পরমহংস মশাই শিমলাতে আসিলে, কখনো কখনো মনোমোহনদাদার বাড়িতে অল্পক্ষণের জন্য বসিয়া, রামদাদার বাড়িতে যাইতেন। শিমলার অন্যান্য বাড়িতেও তাঁহার যাতায়াত ছিল।
এক দিন, বিকালবেলা, পরমহংস মশাই কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীট দিয়া গাড়ি করিয়া যাইতেছিলেন। ডাক্তার বিহারী ভাদুড়ী দোতলায় বারাণ্ডাতে দাঁড়াইয়াছিলেন। তিনি সসম্ভ্রমে পরমহংস মশাইকে উপরে লইয়া যান, এবং তাঁহার সহিত খানিকক্ষণ কথাবার্তা কহেন। বোধ হয়, বিহারী ভাদুড়ীর সহিত পরমহংস মশাই-এর পূর্ব হইতে জানাশুনা ছিল।
পরমহংস মশাই এক বার অষ্টমীর দিন, বেলা তিনটার সময়, গোসাঁইদের বাড়িতে দুর্গাপূজায় আসিলেন। সদর দরজায় ঢুকিতে ডান দিকে রাস্তার ধারের ঘরটিতে তিনি কয়েক মিনিট বসিয়াছিলেন। আমরা পাড়ার অনেক লোক সেখানে যাইলাম। মহেন্দ্র গোস্বামীর সহিত তিনি অনেক কথাবার্তা কহিলেন। সুরেশ মিত্তিরদের তখন নূতন গাড়ি কেনা হইয়াছিল, এইজন্য সুরেশ মিত্তির অতি আগ্রহের সহিত তাঁহাকে নূতন গাড়িতে বসাইয়া নিজেদের বাড়িতে লইয়া গেলেন। আমরা আর যাই নাই। সুরেশ মিত্তিরদের বাড়ি হইতে সেদিন তিনি প্রতিমাদর্শনের জন্য অন্য কোথায় কয়েকটি বাড়িতে চলিয়া গিয়াছিলেন।
পরমহংস মশাই সুরেশ মিত্তিরদের বাড়িতে অনেক বার গিয়াছিলেন। সেখানে গিয়া তিনি খানিকক্ষণ থাকিতেন। সুরেশ মিত্তিরের বাড়ির অপর সকলের ভাব অন্য প্রকার হওয়ায়, তাঁহার বাড়িতে কখনো উৎসবাদি হয় নাই। পাছে বাড়ির কেহ কিছু মনে করে এইজন্য সুরেশ মিত্তির অতি সংকোচে থাকিতেন এবং পরমহংস মশাইকে বাড়িতে লইয়া যাইয়া বিশেষ উৎসবাদি করিতে পারিতেন না। মিত্তিরদের বাড়ি যদিও আমাদের বাড়ির সংলগ্ন ছিল কিন্তু তখনকার দিনে তাঁহাদের বাড়িতে আমরা সর্বদা যাইতাম না; নিমন্ত্রণ করিলে তবে যাইতাম। এইজন্য সুরেশ মিত্তিরদের বাড়িতে যে সকল ঘটনা ঘটিয়াছিল তাহা আমি নিজে দেখি নাই, অপরের মুখে শুনিয়াছি।
এক দিন অপরাহ্নে, পরমহংস মশাই সুরেশ মিত্তিরদের বাড়িতে যান। মিত্তিরদের বাড়ির কোনো ব্যক্তি উচ্চ সরকারি চাকরি করিতেন। তিনি পরমহংস মশাইকে দেখিয়াই মাতব্বরী চালে এইরূপ বলিতে লাগিলেন, - সুরেশ মিত্তির পরমহংস মশাইকে গুরু বলে স্বীকার করেছেন, মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে থাকেন, হাতে করে তাঁর জন্য কিছু জিনিসও নিয়ে যান; শিমলার রামডাক্তার, নরেন্দ্রনাথ ও আরো কয়েকজন লোকও পরমহংস মশাই-এর অনুগত হয়েছে; পরমহংস মশাই ছোট ছেলেগুলিকে বখাচ্ছেন, নষ্ট করছেন, প্রভৃতি; - কথাগুলির তাৎপর্য এই যে, পরমহংস মশাই যেন একজন অকর্মণ্য লোক, কিছু কাজ-কর্ম করেন না, কেবল ছেলেগুলিকে খারাপ করিতেছেন। পরমহংস মশাই খানিকক্ষণ স্থির হইয়া কথাগুলি শুনিলেন, তাহার পর তিনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "তুমি কি কাজ করো?" তিনি সরকারি চাকরি করিতেন, এইজন্য গর্বিতভাবে উত্তর করিলেন, "আমি জগতের হিত করি।" কথাটি শুনিবামাত্রই পরমহংস মশাই অন্যবিধ হইয়া গেলেন, তাঁহার ভিতর হইতে যেন আর একটি ব্যক্তি আবির্ভূত হইল। তিনি বলিতে শুরু করিলেন, "যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, পালন করছেন, তিনি কিছু বোঝেন না - তুমি সামান্য মানুষ, তুমি জগতের হিত করছ? স্রষ্টার চেয়ে তুমি বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ?" পরমহংস মশাই এই বলিয়া তাঁহাকে কঠোর তিরস্কার করিলেন। তিনি তখন অপ্রতিভ ও জড়সড় হইয়া চুপ করিয়া গেলেন। পরমহংস মশাইকে এইরূপ কথা বলার জন্য লোকটির উপর সকলে বিরক্ত হইয়াছিল, কারণ তখন তাঁহার প্রতি অজ্ঞাতসারে সকলের বেশ একটি শ্রদ্ধার ভাব আসিতেছিল। পাড়াতে দিনকতক এই কথা বেশ চলিল; আমরা পরস্পর ঠাট্টা করিয়া বলিতাম, "কি হে, জগতের হিত করছ নাকি তুমি?" কয়েক মাস এইরূপ ঠাট্টা করা চলিয়াছিল।
স্বামী সারদানন্দ এক বার বলিয়াছিলেন যে, এক দিন পূজার সময়, পরমহংস মশাই সুরেশ মিত্তিরদের বাড়ি গিয়াছিলেন। পরমহংস মশাইকে ঠাকুরদালানে মারবেল পাথরের মেঝের উপর আহার করিতে দেওয়া হইয়াছিল। ঠাকুরদালানটি পশ্চিমমুখো। ঠাকুরদালানের দক্ষিণ দিকে দোতলা ঘর। মেয়েরা ঘরের জানালা হইতে পরমহংস মশাইকে দেখিতেছিলেন। পরমহংস মশাই-এর সম্মুখে অনেক লোক দাঁড়াইয়া তাঁহাকে আহার করাইতেছিলেন। পরমহংস মশাই উপু হইয়া বসিয়া আহার করিতেছিলেন। এইরূপ বসিয়া আহার করাই তাঁহার দেশের প্রথা। আমরাও দেখিয়াছি যে, পরমহংস মশাই আসনপিঁড়ি হইয়া বসিয়া আহার করিতেন না, হাঁটু দুইটি উঁচু করিয়া উপু হইয়া বসিয়া আহার করিতেন। তিনি আহার করিতেছেন ও বলিতেছেন যে, পূর্বে তিনি বড় বিভোর থাকিতেন, বাহ্যজ্ঞান কিছুই থাকিত না, কাপড় পরার কথা মনে থাকিত না, একেবারেই বে-ভুল, বে-এক্তিয়ার হইয়া থাকিতেন; কিন্তু এখন তাঁহার সে ভাবটি কাটিয়া গিয়াছে, এখন তিনি কাপড় পরিয়া থাকেন এবং লোকজনের সম্মুখে বেশ সভ্যভব্য হইয়া বসিয়া থাকেন। এই কথা শুনিয়া, উপস্থিত লোকসকল ও যে সকল মেয়েরা জানালা হইতে দেখিতেছিলেন, একটু হাসিয়া উঠিলেন। কেহ কেহ হাসিয়া বলিলেন, "আজ্ঞে, ও-কথা ঠিক তো বটেই!" সকলে এই বলিয়া আমোদ করিয়া তাঁহাকে একটু উপহাস করিতে লাগিলেন। পরমহংস মশাই উপু হইয়া বসিয়া একটু একটু খাইতেছেন ও এইরূপ কথা চলিতেছে। সকলেই মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বাঁ-দিকের বগলের প্রতি হঠাৎ পরমহংস মশাই-এর দৃষ্টি পড়িল। তিনি দেখেন যে, কাপড়খানি বাঁ-বগলের ভিতর জড়ানো রহিয়াছে আর তিনি দিগ্বসন হইয়া বসিয়া আছেন। এইরূপ দেখিয়া তিনি অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, "আরে ছ্যা! আমার ও-টা গেল না; কাপড় পরাটা আর মনে থাকে না!" এই বলিয়া তিনি তাড়াতাড়ি কাপড়খানি লইয়া কোমরে জড়াইতে লাগিলেন। যে সকল পুরুষ দাঁড়াইয়াছিলেন, তাঁহারা সকলে উচ্চরোলে হাসিয়া উঠিলেন, মেয়েরাও জানালা হইতে হাসিয়া উঠিলেন। কিন্তু পরমহংস মশাই-এর ভাব এত সরল, স্নিগ্ধ ও উচ্চ ছিল যে, কাহারো মনে দ্বিধা বা সংকোচ না আসিয়া এক অতীন্দ্রিয় ভাব আসিল। কেহ কেহ বলিলেন, "মশাই আপনার কাপড় পরবার দরকার নেই। আপনি যেমন আছেন, তেমনি থাকুন। আপনার কোন দোষ হয় না।"
ইহা বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, একজন পুরুষ দিগ্বসন হইয়া বসিয়া আছেন, তাহাতে কাহারো মনে দ্বিধা বা সংকোচ আসিতেছে না; এমন কি, স্ত্রীলোকদিগের মধ্যেও কোন দ্বিধা বা সংকোচ বা লজ্জার ভাব আসিতেছে না। ইহা উন্মত্ত ব্যক্তির ভাব নয়, ইহা বালকের ভাবও নয়; ইহা এক অতীন্দ্রিয় ভাব - অন্য এক রাজ্যের ভাব - যাহাতে দ্বিধা বা সংকোচ ও দেহজ্ঞান প্রভৃতি কিছুই নাই। ইহা তর্ক-বিতর্কের বিষয় নয়; গভীর চিন্তা ও ধ্যানের বিষয়। নিমেষের মধ্যেই তিনি সকলের মনকে কোথায় তুলিয়া লইয়া যাইলেন, যেখানে জগতের সঙ্গে আর বিশেষ কোনো সম্পর্ক রহিল না। যীশুর বিষয়ে উল্লেখ আছে, "He was in the world, but not to the world" - তিনি জগতে ছিলেন, কিন্তু জগৎ তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে নাই। এই বাণী এ স্থলেও প্রযোজ্য।
এইরূপে পরমহংস মশাই তখনকার দিনে শিমলার অনেক বাড়িতে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। তিনি শিমলার সকলেরই এক প্রকার পরিচিত লোক ছিলেন, নিতান্ত ঘরের লোক ছিলেন। গুরুগিরির ভাব বা আড়ম্বর তাঁহার কিছুই ছিল না। অতি সাধারণ লোকের ন্যায়, তিনি ইচ্ছামতো এবাড়ি-ওবাড়ি যাইতেন; একলাই অনেক সময় যাইতেন; আর সকলেই তাঁহাকে আপনার লোক বলিয়া বিশেষ সম্মান করিতেন।
No comments:
Post a Comment