সাধারণ লোক প্রস্তরনির্মিত কালী-বিগ্রহকে পাষাণময়ী বলিয়া থাকে। ভাস্কর একখণ্ড প্রস্তর লইয়া বাটালি দিয়া খোদিত করিয়া এই মূর্তি নির্মাণ করিয়াছে, এইজন্য ইহা জড় প্রস্তরমূর্তি, আর কিছুই নয় - এ কথা বলিলে কোনোই ভুল হয় না, কারণ, স্থূলস্নায়ুর প্রক্রিয়া হইল এইরূপ। স্থূলস্নায়ুর প্রকম্পনের জন্য আমরা বস্তুকে 'স্থূল', 'জড়', 'সীমাবদ্ধ' প্রভৃতি বহুপ্রকার দেখিয়া থাকি। এইজন্য সাধারণত, আমরা বস্তুনির্ণয়কালে সীমাবদ্ধ কয়েকটি গুণের উল্লেখ করিয়া থাকি। ইহা ভ্রান্ত মনের কার্য নয়! ইহা ঠিক কথা কারণ, স্থূল অবস্থাতে এইরূপ পরিদর্শন হয়। কিন্তু সূক্ষ্ম-স্নায়ু দিয়া বা বিদেহ অবস্থা হইতে জগতকে দেখিলে অন্যবিধ ভাব হইয়া থাকে কারণ, দ্রষ্টা তখন চিন্ময় হইয়া যান এবং জগৎকেও চিন্ময় দেখেন। বৈষ্ণবদিগের একটি বাণী আছে:
"চিন্ময় শ্যাম, চিন্ময় ধাম, চিন্ময় নাম।"
অর্থাৎ অখণ্ড সচ্চিদানন্দ যিনি, তিনি চিন্ময়, জগৎ বা সৃষ্টি চিন্ময় এবং প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তু অর্থাৎ যাহার নাম ও রূপ আছে তাহাও চিন্ময়।
পরমহংস মশাই অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা কারণ-স্নায়ু দিয়া তাঁহার চিৎ-শক্তি প্রধাবিত করিয়াছিলেন, সেইজন্য তিনি একখানি প্রস্তরখণ্ডকে চিন্ময়ী বলিলেন এবং বিড়ালের ভিতরও সেই চিন্ময়ীকে দেখিলেন। তিনি এত উচ্চ অবস্থায় বা সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে গিয়াছিলেন যে, গাছের পাতা ও ঘাসেতেও সেই চিন্ময়ীকে দেখিতেন। পরমহংস মশাই-এর যে মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া গিয়াছিল তাহা নহে। ইহা উপহাস বা উপেক্ষা করিবার বিষয় নহে। ইহা হইল অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের অবস্থা। সংজ্ঞাক্ষেত্রের ঊর্ধ্বতম অবস্থা হইল অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের অবস্থা। আমাদের স্থূল-স্নায়ু দিয়া যে জ্ঞান হয়, তাহা নিতান্ত খণ্ড ও সীমাবদ্ধ। কিন্তু চিৎ-শক্তি যখন সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে প্রধাবিত হয়, তখন দূরত্ব, পরিধি ও কাল - এ সব কোনো প্রতিবন্ধ থাকে না; খণ্ড হইতে অখণ্ড বা পূর্ণতে আসিবার প্রয়াস হয় এবং অন্য প্রকার গুণ উপলব্ধি হয় বা দর্শন হয়। এই অতীন্দ্রিয় জ্ঞান চিত্তবৃত্তিকে অন্যত্র লইয়া যায়। ইহা যে কি অবস্থা, সাধারণ ক্ষেত্র হইতে তাহা উপলব্ধি করা যায় না।
স্বামীজীরও এই অবস্থা বহুবার দেখিয়াছি, ব্রহ্মানন্দেরও এই অবস্থা বিশেষভাবে দেখিয়াছি। সাধারণ লোকের ইহা অনুকরণ করা উচিত নয়। সাধারণ লোক ইহা অনুকরণ করিলে বাতুল বলিয়া পরিগণিত হইবে এবং তাহাকে বায়ুগ্রস্ত বলিয়া চিকিৎসা করা আবশ্যক হইবে। পরমহংস মশাই, স্বামীজী এবং ব্রহ্মানন্দ এই অবস্থায় অন্যান্য বিষয়েও পারম্পর্য ও সংশ্লিষ্ট ভাব রাখিয়াছিলেন, কিন্তু বায়ুগ্রস্ত ও বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তি এইরূপ অবস্থায় সকল বিষয়ে পারম্পর্য বা সংশ্লিষ্ট ভাব রাখিতে পারে না। বায়ুগ্রস্ত ব্যক্তি অপরের অনুকরণ করিতে পারে মাত্র।
No comments:
Post a Comment