Sunday, March 18, 2018

শক্তি-বিকিরণে

পরমহংস মশাই-এর গা হইতে একপ্রকার আভা - Effluvium বা Halo বাহির হইত। ইহা উপস্থিত সকল ব্যক্তি অনুভব করিতেন। অবশ্য, ইহা সব সময় বাহির হইত না। তিনি যখন সাধারণ অবস্থায় থাকিতেন, তখন ইহা অনুভব করিতাম না; কিন্তু তিনি যখন উচ্চ অবস্থায় উঠিতেন বা সমাধিস্থ হইতেন, তখন এই আভা বা শক্তি বাহির হইত এবং আমরা তাহা অনুভব করিতাম।

নিম্ন-শ্রেণীর ভালবাসা হইল দৈহিক বা স্বার্থপূর্ণ। এক দেহ হইতে আর এক দেহে যে শক্তি যাইতেছে, তাহাকে 'ভালবাসা' বলে। দুই বন্ধু একত্র বাস করিলে তাহাদের ভিতর একটা ভালবাসা হয়। কখনো বা দেখা যায় যে, দুইজন ব্যবসা করিবে - সেইজন্য পরস্পরে বেশ ঘনিষ্ঠতা হইয়াছে, কিন্তু কয়েক দিন পর সেই ভালবাসা বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইয়া বিদ্বেষে পরিণত হয়। ইহা হইল দৈহিক বা স্বার্থপূর্ণ ভালবাসা। স্বার্থপূর্ণ ভালবাসার গতি হইল Straight line-এ - সরল রেখায়। ইহাতে অল্পকাল পরেই প্রতিক্রিয়া আসিয়া থাকে কারণ, গতিবাদ-এর নিয়ম অনুযায়ী সরল রেখা বহুকাল যাবৎ ঋজু পথে চলিতে পারে না, অল্পকাল পরে অনৃজু পথে চলিয়া থাকে। সরল রেখা হইল বক্র রেখার ন্যূনতম অংশ।

উচ্চ-অঙ্গের ভালবাসা অন্য প্রকার। নিজের মন হইতে ইষ্ট-তে এক শক্তির গতি হয়, এবং ইষ্ট হইতে অপর ব্যক্তির প্রতি সেই শক্তি প্রধাবিত ও পরিব্যাপ্ত হয়। আমি ইষ্টকে ভালবাসি ও ভক্তি করি এবং ইষ্ট অপর ব্যক্তিকে ভালবাসেন; এইজন্য আমিও সেই অপর ব্যক্তিকে ভালবাসি। ইহাকে দার্শনিক ভাষায় 'ভালবাসার ত্রিকোণ-মূর্তি' - Triangle of Love বলা হয়। ইহার গতি ঠিক একটি Parabola - অধিবৃত্ত বা বিস্ফারিত বর্তুলের ন্যায় হইয়া থাকে। অহং, ব্রহ্ম ও জীব - এই হইল তিনটি কোণ। আমি বল্লভকে ভালবাসি, বল্লভ অপরকে ভালবাসেন; এইজন্য বল্লভের জন বলিয়া আমি অপরকে ভালবাসি। আমি অপর ব্যক্তিকে ভালবাসিতেছি না, আমি জগৎকে ভালবাসিতেছি না; কিন্তু বল্লভের জন, বল্লভের জগৎ - এইজন্য সেই লোক ও জগৎকে ভালবাসিতেছি।

ভক্তির ভাব দিয়া বিবেচনা করিলে বলিতে হইবে যে পরমহংস মশাই-এর আত্মগোষ্ঠীর ভিতর যে পরস্পরের প্রতি অত ভালবাসা, তাহা বল্লভের জন্যই হইত কারণ প্রত্যেকেই ছিল বল্লভের আশ্রিত।

দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক মত দিয়া আলোচনা করিলে আমরা দেখিতে পাই যে, গা হইতে যে শক্তি নির্গত হয়, তাহা বহু স্তরের হইয়া থাকে। ত্বকের উপরিভাগে একপ্রকার শক্তি আছে, তাহাকে Enveloping energy - 'আবরণী শক্তি' বলে। ত্বকের সংশ্লিষ্ট যে শক্তি, তাহাকে Peripheral energy - 'ত্বক-শক্তি' বলে। ইহার অভ্যন্তরে হইল Preservative energy - 'সংরক্ষণী শক্তি'। ইহারও অভ্যন্তরে আরো অনেক প্রকার সূক্ষ্ম শক্তি আছে। আবরণী-শক্তি সাধারণ লোকের চর্মের উপর আড়াই ইঞ্চি হইতে তিন ইঞ্চি পর্যন্ত ব্যাপ্ত থাকে। এক ব্যক্তির খুব নিকটে অপর কোনো ব্যক্তি বসিলে, সে একটু বিরক্ত হইয়া উঠে, বলে - "গা ঘেসে বসলে কেন।" অনুমান করা যাইতে পারে যে, উভয়ের চর্ম-পরিধির মধ্যে অন্তত ছয় ইঞ্চি ব্যবধান থাকে, কিন্তু উভয়ের এই আবরণী-শক্তির সংঘর্ষণ ও সংযোগ হওয়ায় এইরূপ বিরক্তির ভাব আসিয়া থাকে। কদাচারী ও কুচিন্তাপূর্ণ ব্যক্তিদিগের আবরণী-শক্তির বর্ণ মলিন বা কালো হইয়া থাকে - চলিত কথায় যেমন বলে, "তোমার মুখের ওপর একটা কালো ছায়া পড়েছে।" সাধারণ অবস্থায়, এই আবরণী-শক্তির বর্ণ ধূসর বা কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল হইয়া থাকে। এইজন্য অনেক সময় লোকের মুখ, চন্দ্রের সহিত তুলনা করা হয়, যেন মুখ হইতে একটা দীপ্তি বাহির হইতেছে।

এ সকলই হইল বাহ্যিক বিকাশ বা স্থূল-স্নায়ুর প্রক্রিয়া; কিন্তু মন বা শক্তি যখন স্থূল-স্নায়ু হইতে সূক্ষ্ম-স্নায়ু, কারণ-স্নায়ু বা মহাকারণ-স্নায়ুতে অন্তর্মুখী হইয়া প্রধাবিত হয়, তখন এই শক্তি অপর এক রূপ ধারণ করে।

স্পন্দনবাদের নিয়ম হইল, স্পন্দন যখন অতি স্থূলভাবে হয়, তখন তাহার পরিধি অল্পপরিসরযুক্ত হয়; আর স্পন্দন যখন অতি সূক্ষ্মভাবে হয়, তখন তাহার গতি ও পরিধি বহুদূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয় - Grosser the vibration shorter the range, finer the vibration longer the range. মন বা শক্তি সাধারণ অবস্থায় স্থূল-স্নায়ুতে থাকে। কিন্তু, মন যখন অন্তর্মুখী হইয়া সূক্ষ্ম-স্নায়ু দিয়া প্রধাবিত হয়, তখন তাহার বাহিরের প্রক্রিয়াও সেইরূপ পরিব্যাপ্ত হইয়া থাকে; কারণ সাধারণত, শক্তির গতি হইল বহির্মুখী বা বিকাশমুখী। মনকে যে পরিমাণে অন্তর্মুখী করা যাইবে, বিকাশকালে সেই পরিমাণে বহির্মুখী হইবে। ইহাকে সূক্ষ্ম-স্পন্দন, সূক্ষ্ম-দেহ, বা কারণ-দেহ বলা হয়। সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা কারণ-স্নায়ু হইতে, বা সূক্ষ্ম-শরীর বা কারণ-শরীর হইতে শক্তি উৎপাদন করিয়া বিস্তার করিলে সকলেই তন্ময় ও পরিপূর্ণ হইয়া যায়।

স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে কাঠের মঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া বুকে হাত দিয়া প্রথমে খানিকক্ষণ স্থির হইয়া থাকিতেন, তাহার পর, একটু পদচারণ করিয়া দৃঢ়পদে এক জায়গায় দণ্ডায়মান হইতেন। সেই সময় তাঁহার মুখের ও চোখের সমস্ত স্নায়ু পরিবর্তিত হইয়া যাইত এবং তিনি যেন অন্য এক ব্যক্তি হইয়া যাইতেন। ধীরে ধীরে তাঁহার কণ্ঠ হইতে শব্দ নির্গত হইত। কণ্ঠস্বরের এই একটি বিশেষত্ব ছিল যে, বহু দূরের ব্যক্তিও নিকটের ব্যক্তির মতো সমানভাবে তাহা শুনিতে পাইত। এই কণ্ঠস্বর 'সাম্যস্পন্দন' হইতে উদ্ভূত। স্বামীজী কখনো কখনো বলিতেন, "আমি নিজের শরীর থেকে একটি শক্তি উৎপন্ন করে সেটি শ্রোতাদের উপর বিস্তার করি। শ্রোতারা আমার অঙ্গবিশেষ হয়ে যায়। আমি মনঃশক্তি শ্রোতাদের মধ্যে সঞ্চারিত করি। শ্রোতাদের মন আমার মন বা শক্তির সঙ্গে সংমিশ্রণ করি।" তিনি কৌতুকচ্ছলে ইহাও বলিতেন, "সকলের মনগুলো আমার মনের সঙ্গে এক রঙে রাঙিয়ে নি।" যাহা হউক, এইরূপ অবস্থায় তিনি যাহা বলিতেন, সকলেই তাহা গ্রহণ করিত; দুই মন বা দুই চিন্তা থাকিত না।

পরমহংস মশাই-এর এই শক্তি অতি অদ্ভুত পরিমাণে ছিল। সাধারণ অবস্থায় তাঁহাকে অতি সামান্য লোকের মতো দেখা যাইত, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে তিনি এত উপরে উঠিয়া যাইতেন যে, তাঁহার Altitude - উচ্চতা, কিছুই বুঝিতে পারিতাম না, স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া থাকিতাম মাত্র। তিনি শব্দ, চিন্তা, দ্বন্দ্বভাব, Relative idea বা সাপেক্ষ ভাব প্রভৃতির কত উচ্চে যে উঠিতেন এবং কত সূক্ষ্ম স্নায়ু দিয়া যে শক্তি বিকাশ করিতে পারিতেন, তাহা কিছু বলা যায় না।

সর্ব দেশের ভাষাতেই এইরূপ শব্দ পাওয়া যায়, ভাল লোক, সৎ লোক, সাধু লোক, মহাপুরুষ লোক, মহাত্মা লোক ও অবতার লোক প্রভৃতি। এই যে গুণবিভাগ, ইহার মাপকাঠি কি? ভাষাতেই বা এরূপ শব্দসকল আসিল কেন? - ইহার কারণ নির্ণয় করিতে হইলে বলিতে হইবে যে, বিভিন্ন প্রকার স্নায়ুর বিভিন্ন প্রকার প্রকম্পনের জন্য এক ব্যক্তি হইতে অপর ব্যক্তির এইরূপ প্রভেদ হইয়া থাকে। দেখা যায় যে, স্থূল-স্নায়ু হইতে যে স্পন্দন বা শক্তি বহির্গত হয়, তাহা অতি নিম্ন স্তরের প্রক্রিয়া এবং স্থূল, অল্পপরিসরযুক্ত ও অল্পকালস্থায়ী বা দেশ, কাল ও নিমিত্তের অধীন। কিন্তু স্থূল-স্নায়ু অতিক্রম করিয়া মনোবৃত্তি যেরূপ সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে প্রধাবিত হইবে, তাহার বহির্বিকাশের পরিধিও সেইরূপ হইবে।

স্বামীজী একবার বলিয়াছিলেন, "I conquered America before I visited the country" - আমি আমেরিকা দর্শন করিবার পূর্বেই আমেরিকাকে জয় করিয়াছিলাম। অর্থাৎ, তিনি সূক্ষ্ম-শক্তি বা মহাকারণ-শক্তি বা মহাকারণ-দেহ বিস্তার করিয়া সমস্ত আমেরিকা দেশটিকে আবরণ করিয়াছিলেন, পরে স্থূল-শরীরে তথায় উপস্থিত হইয়াছিলেন মাত্র।

পরমহংস মশাই-এর এই কারণ-শরীর বা মহাকারণ-শরীর যে কত বিস্তৃতি লাভ করিবে তাহা এখন বুঝিতে পারা যাইতেছে না। তাঁহার শরীর হইতে কি যে একটি আভা বা শক্তি বাহির হইত, তাহা আমরা বেশ অনুভব করিতাম ও তাহাতে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িতাম। কিন্তু সেই সূক্ষ্ম-স্পন্দন, কারণ-শরীর বা মহাকারণ-শরীর ভবিষ্যতে যে বিস্তৃতি লাভ করিবে, তাহা তখন কিছু বুঝিতে পারি নাই।

No comments:

Post a Comment