Tuesday, June 5, 2018

কী সাজাবি আমায়

পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে আসিলে সুরেশ মিত্তির আনন্দে বিভোর হইয়া অনবরত পায়চারি করিতেন এবং সকল লোকের তত্ত্বাবধান করিতেন। তিনি ভাবে এত মাতোয়ারা হইয়া পড়িতেন যে, কখনো ঘরটির ভিতর বসিতে পারিতেন না।

গরমিকালে, এক দিন সুরেশ মিত্তির ফরমাশ দিয়া একটি অতি সুন্দর বেলফুলের গ'ড়ে মালা আনাইয়াছিলেন। মালাটি বেশ বড়; এত বড় যে, গলায় দিয়া দাঁড়াইলে মালাটি জাজিমের উপর পড়িয়া আরো খানিকটা বেশী থাকে। মালাটি নীচের দিকে কতকগুলি ফুল দিয়া একটি তোড়ার মতো করা - ফুলের থোব্না, আর মালার মাঝে মাঝে রঙিন ফুল ও জরি দেওয়া তবক। মালাটি যতদূর সম্ভব উৎকৃষ্ট। সুরেশ মিত্তির আনন্দে বড় অধীর হইয়া উঠিয়াছেন। তিনি একটি রূপার বাটিতে গোলাপজল ঢালিয়া বাঁ-হাতে লইয়াছেন, ডান হাতে একটি রূপার ঝাঁজরিওয়ালা পিচকারি, চোঙামুখো নয়। রূপার পিচকারিটি দুই আঙুল দিয়া ধরিবার জন্য দুটি আঙটা বা কড়া আছে, এবং পিচকারির ডাঁটিটি বুড়ো আঙুল দিয়া তুলিবার জন্যও একটি আঙটা বা কড়া আছে। সুরেশ মিত্তির পিচকারি দিয়া সকলের মাথায় গোলাপজল দিতেছেন। তাহার পর, ঐ মালাটি লইয়া পরমহংস মশাই-এর গলায় পরাইয়া দিয়া পায়ের কাছে প্রণাম করিলেন। পরমহংস মশাই দাঁড়াইয়া উঠিলেন। মালাটি তক্তাপোশের উপর জাজিমে ঠেকিয়া লুটাইতে লাগিল। পরমহংস মশাই-এর সমাধি-অবস্থা আসিতে লাগিল। কখনো বা তিনি ডান হাতের আঙুল দিয়া নিজের শরীরের দিকে দেখাইতে লাগিলেন, কখনো বা উপর দিকে নির্দেশ করিতে লাগিলেন, ও মৃদু মৃদু স্বরে এই গানটি গাহিতে শুরু করিলেন:

"আর কী সাজাবি আমায়
জগত-চন্দ্র-হার আমি পরেছি গলায় * *।"

গানটি গাহিয়া নানা প্রকার হাতের ভঙ্গী করিয়া উপরের দিকে দেখাইতে লাগিলেন। ঠিক যেন এই ভাবটি তখন প্রকাশ হইতে লাগিল - কি একটা ফুলের মালা গলায় পরাচ্ছ; আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র সব তো আমার গলায় হারের মতো রয়েছে। অর্থাৎ এই ক্ষুদ্র দেহটির ভিতর এক বিরাট পুরুষ রহিয়াছেন; চন্দ্রাদি গ্রহসমূহ তাঁহার গলার হারের মতো; তিনি আরো ঊর্ধ্বের লোক - তিনি বিরাট, অসীম, অনন্ত ও মহান। এই ক্ষুদ্র দেহটিতে একটি ক্ষুদ্র মালা পরাইয়া কী-বা আশ্চর্য কাজ করিতেছে।

গানটি তিনবার বলিয়াই তিনি সমাধিস্থ হইয়া যাইলেন। কিন্তু, তাঁহার কণ্ঠস্বর এত করুণ ও হৃদয়গ্রাহী হইয়াছিল যে, সেই কণ্ঠস্বর এখনো আমার কানে লাগিয়া রহিয়াছে। তিনি যেন হাত নাড়িয়া বলিতেছেন: জগৎ তুচ্ছ; জগতের এই জিনিস দিয়ে আমায় কী সাজাবে? অনন্ত, অনন্ত সব গ্রহ-তারা, আমি তো সর্বদাই সেই সকল প'রে থাকি। তার চেয়ে আমার মাথা আরো উপরে।

এই বিষয়টি আমার ভাষায় প্রকাশ করিবার শক্তি নাই। মুখের ভাব হাতের ভঙ্গী ও কণ্ঠের স্বর দিয়া তিনি এমন একটি ভাব ব্যক্ত করিয়াছিলেন যে, অসীম অনন্তের ভাবটি স্পষ্ট প্রকাশ পাইয়াছিল। 'শব্দ' হইতে মনকে 'শক্তি'-তে লইয়া যাওয়া ইহাকেই বলে। আমরা তো প্রথমে ফুলের মালা দেখিয়াই খুব আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলাম; কিন্তু এই গানটি বা নাদব্রহ্ম শুনিয়া মন অন্য প্রকার হইয়া গিয়াছিল।

No comments:

Post a Comment