Sunday, March 18, 2018

হাসি তামাশায়

পরমহংস মশাই বড় হাসি-তামাশার লোক ছিলেন। অতি অদ্ভুত তাঁহার হাসি-তামাশা করিবার ক্ষমতা ছিল। অতি নূতন রকমের তামাশা করিতে ও অতি নূতন রকমের উদাহরণ দিতে তিনি পারিতেন। কোনো রকম একঘেয়ে ভাব, গোঁড়ামি, সংকীর্ণভাব বা গুরুগিরির ভাব তিনি একেবারেই পছন্দ করিতেন না; এ সকল অতিশয় ঘৃণা করিতেন। কেহ যদি গোঁড়ামি করিত বা সংকীর্ণভাবে কথা বলিত, তাহা হইলে তিনি নিজের পাড়াগেঁয়ে ভাষায় একটি উপাখ্যান তুলিয়া উত্তর দিতেন। অনেক সময় উত্তর দেওয়ার ভাষা কলিকাতার সমাজের রুচিবিগর্হিত হইত বটে, কিন্তু উত্তরের উদ্দেশ্য হইত অতি সুন্দর এবং তাৎপর্যও হইত অতীব নিগূঢ়; সাধারণ লোকে উহার মর্ম বুঝিতে না পারিয়া তাঁহাকে বিদ্রূপ করিয়া শক্তির অপব্যয় করিবে এবং কি উদ্দেশ্যে পরমহংস মশাই এরূপ কড়াভাবের হাসি-তামাশা করিতেন, তাহা বুঝিতে না পারিয়া উহার কদর্থ করিবে এইজন্য ইচ্ছাপূর্বক এ সম্বন্ধে সে সকল কথা পরিত্যাগ করিলাম।

এই হাসি-তামাশা তাঁহার এক বিশেষ অস্ত্রস্বরূপ ছিল। ব্যঙ্গচ্ছলে এমন একটি উপস্থিত উদাহরণ তিনি দিতেন যে, শ্রোতারা একেবারে আশ্চর্য ও মুগ্ধ হইয়া যাইত। এইরূপ অদ্ভুত কৌতুকের ক্ষমতা থাকায়, কলিকাতার শিক্ষিত যুবকেরা তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল। কারণ সাধারণ লোকের বিশ্বাস যে ধর্ম-কর্ম হইল কতকগুলি শুষ্ক ও গম্ভীর নিয়ম পালন করা মাত্র - ধর্ম-কর্মে হাসি-তামাশা বা চাপল্যভাবের কোনো রেখা পর্যন্ত থাকিবে না।

পরমহংস মশাই এক দিন যুবকবৃন্দকে লইয়া খুব হাসি-তামাশা করিতেছিলেন। যুবকদিগের মধ্যে কাহারো নূতন বিবাহ হইয়াছে, কাহারো বা বিবাহের কথা চলিতেছে। তিনি সে সকল বিষয় লইয়া একেবারেই যুবকদিগের মতো হাসি-তামাশা করিতে লাগিলেন। শ্রদ্ধেয় বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মশাই সেই সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি পরমহংস মশাইকে বলিলেন, "ছেলেরা দূর থেকে দক্ষিণেশ্বরে এসেছে, ওদের দুটো ভাল কথা বলুন, শুধু হাসি-তামাশাই করছেন!" পরমহংস মশাই অমনি উত্তর কহিলেন, "তোমাদের ব্রাহ্মসমাজের ওই একটা দোষ, ছেলেবেলা থেকেই হবিষ্যি খাওয়ার ধাত!" কথাগুলির ভাবটা এই যে তোমরা মনের ও জগতের এক দিক মাত্র দেখাইতেছ কিন্তু অপর দিকও যে একটি আছে তাহার কোনো উল্লেখই করিতেছ না। এইজন্য তোমাদের ভিতর তেমন শক্তি আসিবে না। উহাতে মনের প্রকৃতি বৃদ্ধি হয় না, মন সজীব হয় না। এক দিকে যেমন ভাল ভাব দেখাইতে হয়, অপর দিকে তেমনি বিপরীত ভাবও দেখাইতে হয় - এই হইল প্রকৃত সাধনমার্গ।

স্বামীজীর ভিতরও হাসি-কৌতুকের ক্ষমতা অদ্ভুতরূপে ছিল। ইহা তাঁহার স্বভাবজাত ও বংশগত। Pointed repartee - চটপট সুতীক্ষ্ণ ও সরস উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা স্বামীজীর ভিতর বিশেষভাবে ছিল, এইজন্য তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী অল্পতেই বিধ্বস্ত হইয়া পড়িত। মনোবিজ্ঞানের পর্যায়-ক্রমোন্নতির ইহা একটি বিশেষ নিদর্শন।

প্রবাদ আছে যে, শ্রীচৈতন্যদেব খুব হাসি-কৌতুকপ্রিয় ছিলেন। আর ইহাই সম্ভব; কারণ তীক্ষ্ণ, মেধাবী ও নৈয়ায়িক মনের অপর দিক - অর্থাৎ, ব্যঙ্গ-কৌতুকের দিকটিও পরিবর্ধিত হইবেই। যেমন এক দিকে তর্ক-যুক্তির ক্ষমতা থাকিবে, অপর দিকে তেমনি ব্যঙ্গ-কৌতুকের ক্ষমতা থাকিবে। গোমড়ামুখো বোদা লোকের কোনো দিকটাই খোলে না। কিন্তু গ্রন্থে শ্রীচৈতন্যদেবের এই সকল হাসি-তামাশার বিষয় বিশেষ কিছুই লিপিবদ্ধ করা হয় নাই, শুধু তাঁহার এক দিকটাই বেশী দেখানো হইয়াছে। রাঢ়দেশের অর্থাৎ গঙ্গাতীরবাসী লোকদিগের ভিতর যে এত হাসি-তামাশা দেখা যায় তাহা সম্ভবতঃ শ্রীচৈতন্যদেবের আদর্শতেই হইয়াছে।

বৌদ্ধ গ্রন্থে মাত্র সামান্যভাবে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধদেবও নাকি হাসি-কৌতুক করিতেন। ইহা খুবই সম্ভব; কারণ, তীক্ষ্ণ মেধাবী ব্যক্তির হাসি-কৌতুকের ক্ষমতা মনোবৃত্তির একটি বিশেষ অঙ্গস্বরূপ। Witticism is the sign of intelligence - রঙ্গরস করা তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচায়ক। বৌদ্ধ গ্রন্থেও কিন্তু বুদ্ধদেব যে কিরূপভাবে হাসি-কৌতুক করিতেন, তাহার কোনো উল্লেখ নাই। কেবল ইহাই বিশেষভাবে দেখানো হইয়াছে যে, বুদ্ধদেব একজন স্থির, ধীর ও গম্ভীর প্রকৃতির লোক, হাসি-তামাশার ধার দিয়াও তিনি যান না। কিন্তু মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়া দেখিতে গেলে, ইহা কখনো হয় নাই, সম্ভবও নয়।

No comments:

Post a Comment