Saturday, March 31, 2018

পূর্বতন স্নায়ু-জাগরণে

কথিত আছে যে, সাধনকালে পরমহংস মশাই কাপড়ের ল্যাজ করিয়া বাঁদরের মতো গাছের ডালে বসিয়া প্রস্রাব করিয়াছিলেন; আবার সাধনকালে, তিনি অপবিত্র দ্রব্যাদি স্পর্শ করিয়াছিলেন। তিনি নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণের সন্তান; প্রথম জীবনে তিনি পূজারীর কাজও করিতেন। এইরূপ অবস্থার মধ্যে পরিবর্ধিত হইয়া কি করিয়াই বা তিনি অপবিত্র বা অশুচি দ্রব্যাদি - বিষ্ঠা, মৃত গোবৎস প্রভৃতি স্পর্শ করিয়াছিলেন?

কোনো কোনো ব্যক্তির মতে ইহা হইল পিশাচভাব-এ সাধনার লক্ষণ। এইরূপ উক্তি, ভক্তির কথা হইতে পারে, কিন্তু দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিকগণের নিকট ইহার তত সার্থকতা নাই। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণ প্রত্যেক বস্তুরই কারণ অনুসন্ধান করিয়া থাকেন এবং যথাসম্ভব তাহার কারণ-নির্ণয় করেন। এইজন্য অনেক সময় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণের মতের সহিত ভক্তের মতের পার্থক্য হইয়া থাকে।

এখন আর একটি কথা এই হইতে পারে যে, পরমহংস মশাই সাধনকালে উন্মাদ হইয়াছিলেন এবং সেইজন্য এইরূপ অপবিত্র বস্তু স্পর্শ করিয়াছিলেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মতে উন্মাদ অবস্থা হইল স্নায়ুর এক প্রকার বিকৃত ভাব। সাধারণ অবস্থায় যে সকল স্নায়ুর প্রক্রিয়া হইতেছে অর্থাৎ যে সকল স্নায়ু দিয়া সাধারণতঃ শক্তি প্রধাবিত হয়, সেই সকল স্নায়ু দিয়া বিপর্যস্ত অবস্থায় শক্তি প্রধাবিত হয় না; তখন অন্য প্রকার স্নায়ু দিয়া শক্তি প্রধাবিত হয় এবং প্রধাবন-ক্রিয়া ক্ষণস্থায়ী হইয়া থাকে ও বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হইয়া যায়। এইজন্য এই অবস্থায় চিন্তাশক্তি ও তর্ক-বিতর্ক দিয়া কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বা মীমাংসায় আসিতে পারা যায় না, ইহাই হইল উন্মাদ বা বায়ুগ্রস্ত অবস্থার দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। কিন্তু দেখিতে পাওয়া যায় যে এইরূপ অবস্থায় পরমহংস মশাই-এর চিন্তাশক্তি একটি নির্ধারিত উদ্দেশ্য বা স্থানে উপনীত হইতেছে। বিশেষ স্থানে বা এক কেন্দ্রে তাঁহার চিন্তাশক্তি পরিসমাপ্ত হওয়ায় ইহাকে উন্মাদ অবস্থা বলা যাইতে পারে না। ইহা যদি উন্মাদ অবস্থা না হয় তাহা হইলে এইরূপ বিকৃত বা বিপরীত ভাব কি করিয়া আসিল - এরূপ তো মানুষের ভিতর সাধারণ অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায় না? - ইহাই হইল এখন আলোচ্য বিষয়।

দার্শনিক মত হইল যে, বিভিন্ন স্নায়ুপুঞ্জ যে প্রকার জাগ্রত হইবে, চিন্তাধারাও ঠিক সেই প্রকার হইবে। মনোবিজ্ঞানেও 'ভাল' বা 'মন্দ' বলিয়া কোনো শব্দ নাই। ইহা হইল নীতিশাস্ত্রের কথা। নীতিশাস্ত্রে ভাল বা মন্দের বিচার হইতে পারে; মনোবিজ্ঞানে ভাল বা মন্দ বলিয়া কোনো শব্দ হয় না।

বৌদ্ধ গ্রন্থ জাতকে আছে যে, বুদ্ধদেব পূর্ব পূর্ব জন্মে পশুদেহ ও অন্যান্য নানা প্রকার দেহ ধারণ করিয়াছিলেন এবং সেই কালে তাঁহার সেইরূপ প্রক্রিয়া বা ভাব বিকাশ পাইয়াছিল। কিন্তু জাতক-গ্রন্থে কেবল গল্প বা উপাখ্যান প্রদত্ত হইয়াছে, এইরূপ ভাব-বিকাশের কোনো কারণ নির্ণয় করা হয় না।

জীববিজ্ঞানে দেখা যায় যে, বহুকালব্যাপী শক্তিপ্রয়োগে স্নায়ু পরিবর্তিত হইয়া অতি সামান্য মাত্র প্রাণী হইতে মানুষের দেহ আসিয়াছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও জলবায়ুর যেমন পরিবর্তন হইবে, স্নায়ুপুঞ্জও তেমন নিজের অভ্যন্তরস্থিত শক্তি বিকাশ করিয়া নিজ অবয়ব পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করিবে। ইহাই হইল সমতা-সাধন-বিধি বা Law of Concordance-এর ধারা। সামান্য প্রোটোপ্লাজম্ হইতে ভ্রূণ ও অর্ভক কি করিয়া আসিল, তাহা চিন্তা করিলে এক অতি আশ্চর্য ব্যাপার দেখা যায় - স্নায়ুর বহুকালব্যাপী ক্রমপরিবর্তন ও ক্রমপরিবর্ধন যে হইয়াছে, তাহা আমরা বেশ বুঝিতে পারি। একটি ডিম তরল অবস্থা হইতে কি করিয়া স্নায়ুসংযুক্ত হইয়া পক্ষীর রূপ ধারণ করে, তাহা গবেষণা করিলে স্নায়ুর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন-ক্রিয়া বুঝা যায়। ডারউইন অস্থিনির্দেশ করিয়া জীবের উৎপত্তি নির্ণয় করিয়াছেন। আমি স্নায়ুর উদ্ভব, পরিণতি ও বিকাশ অনুযায়ী জীবের উৎপত্তি নির্ণয় করিতেছি।

জীববিজ্ঞান কিন্তু কেবল ক্রমবিকাশের কথা বলিয়া থাকে; বিপর্যস্ত ভাবের বা বিপরীত গতির - ক্রমবিবর্তনের কোনো উল্লেখ করে না। রাজযোগ ও হঠযোগের মত হইল যে, শক্তি বিপরীত দিকে সঞ্চালিত করিলে বহু পূর্বকালের স্নায়ু, যাহা বর্তমানে সুষুপ্ত বা মৃতকল্প হইয়া আছে, সঞ্জীবিত করা যাইতে পারে। জীববিজ্ঞানের সহিত রাজযোগ এবং হঠযোগের এ স্থলে পার্থক্য রহিয়াছে।

দেখা গিয়াছে যে, অনেক রাজযোগী ও হঠযোগী স্নায়ু পরিবর্তন করিয়া বিভিন্ন প্রকার কার্য করিতে পারেন, যেমন অগ্নির উপর দিয়া পদচারণ করা, মাটির ভিতর অবস্থান করা প্রভৃতি বহু প্রকার অসাধারণ কার্য তাঁহারা করিতে পারেন।

আমি এক ব্যক্তিকে আসবপানে বিহ্ব্ল হইয়া বিশ ঘণ্টাকাল কুকুরের মতো ব্যবহার করিতে দেখিয়াছি। আমি তাহাকে বিশেষ করিয়া পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম। দেখিলাম যে, কুকুরের যেরূপ প্রক্রিয়া হয় - চোখের দৃষ্টি, কণ্ঠস্বর, মূত্রত্যাগ, সমস্তই তাহার সেইরূপ হইতে লাগিল। আসব-সংযোগে বা বাহ্যিক শক্তি-প্রয়োগে তাহার বহু পূর্বের কুকুর-স্নায়ুসকল সঞ্জীবিত হইয়া উঠিয়াছিল। এইজন্য তাহার সমস্ত মানব-ভাব বিলুপ্ত হইয়াছিল এবং কুকুরের সকল ভাব সে পাইয়াছিল।

এক ব্যক্তি সার্কাসে বাঘ লইয়া খেলা করিতেন। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, "আপনি এমন ভালমানুষ কিন্তু কি করে বাঘের সঙ্গে খেলা করতেন?" তিনি উত্তরে বলিলেন, "খেলা হওয়ার আগে নির্জন স্থানে অনবরত চিন্তা করতুম - আমি বাঘ, বাঘই আমি। খানিকক্ষণ এই রকম করবার পর, স্নায়ু যখন দৃঢ় হত, তখন ফের চিন্তা করতুম - আমি বড় বাঘ, ও ছোট বাঘ। তার পর, একটা উন্মত্ত ভাব আসতো; আমি পিঁজরায় গিয়ে একটা, দুটো বা তিনটে বাঘের সঙ্গে খেলা করতুম। আমি যে মানুষ সে ভাবটা আমার মনে থাকতো না। কেবল আমি যে একটা বড় ভীষণ বাঘ - এই ভাবটা জেগে উঠতো।" আমি তাঁহাকে বলিলাম, "ভাবুন দেখি, আপনার শরীরের কোন্ স্নায়ু দিয়ে কি রকম ভাবে শক্তি চলছে - আবার আগেকার ভাব আনবার চেষ্টা করুন।" এইরূপ খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর দেখিলাম যে তাঁহার শান্ত অমায়িক ভাব চলিয়া গিয়া অভ্যন্তরস্থিত ব্যাঘ্রভাব জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে। চোখের দৃষ্টি অন্য প্রকার হইয়া যাইল, ঘাড় বাঁকিয়া গেল, মুখের চেহারা ভীষণ হইয়া উঠিল, গলায় ঘড়ঘড়ে আওয়াজ আসিল। এত পরিবর্তন হইল যে, আমার ভয় হইতে লাগিল পাছে সেই অবস্থায় তিনি আমাকে কামড়াইয়া দেন! আমি সরিয়া যাইলাম। এক অতি আশ্চর্য পরিবর্তন দেখিলাম! তিনি নিজের দেহের বেগ সহ্য করিতে না পারিয়া মেঝের উপর অনেকক্ষণ শুইয়া রহিলেন। তাহার পর শান্ত মানুষের ভাব ফিরিয়া আসিলে চলিয়া যাইলেন। যাইবার সময় বলিলেন, "আজ মাথাটা বিগড়ে গেছে, কোনো কাজ করতে পারবো না।" তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে বাঘের সহিত খেলা করিয়া তিনি অনেকক্ষণ ফাঁকা জায়গায় পড়িয়া থাকিতেন, কারণ তখন তিনি ব্যাঘ্রভাবে ভরপুর থাকিতেন এবং মানুষকে সহসা আক্রমণ করিবার সম্ভাবনাও তখন থাকিত। তাহার পর স্নায়ু ঠাণ্ডা হইলে তিনি মানুষের সহিত দেখা করিতেন।

ময়ূরভঞ্জের শেয়াল-মেয়ে বা 'শেয়াল-রাণী', 'ভল্লুকে-ধরা-মেয়ে', আফ্রিকার 'চিম্প্যানজী-মেয়ে', শিমলা পাহাড়ের 'বাঘ-মানুষ' - এই সকল হইল আরো নানা উদাহরণ।

কয়েক বৎসর পূর্বে কোনো এক বিশিষ্টা রমণী সংবাদপত্রে ময়ূরভঞ্জের শেয়াল-মেয়ে বা শেয়াল-রাণীর কথা লিখিয়াছিলেন। একটি ইংরেজের মেয়েকে অতি শৈশবে শেয়ালে লইয়া যায়। শেয়ালী মেয়েটিকে দুধ দিয়া পালন করিয়াছিল। মেয়েটি বড় হইলে শেয়ালের প্রকৃতি প্রাপ্ত হইল, কেবল অবয়বাদি মানুষের মতো রহিল। সাঁওতালেরা জঙ্গল হইতে গরু চরাইয়া আসিলে বলিত যে, জঙ্গলের ভিতর সাদা পেতনি আছে, মানুষ দেখিলে পলাইয়া যায়। এই কথা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িলে লোকজন যাইয়া জঙ্গল ঘিরিয়া শেয়াল তাড়াইয়া মেয়েটিকে ধরিয়া আনিল। মেয়েটির বয়স পনেরো-ষোল হইবে। মেয়েটিকে কাপড় পরাইয়া তাহারা একটি ঘরে রাখিল। স্বাধীনতা নষ্ট হইয়াছে বলিয়া মেয়েটি শেয়ালের মতো রব করিয়া কাঁদিত। ইহা শুনিয়া চারিদিক হইতে শেয়াল আসিয়া তাহার দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করিয়া কাঁদিত। মেয়েটিকে দুধ আর ভাত খাইতে দেওয়া হইত, সে মুখ দিয়া তাহা খাইত। দিন কতক পরে মেয়েটি মরিয়া যায়।

আমাদের বাড়ির কাছে মহেন্দ্র গোসাঁই লেনে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ হইতে বালিকাদিগের একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। দার্জিলিঙ-এর জঙ্গল হইতে একটি মেয়েকে আনিয়া সেখানে রাখা হইয়াছিল। আমি মাঝে মাঝে মেয়েটিকে দেখিতে যাইতাম এবং আশ্রমের অধ্যক্ষ মহেশ আতর্থী মশাইকে মেয়েটির বিষয় নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতাম। মেয়েটি যখন বালিকাদিগের সহিত খেলা করিত, তখন মানুষের মতো দাঁড়াইয়া থাকিত; কিন্তু যখন একাকী থাকিত, তখন হাঁটু আর হাতের উপর ভর দিয়া চলিত। একটু রাগ হইলে ঘরের কোণে যাইয়া ভল্লুকের মতো গলার আওয়াজ করিত এবং হাতের আঙুল দিয়া আঁচড়াইতে যাইত ও কামড়াইতে যাইত। মেয়েটি একটু বড় হইলে দেখা গেল যে, সে ভুটিয়াদের মেয়ে। বছর বারো-তেরো বয়স হইলে মেয়েটি মারা যায়।

কয়েক বৎসর পূর্বে একখানি সংবাদপত্রে এই সংবাদটি প্রকাশিত হইয়াছিল যে, আফ্রিকায় যেখানে চিম্প্যানজীর বাসস্থান, সেখান হইতে আমেরিকান বৈজ্ঞানিকরা চিড়িয়াখানায় জীবন্ত চিম্প্যানজী ধরিয়া আনিবার জন্য জঙ্গল বেষ্টন করে। অবশেষে বৈজ্ঞানিকরা দেখিল যে, চিম্প্যানজীদের সঙ্গে একটি শুভ্রকায় মেয়ে রহিয়াছে, বয়স বছর দশ হইবে। মেয়েটি গাছের ডালে বসিয়া থাকে, চিম্প্যানজীদের সঙ্গে কথাবার্তা কহিয়া থাকে এবং চিম্প্যানজীদের মতো খাইয়া থাকে। আমেরিকানরা যখন চিম্প্যানজী ধরিবার চেষ্টা করিল, তখন চিম্প্যানজীরা গাছের ডাল ভাঙিয়া লাঠি করিয়া মারিতে আসিল, মেয়েটিও সেই রকম গাছের ডাল ভাঙিয়া লইয়া মারিতে আসিল। আমেরিকানরা অনেক কষ্টে চিম্প্যানজীদের তাড়াইয়া মেয়েটিকে ধরিল এবং তাহার গায়ে আবরণ দিয়া ধরিয়া তাঁবুতে লইয়া আসিল। মেয়েটির শরীর চিম্প্যানজীর মতো বলিষ্ঠ ছিল। পরে বৈজ্ঞানিকদিগের ভিতর কথা উঠিল যে, যদি মেয়েটিকে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দেওয়া যায়, তাহা হইলে চিম্প্যানজীদের ভাষা আর মানুষের ভাষা উভয়ই বুঝা যাইবে। এ বিষয়ে পরে কি হইয়াছিল তাহার কোনো সংবাদ জানি না।

শিমলা পাহাড়ে একটি বাঘ-মানুষ ছিল। ইটালীর উপেন দেবের1 বাড়িতে তাহার ফোটো ছিল। সে হাঁটু ও হাত দিয়া চলিত; কিন্তু ঘোড়া বা গরু দেখিলেই হাঁটু হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ঘোড়া বা গরুর চামড়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া চাটিয়া চাটিয়া রক্তপান করিত। ফোটোতে তাহার চেহারা অনেকটা বাঘের মতন দেখিয়াছিলাম।

এ স্থলে ইহা জানা আবশ্যক যে, মানুষের দেহে পূর্বজন্মের বানর ব্যাঘ্র প্রভৃতি অবস্থার চিহ্ন বা স্নায়ু আজও পর্যন্ত বিদ্যমান রহিয়াছে। জীববিজ্ঞান যে বিষয়ে অনুমানের উপর তর্ক-বিতর্ক করিয়া থাকে, এই সকল উদাহরণের দ্বারা তাহা স্পষ্ট বুঝা যায়। চেষ্টা ও অভ্যাস করিলে বিশেষ প্রক্রিয়ার সাহায্যে পূর্বতন স্নায়ুসমূহকে জাগ্রত করা যাইতে পারে।

বৌদ্ধমতে বলা হয় যে, চৌষট্টি লক্ষ দেহ পরিবর্তন করিয়া জীব মানুষের দেহে উপনীত হয়। এ বিষয়ে এই মাত্র বলা যাইতে পারে যে, মানুষের দেহের ভিতর বহু পূর্বজন্মের সুষুপ্ত স্নায়ুসমূহ আছে। অবশ্য, তাহা সাধারণ লোকে সঞ্জীবিত করিতে পারে না। কিন্তু মানুষের দেহ যে এক কালে কুকুর, ব্যাঘ্র, শূকর প্রভৃতির দেহ ছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়।

সাধনকালে পরমহংস মশাই তাঁহার চিন্তাশক্তি বিপরীত দিকে সঞ্চালিত করিয়া বহু পূর্বজন্মের বা বহু পূর্বদেহের সুষুপ্ত স্নায়ুপুঞ্জ সঞ্জীবিত করিতে পারিয়াছিলেন। তিনি আভ্যন্তরীণ শক্তি উদ্বুদ্ধ করিয়া অতি প্রাচীনতম সুষুপ্ত স্নায়ুপুঞ্জ সঞ্জীবিত করিয়াছিলেন। বাহ্যিক মানুষের মতো দেহ থাকিলেও, আভ্যন্তরীণ স্নায়ুর পরিবর্তন হওয়ায় ক্ষণকালের জন্য তাঁহার দেহ ও প্রবৃত্তি ভিন্নরূপ হইয়া গিয়াছিল। পরমহংস মশাই-এর চিন্তাশক্তি যেমন উচ্চ স্তরে উঠিতে পারিত - যাহার নিকটেও অপরের চিন্তাশক্তি যাইতে পারে না, তেমনি তাঁহার চিন্তাশক্তি বিপরীত দিকে গমন করিয়াও বহু বহু পূর্বকালের স্নায়ুপুঞ্জকে উদ্বোধিত করিতে পারিত। তিনি এক দিকে যেমন সূক্ষ্ম-স্নায়ুপুঞ্জ জাগ্রত করিতে পারিয়াছিলেন, অপরদিকে তেমনি প্রাচীনতম সুষুপ্ত স্নায়ুপুঞ্জ জাগ্রত করিতে পারিয়াছিলেন। এক সীমা হইতে অপর সীমা পর্যন্ত - বহুপ্রকার স্নায়ু তিনি সমভাবে জাগ্রত করিতে পারিয়াছিলেন। এইজন্য নানা বিষয়ে তাঁহার অতীব আশ্চর্য ও অভ্রান্ত ভাব হইয়াছিল। এত উচ্চেও কেহ উঠিতে পারেন নাই কিংবা এত নিম্নেও কেহ নামিতে পারেন নাই। জগতে এইরূপ পুরুষ দেখিতে পাওয়া যায় না। পরমহংস মশাই-এর সাধনকালের এই সকল প্রক্রিয়া উপহাসের বস্তু নয় বা ইহা যে ভক্তজনের লীলারহস্য - তাহাও নয়। পরমহংস মশাই-এর জীবনের এই সকল ব্যাপার ও প্রক্রিয়া দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদিগের বিশেষ গবেষণার বিষয়। এইজন্য, আমি পুনঃপুনঃ বলিতেছি যে, বর্তমান যুগে দর্শনশাস্ত্রের ও বিজ্ঞানশাস্ত্রের তিনি মূর্ত প্রতীক।


1. কলিকাতাস্থ ইটালী-নিবাসী জমিদার, শ্রীযুত উপেন্দ্রনারায়ণ দেব, স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য।

Friday, March 30, 2018

ভাব ও স্নায়ুর সম্মিলনে

এক একটি ভাবের জন্য এক একটি স্নায়ু। এক একটি স্নায়ু দিয়া এক একটি ভাব বা চিন্তাস্রোত বা শক্তির বিকাশ হইয়া থাকে। কিন্তু এক একটি স্নায়ু স্পন্দিত হইয়া তাহা হইতে শক্তির বিকাশ হইলেও, প্রকৃতপক্ষে একটি মাত্র স্নায়ু দিয়া ভাব বিকাশ করা অতীব দুরূহ ব্যাপার। ইহা মাত্র সমাধি-অবস্থায় হইতে পারে। সাধারণত, একের অধিক সমজাতীয় ও সমগুণান্বিত স্নায়ুর প্রকম্পমান অবস্থায় যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তাহাকে 'ভাব' বলা হয়। ভাব হইল - চিন্তা, যাহার কোনো প্রয়োগ হয় নাই, চিন্তার জন্যই চিন্তা। 'বাসনা' হইল - সেই চিন্তা যখন অপর বস্তুতে প্রযুক্ত হয়, এবং সেই বস্তুটিকে নিজের সন্নিকটে টানিবার চেষ্টা হয়। এইজন্য ভাব বা Idea এবং বাসনা বা Desire-এর মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি হইল নিরপেক্ষ বা নিষ্ক্রিয়, আর একটি হইল সাপেক্ষ বা সক্রিয়।

স্বামীজী শেষ জীবনে বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। কবিরাজ ঔষধের ব্যবস্থা করেন। তিনি স্বামীজীকে একচল্লিশ দিন জল পান করিতে নিষেধ করেন এবং ইচ্ছামতো দুধ খাইতে বলেন। স্বামীজী এই সময় এক দিন গিরিশবাবুর বাড়িতে গিয়াছিলেন। গিরিশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, "তুমি বহুমূত্র রুগী, একচল্লিশ দিন জল না খেয়ে কি করে থাকবে?" স্বামীজী বলিলেন, "আমি শরীরকে বারণ করে দিয়েছি, সে একচল্লিশ দিন জল খাবে না।" গিরিশবাবু হাসিয়া বলিলেন, "সে আবার কি কথা, 'শরীরকে বারণ করে দিয়েছি'?" স্বামীজী বলিলেন, "এক গ্লাস জল আনো দেখি।" তাহার পর, স্বামীজী সেই গ্লাসের জলের মাপ দেখাইয়া, সমস্ত জল পান করিলেন; গ্লাসে আর কিছুই জল রহিল না। খানিকক্ষণ পর উদ্গার করিয়া পরিষ্কার জল গ্লাসে ঢালিয়া দিলেন; জলের মাপ পর্যন্ত ঠিক হইল, একটুও কম হইল না, গিরিশবাবু অবাক হইয়া রহিলেন। স্বামীজী বলিলেন, "এক ফোঁটা জলও আর দেহে নেবে না।" গিরিশবাবু ভক্ত লোক, তিনি এ বিষয় অনেক কিছু কথা কহিতে লাগিলেন। স্বামীজী হাসিয়া বলিলেন, "দূর শালা জি. সি.1, এই সামান্য একটা দেখেই অবাক হলি - একে বলে Controlment of nerves - স্নায়ু সংযত করা।"

স্বামীজী লন্ডনে রাজযোগের বক্তৃতাকালে স্নায়ু-সংযমন বা Controlment of nerves-এর বিষয়ে বিশেষ করিয়া বলিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, "The greatest display of energy is in controlling the energy", - শক্তিকে সংযত করাই শক্তিমত্তার প্রধান লক্ষণ বা চিহ্ন।

বিভিন্ন স্নায়ুর যে বিভিন্ন প্রক্রিয়া হইয়া থাকে, এ বিষয়ে কতকগুলি উদাহরণ প্রদত্ত হইলে অপ্রাসঙ্গিক হইবে না।

বাঁকুড়া জেলায়, পাত্রসায়ের-এ গিরিবালা নাম্নী একটি স্ত্রীলোক বহু বৎসর পর্যন্ত কোনো দ্রব্য আহার করেন নাই। তিনি সহজ মানুষের ন্যায় কাজ-কর্ম করিতেন। এইরূপ শুনা গিয়াছে যে, অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায়, নিরাশ্রয়া হইয়া তিনি অত্যন্ত বিমনা ও বিষণ্ণা হইয়া পড়িয়াছিলেন। এইরূপ অতিমাত্রায় বিমনা হওয়ায় বা শক্তির প্রয়োগ করায় তাঁহার স্নায়ু পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল। এইজন্য ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতি যে স্নায়ু-প্রক্রিয়াসমূহ, সে সকল বিলুপ্ত বা নষ্ট হইয়া যায়। সাধারণ লোকের যেরূপ ক্ষুধা-তৃষ্ণা হইয়া থাকে, তাঁহার সেরূপ হইত না; অথচ তাঁহার শরীরের কোনো হানি হয় নাই। ইহা হইতে বেশ বুঝা যাইতেছে যে, বিশেষ এক প্রকার স্নায়ুপ্রক্রিয়া হইলে তাহাকে "ক্ষুধা" বলে।

মহাযুদ্ধের সময় হাঙ্গারির এক ব্যক্তির তোপের গোলায় আঘাত লাগে। হাসপাতালে থাকিয়া চিকিৎসা করাইবার পর যখন সে আরোগ্য হইয়া আসিল তখন তাহার 'নিদ্রা' বলিয়া কোনো ক্রিয়াই রহিল না। নিদ্রাও নাই, ক্লান্তিও নাই। এ স্থলে দেখা যাইতেছে যে, 'নিদ্রা' বলিয়া যে স্নায়ু-প্রক্রিয়া, তাহা বিলুপ্ত হওয়ায়, সেরূপ কোনো প্রক্রিয়াই হইতেছে না।

বুদাপেশ্ৎ-এ কোনো এক বৃদ্ধ অধ্যাপকের শরীরে বাঁদরের স্নায়ু সন্নিবেশিত করা হইয়াছিল। ফল এই হইল যে, বৃদ্ধ অধ্যাপক অবশেষে ব্যবহারে বাঁদরের ন্যায় হইয়া যাইলেন। তিনি কাপড় পরিতেন না, গাছের ডালে উবু হইয়া বসিয়া থাকিতেন, মুখের সাহায্যে খাইতেন এবং কাঁচা গাজর ইত্যাদি তাঁহার প্রিয় খাদ্য হইল। তিনি বাঁদরের মতো মুখ ভেংচাইয়া ক্রোধ প্রকাশ করিতেন। মানুষের ন্যায় কথাবার্তা কহা প্রায় তিনি ভুলিয়া যাইলেন। এরূপে স্নায়ু-পরিবর্তন হওয়ায় তাঁহার সমস্ত মনোবৃত্তি পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল।

জীবচ্ছেদ বা Vivisection প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত হইয়াছে যে, আঙুলের বিশেষ এক একটি সূক্ষ্মস্নায়ু তুলিয়া লইলে, শীতলতা, উষ্ণতা প্রভৃতি ইন্দ্রিয়বোধ বা Sensation থাকে না। আঙুল পুড়িয়া যাইলেও, আঙুলে অগ্নির উত্তাপ বোধ হয় না। এইরূপ বহু প্রকার স্নায়ু-প্রক্রিয়ার উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। এই সকল হইতে বেশ বুঝা যাইতেছে যে, এক একটি স্নায়ু বা স্নায়ুপুঞ্জ এক একটি ভাবপ্রবাহের জন্য সৃষ্ট হইয়াছে।

এখন প্রশ্ন হইতে পারে যে, 'ভাব' হইতে 'স্নায়ু' উৎপন্ন হইয়াছে, না 'স্নায়ু' হইতে 'ভাব' উৎপন্ন হইয়াছে? কোন্ বস্তুটি কাহার কারণ বা কাহার কার্য?

এক মত হইল:

"বাসনায় মনের জনম,
মন সৃষ্টি করে এ শরীর।
অনন্ত বাসনা উঠে তায়,
ভাসে মন বাসনা-সাগরে।"2

বৈজ্ঞানিক মত হইল যে, পরমাণুসমূহের বহুবিধ স্পন্দন হয় এবং এই স্পন্দনসমূহ হইতেই পরমাণুসকল এক সূত্রে পারম্পর্যরূপে সন্নিবেশিত হওয়ায় অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহ সৃষ্ট হয়। এই সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহকে রক্ষা করিবার জন্য পর পর অপর স্থূল-স্নায়ুসমূহ নির্মিত হয়; কারণ বাহ্যিক শক্তি সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহকে অচিরে বিনাশ করিতে পারে। ভ্রূণ ও ডিম হইতে কি করিয়া জীব সৃষ্ট হয়, তাহা পর্যবেক্ষণ করিলেই এ বিষয়ে বেশ বুঝা যাইতে পারে। এইজন্য বাহ্যিক শক্তির সহিত দ্বন্দ্ব করিবার উদ্দেশ্যে এবং সূক্ষ্ম-স্নায়ুপুঞ্জকে রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে, স্থূল-স্নায়ুসমূহ বিভিন্ন স্তর অনুযায়ী পরে নির্মিত হয়। সাধারণ ক্রিয়াসকল এই স্থূল-স্নায়ুসমূহ দিয়া হইয়া থাকে। আর এইজন্যই সাধারণ ভাষায় আমরা 'স্থূল-বুদ্ধির লোক', 'সূক্ষ্মবুদ্ধির লোক' প্রভৃতি বলিয়া থাকি।

পশু ও উদ্ভিদ প্রভৃতির ভিতরেও স্নায়ু-প্রক্রিয়া বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। স্নায়ু-বিজ্ঞান অনুযায়ী চিন্তা করিলে, মানুষ, পশু ও উদ্ভিদ প্রভৃতি সকলই একই শ্রেণীর ভিতর আসিয়া পড়ে, কেবল, ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর স্নায়ুর নানা প্রকার উৎকর্ষ দেখা যায় - এইটুকু যা পার্থক্য। জীববিদ্যায় দেখা যায় যে, মানুষ ও পশুদিগের ভিতর অধিকাংশ স্নায়ুতেই একই প্রকার প্রক্রিয়া হইয়া থাকে এবং পশুদিগের স্নায়ু-প্রক্রিয়া ও উদ্ভিদ ইত্যাদির Fibre - সূক্ষ্ম-সূত্র বা স্নায়ু-প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক পরিমাণে সামঞ্জস্য আছে। এইজন্য এই তিন শ্রেণীই এক বিষয়ক বা এক শ্রেণীর অন্তর্গত।

দেহযন্ত্রের বা ইন্দ্রিয়সমূহের বা বিশেষ উদ্দেশ্যে একত্র সমাবিষ্ট স্নায়ুপুঞ্জের প্রক্রিয়া বা সমষ্টি-শক্তি থাকিলেও, ইহা জানা আবশ্যক যে, প্রত্যেক স্নায়ুতে এবং প্রত্যেক পরমাণুতেও সমস্ত দেহের বা সংশ্লিষ্ট স্নায়ুর শক্তি তো সুষুপ্তভাবে আছেই, এমন কি, সমগ্র শক্তি বা পূর্ণ শক্তিও আছে। এ বিষয়ে একটি ঘটনা উল্লেখ করিতেছি।

কথিত আছে যে, একজন সাধু পিঠ হইতে আলো বাহির করিয়া অন্ধকার রাত্রে পরমহংস মশাইকে কালীমন্দিরে ফিরিয়া আসিবার পথ দেখাইয়াছিলেন।

অনুরূপ আর একটি ঘটনার বিষয়ও শুনিয়াছি। বোম্বাই-এ একটি মারাঠী যুবক ছিল। তাহার একটি শক্তি বা সিদ্ধাই ছিল। দুইটি চোখ তুলা দিয়া ঢাকিয়া কাপড় দিয়া ভাল করিয়া বাঁধিয়া দিলেও, কপালের সম্মুখে বই ধরিলে সে তাহা পড়িয়া যাইতে পারিত। উন্মুক্ত চোখে যেমন দ্রুতভাবে পড়িতে পারিত, বদ্ধ অবস্থায় তেমন পারিত না, ধীরে ধীরে পড়িত - এইমাত্র প্রভেদ। জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিত যে, তাহার কপালের মধ্যে একটি শিরা আছে; তাহার ভিতর হইতে সে আলো বাহির করে এবং সেই আলো বইয়ের উপর পড়িলে, সে দেখিতে পায়। অবশ্য বইখানি নিকটে রাখিতে হইত, অর্থাৎ সেই অদৃশ্য-আলোকের পরিধির ভিতর রাখিতে হইত।

এখন প্রশ্ন হইতেছে, কি করিয়া ইহা সম্ভবপর? এ কথা বুঝিতে হইলে, ইন্দ্রিয় কি, ইন্দ্রিয়সমূহের প্রক্রিয়াই বা কি, তাহা জানা আবশ্যক। - Organ is an organised system of nerves, অর্থাৎ, ইন্দ্রিয় হইল - সমজাতীয়, সমগুণান্বিত এবং সংশ্লিষ্ট স্নায়ুপুঞ্জ। এই স্নায়ুপুঞ্জ কোনো বিশিষ্ট উদ্দেশ্যে একত্র সংযোজিত হইলে এবং তাহার ভিতর দিয়া শক্তি প্রধাবিত হইলে, এক এক প্রকার প্রক্রিয়া হইয়া থাকে, যেমন, চোখের স্নায়ুপুঞ্জ দিয়া এক প্রকার প্রক্রিয়া হইয়া থাকে, নাসিকার স্নায়ুপুঞ্জ দিয়া এক প্রকার প্রক্রিয়া হইয়া থাকে - এইরূপ স্নায়ুপুঞ্জের বিভিন্ন প্রকার প্রক্রিয়া দেখা যায়। প্রত্যেক স্নায়ুপুঞ্জের উদ্দেশ্য হইল আভ্যন্তরীণ স্পন্দন উদ্বুদ্ধ করিয়া বহিঃস্থ স্পন্দনকে গ্রহণ করা, অর্থাৎ বহিঃস্থ স্পন্দন যে পরিমাণে হইতেছে, আভ্যন্তরীণ স্পন্দন সেই পরিমাণে প্রবুদ্ধ করিয়া বা সমভাবে স্পন্দিত করিয়া তাহা গ্রহণ করা। ইহাই হইল বাহ্যিক বস্তুর 'জ্ঞান'। কিন্তু স্পন্দনের যদি তারতম্য হয়, তাহা হইলে বস্তু সম্বন্ধে 'জ্ঞান' হয় না।

এখন দেখা যাউক, 'দৃষ্টিশক্তি' কি? - স্নায়ুর ভিতর পরমাণুসমূহের স্পন্দন হওয়ায়, তাহা হইতে জ্যোতি উৎপন্ন হয়। সেই জ্যোতি বহিঃস্থ স্পন্দনপ্রসূত জ্যোতির সহিত সমক্ষেত্রে আসিলে, আমরা বাহ্যিক আলো বা জ্যোতি দেখিতে পাই। কিন্তু, স্নায়ু যদি নিষ্ক্রিয় বা মৃত হইয়া যায় এবং আভ্যন্তরীণ জ্যোতিঃস্পন্দন উৎপন্ন করিতে না পারে, তাহা হইলে বাহ্যিক জ্যোতি বা স্পন্দন অনুভব করা যায় না। চোখ বুজিয়াও আমরা অনেক সময় জ্যোতিবিন্দু দেখিতে পাই এবং নিদ্রিত অবস্থাতেও জ্যোতিবিন্দু দেখিতে পাই। এই সকল হইল অন্তরস্থিত পরমাণুর স্পন্দনপ্রসূত 'জ্যোতি' বা 'আলোক'। য়ুরোপীয় বৈজ্ঞানিক মত হইতে এই মত সম্পূর্ণ পৃথক, সম্পূর্ণ বিপরীত। রাজযোগ ও হঠযোগে এই মত পোষণ করে।

পরমাণুতে ও স্নায়ুতে সুষুপ্তভাবে শক্তি না থাকিলে, সংশ্লিষ্ট অবস্থায় সমষ্টি-শক্তি আসিতে পারে না, কেবল সমষ্টির শক্তি সক্রিয়; স্নায়ু ও পরমাণুর শক্তি সুষুপ্ত - এই প্রভেদ। কিন্তু প্রয়াস বা অভ্যাস করিলে, পরমাণুর ও স্নায়ুর সুষুপ্ত শক্তি জাগ্রত করা যাইতে পারে। য়ুরোপীয় বৈজ্ঞানিক মতে স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুর কথা যাহা বলা হয়, তাহা এ স্থলে প্রযোজ্য হয় না। স্বয়ংক্রিয় স্নায়ু বহুকালব্যাপী অভ্যাস হইতে হইয়াছে, আয়াস না করিলেও উহার প্রক্রিয়া হইয়া থাকে। কিন্তু অভ্যাস বা প্রয়াস যদি বিপরীত দিকে করা হয় তাহা হইলে স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুর প্রক্রিয়াও বন্ধ করা যাইতে পারে।

প্রশ্ন হইতে পারে যে, স্নায়ুসকল এই সমস্ত প্রক্রিয়া পাইল কিরূপে? - আমি কনস্তান্তিনোপ্ল বা পুরানো ইস্তান-বুল-এ গোল্ডেন হর্ন নামক সমুদ্রের খাঁড়িতে বসিয়া একটি কাঠি দিয়া জেলি-ফিশ (Jelly-fish) বিঁধিয়া নানা রূপ পরীক্ষা করিতাম। দেখিতাম যে, জেলি-ফিশ-এর প্রোটোপ্লাজমের প্রত্যেক অঙ্গ দিয়াই সমস্ত কাজ হইতেছে। ইহাকে In-organic বা অ-ইন্দ্রিয় প্রাণী বলা হয় এবং ইহার উৎপাদন-ক্রিয়া আপনা হইতেই হইয়া থাকে। জেলি-ফিশ-এর পিঠের এক অংশ ফুলিয়া উঠিয়া, পরে বিশ্লিষ্ট হইয়া অপর একটি জেলি-ফিশ হয়। এই অবস্থায় সকল প্রক্রিয়াই প্রোটোপ্লাজম দিয়া হইতেছে।

অপর একটি বিষয় হইল - ভ্রূণ বা Foetus অবস্থার কথা। ভ্রূণের প্রথম অবস্থায় সমস্ত প্রক্রিয়া সকল স্থান দিয়া হইতেছে; পরে যখন সংগঠিত অবস্থায় - Organised state-এ আসে, তখন বিশেষ বিশেষ স্নায়ুপুঞ্জ দিয়া বিশেষ বিশেষ প্রক্রিয়া হইয়া থাকে।

আর একটি উদাহরণ হইল, Invertebrate - মেরুদণ্ডবিহীন জীব বা অ-মেরুদণ্ডী। যে সকল প্রাণীর মেরুদণ্ড হয় নাই, সেই সকল প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি বা দৃষ্টি-প্রক্রিয়া সকল স্থান দিয়াই হইয়া থাকে। কেঁচো, জোঁক প্রভৃতির এইরূপ হইয়া থাকে। Vertebrate - মেরুদণ্ডযুক্ত জীব বা মেরুদণ্ডী হইলে প্রক্রিয়া বিভিন্ন প্রকার হইয়া যায়।

ইহা হইতে বেশ বুঝা যায় যে, সকল স্নায়ুতেই সকল প্রকার শক্তি ও প্রক্রিয়া সুষুপ্তভাবে আছে, কেবল সংগঠিত অবস্থায় বিশিষ্ট স্নায়ু দিয়া শক্তি সক্রিয় হয়। এইজন্য বিশেষ বিশেষ স্নায়ুপুঞ্জ বা ইন্দ্রিয় দিয়া বিশেষ বিশেষ প্রক্রিয়া হইয়া থাকে।

এখন কথা হইল যে সাধুটির পৃষ্ঠদেশ হইতে আলো বা জ্যোতি নির্গত করা সম্ভবপর কিনা? এ স্থলে জানা আবশ্যক যে, ভ্রূণ-অবস্থা হইতে পরিবর্ধিত হইয়া দৃষ্টি-স্নায়ুসকল সর্বশেষে মস্তিষ্কে পরিসমাপ্ত হয়। এইজন্য দৃষ্টি-স্নায়ুসকল বা দৃষ্টির ইন্দ্রিয় এত সূক্ষ্ম। মেরুদণ্ডের এক এক স্থানে বিভিন্ন স্নায়ুপুঞ্জের এক একটি কেন্দ্র আছে এবং সেই স্নায়ুকেন্দ্রসকল মস্তিষ্কের নানা স্থানে পরিসমাপ্ত হইয়াছে। এইজন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকেন্দ্রসকল প্রবুদ্ধ ও সক্রিয় এবং মেরুদণ্ডের স্নায়ুকেন্দ্রসকল সুষুপ্ত। কিন্তু চেষ্টা করিলে বা বিপরীত দিকে শক্তি সঞ্চালিত করিলে মেরুদণ্ডের স্নায়ুকেন্দ্রসমূহকে প্রবুদ্ধ করা যাইতে পারে। ইহা সাধারণ ব্যাপার নয় কিন্তু সম্ভবপর। আমি এই সাধুর ব্যাপারটি দেখি নাই, কিন্তু বোম্বাই-এর মারাঠী বালকটির কথা বিশেষরূপে জানি। জীবতত্ত্ব বা স্নায়ুবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী ইহা যে সম্ভবপর, তাহা বলা যাইতে পারে।

দেখা যাইত যে, পরমহংস মশাই-এর যেমন ভাব হইত, স্নায়ুও সেইরূপ পরিবর্তিত হইয়া যাইত। তিনি যেমন মুখে বলিলেন যে, টাকা বা কাঞ্চন ছুঁইবেন না, তেমনই তাঁহার হাত ইত্যাদি বা স্নায়ুপুঞ্জ আর টাকা বা কাঞ্চন ছুঁইতে পারিল না। এমন কি, যে স্নায়ু বা যে ভাবকে তিনি বন্ধ বা নিষ্ক্রিয় হইতে আদেশ করিতেন, সে স্নায়ুর ক্রিয়া আর হইত না বা সেই ভাব আর আসিত না। এইরূপ বহু উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। এ বিষয় যাঁহারা লক্ষ্য করিয়াছিলেন তাঁহারা খুব স্পষ্ট বুঝিতে পারিবেন। সাধারণ লোকের এইরূপ হইতে পারে না। এইরূপ স্নায়ু-সংযমন ও স্নায়ুর একত্র মিলন জগতে এক অতীব আশ্চর্য ব্যাপার।


1. স্বামী বিবেকানন্দ আনন্দিত হইলে শ্রীযুত গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়কে এই নামে ডাকিতেন।

2. "চৈতন্যলীলা", গিরিশচন্দ্র।

Wednesday, March 21, 2018

মাঝির প্রহারে

কথিত আছে যে, এক দিন গঙ্গার উপর নৌকাতে একজন মাঝি আর একজন মাঝিকে প্রহার করিতেছিল। পরমহংস মশাই নিবিষ্ট মনে তাহাদের ঝগড়া দেখিতেছিলেন। অবশ্য এ কথা বলা বাহুল্য যে, তিনি যখন যাহা দেখিতেন, তাহা একাগ্র ও তন্ময় হইয়া দেখিতেন। আঘাতের ফলে প্রহৃত মাঝির গায়ে দাগ উঠিল। ইহাতে তখনই পরমহংস মশাই-এর গায়েও ঠিক ঐ একই স্থানে আঘাতের দাগ দেখা যাইল। হৃদু মুখুজ্যে পরমহংস মশাই-এর গায়ের এই দাগ দেখিয়া মহা আস্ফালন করিতে লাগিলেন এবং যে প্রহার করিয়াছে, তাহাকে সমুচিত দণ্ড দেওয়ার জন্য অত্যন্ত অস্থির হইয়া পড়িলেন। পরমহংস মশাই বলিলেন, "দেখছো না, একটা মাঝি আর একটা মাঝিকে মারলে! তাতেই আমার গায়ে দাগ উঠল।"

এখন প্রশ্ন হইতেছে ইহা অলীক না কাল্পনিক; না ইহার কোনো প্রকৃত অর্থ বা কারণ আছে? আমি একটি যুবকের নিকট অনুরূপ একটি ঘটনার বিষয় শুনিয়াছিলাম।

স্বামীজী পাশ্চাত্য দেশ হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া দার্জিলিঙ-এ গমন করেন। সেখানে এক দিন সকালে চা পান করিয়া দুইটি বালককে সঙ্গে লইয়া তিনি বেড়াইতে যান। স্বামীজীর শরীর তখন মোটামুটি সুস্থই ছিল। স্বামীজী যখন রাস্তায় বেড়াইতে যাইতেন, তখন নিতান্ত একমনা ও তন্ময় হইয়া চলিতেন। চিন্তাশীল লোকদিগের নিয়মই হইল যে, যখন তাঁহারা পায়চারি করেন বা কোনো নির্জন স্থানে যান বা কোনো সুরম্য দৃশ্য দেখেন, তখন তাঁহারা একেবারে তন্ময় হইয়া পড়েন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখিলেই তাঁহাদের মন সাধারণত উচ্চ অবস্থায় উঠিয়া যায়। ইহা প্রত্যেক চিন্তাশীল ব্যক্তিরই স্বাভাবিক ভাব, তাহা না হইলে তিনি চিন্তাশীল হইতে পারেন না।

যাহা হউক, স্বামীজী অগ্রে যাইতেছিলেন, যুবক দুইটি পশ্চাতে ছিল। স্বামীজী সহসা বলিয়া উঠিলেন, "বড্ড ব্যথা লেগেছে কষ্ট হচ্ছে!" যুবক দুইটি জিজ্ঞাসা করিল, "স্বামীজী, কোথায়? কি করে ব্যথা লাগলো?" স্বামীজী কাতরভাবে ও করুণস্বরে বলিলেন, "দেখলি নি পাহাড়ের গায়ে লেগে ঐ মুটে স্ত্রীলোকটা গুমিয়ে পড়েছে। ওর কোমরটায় কী ধাক্কা লাগলো!" এই বলিয়া স্বামীজী কোমরে হাত দিয়া বড় কাতর হইয়া পড়িলেন। আর বেড়াইলেন না, বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন, সত্যই কত লাগিয়াছে।

যুবক দুইটির বয়স অল্প ছিল তাহারা মনে করিল - এ আবার কি ঢঙ! এক গাঁয়ে ঢেঁকি পড়ে, আর এক গাঁয়ে মাথা ব্যথা! কোথায় মুটে স্ত্রীলোকটার কোমরে চোট লাগলো, আর স্বামীজীর কোমরে ব্যথা হল। জগতে কত ঢঙই যে আছে তা বলা যায় না! তাহারা মুখে কিছু বলিল না, কিন্তু মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিল।

যমজ ভাইদের ভিতরও দেখা গিয়াছে যে, দুই ভাইকে দুই বিভিন্ন স্থানে রাখা হইয়াছে, কিন্তু একজনের শরীরে আঘাত লাগিয়া জ্বর হইলে, অপর ভাইটির অনুরূপ স্থলও সহসা ফুলিয়া উঠিয়া জ্বর হইয়াছে, অথচ অনেক দিন যাবৎ পরস্পরে কেহ কাহাকেও দেখে নাই বা আঘাত লাগার সংবাদও জানে না।

এই সকল ব্যাপার কি করিয়া হয়, ইহাই হইল প্রশ্ন। মন যখন স্থূল-স্নায়ুতে বা স্থূল-শরীরে থাকে, তখন তাহার বিকাশও অতি স্থূলভাবে হইয়া থাকে। স্থূল-শক্তির গতি অল্প সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে বা অল্পপরিধিযুক্ত হয়। এইজন্য স্থূল অবস্থায় বিশিষ্ট ভাব - 'খণ্ড' বা 'দ্বন্দ্ব' অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। ইহা হইল দুঃখ ও অশান্তির কারণ। শান্তি হইল, 'শান্ত' বা সাম্য অবস্থায় উপনীত হওয়া। চিৎ-শক্তি যখন সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে প্রবাহিত হয়, তখন খণ্ড বা বিশিষ্ট ভাব চলিয়া যাইয়া সাম্য, একীভূত বা অখণ্ড অবস্থা বিকাশ পায় - জগৎ বা সৃষ্টি যে সর্বত্র এক শক্তি বা এক উপাদান বা এক মূল কারণে পরিব্যাপ্ত, তাহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়; মাঝখানে কোনো ব্যবধান বা বিচ্ছেদ বলিয়া কিছু থাকে না।

স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে একবার বলিয়াছিলেন, "স্থূল অবস্থায় সমস্তই বিচ্ছিন্ন ও পৃথক দেখা যায়। স্থূল অবস্থায় যে স্পন্দন উৎপন্ন হয়, তাহা অল্পপরিসরযুক্ত ও তাহার গতি অ-দ্রুত; এইজন্য সর্বত্রব্যাপী কোনো শক্তি থাকে না। কিন্তু মন যখন উচ্চ মার্গে যায় বা কারণ-স্নায়ুতে বা কারণ-শরীরে অবস্থান করে, তখন যে সকল স্পন্দন উঠে, অর্থাৎ যে সকল চিন্তাশক্তি উঠে, তাহা সমস্ত সৃষ্টিময় পরিব্যাপ্ত হয়, কারণ চিদাকাশের প্রক্রিয়া স্থূল প্রক্রিয়া হইতে অন্যবিধ।"

বেতার-বার্তা সূক্ষ্ম-স্পন্দনের সামান্য মাত্র পরিচয় দেয়, কিন্তু ইহা হইতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সূক্ষ্ম-স্পন্দন বা সূক্ষ্ম-প্রকম্পন, স্থূল-স্পন্দন অপেক্ষা অধিক শক্তিতে পরিপূর্ণ এবং বহু দূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়। চিৎ-শক্তিকে যদি আরো উচ্চে, কারণ-অবস্থায় বা মহাব্যোমে উঠানো যায়, তাহা হইলে সেই অবস্থায় যে সকল প্রকম্পন বা স্পন্দন উঠিবে, তাহা বিশ্বব্যাপী হইবে। এই স্থলে মনোবিদ্যা ও বিজ্ঞানশাস্ত্র একীভূত হইয়া যায়। মানুষের দেহ হইল অতি সূক্ষ্ম জীবন্ত যন্ত্র, যাহার দ্বারা এই সকল সূক্ষ্ম-স্পন্দনের কার্য-কারণ পরীক্ষা করা যাইতে পারে - Human body is the most delicate living instrument for experimenting the finer vibrations and their causes.

স্বামীজী যখন এই সূক্ষ্ম-স্পন্দনের বিষয় বক্তৃতা করিতেছিলেন, তখন তিনি অন্য প্রকার হইয়া গিয়াছিলেন। সকল বস্তুকেই তিনি যে স্পর্শ করিয়া রহিয়াছেন, তিনি যে বিশ্বব্যাপ্ত, সর্বত্রই রহিয়াছেন ও সর্ব বস্তুর সহিত সংশ্লিষ্ট - ইহাই তিনি বিশেষ করিয়া বুঝাইতে লাগিলেন। আর একটি বক্তৃতায় তিনি এই বিষয় বলিয়াছিলেন, "I am in the Sun, I am in the Moon, I am in the stars, I am everywhere." - অর্থাৎ, আমি সূর্যতে রহিয়াছি, আমি চন্দ্রতে রহিয়াছি - আমি সর্বব্যাপ্ত। আর একবার তিনি বলিয়াছিলেন, "I am a voice without form" - আমি বাণী, দেহ নহি।

স্থূল-দেহে বা স্থূল-স্নায়ুতে এই সকল ভাব বা উক্তি প্রযোজ্য নয়। কারণ বা মহাকারণে চিৎ-শক্তি উঠিলে, জগতের প্রত্যেক বস্তুর ভিতর যে কারণ বা মহাকারণ অন্তর্নিহিত আছে এবং কারণ বা মহাকারণ হইতেই যে প্রত্যেক বস্তু সৃষ্ট হইয়াছে, তাহার দ্বারাই যে পরিব্যাপ্ত ও পরিপূর্ণ হইয়া রহিয়াছে - ইহাই স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তু যেমন মহাকারণ হইতে আসিয়া স্থূল অবস্থা ধারণ করিয়াছে, তেমন প্রত্যেক বস্তুতেই মহাকারণ বা আদিকারণ বা আদিশক্তি অন্তর্নিহিতভাবে রহিয়াছে। মানুষের দেহও সেইরূপ আদিকারণ হইতে উৎপন্ন হইয়া পরিশেষে স্থূল রূপ ধারণ করিয়াছে। কারণ ও মহাকারণে চিৎ-শক্তি তুলিলে, মানুষের দেহ ও অপর সৃষ্ট বস্তুসমূহ সেই একই মহাকারণের বিভিন্ন রূপ বলিয়া পরিগণিত হয়। মহাকারণ হইল, Substratum - আধার। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে আছে:

"আধারভূতা জগতস্ত্বমেকা
মহীস্বরূপেণ যতঃ স্থিতাঽসি।"1

প্রথম অবস্থায় আমরা দুইটি বস্তুর মধ্যে ব্যবধান দেখিয়া থাকি। 'দুইটি পরমাণু' - এইরূপ শব্দ যদি প্রয়োগ করি, তাহা হইলে, অতি সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করিলে দেখিতে পাই যে, মাঝখানে একটি ফাঁক বা ব্যবধান আছে ... এই ভাবটি মনে আসিয়া থাকে; আর দুইটি বিন্দুর পৃথক Location বা পৃথক অবস্থিতি এবং সীমা ও পরিধির বিষয় স্বতঃই মনে আসে। এক বিন্দু হইতে অপর বিন্দুতে যাইতে হইলে মাঝখানে একটি শূন্য বা অনিশ্চিত ভাব বা ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। পৌরাণিক ভাষায় ইহাকেই 'ভবসাগর' বলা হইয়াছে। ভবসাগর যে কি করিয়া উত্তীর্ণ হইতে হইবে, তাহার জন্য সকলেই ব্যতিব্যস্ত।

এখন প্রশ্ন হইতেছে যে, এই ব্যবধানটি কি? - এক বিন্দু অপর বিন্দু হইতে অন্যত্র যাইতেছে, বিপরীত দিকে উভয়ের গতি - ইহাই হইল 'দূরত্ব'। কিন্তু, 'ব্যবধান' হইল সাম্য-অবস্থার কথা, এই স্থলে পরিধির কোন চিন্তা নাই। দুইটি বিন্দুর সীমাবিবর্জিত ব্যবধান চিন্তা করাও যাহা, আর সমস্ত সৃষ্টি যে অব্যক্তভাবে অবস্থিত, ইহা চিন্তা করাও তাহাই - দুইই এক হইয়া যায়। এতদ্-অনুসারে, পরিদৃশ্যমান জগৎ লোপ হইয়া যায়, নিজের দেহও লোপ হইয়া যায়, চিন্তাশক্তিও লোপ হইয়া যায়, মাত্র সত্তা অবস্থান করে। সেই সত্তা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত এবং সেই সত্তা হইতেই পুনরায় সমস্ত সৃজন হইতেছে, পুনরায় সেই সত্তাতেই সমস্ত সৃষ্ট বস্তু মিলাইয়া যাইতেছে। দুইটি পরমাণুর মধ্যস্থিত যে ব্যবধান, তাহার সাম্য-অবস্থা চিন্তা করা এবং সমস্ত জগৎ সৃজন করা - একই হইয়া যায়। এই স্থলে প্রত্যেক বিন্দুই হইল কেন্দ্র, বিশেষ কেন্দ্র কোনো স্থানে নাই - Every point is a centre, nowhere is the centre. কারণ শক্তি সর্বব্যাপ্ত; শরীরের যে কোনো স্থান দিয়া চিন্তা করা যাইতে পারে এবং সেই স্থানটি কেন্দ্র হইতে পারে; বিশেষ কেন্দ্র বলিয়া কিছুই থাকে না। এই সকল হইল দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মত। ইহা যদিও জটিল, কিন্তু ইহা প্রকৃতরূপে সমস্ত বিষয় স্পষ্টভাবে পরিদর্শন করিতে সাহায্য করে।

অতি সূক্ষ্ম বা কারণ অবস্থায় সমগ্র সৃষ্টির প্রত্যেক বস্তু পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ করিয়া থাকে, সংলগ্ন হইয়া থাকে; একে অন্যের সহিত অভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট হইয়া থাকে। এইজন্য, এক জায়গায় স্পন্দন উঠিলে, অপর এক জায়গায় স্পন্দন প্রতিফলিত ও প্রতিবিম্বিত হয়। যাহা কারণ ও মহাকারণে স্পন্দিত হয়, অবশেষে তাহা স্থূলে পরিব্যাপ্ত হয়। পরমহংস মশাই-এর গায়ে যে কেন প্রহারের দাগ পড়িয়াছিল, বা স্বামীজীর কোমরে যে কেন ব্যথা লাগিয়াছিল, ইহাতে তাহা বেশ স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। স্বামীজী যে মহাকারণ-স্পন্দনের ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন, বর্ণিত ঘটনা দুইটি তাহার স্পষ্ট উদাহরণ।

কারণ ও মহাকারণের প্রক্রিয়া পরমহংস মশাই-এর স্থূল দেহে প্রতিফলিত ও প্রতিবিম্বিত হইয়াছিল। মাঝির ও তাঁহার দেহের মধ্যে যে ব্যবধান ছিল, তাহা শূন্য নয়, তাহা সংযোজক শক্তিতে পরিপূর্ণ। এইজন্য, এক কেন্দ্রের স্পন্দন অপর কেন্দ্রে প্রতিবিম্বিত হইল। পরমহংস মশাই যে কত উচ্চ অবস্থায় উঠিয়াছিলেন, তাহা ঘটনাটিতে প্রতীয়মান হয়।


1. তুমিই জগতের একমাত্র আশ্রয়স্বরূপা, যেহেতু তুমি ক্ষিতিরূপে অবস্থিতি করিতেছ।

Tuesday, March 20, 2018

চিন্ময়ী-মৃন্ময়ী

সাধারণ লোক প্রস্তরনির্মিত কালী-বিগ্রহকে পাষাণময়ী বলিয়া থাকে। ভাস্কর একখণ্ড প্রস্তর লইয়া বাটালি দিয়া খোদিত করিয়া এই মূর্তি নির্মাণ করিয়াছে, এইজন্য ইহা জড় প্রস্তরমূর্তি, আর কিছুই নয় - এ কথা বলিলে কোনোই ভুল হয় না, কারণ, স্থূলস্নায়ুর প্রক্রিয়া হইল এইরূপ। স্থূলস্নায়ুর প্রকম্পনের জন্য আমরা বস্তুকে 'স্থূল', 'জড়', 'সীমাবদ্ধ' প্রভৃতি বহুপ্রকার দেখিয়া থাকি। এইজন্য সাধারণত, আমরা বস্তুনির্ণয়কালে সীমাবদ্ধ কয়েকটি গুণের উল্লেখ করিয়া থাকি। ইহা ভ্রান্ত মনের কার্য নয়! ইহা ঠিক কথা কারণ, স্থূল অবস্থাতে এইরূপ পরিদর্শন হয়। কিন্তু সূক্ষ্ম-স্নায়ু দিয়া বা বিদেহ অবস্থা হইতে জগতকে দেখিলে অন্যবিধ ভাব হইয়া থাকে কারণ, দ্রষ্টা তখন চিন্ময় হইয়া যান এবং জগৎকেও চিন্ময় দেখেন। বৈষ্ণবদিগের একটি বাণী আছে:

"চিন্ময় শ্যাম, চিন্ময় ধাম, চিন্ময় নাম।"

অর্থাৎ অখণ্ড সচ্চিদানন্দ যিনি, তিনি চিন্ময়, জগৎ বা সৃষ্টি চিন্ময় এবং প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তু অর্থাৎ যাহার নাম ও রূপ আছে তাহাও চিন্ময়।

পরমহংস মশাই অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা কারণ-স্নায়ু দিয়া তাঁহার চিৎ-শক্তি প্রধাবিত করিয়াছিলেন, সেইজন্য তিনি একখানি প্রস্তরখণ্ডকে চিন্ময়ী বলিলেন এবং বিড়ালের ভিতরও সেই চিন্ময়ীকে দেখিলেন। তিনি এত উচ্চ অবস্থায় বা সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে গিয়াছিলেন যে, গাছের পাতা ও ঘাসেতেও সেই চিন্ময়ীকে দেখিতেন। পরমহংস মশাই-এর যে মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া গিয়াছিল তাহা নহে। ইহা উপহাস বা উপেক্ষা করিবার বিষয় নহে। ইহা হইল অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের অবস্থা। সংজ্ঞাক্ষেত্রের ঊর্ধ্বতম অবস্থা হইল অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের অবস্থা। আমাদের স্থূল-স্নায়ু দিয়া যে জ্ঞান হয়, তাহা নিতান্ত খণ্ড ও সীমাবদ্ধ। কিন্তু চিৎ-শক্তি যখন সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে প্রধাবিত হয়, তখন দূরত্ব, পরিধি ও কাল - এ সব কোনো প্রতিবন্ধ থাকে না; খণ্ড হইতে অখণ্ড বা পূর্ণতে আসিবার প্রয়াস হয় এবং অন্য প্রকার গুণ উপলব্ধি হয় বা দর্শন হয়। এই অতীন্দ্রিয় জ্ঞান চিত্তবৃত্তিকে অন্যত্র লইয়া যায়। ইহা যে কি অবস্থা, সাধারণ ক্ষেত্র হইতে তাহা উপলব্ধি করা যায় না।

স্বামীজীরও এই অবস্থা বহুবার দেখিয়াছি, ব্রহ্মানন্দেরও এই অবস্থা বিশেষভাবে দেখিয়াছি। সাধারণ লোকের ইহা অনুকরণ করা উচিত নয়। সাধারণ লোক ইহা অনুকরণ করিলে বাতুল বলিয়া পরিগণিত হইবে এবং তাহাকে বায়ুগ্রস্ত বলিয়া চিকিৎসা করা আবশ্যক হইবে। পরমহংস মশাই, স্বামীজী এবং ব্রহ্মানন্দ এই অবস্থায় অন্যান্য বিষয়েও পারম্পর্য ও সংশ্লিষ্ট ভাব রাখিয়াছিলেন, কিন্তু বায়ুগ্রস্ত ও বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তি এইরূপ অবস্থায় সকল বিষয়ে পারম্পর্য বা সংশ্লিষ্ট ভাব রাখিতে পারে না। বায়ুগ্রস্ত ব্যক্তি অপরের অনুকরণ করিতে পারে মাত্র।

Sunday, March 18, 2018

শক্তি-বিকিরণে

পরমহংস মশাই-এর গা হইতে একপ্রকার আভা - Effluvium বা Halo বাহির হইত। ইহা উপস্থিত সকল ব্যক্তি অনুভব করিতেন। অবশ্য, ইহা সব সময় বাহির হইত না। তিনি যখন সাধারণ অবস্থায় থাকিতেন, তখন ইহা অনুভব করিতাম না; কিন্তু তিনি যখন উচ্চ অবস্থায় উঠিতেন বা সমাধিস্থ হইতেন, তখন এই আভা বা শক্তি বাহির হইত এবং আমরা তাহা অনুভব করিতাম।

নিম্ন-শ্রেণীর ভালবাসা হইল দৈহিক বা স্বার্থপূর্ণ। এক দেহ হইতে আর এক দেহে যে শক্তি যাইতেছে, তাহাকে 'ভালবাসা' বলে। দুই বন্ধু একত্র বাস করিলে তাহাদের ভিতর একটা ভালবাসা হয়। কখনো বা দেখা যায় যে, দুইজন ব্যবসা করিবে - সেইজন্য পরস্পরে বেশ ঘনিষ্ঠতা হইয়াছে, কিন্তু কয়েক দিন পর সেই ভালবাসা বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইয়া বিদ্বেষে পরিণত হয়। ইহা হইল দৈহিক বা স্বার্থপূর্ণ ভালবাসা। স্বার্থপূর্ণ ভালবাসার গতি হইল Straight line-এ - সরল রেখায়। ইহাতে অল্পকাল পরেই প্রতিক্রিয়া আসিয়া থাকে কারণ, গতিবাদ-এর নিয়ম অনুযায়ী সরল রেখা বহুকাল যাবৎ ঋজু পথে চলিতে পারে না, অল্পকাল পরে অনৃজু পথে চলিয়া থাকে। সরল রেখা হইল বক্র রেখার ন্যূনতম অংশ।

উচ্চ-অঙ্গের ভালবাসা অন্য প্রকার। নিজের মন হইতে ইষ্ট-তে এক শক্তির গতি হয়, এবং ইষ্ট হইতে অপর ব্যক্তির প্রতি সেই শক্তি প্রধাবিত ও পরিব্যাপ্ত হয়। আমি ইষ্টকে ভালবাসি ও ভক্তি করি এবং ইষ্ট অপর ব্যক্তিকে ভালবাসেন; এইজন্য আমিও সেই অপর ব্যক্তিকে ভালবাসি। ইহাকে দার্শনিক ভাষায় 'ভালবাসার ত্রিকোণ-মূর্তি' - Triangle of Love বলা হয়। ইহার গতি ঠিক একটি Parabola - অধিবৃত্ত বা বিস্ফারিত বর্তুলের ন্যায় হইয়া থাকে। অহং, ব্রহ্ম ও জীব - এই হইল তিনটি কোণ। আমি বল্লভকে ভালবাসি, বল্লভ অপরকে ভালবাসেন; এইজন্য বল্লভের জন বলিয়া আমি অপরকে ভালবাসি। আমি অপর ব্যক্তিকে ভালবাসিতেছি না, আমি জগৎকে ভালবাসিতেছি না; কিন্তু বল্লভের জন, বল্লভের জগৎ - এইজন্য সেই লোক ও জগৎকে ভালবাসিতেছি।

ভক্তির ভাব দিয়া বিবেচনা করিলে বলিতে হইবে যে পরমহংস মশাই-এর আত্মগোষ্ঠীর ভিতর যে পরস্পরের প্রতি অত ভালবাসা, তাহা বল্লভের জন্যই হইত কারণ প্রত্যেকেই ছিল বল্লভের আশ্রিত।

দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক মত দিয়া আলোচনা করিলে আমরা দেখিতে পাই যে, গা হইতে যে শক্তি নির্গত হয়, তাহা বহু স্তরের হইয়া থাকে। ত্বকের উপরিভাগে একপ্রকার শক্তি আছে, তাহাকে Enveloping energy - 'আবরণী শক্তি' বলে। ত্বকের সংশ্লিষ্ট যে শক্তি, তাহাকে Peripheral energy - 'ত্বক-শক্তি' বলে। ইহার অভ্যন্তরে হইল Preservative energy - 'সংরক্ষণী শক্তি'। ইহারও অভ্যন্তরে আরো অনেক প্রকার সূক্ষ্ম শক্তি আছে। আবরণী-শক্তি সাধারণ লোকের চর্মের উপর আড়াই ইঞ্চি হইতে তিন ইঞ্চি পর্যন্ত ব্যাপ্ত থাকে। এক ব্যক্তির খুব নিকটে অপর কোনো ব্যক্তি বসিলে, সে একটু বিরক্ত হইয়া উঠে, বলে - "গা ঘেসে বসলে কেন।" অনুমান করা যাইতে পারে যে, উভয়ের চর্ম-পরিধির মধ্যে অন্তত ছয় ইঞ্চি ব্যবধান থাকে, কিন্তু উভয়ের এই আবরণী-শক্তির সংঘর্ষণ ও সংযোগ হওয়ায় এইরূপ বিরক্তির ভাব আসিয়া থাকে। কদাচারী ও কুচিন্তাপূর্ণ ব্যক্তিদিগের আবরণী-শক্তির বর্ণ মলিন বা কালো হইয়া থাকে - চলিত কথায় যেমন বলে, "তোমার মুখের ওপর একটা কালো ছায়া পড়েছে।" সাধারণ অবস্থায়, এই আবরণী-শক্তির বর্ণ ধূসর বা কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল হইয়া থাকে। এইজন্য অনেক সময় লোকের মুখ, চন্দ্রের সহিত তুলনা করা হয়, যেন মুখ হইতে একটা দীপ্তি বাহির হইতেছে।

এ সকলই হইল বাহ্যিক বিকাশ বা স্থূল-স্নায়ুর প্রক্রিয়া; কিন্তু মন বা শক্তি যখন স্থূল-স্নায়ু হইতে সূক্ষ্ম-স্নায়ু, কারণ-স্নায়ু বা মহাকারণ-স্নায়ুতে অন্তর্মুখী হইয়া প্রধাবিত হয়, তখন এই শক্তি অপর এক রূপ ধারণ করে।

স্পন্দনবাদের নিয়ম হইল, স্পন্দন যখন অতি স্থূলভাবে হয়, তখন তাহার পরিধি অল্পপরিসরযুক্ত হয়; আর স্পন্দন যখন অতি সূক্ষ্মভাবে হয়, তখন তাহার গতি ও পরিধি বহুদূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয় - Grosser the vibration shorter the range, finer the vibration longer the range. মন বা শক্তি সাধারণ অবস্থায় স্থূল-স্নায়ুতে থাকে। কিন্তু, মন যখন অন্তর্মুখী হইয়া সূক্ষ্ম-স্নায়ু দিয়া প্রধাবিত হয়, তখন তাহার বাহিরের প্রক্রিয়াও সেইরূপ পরিব্যাপ্ত হইয়া থাকে; কারণ সাধারণত, শক্তির গতি হইল বহির্মুখী বা বিকাশমুখী। মনকে যে পরিমাণে অন্তর্মুখী করা যাইবে, বিকাশকালে সেই পরিমাণে বহির্মুখী হইবে। ইহাকে সূক্ষ্ম-স্পন্দন, সূক্ষ্ম-দেহ, বা কারণ-দেহ বলা হয়। সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা কারণ-স্নায়ু হইতে, বা সূক্ষ্ম-শরীর বা কারণ-শরীর হইতে শক্তি উৎপাদন করিয়া বিস্তার করিলে সকলেই তন্ময় ও পরিপূর্ণ হইয়া যায়।

স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে কাঠের মঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া বুকে হাত দিয়া প্রথমে খানিকক্ষণ স্থির হইয়া থাকিতেন, তাহার পর, একটু পদচারণ করিয়া দৃঢ়পদে এক জায়গায় দণ্ডায়মান হইতেন। সেই সময় তাঁহার মুখের ও চোখের সমস্ত স্নায়ু পরিবর্তিত হইয়া যাইত এবং তিনি যেন অন্য এক ব্যক্তি হইয়া যাইতেন। ধীরে ধীরে তাঁহার কণ্ঠ হইতে শব্দ নির্গত হইত। কণ্ঠস্বরের এই একটি বিশেষত্ব ছিল যে, বহু দূরের ব্যক্তিও নিকটের ব্যক্তির মতো সমানভাবে তাহা শুনিতে পাইত। এই কণ্ঠস্বর 'সাম্যস্পন্দন' হইতে উদ্ভূত। স্বামীজী কখনো কখনো বলিতেন, "আমি নিজের শরীর থেকে একটি শক্তি উৎপন্ন করে সেটি শ্রোতাদের উপর বিস্তার করি। শ্রোতারা আমার অঙ্গবিশেষ হয়ে যায়। আমি মনঃশক্তি শ্রোতাদের মধ্যে সঞ্চারিত করি। শ্রোতাদের মন আমার মন বা শক্তির সঙ্গে সংমিশ্রণ করি।" তিনি কৌতুকচ্ছলে ইহাও বলিতেন, "সকলের মনগুলো আমার মনের সঙ্গে এক রঙে রাঙিয়ে নি।" যাহা হউক, এইরূপ অবস্থায় তিনি যাহা বলিতেন, সকলেই তাহা গ্রহণ করিত; দুই মন বা দুই চিন্তা থাকিত না।

পরমহংস মশাই-এর এই শক্তি অতি অদ্ভুত পরিমাণে ছিল। সাধারণ অবস্থায় তাঁহাকে অতি সামান্য লোকের মতো দেখা যাইত, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে তিনি এত উপরে উঠিয়া যাইতেন যে, তাঁহার Altitude - উচ্চতা, কিছুই বুঝিতে পারিতাম না, স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া থাকিতাম মাত্র। তিনি শব্দ, চিন্তা, দ্বন্দ্বভাব, Relative idea বা সাপেক্ষ ভাব প্রভৃতির কত উচ্চে যে উঠিতেন এবং কত সূক্ষ্ম স্নায়ু দিয়া যে শক্তি বিকাশ করিতে পারিতেন, তাহা কিছু বলা যায় না।

সর্ব দেশের ভাষাতেই এইরূপ শব্দ পাওয়া যায়, ভাল লোক, সৎ লোক, সাধু লোক, মহাপুরুষ লোক, মহাত্মা লোক ও অবতার লোক প্রভৃতি। এই যে গুণবিভাগ, ইহার মাপকাঠি কি? ভাষাতেই বা এরূপ শব্দসকল আসিল কেন? - ইহার কারণ নির্ণয় করিতে হইলে বলিতে হইবে যে, বিভিন্ন প্রকার স্নায়ুর বিভিন্ন প্রকার প্রকম্পনের জন্য এক ব্যক্তি হইতে অপর ব্যক্তির এইরূপ প্রভেদ হইয়া থাকে। দেখা যায় যে, স্থূল-স্নায়ু হইতে যে স্পন্দন বা শক্তি বহির্গত হয়, তাহা অতি নিম্ন স্তরের প্রক্রিয়া এবং স্থূল, অল্পপরিসরযুক্ত ও অল্পকালস্থায়ী বা দেশ, কাল ও নিমিত্তের অধীন। কিন্তু স্থূল-স্নায়ু অতিক্রম করিয়া মনোবৃত্তি যেরূপ সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে প্রধাবিত হইবে, তাহার বহির্বিকাশের পরিধিও সেইরূপ হইবে।

স্বামীজী একবার বলিয়াছিলেন, "I conquered America before I visited the country" - আমি আমেরিকা দর্শন করিবার পূর্বেই আমেরিকাকে জয় করিয়াছিলাম। অর্থাৎ, তিনি সূক্ষ্ম-শক্তি বা মহাকারণ-শক্তি বা মহাকারণ-দেহ বিস্তার করিয়া সমস্ত আমেরিকা দেশটিকে আবরণ করিয়াছিলেন, পরে স্থূল-শরীরে তথায় উপস্থিত হইয়াছিলেন মাত্র।

পরমহংস মশাই-এর এই কারণ-শরীর বা মহাকারণ-শরীর যে কত বিস্তৃতি লাভ করিবে তাহা এখন বুঝিতে পারা যাইতেছে না। তাঁহার শরীর হইতে কি যে একটি আভা বা শক্তি বাহির হইত, তাহা আমরা বেশ অনুভব করিতাম ও তাহাতে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িতাম। কিন্তু সেই সূক্ষ্ম-স্পন্দন, কারণ-শরীর বা মহাকারণ-শরীর ভবিষ্যতে যে বিস্তৃতি লাভ করিবে, তাহা তখন কিছু বুঝিতে পারি নাই।

হাসি তামাশায়

পরমহংস মশাই বড় হাসি-তামাশার লোক ছিলেন। অতি অদ্ভুত তাঁহার হাসি-তামাশা করিবার ক্ষমতা ছিল। অতি নূতন রকমের তামাশা করিতে ও অতি নূতন রকমের উদাহরণ দিতে তিনি পারিতেন। কোনো রকম একঘেয়ে ভাব, গোঁড়ামি, সংকীর্ণভাব বা গুরুগিরির ভাব তিনি একেবারেই পছন্দ করিতেন না; এ সকল অতিশয় ঘৃণা করিতেন। কেহ যদি গোঁড়ামি করিত বা সংকীর্ণভাবে কথা বলিত, তাহা হইলে তিনি নিজের পাড়াগেঁয়ে ভাষায় একটি উপাখ্যান তুলিয়া উত্তর দিতেন। অনেক সময় উত্তর দেওয়ার ভাষা কলিকাতার সমাজের রুচিবিগর্হিত হইত বটে, কিন্তু উত্তরের উদ্দেশ্য হইত অতি সুন্দর এবং তাৎপর্যও হইত অতীব নিগূঢ়; সাধারণ লোকে উহার মর্ম বুঝিতে না পারিয়া তাঁহাকে বিদ্রূপ করিয়া শক্তির অপব্যয় করিবে এবং কি উদ্দেশ্যে পরমহংস মশাই এরূপ কড়াভাবের হাসি-তামাশা করিতেন, তাহা বুঝিতে না পারিয়া উহার কদর্থ করিবে এইজন্য ইচ্ছাপূর্বক এ সম্বন্ধে সে সকল কথা পরিত্যাগ করিলাম।

এই হাসি-তামাশা তাঁহার এক বিশেষ অস্ত্রস্বরূপ ছিল। ব্যঙ্গচ্ছলে এমন একটি উপস্থিত উদাহরণ তিনি দিতেন যে, শ্রোতারা একেবারে আশ্চর্য ও মুগ্ধ হইয়া যাইত। এইরূপ অদ্ভুত কৌতুকের ক্ষমতা থাকায়, কলিকাতার শিক্ষিত যুবকেরা তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল। কারণ সাধারণ লোকের বিশ্বাস যে ধর্ম-কর্ম হইল কতকগুলি শুষ্ক ও গম্ভীর নিয়ম পালন করা মাত্র - ধর্ম-কর্মে হাসি-তামাশা বা চাপল্যভাবের কোনো রেখা পর্যন্ত থাকিবে না।

পরমহংস মশাই এক দিন যুবকবৃন্দকে লইয়া খুব হাসি-তামাশা করিতেছিলেন। যুবকদিগের মধ্যে কাহারো নূতন বিবাহ হইয়াছে, কাহারো বা বিবাহের কথা চলিতেছে। তিনি সে সকল বিষয় লইয়া একেবারেই যুবকদিগের মতো হাসি-তামাশা করিতে লাগিলেন। শ্রদ্ধেয় বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মশাই সেই সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি পরমহংস মশাইকে বলিলেন, "ছেলেরা দূর থেকে দক্ষিণেশ্বরে এসেছে, ওদের দুটো ভাল কথা বলুন, শুধু হাসি-তামাশাই করছেন!" পরমহংস মশাই অমনি উত্তর কহিলেন, "তোমাদের ব্রাহ্মসমাজের ওই একটা দোষ, ছেলেবেলা থেকেই হবিষ্যি খাওয়ার ধাত!" কথাগুলির ভাবটা এই যে তোমরা মনের ও জগতের এক দিক মাত্র দেখাইতেছ কিন্তু অপর দিকও যে একটি আছে তাহার কোনো উল্লেখই করিতেছ না। এইজন্য তোমাদের ভিতর তেমন শক্তি আসিবে না। উহাতে মনের প্রকৃতি বৃদ্ধি হয় না, মন সজীব হয় না। এক দিকে যেমন ভাল ভাব দেখাইতে হয়, অপর দিকে তেমনি বিপরীত ভাবও দেখাইতে হয় - এই হইল প্রকৃত সাধনমার্গ।

স্বামীজীর ভিতরও হাসি-কৌতুকের ক্ষমতা অদ্ভুতরূপে ছিল। ইহা তাঁহার স্বভাবজাত ও বংশগত। Pointed repartee - চটপট সুতীক্ষ্ণ ও সরস উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা স্বামীজীর ভিতর বিশেষভাবে ছিল, এইজন্য তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী অল্পতেই বিধ্বস্ত হইয়া পড়িত। মনোবিজ্ঞানের পর্যায়-ক্রমোন্নতির ইহা একটি বিশেষ নিদর্শন।

প্রবাদ আছে যে, শ্রীচৈতন্যদেব খুব হাসি-কৌতুকপ্রিয় ছিলেন। আর ইহাই সম্ভব; কারণ তীক্ষ্ণ, মেধাবী ও নৈয়ায়িক মনের অপর দিক - অর্থাৎ, ব্যঙ্গ-কৌতুকের দিকটিও পরিবর্ধিত হইবেই। যেমন এক দিকে তর্ক-যুক্তির ক্ষমতা থাকিবে, অপর দিকে তেমনি ব্যঙ্গ-কৌতুকের ক্ষমতা থাকিবে। গোমড়ামুখো বোদা লোকের কোনো দিকটাই খোলে না। কিন্তু গ্রন্থে শ্রীচৈতন্যদেবের এই সকল হাসি-তামাশার বিষয় বিশেষ কিছুই লিপিবদ্ধ করা হয় নাই, শুধু তাঁহার এক দিকটাই বেশী দেখানো হইয়াছে। রাঢ়দেশের অর্থাৎ গঙ্গাতীরবাসী লোকদিগের ভিতর যে এত হাসি-তামাশা দেখা যায় তাহা সম্ভবতঃ শ্রীচৈতন্যদেবের আদর্শতেই হইয়াছে।

বৌদ্ধ গ্রন্থে মাত্র সামান্যভাবে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধদেবও নাকি হাসি-কৌতুক করিতেন। ইহা খুবই সম্ভব; কারণ, তীক্ষ্ণ মেধাবী ব্যক্তির হাসি-কৌতুকের ক্ষমতা মনোবৃত্তির একটি বিশেষ অঙ্গস্বরূপ। Witticism is the sign of intelligence - রঙ্গরস করা তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচায়ক। বৌদ্ধ গ্রন্থেও কিন্তু বুদ্ধদেব যে কিরূপভাবে হাসি-কৌতুক করিতেন, তাহার কোনো উল্লেখ নাই। কেবল ইহাই বিশেষভাবে দেখানো হইয়াছে যে, বুদ্ধদেব একজন স্থির, ধীর ও গম্ভীর প্রকৃতির লোক, হাসি-তামাশার ধার দিয়াও তিনি যান না। কিন্তু মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়া দেখিতে গেলে, ইহা কখনো হয় নাই, সম্ভবও নয়।

Saturday, March 17, 2018

রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ

শ্রীরামকৃষ্ণের চোখ হইল ক্ষুদ্র যাহাকে বলে - হাতি-চোখ। মুখে বিশেষ ওজস্বী ভাব নাই; বাহু-সঞ্চালন অতি ধীর ও করুণাব্যঞ্জক। সাধারণ অবস্থায় কণ্ঠস্বর মৃদু, একপ্রকার কাতর স্বর বলা যাইতে পারে। দেখিলে বোধ হয়, যেন জগতের সম্পর্ক হইতে বিশ্লিষ্ট হইয়া স্বতন্ত্র থাকিবার - নিরিবিলি ও একাকী থাকিবার তাঁহার ইচ্ছা, জগৎ যেন তাঁহাকে স্পর্শ করিতে না পারে।

বিবেকানন্দের চোখ হইল বিস্ফারিত; দৃষ্টি তীক্ষ্ণ; মুখ - সুডৌল, পুরুষ্ট। মুখে আজ্ঞাপ্রদ ভাব, Defiant attitude - বাধাবিঘ্ন-তুচ্ছকারী ভাব, যেন জগৎকে গ্রাহ্যই করিতেছে না। বাহু-সঞ্চালন ও তর্জনী-নির্দেশ যেন জগৎকে শাসন করিবার বা আজ্ঞা দিবার মতো, যাহাকে বলে নাপোলিঅঁ-র মতো অঙ্গভঙ্গী ও অঙ্গ-সঞ্চালন, আজ্ঞা শুনিয়া যেন সকলে স্তব্ধ হইয়া যাইবে। প্রথম দৃষ্টিতে দুইজনের ভিতর এই পার্থক্য দেখা যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের বিশেষ লক্ষণ হইল - বহুবিধ স্নায়ু দিয়া বহু প্রকার চিন্তা করা। শক্তি-বিকাশ করা বা যাহাতে ক্ষাত্রশক্তির আবশ্যক, এইরূপ কার্য তাঁহার নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের হইল গভীর চিন্তা করা মুখ্য, শক্তি-বিকাশ করা গৌণ। এইজন্য প্রথম অবস্থায় সাধারণ লোক তাঁহাকে কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া উন্মাদ ও বাতুল বলিয়া বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা করিত।

বিবেকানন্দের হইল শক্তি-বিকাশ করাই মুখ্য, গভীর চিন্তা করা হইল গৌণ।

এই দুইটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখিয়া উভয়ের জীবনী আলোচনা করিলে, উভয় ব্যক্তির মধ্যে বেশ একটি সামঞ্জস্য দেখা যায়। এ স্থলে বিশেষ করিয়া স্মরণ রাখিতে হইবে যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে অনুকরণ করেন নাই। একজন অপরের অনুকরণ করিয়াছিলেন - ইহা অতীব ভুল মত। উভয়েই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিত্ব অটুট রাখিয়াছিলেন। পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধা-ভালবাসা ছিল; কিন্তু উভয়ের কার্যক্ষেত্র ও বিকাশ-প্রণালী ভিন্ন ছিল। উভয়েই নিজ নিজ ভাবে চিন্তা করিয়াছিলেন। উভয়েই জগৎকে এবং জগতের সম্পর্কিত ও সংশ্লিষ্ট ভাবসমূহ নিজ নিজ চিন্তা অনুযায়ী উপলব্ধি করিয়াছিলেন। উভয়েই নিজ ভাবে জগতের প্রশ্নসকল মীমাংসা করিয়াছিলেন এবং সেইরূপ শক্তি বিকাশ করিয়াছিলেন। এইরূপ তেজঃপূর্ণ, বলিষ্ঠ ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ পুরুষ যাঁহারা, তাঁহারা কেহ কাহাকেও অনুকরণ করিতে পারেন না। নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখাই হইল এইরূপ পুরুষদিগের বৃত্তি।

মনোবিজ্ঞান দিয়া বুঝিতে হইলে দেখা যায় যে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব হইল ব্যক্ত হইতে অব্যক্তে চলিয়া যাওয়া। বিবেকানন্দের ভাব হইল অব্যক্ত হইতে ব্যক্তে চলিয়া আসা। শ্রীরামকৃষ্ণের হইল ঈশ্বর কেন্দ্র, জীব বা মনুষ্য পরিধি। বিবেকানন্দের হইল জীব বা মনুষ্য কেন্দ্র, ঈশ্বর পরিধি।

এখন প্রশ্ন হইতে পারে এই যে, যদি দুইজনের মধ্যে এই সব বিষয়ের পার্থক্য থাকে, তবে উভয়ের ভিতর সামঞ্জস্য কোথায়?

ইহা জানা আবশ্যক যে, শক্তির প্রবাহ যদি কেন্দ্র হইতে খুব গভীর স্তরে যায়, তাহা হইলে উপবৃত্ত - Ellipse হইয়া তাহার বিকাশ হইয়া থাকে। এইরূপ উপবৃত্ত হইয়া শক্তি পুনরায় নিজ কেন্দ্রে বা প্রাথমিক অবস্থাবিন্দু-তে উপনীত হয়। যে শক্তি বহির্মুখী বা বিকাশমুখী হইয়াছিল, তাহা উপবৃত্তের আকারে প্রধাবিত হইয়া পুনরায় নিজ কেন্দ্র বা প্রাথমিক অবস্থাবিন্দু-তে প্রশমিত হয়। ইহা হইল Theory of Motion - গতিবাদ-এর নিয়ম। এই নিয়ম সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা সূক্ষ্ম-শরীর সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। এইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণের ঈশ্বর কেন্দ্র হইলেও, জীবেও ঈশ্বরত্ব আরোপিত হয় বা ঈশ্বর-দর্শন হয় এবং বিবেকানন্দের জীব বা মনুষ্য কেন্দ্র হইলেও, পরিশেষে জীবেও ঈশ্বরত্ব আরোপিত হয় বা ঈশ্বর-দর্শন হয়। দর্শনশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্র - এই দুই শাস্ত্র দিয়া পর্যালোচনা করিলে, শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মনোবৃত্তি ও ক্রিয়াকলাপ বিশেষভাবে বুঝা যাইতে পারে।

শ্রীরামকৃষ্ণের স্নায়ু-প্রক্রিয়া এবং বিবেকানন্দের লন্ডনে বক্তৃতাকালে স্নায়ু-প্রক্রিয়ার বিষয় অনুধাবন করিলে অসংকোচচিত্তে বলা যায় যে, য়ুরোপীয় দর্শনশাস্ত্র ও শারীরবিজ্ঞান, ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের কাছে শিশুপাঠ্য পুস্তকসদৃশ।

দর্শনশাস্ত্রে ও বিজ্ঞানশাস্ত্রে যেসকল জটিল প্রশ্ন আছে এবং স্পন্দনবাদ ও স্নায়ু-প্রক্রিয়া প্রভৃতি যেসকল অতি দুরূহ বিষয় দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিকদিগকে বিভ্রান্ত করিতেছে, পরমহংস মশাই-এর দেহের প্রক্রিয়া, চিন্তাশক্তি ও শক্তিবিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করিলে, সেসকল জটিল বিষয়ের অতি সহজ সমাধান হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের ক্রিয়াকলাপ, স্নায়ুগতি ও স্নায়ুসঞ্চালনের বিষয় চিন্তা করিলে, জগতের দর্শনশাস্ত্র ও বিজ্ঞানশাস্ত্র নূতন প্রকারে লিখিতে হইবে এবং বহু প্রাচীন মত, যাহা য়ুরোপীয়েরা পোষণ করেন, পরিবর্তন করিতে হইবে, কারণ তাহা না হইলে কোনো সামঞ্জস্য থাকে না। আমি এইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণকে সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক - দর্শনশাস্ত্রের ও বিজ্ঞানশাস্ত্রের জীবন্ত প্রতিমূর্তি বলিয়া অভিহিত করি। ভবিষ্যতে জগতে যে দর্শনশাস্ত্র ও বিজ্ঞানশাস্ত্র নূতন প্রণালীতে লিখিত হইবে এই মহাপুরুষই হইলেন তাহার আদর্শ। ধর্মশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র ও বিজ্ঞানশাস্ত্র - এই তিন শাস্ত্রই যে অভিন্ন, এক-ই, শ্রীরামকৃষ্ণ তাহা জগৎকে দেখাইয়াছেন।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ