবনের গতি এক বিশিষ্ট ধারায় প্রবাহিত হয়। গুরুর প্রতি অব্যভিচারিণী ভক্তি তাঁহার ধর্মজীবনকে অপূর্ব-শ্রীমণ্ডিত করিয়া রাখিয়াছে। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নাম ও ভাব প্রচার-প্রচেষ্টায়, প্রথমকালে, রামচন্দ্রই ছিলেন অধিনায়ক।

১৩০৫ সালে রামচন্দ্র পরলোক গমন করেন।

Saturday, July 7, 2018

গ্রন্থপ্রসঙ্গে

সুধী পাঠকদের কাছে পূজনীয় গ্রন্থকার শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়ের পরিচয় দেওয়া অনাবশ্যক। এই গ্রন্থের সকল খুঁটিনাটি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলাও নিষ্প্রয়োজন; মাত্র দু-একটি বিষয়ে সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করি।

গ্রন্থকার যে উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গ্রন্থখানি লিখেছেন, তা তাঁর 'নিবেদন'-এ সুস্পষ্ট। গ্রন্থখানি জীবনী নয়, জীবনী-চিন্তন - সুপ্রাচীন গ্রন্থকারের শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে অনুধ্যান। এইজন্যে শ্রীরামকৃষ্ণের সকল জীবন-বৃত্তান্ত যে পরিজ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে প্রথমেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের বহু দিক বিভিন্ন মনীষী এর পূর্বে পর্যালোচনা করেছেন; কিন্তু তাঁর ক্রিয়াকলাপ ও মনোবৃত্তি ঠিক এ রকম দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন শাস্ত্রসহায়ে কেউ ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন কিনা জানি না। অন্যান্য বহু বিষয়েও গ্রন্থকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত যে সম্পূর্ণ পৃথক, তাও তীক্ষ্ণদর্শী পাঠকেরা লক্ষ্য করবেন।

বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয়, প্রচলিত বহু দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত স্বকীয় মতবাদসমূহের উপর ভিত্তি করে গ্রন্থকার শ্রীরামকৃষ্ণের ক্রিয়াকলাপ ও মনোবৃত্তি বিশ্লেষণ করেছেন। এ সকল বিভিন্ন দুরূহ মতবাদ সম্বন্ধে তাঁর কতকগুলি স্বতন্ত্র বিশদ গ্রন্থও আছে; কিন্তু বড়ই আক্ষেপের বিষয় যে, সেগুলির অধিকাংশই নানা কারণে আজও অপ্রকাশিত রয়েছে।1

আর একটি বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয়, গ্রন্থকার কোন বস্তু বা কোনো বিষয়ের নির্দিষ্ট সীমারেখা টানেননি এবং তাদের পারস্পরিক বিরোধের কথাও বলেন নি। প্রকৃত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকের মতো তিনি সকল বস্তু ও সকল বিষয়ের মধ্যে একটি প্রাণময় যোগসূত্র বার করার প্রয়াস পেয়ে এক মহামিলনের - পূর্ণতার বাণীই শুনিয়েছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী - শক্তির উৎস, তা কখনো রুদ্ধ হবার নয়; তাঁর বাণী - ব্রহ্মবীজ, তাও কখনো নষ্ট হবার নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী ও বাণী পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের মনীষীদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছে; তাঁর জীবনী ও বাণী মানব-জাতির সম্পদ। শ্রীরামকৃষ্ণের মতো একজন পুরুষের জীবনের প্রতিটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করার এবং তাঁর ক্রিয়াকলাপ ও মনোবৃত্তি বিশ্লেষণ ও সমীক্ষণ করার প্রয়োজনও তাই সমধিক। এজন্য গ্রন্থকার শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে তাঁর সঞ্চিত স্মৃতি - দৃষ্ট ঘটনা ও উপলব্ধ বিষয়সমূহের কিছু লিপিবদ্ধ করে সকলের বিশেষ কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। এ স্মৃতি-লেখার ঐতিহাসিক মূল্য তো আছেই, অধিকন্তু সত্যানুসন্ধিৎসু জনের কাছে এর সার্থকতা যথেষ্ট। আর বহুশাস্ত্রবিৎ বহুদর্শী গ্রন্থকার শ্রীরামকৃষ্ণের কল্যাণপ্রদ জীবনের বিশেষ একটি দিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পর্যালোচনা করে যে অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত করেছেন, এখন না হোক কালে নিশ্চয়ই তা দেশ-বিদেশের স্বাধীন চিন্তাশীল মনীষীদের গভীর ধ্যানের বিষয় হবে এবং তাঁদের এই ধ্যানপ্রসূত সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়ে ভবিষ্য মানব-সমাজ যে প্রভূত উপকৃত হবে তাও সুনিশ্চিত।

পরিশেষে, যাঁদের সাহচর্য ও সহানুভূতিতে, যুদ্ধের দরুন বর্তমান ওলটপালট অবস্থায় বহু অসুবিধার মধ্যেও, এই গ্রন্থ-সম্পাদন সম্ভব হয়েছে তাঁদের প্রত্যেকেরই প্রতি, কোনো রকম লৌকিকতা না করে আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ন্যস্ত কর্মভার সম্পাদনে, অনবধানতাবশতঃ যদি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে তো সে দোষ আমার; ক্ষমাশীল পাঠকদের কাছে সেজন্য মার্জনা ভিক্ষা করি।

শ্রীধীরেন্দ্রনাথ বসু
প্রথম সংস্করণ


1. বর্তমানে সেগুলি প্রকাশিত।

Friday, July 6, 2018

নিবেদন

বর্তমান সংস্করণটি পাঠকবর্গের পঠন-সুবিধার্থে ডি.টি.পি.-তে ছাপা হইল। মুদ্রাকর - শৈলী প্রেসের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাই। পাঠকবর্গের আগ্রহের জন্য গ্রন্থটির অষ্টম সংস্করণটি শীঘ্রই নিঃশেষিত হইবে আশা করি।

প্রকাশক
অষ্টম সংস্করণ

Thursday, July 5, 2018

কৃতজ্ঞতা

পূজনীয় শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়ের বহু অমূল্য পাণ্ডুলিপি এখনো অপ্রকাশিত রহিয়াছে। বর্তমান পুস্তকখানি সেগুলিরই অন্যতম। কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহৃদয় ব্যক্তির আগ্রহ ও সাহায্য ব্যতীত এই পুস্তকখানি আজ প্রকাশ করা কিছুতেই সম্ভবপর হইয়া উঠিত না। তন্মধ্যে, কলিকাতা কর্পোরেশনের ভূতপূর্ব কাউন্সিলর শ্রীরামচন্দ্র শেঠ, বি, এল, এবং প্রিয়ভাষী কর্মী ডাঃ শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র শেঠ মহাশয়দ্বয়ের পরমারাধ্যা মাতৃদেবী শ্রীমতী নন্দরাণী শেঠ মহাশয়া অর্থসাহায্য দ্বারা আমাদিগের এই পুস্তক প্রকাশনের ব্যয়ভার বহুল অংশে লাঘব করিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত, শ্রীবিধুভূষণ ঘোষাল, শ্রীশংকরপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীরমেশচন্দ্র মিত্র, শ্রীরবীন্দ্রনাথ মিত্র ও শ্রীযতিপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, বি, এ, কাব্যসাংখ্যতীর্থ, মহাশয়গণ পুস্তকের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত, প্রুফ-সংশোধন ও আনুষঙ্গিক কার্যে বহু অধ্যবসায় ও ধৈর্য অবলম্বনপূর্বক নানাভাবে সাহায্য করিয়াছেন। শ্রীশচীন্দ্রনাথ সিংহ, এম.এ, শিল্পী শ্রীনির্মলকুমার দে ও মনোরঞ্জন দাস মহাশয়গণ বিভিন্ন বিষয়ে অতি আন্তরিকভাবে সাহায্য করিয়াছেন।

এই পুস্তকে সন্নিবিষ্ট শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব ও শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দের ছবি দুইখানি আমরা 'উদ্বোধন' কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে এবং মহাত্মা রামচন্দ্র দত্তের ছবিখানি আমরা তাঁহার অন্যতম দৌহিত্র ডাঃ শ্রীসতীন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত হইয়াছি। পরবর্তী ছবিখানি সম্বন্ধে এ স্থলে উল্লেখযোগ্য যে, মূল ফোটোখানি সামান্যমাত্র পরিবর্তিতরূপে মুদ্রিত করা হইয়াছে। 'কিশোর বাংলা'-র কর্তৃপক্ষের নিকটে আমরা কয়েকটি বিষয়ে সাহায্যলাভ করিয়া উপকৃত হইয়াছি। ক্যালকাটা ইউনাইটেড প্রিন্টার্স লিমিটেডের সুযোগ্য ম্যানেজার শ্রীমণীন্দ্রনাথ দে মহাশয়ও তাঁহার পরামর্শ-সাহায্যাদি দ্বারা আমাদিগের যথেষ্ট উপকার করিয়াছেন। পরিশেষে, ইহা বিশেষরূপে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শ্রীধীরেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের সম্পাদন ও তত্ত্বাবধান ব্যতিরেকে এই পুস্তকখানি বর্তমানে সুন্দর করিয়া প্রকাশ করিবার প্রয়াস আমাদিগের পক্ষে মোটেই সহজ হইত না। ইঁহাদিগের প্রত্যেকের প্রতি এবং আরও যে-সকল শুভাকাঙ্ক্ষী ও সুধীজন অলক্ষ্যে থাকিয়া এই পুস্তক প্রকাশনে নানাভাবে সাহায্য করিয়াছেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেকের প্রতি, আমরা গুণমুগ্ধচিত্তে ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি। ইতি,

বিনীত
শ্রীপ্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়

প্রথম সংস্করণ
১২ ফাল্গুন শুক্রবার, ১৩৫০

Wednesday, July 4, 2018

নিবেদন

পরমহংস মশাই মাঝে মাঝে, বোধ হয় ১৮৮২ বা ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দের মধ্যভাগ হইতে ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যভাগ পর্যন্ত রামদাদার বাড়িতে আসিয়া অনেক কথাবার্তা কহিয়াছিলেন। আমি যদিও অনেক সময় সেখানে উপস্থিত থাকিতাম, কিন্তু তখন আমার বয়স অল্প হওয়ায়, সেই সকল কথার অর্থ বিশেষ বুঝিতে পারি নাই; আর অনেক দিনকার ঘটনা হওয়ায়, এখন সেই সকল কথাবার্তা বিশেষ কিছু স্মরণও নাই। বোধ হয়, অপরেও সেই সকল কথাবার্তা বিশেষ কিছু স্মরণ করিয়া রাখেন নাই বা সেই সম্বন্ধে বিশেষ কিছু লিখিয়া যান নাই। সেই সকল ঘটনার যে বিশেষ কোনো সার্থকতা আছে এবং পরে যে সেগুলির বিশেষ কোনো মূল্য হইবে, এ বিষয়ে তখন কেহ চিন্তাও করেন নাই। সকলেই এই সকল ঘটনা অতি সাধারণ ব্যাপার মনে করিতেন বলিয়া পরমহংস মশাই-এর কথাবার্তা বিশেষ মন দিয়া শুনেন নাই, বা বিশেষ কিছু লিখিয়া রাখেন নাই। এইজন্য, এ বিষয় অতি সামান্যভাবে যাহা আমার স্মরণ আছে, তাহা এ স্থলে বিবৃত করিতে চেষ্টা করিয়াছি; আর সেই সময় পরমহংস মশাই-এর যেরূপ ভাব-ভঙ্গী দেখিয়াছি এবং তাহা দেখিয়া আমার মনে যে প্রকার ভাবের উদয় হইত তাহা ব্যক্ত করিতে প্রয়াস পাইয়াছি। অনেক দিনকার পুরানো কথা হওয়ায়, প্রত্যেক বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে মনে আনিতে পারিতেছি না; তবে যেটুকু পারিতেছি ও ঠিক বলিয়া বোধ হইতেছে কেবল সেইটুকুই বিবৃত করিতেছি। ঠিক পর পর কোন্ দিন কি ঘটিয়াছিল এবং কথাবার্তাকালে পরমহংস মশাই বা অন্য কেহ ঠিক যে কি ভাষা ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহাও স্মৃতিতে আনিতে পারিতেছি না। এইজন্য বিবৃত ঘটনাগুলির আগু-পাছু হইয়া যাওয়া সম্ভব এবং কথাবার্তার ভাষাও বদলাইয়া যাওয়া সম্ভব। যে সকল ঘটনা আমি নিজ চক্ষে দেখি নাই, সেগুলি অপরের মুখে যেমন শুনিয়াছি, তেমন লিখিয়াছি; কিন্তু, সকল ক্ষেত্রে তাহাদের নাম উল্লেখ করা সম্ভব হয় নাই।

এই গ্রন্থের পূর্ব ভাগে, অন্যান্য বিষয়ের সহিত, পরমহংস মশাই-এর জীবনের কতকগুলি ঘটনা ও প্রক্রিয়ার বিষয় সন্নিবেশ করা হইয়াছে, কিন্তু সেগুলি বিশ্লেষণ করা হয় নাই। পরমহংস মশাই-এর ক্রিয়াকলাপ বিশ্লেষণ করিলে, তিনি যে এক অতীব মহান দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ছিলেন, তাহা বেশ স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়; কারণ, তিনি নিজ অনুভূত বহু নূতন দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক সত্যের জীবন্ত রূপ দিয়াছিলেন। পরমহংস মশাই-এর ক্রিয়াকলাপ অনুধাবন করিলে অনেক প্রকার নূতন দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মতের সাহায্যে তাহার কয়েকটি মাত্র অতি সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করিতে প্রয়াস পাইয়াছি, কারণ, সবগুলি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করিতে হইলে স্বতন্ত্রভাবে বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করা আবশ্যক। আমি যেগুলি বিশ্লেষণ করিয়াছি, সেগুলি গ্রন্থের উত্তর ভাগে লিপিবদ্ধ করিয়াছি। ইহাতে যদি ভ্রম হয়, তবে সে ত্রুটি আমার; কারণ আমার ক্ষুদ্র শক্তিতে ও সামান্য বুদ্ধিতে তাঁহার সম্বন্ধে অল্পমাত্র যাহা বুঝিয়াছি, তাহাই এ স্থলে প্রকাশ করিয়াছি।

পরমহংস মশাই-এর মতো আদর্শ পুরুষের বিষয় কোনো কিছু বলা অতীব দুরূহ। পরমহংস মশাই-এর যে বহুবিধ ভাব ও বহুবিধ শক্তি ছিল, আমরা সে সকল কিছুই নির্ণয় করিতে পারি নাই। ভক্তিমার্গের লোকেরা তাঁহাকে মহাভক্ত বলিতেন; জ্ঞানমার্গের লোকেরা তাঁহাকে মহাজ্ঞানী বলিতেন; দার্শনিকগণ তাঁহাকে দর্শনশাস্ত্রের প্রতিমূর্তি বলিতেন; বৈজ্ঞানিকগণ তাঁহাকে বিজ্ঞানশাস্ত্রের প্রমাণপুরুষ বলিতেন; এবং অন্যান্য মতাবলম্বীগণও তাঁহাকে নিজ নিজ মতের আদর্শপুরুষ বলিয়া গ্রহণ করিতেন। পরমহংস মশাই-এর বিষয় অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়াছে সত্য, কিন্তু আরো অধিকসংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশ করা আবশ্যক; কারণ, তাহা হইলে, তাঁহার জীবনী বিশদভাবে আলোচিত হইতে পারে এবং বিভিন্ন দিক হইতে তাঁহাকে বুঝিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে।

এই গ্রন্থ পাঠে যদি কাহারো কিছুমাত্র উপকার হয়, তাহা হইলে আমার শ্রম সার্থক হইল মনে করিব।

বিনীত,
শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্ত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথি
১২ ফাল্গুন, শুক্রবার, ১৩৫০
৩, গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রীট,
কলিকাতা - ৬

Monday, July 2, 2018

মহাপুরুষদিগের বাণী

মহাপুরুষদিগের বাণীসমূহ পর্যালোচনা করিলে, আমরা তিন শ্রেণীর বাণী দেখিতে পাই।

এক প্রকার বাণী হইল - বিধিমূলক। এই সকল সময়োপযোগী বিধি অবলম্বন ও প্রতিপালন করিলে, মানবের অশেষ হিতসাধন হইতে পারে। এইজন্য, তাঁহারা অনেকগুলি বিধি-বাক্যের নির্দেশ দিয়া যান।

অপর এক প্রকার বাণী হইল - নিষেধমূলক। সমাজে যে সকল দুর্নীতির প্রচলন রহিয়াছে এবং যে সকল কারণের জন্য সমাজে বিশৃঙ্খলতা আসিয়াছে ও মানব-মন নিম্নগামী হইয়াছে, সেই সকল দুর্নীতি দূর করিবার জন্য: মহাপুরুষগণ উপদেশচ্ছলে বাল্য-উপাখ্যান, রূপকথা প্রভৃতি দিয়া কতকগুলি নিষেধ-বাণী কহিয়া থাকেন। উচ্চমনা ধীশক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষগণ, মানব-জীবনের কদর্য ভাবসমূহ দেখিয়া ব্যথিত হইয়া, নানারূপ নিষেধ-বাণী কহিয়া যান। সেগুলি পালন করিলে ভবিষ্য-সমাজের মঙ্গল হইতে পারে।

বিধি-বাক্য ও নিষেধ-বাণী দুই-ই হইল স্থানীয় ও সাময়িক ব্যাপার। সমাজের দুর্নীতি তিরোহিত হইলে, এই সকল বিধি ও নিষেধ তত ফলদায়ক হয় না; এমন কি, কয়েক শত বৎসর পর, এই সকল বিধি ও নিষেধ, অল্প বা অধিক পরিমাণে, পরিবর্তন করিতে হয়। এই সকল বিধি ও নিষেধ চিরস্থায়ী - এ কথা কেহ যেন মনে না করেন। এ সকলই হইল দেশ-কাল ইত্যাদির অন্তর্গত; এইজন্য, ইহাদের কার্যকারিতা বা সার্থকতা মাত্র কিছুকালের জন্য থাকে। কিছুকাল পরে, ইহারা আপনা-আপনি নিষ্ফল হইয়া যায় এবং তখন, এই সকল বিধি ও নিষেধের পরিবর্তন নিতান্ত আবশ্যক হইয়া উঠে।

মহাপুরুষদিগের আর এক প্রকার বাণী আছে, যাহা শাশ্বত ও সার্বভৌম। এইরূপ বাণী Transcendentalism বা 'অনুত্তর সম্যক্ সম্বোধি'-র ভাব প্রকাশ করিয়া থাকে। বিধিমূলক ও নিষেধমূলক বাণীসমূহ ভবিষ্যতে যেরূপ লুপ্ত হইয়া যায়, এই নিত্য ও বিশ্বব্যাপী বাণীগুলি সেরূপ লুপ্ত হইয়া যায় না। এইগুলি চিরস্থায়ী ও কালজয়ী। এইজন্য, এইরূপ বাণী সর্ব স্থানে, সর্ব দেশে ও সর্ব জাতির ভিতর প্রযোজ্য।

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক পাঠ করিলে বেশ স্পষ্ট বুঝা যায় যে, চিন্তাশীল বুদ্ধদেব, সমাজে যে সকল দুর্নীতির আবির্ভাব হইয়াছিল, সে সকল দূরীকরণ করিবার জন্য কতকগুলি বিধিনিষেধ নির্ধারণ করিতেছেন। বুদ্ধদেবের যে বাণী - "জাতি, জরা, মৃত্যু নিরাকরণ করিব; অনুত্তর সম্যক্ সম্বোধি লাভ করিব", তা চিরন্তন। বুদ্ধদেবের 'দ্বাদশ নিদান'ও1 সনাতন।

প্রভু যীশুর বাণী বা উক্তি পাঠ করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, তিনি অনেক স্থানে সামাজিক প্রথা এবং অন্যান্য প্রথাসমূহ প্রবর্তন করিবার চেষ্টা করিতেছেন। যীশুর বাণী এবং ইহুদীদিগের ইতিহাস একত্র পাঠ করিলে বেশ স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইহুদী সমাজের কিরূপ অবস্থা ছিল এবং কিরূপ দূষণীয় আচার-পদ্ধতি ইহুদী সমাজে প্রচলিত ছিল। সেইজন্য, চিন্তাশীল যীশু এই সকল নিষেধ করিতেছেন।

মহাপণ্ডিত তীক্ষ্ণধী ও ওজস্বী পল2 যদিও জীবনের প্রথম অবস্থায় যীশুর সম্প্রদায়ের পরম বিরোধী ছিলেন এবং যীশুর অন্তেবাসীদিগকে নানা প্রকার নির্যাতন করিয়াছিলেন, কিন্তু দামাস্কাস যাত্রাকালে, যখন শূন্যপথে যীশুর দেখা পাইলেন, তখন হইতে তিনি যীশুর ভক্ত হইলেন। পল বিরক্ত হইয়া, স্থবির ও সংকীর্ণ ইহুদী সমাজ পরিত্যাগ করিয়া, গ্রীক ও রোমান সমাজের আচার-পদ্ধতি গ্রহণ করিয়া উদার ভাব প্রচার করিলেন, যাহাতে যীশুর ভাবসমূহ জগতের সর্বত্র প্রচারিত হইতে পারে। এইজন্য, জগতে খ্রীষ্টীয় ধর্মের এত প্রচার হইয়াছিল।

এই স্থানে ইহা জানা আবশ্যক যে, যীশুর নামে প্রচলিত গ্রন্থসমূহ পাঠ করিলে আমরা অনেক সময় সন্দিহান হইয়া থাকি যে, কোন্ ভাবটি যীশুর ছিল এবং কোন্ ভাবটিই বা পল-এর ভাবের ছায়া অনুযায়ী লিখিত হইয়াছে। কারণ পল-এর ভাব প্রচারিত হইয়া দৃঢ়ীভূত হইবার পর, যীশুর কয়েকখানি জীবনী লিখিত হয়। এইজন্য পল-প্রণোদিত যীশুর ভাবমাত্র আমরা গ্রন্থে পাই, কিন্তু যীশুর আসল ভাব যে কি ছিল, তাহা বুঝা যায় না।

যাহা হউক, সমাজকে পরিবর্ধিত করিতে হইলে কি উপায় অবলম্বন করিতে হইবে, সে বিষয় যীশু ও পল উভয়েই চিন্তা করিয়াছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীসমূহ বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলেও, আমরা এইরূপ তিন শ্রেণীর বাণী দেখিতে পাই। সমাজের দুর্নীতিসমূহ স্বচক্ষে দেখিয়া, বহু বৎসর ধরিয়া চিন্তা করিয়া তিনি কতকগুলি বিধি-নিষেধ নির্দেশ করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সমস্ত ভাবগুলি একসঙ্গে মিলাইলে সাধারণ লোকের পক্ষে তাহার তাৎপর্য বুঝিতে অসুবিধা হইতে পারে, এবং মনে চাঞ্চল্য আসিতে পারে; কারণ, সব ভাবগুলি, সকল সময়ে ও সকল দেশে প্রযোজ্য নয়। এইজন্য, স্বামী বিবেকানন্দ বহু বৎসর চিন্তা করিয়া আরো কতকগুলি বিধি-নিষেধ প্রণয়ন করিয়াছিলেন, এবং নিজের ধীশক্তি দিয়া অনেক প্রকার নতুন ভাব প্রচার করিয়াছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ কেন এইরূপ বিধি-নিষেধ নির্ধারণ করিলেন? পূর্বতন মহাপুরুষগণ যে ঠিক এইভাবে বিধি-নিষেধ করেন নাই এবং এইভাবে কথা বলেন নাই, ইহারই বা তাৎপর্য কি? - ইহার কারণ বুঝিতে হইলে, শ্রীরামকৃষ্ণের সময় কলিকাতার ও বাংলাদেশের সমাজের অবস্থা কিরূপ ছিল তাহার বিষয় কিছু জানা আবশ্যক। কেবল শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি ও বাণী পাঠ করিলেই সেগুলির সার্থকতা বুঝা যায় না। সমাজের অবস্থা অবগত না হইলে, চিন্তাশীল ব্যক্তির মনোভাব বুঝা সম্ভবপর নয়।

সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক কি? - সমাজ ব্যক্তি উৎপন্ন করিয়া থাকে; সমাজের নানা প্রকার চঞ্চল ভাব হইতে মহাপুরুষ আবির্ভূত হইয়া থাকেন। সমাজের ভাব চঞ্চল ও বিক্ষুব্ধ না হইলে, চিন্তাশীল ও ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি উদ্ভূত হইতে পারেন না। সমাজ আবশ্যক শক্তিপুঞ্জ কেন্দ্রীভূত করিলে, মহাপুরুষের অভ্যুত্থান হইয়া থাকে, এবং পরিশেষে, এই মহাপুরুষই সমাজকে পরিচালন করিয়া থাকেন। A great man is the outcome of revolution, fulfils the revolution and is the father of future ages - অর্থাৎ, মহাপুরুষ বিপ্লবের পরিণতি, বিপ্লবকে পূর্ণতা দান করেন, এবং ভবিষ্য যুগের স্রষ্টা।

সমাজ এবং ব্যক্তির মধ্যে ইহাই হইল পরস্পর সম্পর্ক।


1. ১. অধিবিদ্যা। ২. সংস্কার। ৩. বিজ্ঞান। ৪. নাম-রূপ। ৫. ষড়ায়তন। ৬. স্পর্শ। ৭. বেদনা। ৮. তৃষ্ণা। ৯. উপাদান। ১০. ভব। ১১. জাতি। ১২. জরা, মৃত্যু, দুঃখ, দৌর্মনস্য। পরস্পর পরস্পরের কারণ বলিয়া, এইগুলির নাম নিদান। বোধিবৃক্ষমূলে তপস্যাকালে বুদ্ধদেব সৃষ্টির আদিকারণ সম্বন্ধে পর্যালোচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার মতে, এই দ্বাদশ নিদান কার্য-কারণ তত্ত্বের বিষয় ও পরিণাম।

2. মহাত্মা পল-এর পূর্বকার নাম ছিল 'সল'। প্রথম জীবনে তিনি ঘোর খ্রীষ্ট-বিদ্বেষী ছিলেন। তিনি খ্রীষ্ট-অনুচরগণকে নির্যাতন করিবার মানসে দামাস্কাস-এর নিকট পৌঁছিলে, অকস্মাৎ, আকাশ হইতে তাঁহার চতুর্দিকে এক জ্যোতি দীপ্তি পাইল। সল ভূমিতে পড়িয়া যাইলেন এবং একটি বাণী শুনিতে পাইলেন - "সল, সল, তুমি আমাকে নির্যাতন করিতেছ কেন?" সল জিজ্ঞাসা করিলেন, "প্রভো, আপনি কে?" উত্তর হইল, "আমি সেই যীশু, তুমি যাহাকে নির্যাতন করিতেছ; কণ্টকের মুখে পদাঘাত করা তোমার পক্ষে দুষ্কর।" সল আশ্চর্যান্বিত হইয়া কম্পিতস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, "প্রভো, আপনার কি ইচ্ছা? আমি কি করিব?" প্রভু বলিলেন, "তুমি উঠিয়া শহরে যাও, যাহা করিতে হইবে, পরে জানিতে পারিবে।"

সল-এর সহগামীগণ কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া এবং এইরূপ কথাবার্তা শুনিয়া নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। সল ভূমি হইতে উঠিলেন এবং নেত্রদ্বয় উন্মীলন করিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। সহগামীগণ তাঁহার হাত ধরিয়া তাঁহাকে দামাস্কাস শহরে লইয়া যাইলেন। সল তিন দিন দৃষ্টিহীন অবস্থায় ছিলেন এবং কোনো কিছু আহার বা পান করেন নাই।

সল, পরে, খ্রীষ্ট-ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন এবং সেন্ট পল, অর্থাৎ, সাধু পল নামে পরিচিত হইয়াছিলেন।