সুধী পাঠকদের কাছে পূজনীয় গ্রন্থকার শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়ের পরিচয় দেওয়া অনাবশ্যক। এই গ্রন্থের সকল খুঁটিনাটি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলাও নিষ্প্রয়োজন; মাত্র দু-একটি বিষয়ে সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করি।
গ্রন্থকার যে উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গ্রন্থখানি লিখেছেন, তা তাঁর 'নিবেদন'-এ সুস্পষ্ট। গ্রন্থখানি জীবনী নয়, জীবনী-চিন্তন - সুপ্রাচীন গ্রন্থকারের শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে অনুধ্যান। এইজন্যে শ্রীরামকৃষ্ণের সকল জীবন-বৃত্তান্ত যে পরিজ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে প্রথমেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের বহু দিক বিভিন্ন মনীষী এর পূর্বে পর্যালোচনা করেছেন; কিন্তু তাঁর ক্রিয়াকলাপ ও মনোবৃত্তি ঠিক এ রকম দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন শাস্ত্রসহায়ে কেউ ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন কিনা জানি না। অন্যান্য বহু বিষয়েও গ্রন্থকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত যে সম্পূর্ণ পৃথক, তাও তীক্ষ্ণদর্শী পাঠকেরা লক্ষ্য করবেন।
বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয়, প্রচলিত বহু দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত স্বকীয় মতবাদসমূহের উপর ভিত্তি করে গ্রন্থকার শ্রীরামকৃষ্ণের ক্রিয়াকলাপ ও মনোবৃত্তি বিশ্লেষণ করেছেন। এ সকল বিভিন্ন দুরূহ মতবাদ সম্বন্ধে তাঁর কতকগুলি স্বতন্ত্র বিশদ গ্রন্থও আছে; কিন্তু বড়ই আক্ষেপের বিষয় যে, সেগুলির অধিকাংশই নানা কারণে আজও অপ্রকাশিত রয়েছে।1
আর একটি বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয়, গ্রন্থকার কোন বস্তু বা কোনো বিষয়ের নির্দিষ্ট সীমারেখা টানেননি এবং তাদের পারস্পরিক বিরোধের কথাও বলেন নি। প্রকৃত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকের মতো তিনি সকল বস্তু ও সকল বিষয়ের মধ্যে একটি প্রাণময় যোগসূত্র বার করার প্রয়াস পেয়ে এক মহামিলনের - পূর্ণতার বাণীই শুনিয়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী - শক্তির উৎস, তা কখনো রুদ্ধ হবার নয়; তাঁর বাণী - ব্রহ্মবীজ, তাও কখনো নষ্ট হবার নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী ও বাণী পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের মনীষীদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছে; তাঁর জীবনী ও বাণী মানব-জাতির সম্পদ। শ্রীরামকৃষ্ণের মতো একজন পুরুষের জীবনের প্রতিটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করার এবং তাঁর ক্রিয়াকলাপ ও মনোবৃত্তি বিশ্লেষণ ও সমীক্ষণ করার প্রয়োজনও তাই সমধিক। এজন্য গ্রন্থকার শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে তাঁর সঞ্চিত স্মৃতি - দৃষ্ট ঘটনা ও উপলব্ধ বিষয়সমূহের কিছু লিপিবদ্ধ করে সকলের বিশেষ কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। এ স্মৃতি-লেখার ঐতিহাসিক মূল্য তো আছেই, অধিকন্তু সত্যানুসন্ধিৎসু জনের কাছে এর সার্থকতা যথেষ্ট। আর বহুশাস্ত্রবিৎ বহুদর্শী গ্রন্থকার শ্রীরামকৃষ্ণের কল্যাণপ্রদ জীবনের বিশেষ একটি দিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পর্যালোচনা করে যে অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত করেছেন, এখন না হোক কালে নিশ্চয়ই তা দেশ-বিদেশের স্বাধীন চিন্তাশীল মনীষীদের গভীর ধ্যানের বিষয় হবে এবং তাঁদের এই ধ্যানপ্রসূত সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়ে ভবিষ্য মানব-সমাজ যে প্রভূত উপকৃত হবে তাও সুনিশ্চিত।
পরিশেষে, যাঁদের সাহচর্য ও সহানুভূতিতে, যুদ্ধের দরুন বর্তমান ওলটপালট অবস্থায় বহু অসুবিধার মধ্যেও, এই গ্রন্থ-সম্পাদন সম্ভব হয়েছে তাঁদের প্রত্যেকেরই প্রতি, কোনো রকম লৌকিকতা না করে আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ন্যস্ত কর্মভার সম্পাদনে, অনবধানতাবশতঃ যদি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে তো সে দোষ আমার; ক্ষমাশীল পাঠকদের কাছে সেজন্য মার্জনা ভিক্ষা করি।
শ্রীধীরেন্দ্রনাথ বসু
প্রথম সংস্করণ
1. বর্তমানে সেগুলি প্রকাশিত।↩
No comments:
Post a Comment