Thursday, June 21, 2018

দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস

দক্ষিণেশ্বরে যে, 'পরমহংস' নামে একজন লোক আছেন, তিনি যে খুব উচ্চ অবস্থার লোক, অতি সাধু ও অমায়িক - যাহাকে বলে, 'বালক-স্বভাব', এই প্রকৃতির লোক - এ কথা কেশববাবুর বক্তৃতা হইতে লোকে জানিতে পারিল। কেশববাবু বলিলেন যে, এই পরমহংসের 'ট্রান্স' (Trance) হয়; যীশুরও এইরূপ ট্রান্স হইত। ট্রান্স কি এক নূতন শব্দ আমরা তাহার কিছু মানে জানিতাম না। সাধারণ লোকের ধারণা হইল যে দক্ষিণেশ্বরে পরমহংস নামে কে-একজন লোক থাকে, তাহার মিরগি হয়, কিন্তু হাত-পা খেঁচাখেঁচি করে না, আপনা-আপনি ভাল হয়, ডাক্তার দেখাইতে হয় না। সাধারণ লোকে ট্রান্স বলিতে এইরূপ বুঝিত। আবার শুনা গেল যে, সে লোকটি রাসমণিদের1 পূজারী; কালীপূজা করিয়া থাকে। লোকটার নাম আবার 'পরমহংস', - এ আবার কি কথা! লোকেরা অমনি হাসি ও ব্যঙ্গচ্ছলে পরমহংস-কে 'গ্রেট গূস' (Great goose) বলিতে লাগিল।

পরমহংস মশাই-এর প্রতি তখনকার লোকের প্রথমে এইরূপ কিঞ্চিৎ অবজ্ঞা বা অশ্রদ্ধার ভাব ছিল। আমরা তখন তাঁহাকে দেখি নাই, আর দেখিতে যাইবার ইচ্ছাও ছিল না। - কোথায়, কে একজন লোক আছে, তার মিরগি ব্যামো হয়, কি আর দেখবো! কেশববাবু বলিয়াছেন, লোকটি ভাল, এইজন্য তাহার বিষয় কিঞ্চিৎ জানিতে আগ্রহ ছিল মাত্র। দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের বিষয় এর বেশী কিছু আমাদের জানা ছিল না, এবং অন্য লোকেরাও জানিত না।

বোধ হয়, ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে রামদাদার বাড়িতে কলেরা হয়। তাহাতে, রামদাদার প্রথম মেয়েটি এবং দুইটি ভগিনী, সাত দিনের ভিতর মারা যায়। রামদাদা সেই সময় বড়ই অধীর হইয়া পড়িয়াছিলেন, এবং কোনো জায়গায় শান্তি পাইলেন না। অবশেষে, তিনি দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের নিকট যাইলেন। কেশববাবুর নিকট হইতে শুনিয়া পূর্বে তিনি দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের কাছে যাতায়াত করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু শ্রদ্ধা, ভক্তি করিয়া তাঁহার নিকট যাওয়া, এবং তাঁহার সহিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসা, এই হইল প্রথম। পরমহংস মশাই-এর সহিত রামদাদার কি কথাবার্তা হইয়াছিল, সে সব বিষয় আমার কিছু জানা নাই। তবে রামদাদা, পরমহংস মশাই-এর কাছে যাইয়া, অনেকটা শান্তি পাইলেন এবং স্থির-ধীর হইয়া কার্য করিতে লাগিলেন। মোট কথা, এই হইল আমাদের শিমলার লোকের পরমহংস মশাই-এর সহিত প্রথম ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ।

রামদাদা ডাক্তারি করিতেন। এইজন্য, তাঁহাকে লোকে 'রামডাক্তার' বলিয়া ডাকিত। রামদাদা কিছু দিন দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিবার পর, শিমলায় খবর রটিল যে রামডাক্তারের এক গুরু হইয়াছে, সে কৈবর্তদিগের পূজারী, দক্ষিণেশ্বরে থাকে। ইহাতে নানাপ্রকার কথাবার্তা উঠিল, কারণ, রামদাদারা হইলেন বৈষ্ণববংশীয়। রামদাদার পিতামহ, কুঞ্জবিহারী দত্ত গোঁসাই ছিলেন, এবং তাঁহার বহু শিষ্য ছিল। রামদাদা নিজের কুলগুরুর কাছে দীক্ষা না লইয়া, এক অজানা ব্যক্তির কাছে দীক্ষা লইয়াছেন, সে ব্যক্তি আবার কালীর উপাসক, শাক্ত! এইজন্য, অনেকেই তাঁহার উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। যাহা হউক, রামদাদা নিজের কুলগুরুর নিকট মন্ত্র না লইয়া পরমহংস মশাইকে গুরু বলিয়া স্বীকার করিলেন।

রামদাদা দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করায়, প্রথমে কিছু দিন সকলেই তাঁহাকে বিদ্রূপ করিতে লাগিল: এ আবার কি ঢঙ হ'ল, পরমহংসই বা কি? রামদাদা কিন্তু রবিবারে অবসর পাইলেই দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতে লাগিলেন। তিনি তাঁহার সমবয়সী বন্ধু ও পাড়ার লোক, সুরেশ মিত্তিরকে2 এই সকল কথা বলেন।

সুরেশ মিত্তির সওদাগরী অফিসের একজন বড় কর্মচারী ছিলেন। সুরেশ মিত্তিরদের বাড়ি আমাদের তিন নম্বর গৌরমোহন মুখার্জী ষ্ট্রীটের বাড়ি-সংলগ্ন ছিল। আমাদের বাড়ির পিছনে পুকুরের পাড় দিয়া তাঁহাদের বাড়ির ভিতর যাতায়াত করা যাইত তবে, তাঁহাদের বাড়ির সদর দরজা ভিন্ন রাস্তায় ছিল। এখন সে বাড়ি ভাঙিয়া রাস্তা হইয়াছে। সুরেশ মিত্তির শাক্ত ছিলেন, প্রথম অবস্থায় তিনি অতি দুর্ধর্ষ লোক ছিলেন। কেশববাবু যখন বিডন গার্ডেন-এ বক্তৃতা দিয়াছিলেন ও খোল বাজাইয়া নামকীর্তন করিয়াছিলেন, তখন সুরেশ মিত্তির ছুরি দিয়া খোলের চামড়া কাটিয়া দিয়াছিলেন।

রামদাদা সুরেশ মিত্তিরকে পরমহংস মশাই-এর কথা বলিলে, তিনি উপহাস করিয়া বলিলেন, "ওহে রাম, তোমার গুরু, পরমহংস যদি আমার কথার উত্তর দিতে পারে, তবে ভাল, নইলে তার কান মলে দিয়ে আসবো।" সুরেশ মিত্তির কান মলিয়া দিবেন, এই শর্তে দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছিলেন; কিন্তু পরমহংস মশাই-এর সহিত খানিকক্ষণ কথাবার্তা কহিবার পর তাঁহার প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, এবং তাহার পর হইতে তিনি পরমহংস মশাই-এর অন্তরঙ্গ হইয়াছিলেন।

কৈলাস ডাক্তারও3 আমাকে এক বার বলিয়াছিলেন যে, রামদাদা যখন তাঁহাকে এক বার কাশীপুরের বাগানে যাইয়া পরমহংস মশাইকে দেখিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন, তখন তিনি বলিয়াছিলেন, "রাম তোমার পরমহংস যদি ভাল লোক হয় তো ভাল, নইলে তার কান মলে দেবো।" এই কড়ারে, কৈলাসডাক্তার, রামদাদার সহিত কাশীপুরের বাগানে গিয়া, নীচে পুকুরের ধারে চাতালে বসিয়া থাকেন। তিনি বলিয়াছিলেন, "আরে প্রথমে গিয়ে দেখলুম যে নরেনটা বি.এ. পাশ করে একেবারে বখে গেছে, নীচেকার হলঘরে কতকগুলো ছোঁড়া নিয়ে এলোমেলো ভাবে বসে আছে, আর, রামের বাড়ির সেই চাকর ছোঁড়া লাটু4, সেটাও কাছে বসে আছে, আরে ছ্যা!" - তিনি বলিতে লাগিলেন, "পরমহংস মশাই-এর শরীর অসুস্থ ছিল, সেইজন্য লোক মারফৎ বলে পাঠালেন, যে, যে বাবুটি আমার কান মলে দেবেন বলেছেন, তাঁকে ওপরে নিয়ে এস। যে লোকটি ডাকতে এসেছিল, সে তো অবাক্ হয়ে খুঁজতে লাগলো, আর, কিছু ইতস্ততঃ করে ঐ কথাগুলি বলতে লাগলো।"

এই শুনিয়া, অপ্রতিভ হইয়া, কৈলাস ডাক্তার অবশেষে সসম্ভ্রমে উপরে যাইবার উদ্যোগ করিলেন এবং ভাবিতে লাগিলেন, "শিমলাতে ঘরের ভেতর বসে রামের সঙ্গে পরমহংসের বিষয় যে কথা হয়েছিল, কাশীপুরের বাগানে সে সংবাদ এখনি কি করে এল!" তিনি আশ্চর্যান্বিত হইয়া উপরে যাইয়া পরমহংস মশাই-এর পায়ের কাছে প্রণাম করিলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, অজান্তে কি ভুল কাজই না করিয়াছিলেন। সেই অবধি কৈলাস ডাক্তার পরমহংস মশাইকে গুরু বলিয়া মানিতেন এবং তাঁহার প্রতিকৃতি প্রণাম না করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইতেন না।

নরেন্দ্রনাথ ছিল শিমলার এক দুষ্টু ছেলে। বয়স অল্প হইলেও, সে খুব ধীশক্তিসম্পন্ন ছিল। সাধারণ-সমাজ, কেশববাবুর সমাজ, প্রভৃতি অনেক জায়গায় সে যাতায়াত করিত। পাড়ায় তাহার একটা বেশ নাম ছিল। সে ছিল পাড়ার ছেলেদের চাঁই বা সর্দার। পাড়ার সব ছেলে তার অনুগত ছিল। নরেন্দ্রনাথের পাড়ার ডাক-নাম ছিল 'বিলে'। কাশীর ৺বীরেশ্বরের পূজা করিয়া তাহার জন্ম হওয়ায়, তাহার নাম রাখা হইয়াছিল 'বীরেশ্বর' - ক্রমে, সংক্ষেপে তাহা 'বিলে' হইয়া যাইল। রামদাদা এক দিন বলিলেন, "বিলে, তুই তো এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াস, দক্ষিণেশ্বরে এক পরমহংস আছেন, দেখতে যাবি? চল্।" নরেন্দ্রনাথ অমনি বলিল, "সেটা তো মুক্খু, কী সে পেয়েছে, যে তার কাছে তা শুনতে যাব? আমি স্পেনসার, মিল, হ্যামিলটন, জন লক, প্রভৃতির এত দর্শনশাস্ত্র পড়লুম আমি কিছু বুঝি না, আর, একটা আকাট মুক্খু, কালীর পূজারী, কৈবর্তদের বামুন - সেইটার কাছে শিখতে যাব? সেটা জানে কি? কী জেনেছে, যে আমাকে শেখাতে পারে?" রামদাদা তথাপি নরেন্দ্রনাথকে পরমহংস মশাই-এর কাছে যাইবার জন্য অনেক অনুনয় করিয়া বলিতে লাগিলেন। অবশেষে নরেন্দ্রনাথ বলিল, "যদি সে রসগোল্লা খাওয়াতে পারে তো ভাল, নইলে কান মলে দেবো, আকাট মুক্খুটাকে সিধে করে দেবো।" - তখনকার দিনে 'কান মলে দেবো' বলাটাই যেন অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়া কথা বলিবার ধারা ছিল।

নরেন্দ্রনাথ পরে এক দিন দক্ষিণেশ্বরে পরমহংস মশাই-এর কাছে গিয়াছিল। নরেন্দ্রনাথকে দেখিয়া পরমহংস মশাই জোড়হাত করিয়া অনেক স্তবস্তুতি করিয়াছিলেন। আর এক দিন নাকি, পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথকে স্পর্শ করিতেই সে অর্ধজ্ঞানশূন্য হইয়া যাইয়া বলিয়াছিল, "তুমি আমায় কি করলে, আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমার যে বাপ-মা আছে! আমি যে উকিল হবো!" - ইহা আমার শুনা-কথা, আমি সে সময়ে উপস্থিত ছিলাম না, এইজন্য ঠিকভাবে বলিতে পারিতেছি না। আমি এ বিষয়ে স্বামী সারদানন্দের কাছে শুনিয়াছিলাম; রামদাদার কাছেও কিছু কিছু শুনিয়াছিলাম।

পূর্বে, মাত্র রামদাদা দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতেন, কিন্তু এখন পাড়ার সুরেশ মিত্তির ও নরেন্দ্রনাথও দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতে লাগিলেন। রামদাদা এখন একটু জোর পাইলেন যে, পাড়ার কেহ আর বিদ্রূপ ও আপত্তি করিবে না। শিমলার সুরেশ মিত্তির ও নরেন্দ্রনাথ পরমহংস মশাই-এর অনুরক্ত হইলে, শিমলার লোকের মনের ভাব অনেক বদলাইল; কারণ, এই দুই ব্যক্তিই ছিলেন শিমলার যুবকদের সর্দার। এইজন্য, রামদাদা এই ভাবিয়া মহা আনন্দিত হইলেন যে, তাঁহার কার্য সফল হইয়াছে।


1. রাণী রাসমণি।

2. শ্রীযুত সুরেন্দ্রনাথ মিত্র ইঁহার নাম, পাড়ার লোকে 'সুরেশ মিত্তির' বলিয়া ডাকিতেন। শুনা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণদেবও ইঁহাকে আদর করিয়া 'সুরেশ' বলিয়া ডাকিতেন।

3. ডাক্তার স্যার কৈলাসচন্দ্র বসু।

4. শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র দত্তের যুবক-ভৃত্য; উত্তরকালে স্বামী অদ্ভুতানন্দ।

No comments:

Post a Comment