Friday, March 30, 2018

ভাব ও স্নায়ুর সম্মিলনে

এক একটি ভাবের জন্য এক একটি স্নায়ু। এক একটি স্নায়ু দিয়া এক একটি ভাব বা চিন্তাস্রোত বা শক্তির বিকাশ হইয়া থাকে। কিন্তু এক একটি স্নায়ু স্পন্দিত হইয়া তাহা হইতে শক্তির বিকাশ হইলেও, প্রকৃতপক্ষে একটি মাত্র স্নায়ু দিয়া ভাব বিকাশ করা অতীব দুরূহ ব্যাপার। ইহা মাত্র সমাধি-অবস্থায় হইতে পারে। সাধারণত, একের অধিক সমজাতীয় ও সমগুণান্বিত স্নায়ুর প্রকম্পমান অবস্থায় যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তাহাকে 'ভাব' বলা হয়। ভাব হইল - চিন্তা, যাহার কোনো প্রয়োগ হয় নাই, চিন্তার জন্যই চিন্তা। 'বাসনা' হইল - সেই চিন্তা যখন অপর বস্তুতে প্রযুক্ত হয়, এবং সেই বস্তুটিকে নিজের সন্নিকটে টানিবার চেষ্টা হয়। এইজন্য ভাব বা Idea এবং বাসনা বা Desire-এর মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি হইল নিরপেক্ষ বা নিষ্ক্রিয়, আর একটি হইল সাপেক্ষ বা সক্রিয়।

স্বামীজী শেষ জীবনে বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। কবিরাজ ঔষধের ব্যবস্থা করেন। তিনি স্বামীজীকে একচল্লিশ দিন জল পান করিতে নিষেধ করেন এবং ইচ্ছামতো দুধ খাইতে বলেন। স্বামীজী এই সময় এক দিন গিরিশবাবুর বাড়িতে গিয়াছিলেন। গিরিশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, "তুমি বহুমূত্র রুগী, একচল্লিশ দিন জল না খেয়ে কি করে থাকবে?" স্বামীজী বলিলেন, "আমি শরীরকে বারণ করে দিয়েছি, সে একচল্লিশ দিন জল খাবে না।" গিরিশবাবু হাসিয়া বলিলেন, "সে আবার কি কথা, 'শরীরকে বারণ করে দিয়েছি'?" স্বামীজী বলিলেন, "এক গ্লাস জল আনো দেখি।" তাহার পর, স্বামীজী সেই গ্লাসের জলের মাপ দেখাইয়া, সমস্ত জল পান করিলেন; গ্লাসে আর কিছুই জল রহিল না। খানিকক্ষণ পর উদ্গার করিয়া পরিষ্কার জল গ্লাসে ঢালিয়া দিলেন; জলের মাপ পর্যন্ত ঠিক হইল, একটুও কম হইল না, গিরিশবাবু অবাক হইয়া রহিলেন। স্বামীজী বলিলেন, "এক ফোঁটা জলও আর দেহে নেবে না।" গিরিশবাবু ভক্ত লোক, তিনি এ বিষয় অনেক কিছু কথা কহিতে লাগিলেন। স্বামীজী হাসিয়া বলিলেন, "দূর শালা জি. সি.1, এই সামান্য একটা দেখেই অবাক হলি - একে বলে Controlment of nerves - স্নায়ু সংযত করা।"

স্বামীজী লন্ডনে রাজযোগের বক্তৃতাকালে স্নায়ু-সংযমন বা Controlment of nerves-এর বিষয়ে বিশেষ করিয়া বলিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, "The greatest display of energy is in controlling the energy", - শক্তিকে সংযত করাই শক্তিমত্তার প্রধান লক্ষণ বা চিহ্ন।

বিভিন্ন স্নায়ুর যে বিভিন্ন প্রক্রিয়া হইয়া থাকে, এ বিষয়ে কতকগুলি উদাহরণ প্রদত্ত হইলে অপ্রাসঙ্গিক হইবে না।

বাঁকুড়া জেলায়, পাত্রসায়ের-এ গিরিবালা নাম্নী একটি স্ত্রীলোক বহু বৎসর পর্যন্ত কোনো দ্রব্য আহার করেন নাই। তিনি সহজ মানুষের ন্যায় কাজ-কর্ম করিতেন। এইরূপ শুনা গিয়াছে যে, অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায়, নিরাশ্রয়া হইয়া তিনি অত্যন্ত বিমনা ও বিষণ্ণা হইয়া পড়িয়াছিলেন। এইরূপ অতিমাত্রায় বিমনা হওয়ায় বা শক্তির প্রয়োগ করায় তাঁহার স্নায়ু পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল। এইজন্য ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতি যে স্নায়ু-প্রক্রিয়াসমূহ, সে সকল বিলুপ্ত বা নষ্ট হইয়া যায়। সাধারণ লোকের যেরূপ ক্ষুধা-তৃষ্ণা হইয়া থাকে, তাঁহার সেরূপ হইত না; অথচ তাঁহার শরীরের কোনো হানি হয় নাই। ইহা হইতে বেশ বুঝা যাইতেছে যে, বিশেষ এক প্রকার স্নায়ুপ্রক্রিয়া হইলে তাহাকে "ক্ষুধা" বলে।

মহাযুদ্ধের সময় হাঙ্গারির এক ব্যক্তির তোপের গোলায় আঘাত লাগে। হাসপাতালে থাকিয়া চিকিৎসা করাইবার পর যখন সে আরোগ্য হইয়া আসিল তখন তাহার 'নিদ্রা' বলিয়া কোনো ক্রিয়াই রহিল না। নিদ্রাও নাই, ক্লান্তিও নাই। এ স্থলে দেখা যাইতেছে যে, 'নিদ্রা' বলিয়া যে স্নায়ু-প্রক্রিয়া, তাহা বিলুপ্ত হওয়ায়, সেরূপ কোনো প্রক্রিয়াই হইতেছে না।

বুদাপেশ্ৎ-এ কোনো এক বৃদ্ধ অধ্যাপকের শরীরে বাঁদরের স্নায়ু সন্নিবেশিত করা হইয়াছিল। ফল এই হইল যে, বৃদ্ধ অধ্যাপক অবশেষে ব্যবহারে বাঁদরের ন্যায় হইয়া যাইলেন। তিনি কাপড় পরিতেন না, গাছের ডালে উবু হইয়া বসিয়া থাকিতেন, মুখের সাহায্যে খাইতেন এবং কাঁচা গাজর ইত্যাদি তাঁহার প্রিয় খাদ্য হইল। তিনি বাঁদরের মতো মুখ ভেংচাইয়া ক্রোধ প্রকাশ করিতেন। মানুষের ন্যায় কথাবার্তা কহা প্রায় তিনি ভুলিয়া যাইলেন। এরূপে স্নায়ু-পরিবর্তন হওয়ায় তাঁহার সমস্ত মনোবৃত্তি পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল।

জীবচ্ছেদ বা Vivisection প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত হইয়াছে যে, আঙুলের বিশেষ এক একটি সূক্ষ্মস্নায়ু তুলিয়া লইলে, শীতলতা, উষ্ণতা প্রভৃতি ইন্দ্রিয়বোধ বা Sensation থাকে না। আঙুল পুড়িয়া যাইলেও, আঙুলে অগ্নির উত্তাপ বোধ হয় না। এইরূপ বহু প্রকার স্নায়ু-প্রক্রিয়ার উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। এই সকল হইতে বেশ বুঝা যাইতেছে যে, এক একটি স্নায়ু বা স্নায়ুপুঞ্জ এক একটি ভাবপ্রবাহের জন্য সৃষ্ট হইয়াছে।

এখন প্রশ্ন হইতে পারে যে, 'ভাব' হইতে 'স্নায়ু' উৎপন্ন হইয়াছে, না 'স্নায়ু' হইতে 'ভাব' উৎপন্ন হইয়াছে? কোন্ বস্তুটি কাহার কারণ বা কাহার কার্য?

এক মত হইল:

"বাসনায় মনের জনম,
মন সৃষ্টি করে এ শরীর।
অনন্ত বাসনা উঠে তায়,
ভাসে মন বাসনা-সাগরে।"2

বৈজ্ঞানিক মত হইল যে, পরমাণুসমূহের বহুবিধ স্পন্দন হয় এবং এই স্পন্দনসমূহ হইতেই পরমাণুসকল এক সূত্রে পারম্পর্যরূপে সন্নিবেশিত হওয়ায় অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহ সৃষ্ট হয়। এই সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহকে রক্ষা করিবার জন্য পর পর অপর স্থূল-স্নায়ুসমূহ নির্মিত হয়; কারণ বাহ্যিক শক্তি সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহকে অচিরে বিনাশ করিতে পারে। ভ্রূণ ও ডিম হইতে কি করিয়া জীব সৃষ্ট হয়, তাহা পর্যবেক্ষণ করিলেই এ বিষয়ে বেশ বুঝা যাইতে পারে। এইজন্য বাহ্যিক শক্তির সহিত দ্বন্দ্ব করিবার উদ্দেশ্যে এবং সূক্ষ্ম-স্নায়ুপুঞ্জকে রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে, স্থূল-স্নায়ুসমূহ বিভিন্ন স্তর অনুযায়ী পরে নির্মিত হয়। সাধারণ ক্রিয়াসকল এই স্থূল-স্নায়ুসমূহ দিয়া হইয়া থাকে। আর এইজন্যই সাধারণ ভাষায় আমরা 'স্থূল-বুদ্ধির লোক', 'সূক্ষ্মবুদ্ধির লোক' প্রভৃতি বলিয়া থাকি।

পশু ও উদ্ভিদ প্রভৃতির ভিতরেও স্নায়ু-প্রক্রিয়া বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। স্নায়ু-বিজ্ঞান অনুযায়ী চিন্তা করিলে, মানুষ, পশু ও উদ্ভিদ প্রভৃতি সকলই একই শ্রেণীর ভিতর আসিয়া পড়ে, কেবল, ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর স্নায়ুর নানা প্রকার উৎকর্ষ দেখা যায় - এইটুকু যা পার্থক্য। জীববিদ্যায় দেখা যায় যে, মানুষ ও পশুদিগের ভিতর অধিকাংশ স্নায়ুতেই একই প্রকার প্রক্রিয়া হইয়া থাকে এবং পশুদিগের স্নায়ু-প্রক্রিয়া ও উদ্ভিদ ইত্যাদির Fibre - সূক্ষ্ম-সূত্র বা স্নায়ু-প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক পরিমাণে সামঞ্জস্য আছে। এইজন্য এই তিন শ্রেণীই এক বিষয়ক বা এক শ্রেণীর অন্তর্গত।

দেহযন্ত্রের বা ইন্দ্রিয়সমূহের বা বিশেষ উদ্দেশ্যে একত্র সমাবিষ্ট স্নায়ুপুঞ্জের প্রক্রিয়া বা সমষ্টি-শক্তি থাকিলেও, ইহা জানা আবশ্যক যে, প্রত্যেক স্নায়ুতে এবং প্রত্যেক পরমাণুতেও সমস্ত দেহের বা সংশ্লিষ্ট স্নায়ুর শক্তি তো সুষুপ্তভাবে আছেই, এমন কি, সমগ্র শক্তি বা পূর্ণ শক্তিও আছে। এ বিষয়ে একটি ঘটনা উল্লেখ করিতেছি।

কথিত আছে যে, একজন সাধু পিঠ হইতে আলো বাহির করিয়া অন্ধকার রাত্রে পরমহংস মশাইকে কালীমন্দিরে ফিরিয়া আসিবার পথ দেখাইয়াছিলেন।

অনুরূপ আর একটি ঘটনার বিষয়ও শুনিয়াছি। বোম্বাই-এ একটি মারাঠী যুবক ছিল। তাহার একটি শক্তি বা সিদ্ধাই ছিল। দুইটি চোখ তুলা দিয়া ঢাকিয়া কাপড় দিয়া ভাল করিয়া বাঁধিয়া দিলেও, কপালের সম্মুখে বই ধরিলে সে তাহা পড়িয়া যাইতে পারিত। উন্মুক্ত চোখে যেমন দ্রুতভাবে পড়িতে পারিত, বদ্ধ অবস্থায় তেমন পারিত না, ধীরে ধীরে পড়িত - এইমাত্র প্রভেদ। জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিত যে, তাহার কপালের মধ্যে একটি শিরা আছে; তাহার ভিতর হইতে সে আলো বাহির করে এবং সেই আলো বইয়ের উপর পড়িলে, সে দেখিতে পায়। অবশ্য বইখানি নিকটে রাখিতে হইত, অর্থাৎ সেই অদৃশ্য-আলোকের পরিধির ভিতর রাখিতে হইত।

এখন প্রশ্ন হইতেছে, কি করিয়া ইহা সম্ভবপর? এ কথা বুঝিতে হইলে, ইন্দ্রিয় কি, ইন্দ্রিয়সমূহের প্রক্রিয়াই বা কি, তাহা জানা আবশ্যক। - Organ is an organised system of nerves, অর্থাৎ, ইন্দ্রিয় হইল - সমজাতীয়, সমগুণান্বিত এবং সংশ্লিষ্ট স্নায়ুপুঞ্জ। এই স্নায়ুপুঞ্জ কোনো বিশিষ্ট উদ্দেশ্যে একত্র সংযোজিত হইলে এবং তাহার ভিতর দিয়া শক্তি প্রধাবিত হইলে, এক এক প্রকার প্রক্রিয়া হইয়া থাকে, যেমন, চোখের স্নায়ুপুঞ্জ দিয়া এক প্রকার প্রক্রিয়া হইয়া থাকে, নাসিকার স্নায়ুপুঞ্জ দিয়া এক প্রকার প্রক্রিয়া হইয়া থাকে - এইরূপ স্নায়ুপুঞ্জের বিভিন্ন প্রকার প্রক্রিয়া দেখা যায়। প্রত্যেক স্নায়ুপুঞ্জের উদ্দেশ্য হইল আভ্যন্তরীণ স্পন্দন উদ্বুদ্ধ করিয়া বহিঃস্থ স্পন্দনকে গ্রহণ করা, অর্থাৎ বহিঃস্থ স্পন্দন যে পরিমাণে হইতেছে, আভ্যন্তরীণ স্পন্দন সেই পরিমাণে প্রবুদ্ধ করিয়া বা সমভাবে স্পন্দিত করিয়া তাহা গ্রহণ করা। ইহাই হইল বাহ্যিক বস্তুর 'জ্ঞান'। কিন্তু স্পন্দনের যদি তারতম্য হয়, তাহা হইলে বস্তু সম্বন্ধে 'জ্ঞান' হয় না।

এখন দেখা যাউক, 'দৃষ্টিশক্তি' কি? - স্নায়ুর ভিতর পরমাণুসমূহের স্পন্দন হওয়ায়, তাহা হইতে জ্যোতি উৎপন্ন হয়। সেই জ্যোতি বহিঃস্থ স্পন্দনপ্রসূত জ্যোতির সহিত সমক্ষেত্রে আসিলে, আমরা বাহ্যিক আলো বা জ্যোতি দেখিতে পাই। কিন্তু, স্নায়ু যদি নিষ্ক্রিয় বা মৃত হইয়া যায় এবং আভ্যন্তরীণ জ্যোতিঃস্পন্দন উৎপন্ন করিতে না পারে, তাহা হইলে বাহ্যিক জ্যোতি বা স্পন্দন অনুভব করা যায় না। চোখ বুজিয়াও আমরা অনেক সময় জ্যোতিবিন্দু দেখিতে পাই এবং নিদ্রিত অবস্থাতেও জ্যোতিবিন্দু দেখিতে পাই। এই সকল হইল অন্তরস্থিত পরমাণুর স্পন্দনপ্রসূত 'জ্যোতি' বা 'আলোক'। য়ুরোপীয় বৈজ্ঞানিক মত হইতে এই মত সম্পূর্ণ পৃথক, সম্পূর্ণ বিপরীত। রাজযোগ ও হঠযোগে এই মত পোষণ করে।

পরমাণুতে ও স্নায়ুতে সুষুপ্তভাবে শক্তি না থাকিলে, সংশ্লিষ্ট অবস্থায় সমষ্টি-শক্তি আসিতে পারে না, কেবল সমষ্টির শক্তি সক্রিয়; স্নায়ু ও পরমাণুর শক্তি সুষুপ্ত - এই প্রভেদ। কিন্তু প্রয়াস বা অভ্যাস করিলে, পরমাণুর ও স্নায়ুর সুষুপ্ত শক্তি জাগ্রত করা যাইতে পারে। য়ুরোপীয় বৈজ্ঞানিক মতে স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুর কথা যাহা বলা হয়, তাহা এ স্থলে প্রযোজ্য হয় না। স্বয়ংক্রিয় স্নায়ু বহুকালব্যাপী অভ্যাস হইতে হইয়াছে, আয়াস না করিলেও উহার প্রক্রিয়া হইয়া থাকে। কিন্তু অভ্যাস বা প্রয়াস যদি বিপরীত দিকে করা হয় তাহা হইলে স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুর প্রক্রিয়াও বন্ধ করা যাইতে পারে।

প্রশ্ন হইতে পারে যে, স্নায়ুসকল এই সমস্ত প্রক্রিয়া পাইল কিরূপে? - আমি কনস্তান্তিনোপ্ল বা পুরানো ইস্তান-বুল-এ গোল্ডেন হর্ন নামক সমুদ্রের খাঁড়িতে বসিয়া একটি কাঠি দিয়া জেলি-ফিশ (Jelly-fish) বিঁধিয়া নানা রূপ পরীক্ষা করিতাম। দেখিতাম যে, জেলি-ফিশ-এর প্রোটোপ্লাজমের প্রত্যেক অঙ্গ দিয়াই সমস্ত কাজ হইতেছে। ইহাকে In-organic বা অ-ইন্দ্রিয় প্রাণী বলা হয় এবং ইহার উৎপাদন-ক্রিয়া আপনা হইতেই হইয়া থাকে। জেলি-ফিশ-এর পিঠের এক অংশ ফুলিয়া উঠিয়া, পরে বিশ্লিষ্ট হইয়া অপর একটি জেলি-ফিশ হয়। এই অবস্থায় সকল প্রক্রিয়াই প্রোটোপ্লাজম দিয়া হইতেছে।

অপর একটি বিষয় হইল - ভ্রূণ বা Foetus অবস্থার কথা। ভ্রূণের প্রথম অবস্থায় সমস্ত প্রক্রিয়া সকল স্থান দিয়া হইতেছে; পরে যখন সংগঠিত অবস্থায় - Organised state-এ আসে, তখন বিশেষ বিশেষ স্নায়ুপুঞ্জ দিয়া বিশেষ বিশেষ প্রক্রিয়া হইয়া থাকে।

আর একটি উদাহরণ হইল, Invertebrate - মেরুদণ্ডবিহীন জীব বা অ-মেরুদণ্ডী। যে সকল প্রাণীর মেরুদণ্ড হয় নাই, সেই সকল প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি বা দৃষ্টি-প্রক্রিয়া সকল স্থান দিয়াই হইয়া থাকে। কেঁচো, জোঁক প্রভৃতির এইরূপ হইয়া থাকে। Vertebrate - মেরুদণ্ডযুক্ত জীব বা মেরুদণ্ডী হইলে প্রক্রিয়া বিভিন্ন প্রকার হইয়া যায়।

ইহা হইতে বেশ বুঝা যায় যে, সকল স্নায়ুতেই সকল প্রকার শক্তি ও প্রক্রিয়া সুষুপ্তভাবে আছে, কেবল সংগঠিত অবস্থায় বিশিষ্ট স্নায়ু দিয়া শক্তি সক্রিয় হয়। এইজন্য বিশেষ বিশেষ স্নায়ুপুঞ্জ বা ইন্দ্রিয় দিয়া বিশেষ বিশেষ প্রক্রিয়া হইয়া থাকে।

এখন কথা হইল যে সাধুটির পৃষ্ঠদেশ হইতে আলো বা জ্যোতি নির্গত করা সম্ভবপর কিনা? এ স্থলে জানা আবশ্যক যে, ভ্রূণ-অবস্থা হইতে পরিবর্ধিত হইয়া দৃষ্টি-স্নায়ুসকল সর্বশেষে মস্তিষ্কে পরিসমাপ্ত হয়। এইজন্য দৃষ্টি-স্নায়ুসকল বা দৃষ্টির ইন্দ্রিয় এত সূক্ষ্ম। মেরুদণ্ডের এক এক স্থানে বিভিন্ন স্নায়ুপুঞ্জের এক একটি কেন্দ্র আছে এবং সেই স্নায়ুকেন্দ্রসকল মস্তিষ্কের নানা স্থানে পরিসমাপ্ত হইয়াছে। এইজন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকেন্দ্রসকল প্রবুদ্ধ ও সক্রিয় এবং মেরুদণ্ডের স্নায়ুকেন্দ্রসকল সুষুপ্ত। কিন্তু চেষ্টা করিলে বা বিপরীত দিকে শক্তি সঞ্চালিত করিলে মেরুদণ্ডের স্নায়ুকেন্দ্রসমূহকে প্রবুদ্ধ করা যাইতে পারে। ইহা সাধারণ ব্যাপার নয় কিন্তু সম্ভবপর। আমি এই সাধুর ব্যাপারটি দেখি নাই, কিন্তু বোম্বাই-এর মারাঠী বালকটির কথা বিশেষরূপে জানি। জীবতত্ত্ব বা স্নায়ুবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী ইহা যে সম্ভবপর, তাহা বলা যাইতে পারে।

দেখা যাইত যে, পরমহংস মশাই-এর যেমন ভাব হইত, স্নায়ুও সেইরূপ পরিবর্তিত হইয়া যাইত। তিনি যেমন মুখে বলিলেন যে, টাকা বা কাঞ্চন ছুঁইবেন না, তেমনই তাঁহার হাত ইত্যাদি বা স্নায়ুপুঞ্জ আর টাকা বা কাঞ্চন ছুঁইতে পারিল না। এমন কি, যে স্নায়ু বা যে ভাবকে তিনি বন্ধ বা নিষ্ক্রিয় হইতে আদেশ করিতেন, সে স্নায়ুর ক্রিয়া আর হইত না বা সেই ভাব আর আসিত না। এইরূপ বহু উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। এ বিষয় যাঁহারা লক্ষ্য করিয়াছিলেন তাঁহারা খুব স্পষ্ট বুঝিতে পারিবেন। সাধারণ লোকের এইরূপ হইতে পারে না। এইরূপ স্নায়ু-সংযমন ও স্নায়ুর একত্র মিলন জগতে এক অতীব আশ্চর্য ব্যাপার।


1. স্বামী বিবেকানন্দ আনন্দিত হইলে শ্রীযুত গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়কে এই নামে ডাকিতেন।

2. "চৈতন্যলীলা", গিরিশচন্দ্র।

No comments:

Post a Comment