শ্রীরামকৃষ্ণের চোখ হইল ক্ষুদ্র যাহাকে বলে - হাতি-চোখ। মুখে বিশেষ ওজস্বী ভাব নাই; বাহু-সঞ্চালন অতি ধীর ও করুণাব্যঞ্জক। সাধারণ অবস্থায় কণ্ঠস্বর মৃদু, একপ্রকার কাতর স্বর বলা যাইতে পারে। দেখিলে বোধ হয়, যেন জগতের সম্পর্ক হইতে বিশ্লিষ্ট হইয়া স্বতন্ত্র থাকিবার - নিরিবিলি ও একাকী থাকিবার তাঁহার ইচ্ছা, জগৎ যেন তাঁহাকে স্পর্শ করিতে না পারে।
বিবেকানন্দের চোখ হইল বিস্ফারিত; দৃষ্টি তীক্ষ্ণ; মুখ - সুডৌল, পুরুষ্ট। মুখে আজ্ঞাপ্রদ ভাব, Defiant attitude - বাধাবিঘ্ন-তুচ্ছকারী ভাব, যেন জগৎকে গ্রাহ্যই করিতেছে না। বাহু-সঞ্চালন ও তর্জনী-নির্দেশ যেন জগৎকে শাসন করিবার বা আজ্ঞা দিবার মতো, যাহাকে বলে নাপোলিঅঁ-র মতো অঙ্গভঙ্গী ও অঙ্গ-সঞ্চালন, আজ্ঞা শুনিয়া যেন সকলে স্তব্ধ হইয়া যাইবে। প্রথম দৃষ্টিতে দুইজনের ভিতর এই পার্থক্য দেখা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের বিশেষ লক্ষণ হইল - বহুবিধ স্নায়ু দিয়া বহু প্রকার চিন্তা করা। শক্তি-বিকাশ করা বা যাহাতে ক্ষাত্রশক্তির আবশ্যক, এইরূপ কার্য তাঁহার নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের হইল গভীর চিন্তা করা মুখ্য, শক্তি-বিকাশ করা গৌণ। এইজন্য প্রথম অবস্থায় সাধারণ লোক তাঁহাকে কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া উন্মাদ ও বাতুল বলিয়া বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা করিত।
বিবেকানন্দের হইল শক্তি-বিকাশ করাই মুখ্য, গভীর চিন্তা করা হইল গৌণ।
এই দুইটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখিয়া উভয়ের জীবনী আলোচনা করিলে, উভয় ব্যক্তির মধ্যে বেশ একটি সামঞ্জস্য দেখা যায়। এ স্থলে বিশেষ করিয়া স্মরণ রাখিতে হইবে যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে অনুকরণ করেন নাই। একজন অপরের অনুকরণ করিয়াছিলেন - ইহা অতীব ভুল মত। উভয়েই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিত্ব অটুট রাখিয়াছিলেন। পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধা-ভালবাসা ছিল; কিন্তু উভয়ের কার্যক্ষেত্র ও বিকাশ-প্রণালী ভিন্ন ছিল। উভয়েই নিজ নিজ ভাবে চিন্তা করিয়াছিলেন। উভয়েই জগৎকে এবং জগতের সম্পর্কিত ও সংশ্লিষ্ট ভাবসমূহ নিজ নিজ চিন্তা অনুযায়ী উপলব্ধি করিয়াছিলেন। উভয়েই নিজ ভাবে জগতের প্রশ্নসকল মীমাংসা করিয়াছিলেন এবং সেইরূপ শক্তি বিকাশ করিয়াছিলেন। এইরূপ তেজঃপূর্ণ, বলিষ্ঠ ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ পুরুষ যাঁহারা, তাঁহারা কেহ কাহাকেও অনুকরণ করিতে পারেন না। নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখাই হইল এইরূপ পুরুষদিগের বৃত্তি।
মনোবিজ্ঞান দিয়া বুঝিতে হইলে দেখা যায় যে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব হইল ব্যক্ত হইতে অব্যক্তে চলিয়া যাওয়া। বিবেকানন্দের ভাব হইল অব্যক্ত হইতে ব্যক্তে চলিয়া আসা। শ্রীরামকৃষ্ণের হইল ঈশ্বর কেন্দ্র, জীব বা মনুষ্য পরিধি। বিবেকানন্দের হইল জীব বা মনুষ্য কেন্দ্র, ঈশ্বর পরিধি।
এখন প্রশ্ন হইতে পারে এই যে, যদি দুইজনের মধ্যে এই সব বিষয়ের পার্থক্য থাকে, তবে উভয়ের ভিতর সামঞ্জস্য কোথায়?
ইহা জানা আবশ্যক যে, শক্তির প্রবাহ যদি কেন্দ্র হইতে খুব গভীর স্তরে যায়, তাহা হইলে উপবৃত্ত - Ellipse হইয়া তাহার বিকাশ হইয়া থাকে। এইরূপ উপবৃত্ত হইয়া শক্তি পুনরায় নিজ কেন্দ্রে বা প্রাথমিক অবস্থাবিন্দু-তে উপনীত হয়। যে শক্তি বহির্মুখী বা বিকাশমুখী হইয়াছিল, তাহা উপবৃত্তের আকারে প্রধাবিত হইয়া পুনরায় নিজ কেন্দ্র বা প্রাথমিক অবস্থাবিন্দু-তে প্রশমিত হয়। ইহা হইল Theory of Motion - গতিবাদ-এর নিয়ম। এই নিয়ম সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা সূক্ষ্ম-শরীর সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। এইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণের ঈশ্বর কেন্দ্র হইলেও, জীবেও ঈশ্বরত্ব আরোপিত হয় বা ঈশ্বর-দর্শন হয় এবং বিবেকানন্দের জীব বা মনুষ্য কেন্দ্র হইলেও, পরিশেষে জীবেও ঈশ্বরত্ব আরোপিত হয় বা ঈশ্বর-দর্শন হয়। দর্শনশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্র - এই দুই শাস্ত্র দিয়া পর্যালোচনা করিলে, শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মনোবৃত্তি ও ক্রিয়াকলাপ বিশেষভাবে বুঝা যাইতে পারে।
শ্রীরামকৃষ্ণের স্নায়ু-প্রক্রিয়া এবং বিবেকানন্দের লন্ডনে বক্তৃতাকালে স্নায়ু-প্রক্রিয়ার বিষয় অনুধাবন করিলে অসংকোচচিত্তে বলা যায় যে, য়ুরোপীয় দর্শনশাস্ত্র ও শারীরবিজ্ঞান, ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের কাছে শিশুপাঠ্য পুস্তকসদৃশ।
দর্শনশাস্ত্রে ও বিজ্ঞানশাস্ত্রে যেসকল জটিল প্রশ্ন আছে এবং স্পন্দনবাদ ও স্নায়ু-প্রক্রিয়া প্রভৃতি যেসকল অতি দুরূহ বিষয় দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিকদিগকে বিভ্রান্ত করিতেছে, পরমহংস মশাই-এর দেহের প্রক্রিয়া, চিন্তাশক্তি ও শক্তিবিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করিলে, সেসকল জটিল বিষয়ের অতি সহজ সমাধান হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের ক্রিয়াকলাপ, স্নায়ুগতি ও স্নায়ুসঞ্চালনের বিষয় চিন্তা করিলে, জগতের দর্শনশাস্ত্র ও বিজ্ঞানশাস্ত্র নূতন প্রকারে লিখিতে হইবে এবং বহু প্রাচীন মত, যাহা য়ুরোপীয়েরা পোষণ করেন, পরিবর্তন করিতে হইবে, কারণ তাহা না হইলে কোনো সামঞ্জস্য থাকে না। আমি এইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণকে সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক - দর্শনশাস্ত্রের ও বিজ্ঞানশাস্ত্রের জীবন্ত প্রতিমূর্তি বলিয়া অভিহিত করি। ভবিষ্যতে জগতে যে দর্শনশাস্ত্র ও বিজ্ঞানশাস্ত্র নূতন প্রণালীতে লিখিত হইবে এই মহাপুরুষই হইলেন তাহার আদর্শ। ধর্মশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র ও বিজ্ঞানশাস্ত্র - এই তিন শাস্ত্রই যে অভিন্ন, এক-ই, শ্রীরামকৃষ্ণ তাহা জগৎকে দেখাইয়াছেন।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ
No comments:
Post a Comment