কথিত আছে যে, সাধনকালে পরমহংস মশাই কাপড়ের ল্যাজ করিয়া বাঁদরের মতো গাছের ডালে বসিয়া প্রস্রাব করিয়াছিলেন; আবার সাধনকালে, তিনি অপবিত্র দ্রব্যাদি স্পর্শ করিয়াছিলেন। তিনি নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণের সন্তান; প্রথম জীবনে তিনি পূজারীর কাজও করিতেন। এইরূপ অবস্থার মধ্যে পরিবর্ধিত হইয়া কি করিয়াই বা তিনি অপবিত্র বা অশুচি দ্রব্যাদি - বিষ্ঠা, মৃত গোবৎস প্রভৃতি স্পর্শ করিয়াছিলেন?
কোনো কোনো ব্যক্তির মতে ইহা হইল পিশাচভাব-এ সাধনার লক্ষণ। এইরূপ উক্তি, ভক্তির কথা হইতে পারে, কিন্তু দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিকগণের নিকট ইহার তত সার্থকতা নাই। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণ প্রত্যেক বস্তুরই কারণ অনুসন্ধান করিয়া থাকেন এবং যথাসম্ভব তাহার কারণ-নির্ণয় করেন। এইজন্য অনেক সময় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণের মতের সহিত ভক্তের মতের পার্থক্য হইয়া থাকে।
এখন আর একটি কথা এই হইতে পারে যে, পরমহংস মশাই সাধনকালে উন্মাদ হইয়াছিলেন এবং সেইজন্য এইরূপ অপবিত্র বস্তু স্পর্শ করিয়াছিলেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মতে উন্মাদ অবস্থা হইল স্নায়ুর এক প্রকার বিকৃত ভাব। সাধারণ অবস্থায় যে সকল স্নায়ুর প্রক্রিয়া হইতেছে অর্থাৎ যে সকল স্নায়ু দিয়া সাধারণতঃ শক্তি প্রধাবিত হয়, সেই সকল স্নায়ু দিয়া বিপর্যস্ত অবস্থায় শক্তি প্রধাবিত হয় না; তখন অন্য প্রকার স্নায়ু দিয়া শক্তি প্রধাবিত হয় এবং প্রধাবন-ক্রিয়া ক্ষণস্থায়ী হইয়া থাকে ও বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হইয়া যায়। এইজন্য এই অবস্থায় চিন্তাশক্তি ও তর্ক-বিতর্ক দিয়া কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বা মীমাংসায় আসিতে পারা যায় না, ইহাই হইল উন্মাদ বা বায়ুগ্রস্ত অবস্থার দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। কিন্তু দেখিতে পাওয়া যায় যে এইরূপ অবস্থায় পরমহংস মশাই-এর চিন্তাশক্তি একটি নির্ধারিত উদ্দেশ্য বা স্থানে উপনীত হইতেছে। বিশেষ স্থানে বা এক কেন্দ্রে তাঁহার চিন্তাশক্তি পরিসমাপ্ত হওয়ায় ইহাকে উন্মাদ অবস্থা বলা যাইতে পারে না। ইহা যদি উন্মাদ অবস্থা না হয় তাহা হইলে এইরূপ বিকৃত বা বিপরীত ভাব কি করিয়া আসিল - এরূপ তো মানুষের ভিতর সাধারণ অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায় না? - ইহাই হইল এখন আলোচ্য বিষয়।
দার্শনিক মত হইল যে, বিভিন্ন স্নায়ুপুঞ্জ যে প্রকার জাগ্রত হইবে, চিন্তাধারাও ঠিক সেই প্রকার হইবে। মনোবিজ্ঞানেও 'ভাল' বা 'মন্দ' বলিয়া কোনো শব্দ নাই। ইহা হইল নীতিশাস্ত্রের কথা। নীতিশাস্ত্রে ভাল বা মন্দের বিচার হইতে পারে; মনোবিজ্ঞানে ভাল বা মন্দ বলিয়া কোনো শব্দ হয় না।
বৌদ্ধ গ্রন্থ জাতকে আছে যে, বুদ্ধদেব পূর্ব পূর্ব জন্মে পশুদেহ ও অন্যান্য নানা প্রকার দেহ ধারণ করিয়াছিলেন এবং সেই কালে তাঁহার সেইরূপ প্রক্রিয়া বা ভাব বিকাশ পাইয়াছিল। কিন্তু জাতক-গ্রন্থে কেবল গল্প বা উপাখ্যান প্রদত্ত হইয়াছে, এইরূপ ভাব-বিকাশের কোনো কারণ নির্ণয় করা হয় না।
জীববিজ্ঞানে দেখা যায় যে, বহুকালব্যাপী শক্তিপ্রয়োগে স্নায়ু পরিবর্তিত হইয়া অতি সামান্য মাত্র প্রাণী হইতে মানুষের দেহ আসিয়াছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও জলবায়ুর যেমন পরিবর্তন হইবে, স্নায়ুপুঞ্জও তেমন নিজের অভ্যন্তরস্থিত শক্তি বিকাশ করিয়া নিজ অবয়ব পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করিবে। ইহাই হইল সমতা-সাধন-বিধি বা Law of Concordance-এর ধারা। সামান্য প্রোটোপ্লাজম্ হইতে ভ্রূণ ও অর্ভক কি করিয়া আসিল, তাহা চিন্তা করিলে এক অতি আশ্চর্য ব্যাপার দেখা যায় - স্নায়ুর বহুকালব্যাপী ক্রমপরিবর্তন ও ক্রমপরিবর্ধন যে হইয়াছে, তাহা আমরা বেশ বুঝিতে পারি। একটি ডিম তরল অবস্থা হইতে কি করিয়া স্নায়ুসংযুক্ত হইয়া পক্ষীর রূপ ধারণ করে, তাহা গবেষণা করিলে স্নায়ুর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন-ক্রিয়া বুঝা যায়। ডারউইন অস্থিনির্দেশ করিয়া জীবের উৎপত্তি নির্ণয় করিয়াছেন। আমি স্নায়ুর উদ্ভব, পরিণতি ও বিকাশ অনুযায়ী জীবের উৎপত্তি নির্ণয় করিতেছি।
জীববিজ্ঞান কিন্তু কেবল ক্রমবিকাশের কথা বলিয়া থাকে; বিপর্যস্ত ভাবের বা বিপরীত গতির - ক্রমবিবর্তনের কোনো উল্লেখ করে না। রাজযোগ ও হঠযোগের মত হইল যে, শক্তি বিপরীত দিকে সঞ্চালিত করিলে বহু পূর্বকালের স্নায়ু, যাহা বর্তমানে সুষুপ্ত বা মৃতকল্প হইয়া আছে, সঞ্জীবিত করা যাইতে পারে। জীববিজ্ঞানের সহিত রাজযোগ এবং হঠযোগের এ স্থলে পার্থক্য রহিয়াছে।
দেখা গিয়াছে যে, অনেক রাজযোগী ও হঠযোগী স্নায়ু পরিবর্তন করিয়া বিভিন্ন প্রকার কার্য করিতে পারেন, যেমন অগ্নির উপর দিয়া পদচারণ করা, মাটির ভিতর অবস্থান করা প্রভৃতি বহু প্রকার অসাধারণ কার্য তাঁহারা করিতে পারেন।
আমি এক ব্যক্তিকে আসবপানে বিহ্ব্ল হইয়া বিশ ঘণ্টাকাল কুকুরের মতো ব্যবহার করিতে দেখিয়াছি। আমি তাহাকে বিশেষ করিয়া পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম। দেখিলাম যে, কুকুরের যেরূপ প্রক্রিয়া হয় - চোখের দৃষ্টি, কণ্ঠস্বর, মূত্রত্যাগ, সমস্তই তাহার সেইরূপ হইতে লাগিল। আসব-সংযোগে বা বাহ্যিক শক্তি-প্রয়োগে তাহার বহু পূর্বের কুকুর-স্নায়ুসকল সঞ্জীবিত হইয়া উঠিয়াছিল। এইজন্য তাহার সমস্ত মানব-ভাব বিলুপ্ত হইয়াছিল এবং কুকুরের সকল ভাব সে পাইয়াছিল।
এক ব্যক্তি সার্কাসে বাঘ লইয়া খেলা করিতেন। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, "আপনি এমন ভালমানুষ কিন্তু কি করে বাঘের সঙ্গে খেলা করতেন?" তিনি উত্তরে বলিলেন, "খেলা হওয়ার আগে নির্জন স্থানে অনবরত চিন্তা করতুম - আমি বাঘ, বাঘই আমি। খানিকক্ষণ এই রকম করবার পর, স্নায়ু যখন দৃঢ় হত, তখন ফের চিন্তা করতুম - আমি বড় বাঘ, ও ছোট বাঘ। তার পর, একটা উন্মত্ত ভাব আসতো; আমি পিঁজরায় গিয়ে একটা, দুটো বা তিনটে বাঘের সঙ্গে খেলা করতুম। আমি যে মানুষ সে ভাবটা আমার মনে থাকতো না। কেবল আমি যে একটা বড় ভীষণ বাঘ - এই ভাবটা জেগে উঠতো।" আমি তাঁহাকে বলিলাম, "ভাবুন দেখি, আপনার শরীরের কোন্ স্নায়ু দিয়ে কি রকম ভাবে শক্তি চলছে - আবার আগেকার ভাব আনবার চেষ্টা করুন।" এইরূপ খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর দেখিলাম যে তাঁহার শান্ত অমায়িক ভাব চলিয়া গিয়া অভ্যন্তরস্থিত ব্যাঘ্রভাব জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে। চোখের দৃষ্টি অন্য প্রকার হইয়া যাইল, ঘাড় বাঁকিয়া গেল, মুখের চেহারা ভীষণ হইয়া উঠিল, গলায় ঘড়ঘড়ে আওয়াজ আসিল। এত পরিবর্তন হইল যে, আমার ভয় হইতে লাগিল পাছে সেই অবস্থায় তিনি আমাকে কামড়াইয়া দেন! আমি সরিয়া যাইলাম। এক অতি আশ্চর্য পরিবর্তন দেখিলাম! তিনি নিজের দেহের বেগ সহ্য করিতে না পারিয়া মেঝের উপর অনেকক্ষণ শুইয়া রহিলেন। তাহার পর শান্ত মানুষের ভাব ফিরিয়া আসিলে চলিয়া যাইলেন। যাইবার সময় বলিলেন, "আজ মাথাটা বিগড়ে গেছে, কোনো কাজ করতে পারবো না।" তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে বাঘের সহিত খেলা করিয়া তিনি অনেকক্ষণ ফাঁকা জায়গায় পড়িয়া থাকিতেন, কারণ তখন তিনি ব্যাঘ্রভাবে ভরপুর থাকিতেন এবং মানুষকে সহসা আক্রমণ করিবার সম্ভাবনাও তখন থাকিত। তাহার পর স্নায়ু ঠাণ্ডা হইলে তিনি মানুষের সহিত দেখা করিতেন।
ময়ূরভঞ্জের শেয়াল-মেয়ে বা 'শেয়াল-রাণী', 'ভল্লুকে-ধরা-মেয়ে', আফ্রিকার 'চিম্প্যানজী-মেয়ে', শিমলা পাহাড়ের 'বাঘ-মানুষ' - এই সকল হইল আরো নানা উদাহরণ।
কয়েক বৎসর পূর্বে কোনো এক বিশিষ্টা রমণী সংবাদপত্রে ময়ূরভঞ্জের শেয়াল-মেয়ে বা শেয়াল-রাণীর কথা লিখিয়াছিলেন। একটি ইংরেজের মেয়েকে অতি শৈশবে শেয়ালে লইয়া যায়। শেয়ালী মেয়েটিকে দুধ দিয়া পালন করিয়াছিল। মেয়েটি বড় হইলে শেয়ালের প্রকৃতি প্রাপ্ত হইল, কেবল অবয়বাদি মানুষের মতো রহিল। সাঁওতালেরা জঙ্গল হইতে গরু চরাইয়া আসিলে বলিত যে, জঙ্গলের ভিতর সাদা পেতনি আছে, মানুষ দেখিলে পলাইয়া যায়। এই কথা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িলে লোকজন যাইয়া জঙ্গল ঘিরিয়া শেয়াল তাড়াইয়া মেয়েটিকে ধরিয়া আনিল। মেয়েটির বয়স পনেরো-ষোল হইবে। মেয়েটিকে কাপড় পরাইয়া তাহারা একটি ঘরে রাখিল। স্বাধীনতা নষ্ট হইয়াছে বলিয়া মেয়েটি শেয়ালের মতো রব করিয়া কাঁদিত। ইহা শুনিয়া চারিদিক হইতে শেয়াল আসিয়া তাহার দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করিয়া কাঁদিত। মেয়েটিকে দুধ আর ভাত খাইতে দেওয়া হইত, সে মুখ দিয়া তাহা খাইত। দিন কতক পরে মেয়েটি মরিয়া যায়।
আমাদের বাড়ির কাছে মহেন্দ্র গোসাঁই লেনে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ হইতে বালিকাদিগের একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। দার্জিলিঙ-এর জঙ্গল হইতে একটি মেয়েকে আনিয়া সেখানে রাখা হইয়াছিল। আমি মাঝে মাঝে মেয়েটিকে দেখিতে যাইতাম এবং আশ্রমের অধ্যক্ষ মহেশ আতর্থী মশাইকে মেয়েটির বিষয় নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতাম। মেয়েটি যখন বালিকাদিগের সহিত খেলা করিত, তখন মানুষের মতো দাঁড়াইয়া থাকিত; কিন্তু যখন একাকী থাকিত, তখন হাঁটু আর হাতের উপর ভর দিয়া চলিত। একটু রাগ হইলে ঘরের কোণে যাইয়া ভল্লুকের মতো গলার আওয়াজ করিত এবং হাতের আঙুল দিয়া আঁচড়াইতে যাইত ও কামড়াইতে যাইত। মেয়েটি একটু বড় হইলে দেখা গেল যে, সে ভুটিয়াদের মেয়ে। বছর বারো-তেরো বয়স হইলে মেয়েটি মারা যায়।
কয়েক বৎসর পূর্বে একখানি সংবাদপত্রে এই সংবাদটি প্রকাশিত হইয়াছিল যে, আফ্রিকায় যেখানে চিম্প্যানজীর বাসস্থান, সেখান হইতে আমেরিকান বৈজ্ঞানিকরা চিড়িয়াখানায় জীবন্ত চিম্প্যানজী ধরিয়া আনিবার জন্য জঙ্গল বেষ্টন করে। অবশেষে বৈজ্ঞানিকরা দেখিল যে, চিম্প্যানজীদের সঙ্গে একটি শুভ্রকায় মেয়ে রহিয়াছে, বয়স বছর দশ হইবে। মেয়েটি গাছের ডালে বসিয়া থাকে, চিম্প্যানজীদের সঙ্গে কথাবার্তা কহিয়া থাকে এবং চিম্প্যানজীদের মতো খাইয়া থাকে। আমেরিকানরা যখন চিম্প্যানজী ধরিবার চেষ্টা করিল, তখন চিম্প্যানজীরা গাছের ডাল ভাঙিয়া লাঠি করিয়া মারিতে আসিল, মেয়েটিও সেই রকম গাছের ডাল ভাঙিয়া লইয়া মারিতে আসিল। আমেরিকানরা অনেক কষ্টে চিম্প্যানজীদের তাড়াইয়া মেয়েটিকে ধরিল এবং তাহার গায়ে আবরণ দিয়া ধরিয়া তাঁবুতে লইয়া আসিল। মেয়েটির শরীর চিম্প্যানজীর মতো বলিষ্ঠ ছিল। পরে বৈজ্ঞানিকদিগের ভিতর কথা উঠিল যে, যদি মেয়েটিকে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দেওয়া যায়, তাহা হইলে চিম্প্যানজীদের ভাষা আর মানুষের ভাষা উভয়ই বুঝা যাইবে। এ বিষয়ে পরে কি হইয়াছিল তাহার কোনো সংবাদ জানি না।
শিমলা পাহাড়ে একটি বাঘ-মানুষ ছিল। ইটালীর উপেন দেবের1 বাড়িতে তাহার ফোটো ছিল। সে হাঁটু ও হাত দিয়া চলিত; কিন্তু ঘোড়া বা গরু দেখিলেই হাঁটু হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ঘোড়া বা গরুর চামড়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া চাটিয়া চাটিয়া রক্তপান করিত। ফোটোতে তাহার চেহারা অনেকটা বাঘের মতন দেখিয়াছিলাম।
এ স্থলে ইহা জানা আবশ্যক যে, মানুষের দেহে পূর্বজন্মের বানর ব্যাঘ্র প্রভৃতি অবস্থার চিহ্ন বা স্নায়ু আজও পর্যন্ত বিদ্যমান রহিয়াছে। জীববিজ্ঞান যে বিষয়ে অনুমানের উপর তর্ক-বিতর্ক করিয়া থাকে, এই সকল উদাহরণের দ্বারা তাহা স্পষ্ট বুঝা যায়। চেষ্টা ও অভ্যাস করিলে বিশেষ প্রক্রিয়ার সাহায্যে পূর্বতন স্নায়ুসমূহকে জাগ্রত করা যাইতে পারে।
বৌদ্ধমতে বলা হয় যে, চৌষট্টি লক্ষ দেহ পরিবর্তন করিয়া জীব মানুষের দেহে উপনীত হয়। এ বিষয়ে এই মাত্র বলা যাইতে পারে যে, মানুষের দেহের ভিতর বহু পূর্বজন্মের সুষুপ্ত স্নায়ুসমূহ আছে। অবশ্য, তাহা সাধারণ লোকে সঞ্জীবিত করিতে পারে না। কিন্তু মানুষের দেহ যে এক কালে কুকুর, ব্যাঘ্র, শূকর প্রভৃতির দেহ ছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়।
সাধনকালে পরমহংস মশাই তাঁহার চিন্তাশক্তি বিপরীত দিকে সঞ্চালিত করিয়া বহু পূর্বজন্মের বা বহু পূর্বদেহের সুষুপ্ত স্নায়ুপুঞ্জ সঞ্জীবিত করিতে পারিয়াছিলেন। তিনি আভ্যন্তরীণ শক্তি উদ্বুদ্ধ করিয়া অতি প্রাচীনতম সুষুপ্ত স্নায়ুপুঞ্জ সঞ্জীবিত করিয়াছিলেন। বাহ্যিক মানুষের মতো দেহ থাকিলেও, আভ্যন্তরীণ স্নায়ুর পরিবর্তন হওয়ায় ক্ষণকালের জন্য তাঁহার দেহ ও প্রবৃত্তি ভিন্নরূপ হইয়া গিয়াছিল। পরমহংস মশাই-এর চিন্তাশক্তি যেমন উচ্চ স্তরে উঠিতে পারিত - যাহার নিকটেও অপরের চিন্তাশক্তি যাইতে পারে না, তেমনি তাঁহার চিন্তাশক্তি বিপরীত দিকে গমন করিয়াও বহু বহু পূর্বকালের স্নায়ুপুঞ্জকে উদ্বোধিত করিতে পারিত। তিনি এক দিকে যেমন সূক্ষ্ম-স্নায়ুপুঞ্জ জাগ্রত করিতে পারিয়াছিলেন, অপরদিকে তেমনি প্রাচীনতম সুষুপ্ত স্নায়ুপুঞ্জ জাগ্রত করিতে পারিয়াছিলেন। এক সীমা হইতে অপর সীমা পর্যন্ত - বহুপ্রকার স্নায়ু তিনি সমভাবে জাগ্রত করিতে পারিয়াছিলেন। এইজন্য নানা বিষয়ে তাঁহার অতীব আশ্চর্য ও অভ্রান্ত ভাব হইয়াছিল। এত উচ্চেও কেহ উঠিতে পারেন নাই কিংবা এত নিম্নেও কেহ নামিতে পারেন নাই। জগতে এইরূপ পুরুষ দেখিতে পাওয়া যায় না। পরমহংস মশাই-এর সাধনকালের এই সকল প্রক্রিয়া উপহাসের বস্তু নয় বা ইহা যে ভক্তজনের লীলারহস্য - তাহাও নয়। পরমহংস মশাই-এর জীবনের এই সকল ব্যাপার ও প্রক্রিয়া দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদিগের বিশেষ গবেষণার বিষয়। এইজন্য, আমি পুনঃপুনঃ বলিতেছি যে, বর্তমান যুগে দর্শনশাস্ত্রের ও বিজ্ঞানশাস্ত্রের তিনি মূর্ত প্রতীক।
1. কলিকাতাস্থ ইটালী-নিবাসী জমিদার, শ্রীযুত উপেন্দ্রনারায়ণ দেব, স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য।↩