মহাপুরুষদিগের বাণীসমূহ পর্যালোচনা করিলে, আমরা তিন শ্রেণীর বাণী দেখিতে পাই।
এক প্রকার বাণী হইল - বিধিমূলক। এই সকল সময়োপযোগী বিধি অবলম্বন ও প্রতিপালন করিলে, মানবের অশেষ হিতসাধন হইতে পারে। এইজন্য, তাঁহারা অনেকগুলি বিধি-বাক্যের নির্দেশ দিয়া যান।
অপর এক প্রকার বাণী হইল - নিষেধমূলক। সমাজে যে সকল দুর্নীতির প্রচলন রহিয়াছে এবং যে সকল কারণের জন্য সমাজে বিশৃঙ্খলতা আসিয়াছে ও মানব-মন নিম্নগামী হইয়াছে, সেই সকল দুর্নীতি দূর করিবার জন্য: মহাপুরুষগণ উপদেশচ্ছলে বাল্য-উপাখ্যান, রূপকথা প্রভৃতি দিয়া কতকগুলি নিষেধ-বাণী কহিয়া থাকেন। উচ্চমনা ধীশক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষগণ, মানব-জীবনের কদর্য ভাবসমূহ দেখিয়া ব্যথিত হইয়া, নানারূপ নিষেধ-বাণী কহিয়া যান। সেগুলি পালন করিলে ভবিষ্য-সমাজের মঙ্গল হইতে পারে।
বিধি-বাক্য ও নিষেধ-বাণী দুই-ই হইল স্থানীয় ও সাময়িক ব্যাপার। সমাজের দুর্নীতি তিরোহিত হইলে, এই সকল বিধি ও নিষেধ তত ফলদায়ক হয় না; এমন কি, কয়েক শত বৎসর পর, এই সকল বিধি ও নিষেধ, অল্প বা অধিক পরিমাণে, পরিবর্তন করিতে হয়। এই সকল বিধি ও নিষেধ চিরস্থায়ী - এ কথা কেহ যেন মনে না করেন। এ সকলই হইল দেশ-কাল ইত্যাদির অন্তর্গত; এইজন্য, ইহাদের কার্যকারিতা বা সার্থকতা মাত্র কিছুকালের জন্য থাকে। কিছুকাল পরে, ইহারা আপনা-আপনি নিষ্ফল হইয়া যায় এবং তখন, এই সকল বিধি ও নিষেধের পরিবর্তন নিতান্ত আবশ্যক হইয়া উঠে।
মহাপুরুষদিগের আর এক প্রকার বাণী আছে, যাহা শাশ্বত ও সার্বভৌম। এইরূপ বাণী Transcendentalism বা 'অনুত্তর সম্যক্ সম্বোধি'-র ভাব প্রকাশ করিয়া থাকে। বিধিমূলক ও নিষেধমূলক বাণীসমূহ ভবিষ্যতে যেরূপ লুপ্ত হইয়া যায়, এই নিত্য ও বিশ্বব্যাপী বাণীগুলি সেরূপ লুপ্ত হইয়া যায় না। এইগুলি চিরস্থায়ী ও কালজয়ী। এইজন্য, এইরূপ বাণী সর্ব স্থানে, সর্ব দেশে ও সর্ব জাতির ভিতর প্রযোজ্য।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক পাঠ করিলে বেশ স্পষ্ট বুঝা যায় যে, চিন্তাশীল বুদ্ধদেব, সমাজে যে সকল দুর্নীতির আবির্ভাব হইয়াছিল, সে সকল দূরীকরণ করিবার জন্য কতকগুলি বিধিনিষেধ নির্ধারণ করিতেছেন। বুদ্ধদেবের যে বাণী - "জাতি, জরা, মৃত্যু নিরাকরণ করিব; অনুত্তর সম্যক্ সম্বোধি লাভ করিব", তা চিরন্তন। বুদ্ধদেবের 'দ্বাদশ নিদান'ও1 সনাতন।
প্রভু যীশুর বাণী বা উক্তি পাঠ করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, তিনি অনেক স্থানে সামাজিক প্রথা এবং অন্যান্য প্রথাসমূহ প্রবর্তন করিবার চেষ্টা করিতেছেন। যীশুর বাণী এবং ইহুদীদিগের ইতিহাস একত্র পাঠ করিলে বেশ স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইহুদী সমাজের কিরূপ অবস্থা ছিল এবং কিরূপ দূষণীয় আচার-পদ্ধতি ইহুদী সমাজে প্রচলিত ছিল। সেইজন্য, চিন্তাশীল যীশু এই সকল নিষেধ করিতেছেন।
মহাপণ্ডিত তীক্ষ্ণধী ও ওজস্বী পল2 যদিও জীবনের প্রথম অবস্থায় যীশুর সম্প্রদায়ের পরম বিরোধী ছিলেন এবং যীশুর অন্তেবাসীদিগকে নানা প্রকার নির্যাতন করিয়াছিলেন, কিন্তু দামাস্কাস যাত্রাকালে, যখন শূন্যপথে যীশুর দেখা পাইলেন, তখন হইতে তিনি যীশুর ভক্ত হইলেন। পল বিরক্ত হইয়া, স্থবির ও সংকীর্ণ ইহুদী সমাজ পরিত্যাগ করিয়া, গ্রীক ও রোমান সমাজের আচার-পদ্ধতি গ্রহণ করিয়া উদার ভাব প্রচার করিলেন, যাহাতে যীশুর ভাবসমূহ জগতের সর্বত্র প্রচারিত হইতে পারে। এইজন্য, জগতে খ্রীষ্টীয় ধর্মের এত প্রচার হইয়াছিল।
এই স্থানে ইহা জানা আবশ্যক যে, যীশুর নামে প্রচলিত গ্রন্থসমূহ পাঠ করিলে আমরা অনেক সময় সন্দিহান হইয়া থাকি যে, কোন্ ভাবটি যীশুর ছিল এবং কোন্ ভাবটিই বা পল-এর ভাবের ছায়া অনুযায়ী লিখিত হইয়াছে। কারণ পল-এর ভাব প্রচারিত হইয়া দৃঢ়ীভূত হইবার পর, যীশুর কয়েকখানি জীবনী লিখিত হয়। এইজন্য পল-প্রণোদিত যীশুর ভাবমাত্র আমরা গ্রন্থে পাই, কিন্তু যীশুর আসল ভাব যে কি ছিল, তাহা বুঝা যায় না।
যাহা হউক, সমাজকে পরিবর্ধিত করিতে হইলে কি উপায় অবলম্বন করিতে হইবে, সে বিষয় যীশু ও পল উভয়েই চিন্তা করিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীসমূহ বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলেও, আমরা এইরূপ তিন শ্রেণীর বাণী দেখিতে পাই। সমাজের দুর্নীতিসমূহ স্বচক্ষে দেখিয়া, বহু বৎসর ধরিয়া চিন্তা করিয়া তিনি কতকগুলি বিধি-নিষেধ নির্দেশ করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সমস্ত ভাবগুলি একসঙ্গে মিলাইলে সাধারণ লোকের পক্ষে তাহার তাৎপর্য বুঝিতে অসুবিধা হইতে পারে, এবং মনে চাঞ্চল্য আসিতে পারে; কারণ, সব ভাবগুলি, সকল সময়ে ও সকল দেশে প্রযোজ্য নয়। এইজন্য, স্বামী বিবেকানন্দ বহু বৎসর চিন্তা করিয়া আরো কতকগুলি বিধি-নিষেধ প্রণয়ন করিয়াছিলেন, এবং নিজের ধীশক্তি দিয়া অনেক প্রকার নতুন ভাব প্রচার করিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ কেন এইরূপ বিধি-নিষেধ নির্ধারণ করিলেন? পূর্বতন মহাপুরুষগণ যে ঠিক এইভাবে বিধি-নিষেধ করেন নাই এবং এইভাবে কথা বলেন নাই, ইহারই বা তাৎপর্য কি? - ইহার কারণ বুঝিতে হইলে, শ্রীরামকৃষ্ণের সময় কলিকাতার ও বাংলাদেশের সমাজের অবস্থা কিরূপ ছিল তাহার বিষয় কিছু জানা আবশ্যক। কেবল শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি ও বাণী পাঠ করিলেই সেগুলির সার্থকতা বুঝা যায় না। সমাজের অবস্থা অবগত না হইলে, চিন্তাশীল ব্যক্তির মনোভাব বুঝা সম্ভবপর নয়।
সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক কি? - সমাজ ব্যক্তি উৎপন্ন করিয়া থাকে; সমাজের নানা প্রকার চঞ্চল ভাব হইতে মহাপুরুষ আবির্ভূত হইয়া থাকেন। সমাজের ভাব চঞ্চল ও বিক্ষুব্ধ না হইলে, চিন্তাশীল ও ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি উদ্ভূত হইতে পারেন না। সমাজ আবশ্যক শক্তিপুঞ্জ কেন্দ্রীভূত করিলে, মহাপুরুষের অভ্যুত্থান হইয়া থাকে, এবং পরিশেষে, এই মহাপুরুষই সমাজকে পরিচালন করিয়া থাকেন। A great man is the outcome of revolution, fulfils the revolution and is the father of future ages - অর্থাৎ, মহাপুরুষ বিপ্লবের পরিণতি, বিপ্লবকে পূর্ণতা দান করেন, এবং ভবিষ্য যুগের স্রষ্টা।
সমাজ এবং ব্যক্তির মধ্যে ইহাই হইল পরস্পর সম্পর্ক।
1. ১. অধিবিদ্যা। ২. সংস্কার। ৩. বিজ্ঞান। ৪. নাম-রূপ। ৫. ষড়ায়তন। ৬. স্পর্শ। ৭. বেদনা। ৮. তৃষ্ণা। ৯. উপাদান। ১০. ভব। ১১. জাতি। ১২. জরা, মৃত্যু, দুঃখ, দৌর্মনস্য। পরস্পর পরস্পরের কারণ বলিয়া, এইগুলির নাম নিদান। বোধিবৃক্ষমূলে তপস্যাকালে বুদ্ধদেব সৃষ্টির আদিকারণ সম্বন্ধে পর্যালোচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার মতে, এই দ্বাদশ নিদান কার্য-কারণ তত্ত্বের বিষয় ও পরিণাম।↩
2. মহাত্মা পল-এর পূর্বকার নাম ছিল 'সল'। প্রথম জীবনে তিনি ঘোর খ্রীষ্ট-বিদ্বেষী ছিলেন। তিনি খ্রীষ্ট-অনুচরগণকে নির্যাতন করিবার মানসে দামাস্কাস-এর নিকট পৌঁছিলে, অকস্মাৎ, আকাশ হইতে তাঁহার চতুর্দিকে এক জ্যোতি দীপ্তি পাইল। সল ভূমিতে পড়িয়া যাইলেন এবং একটি বাণী শুনিতে পাইলেন - "সল, সল, তুমি আমাকে নির্যাতন করিতেছ কেন?" সল জিজ্ঞাসা করিলেন, "প্রভো, আপনি কে?" উত্তর হইল, "আমি সেই যীশু, তুমি যাহাকে নির্যাতন করিতেছ; কণ্টকের মুখে পদাঘাত করা তোমার পক্ষে দুষ্কর।" সল আশ্চর্যান্বিত হইয়া কম্পিতস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, "প্রভো, আপনার কি ইচ্ছা? আমি কি করিব?" প্রভু বলিলেন, "তুমি উঠিয়া শহরে যাও, যাহা করিতে হইবে, পরে জানিতে পারিবে।"
সল-এর সহগামীগণ কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া এবং এইরূপ কথাবার্তা শুনিয়া নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। সল ভূমি হইতে উঠিলেন এবং নেত্রদ্বয় উন্মীলন করিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। সহগামীগণ তাঁহার হাত ধরিয়া তাঁহাকে দামাস্কাস শহরে লইয়া যাইলেন। সল তিন দিন দৃষ্টিহীন অবস্থায় ছিলেন এবং কোনো কিছু আহার বা পান করেন নাই।
সল, পরে, খ্রীষ্ট-ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন এবং সেন্ট পল, অর্থাৎ, সাধু পল নামে পরিচিত হইয়াছিলেন।↩