Sunday, May 27, 2018

ভাগবত-কথা প্রসঙ্গে

রামদাদার বাড়িতে কয়েক মাস ভাগবত পাঠ হইয়াছিল। রামদাদা ভাগবত কথা সাঙ্গের পর, একদিন উৎসব করিয়াছিলেন। সময়টা বোধ হয় বর্ষার শেষে এক শনিবারে। প্রথম অবস্থায় রামদাদার মাহিনা অল্প ছিল। এই উৎসবের সময় রামদাদার দুই শত টাকা মাহিনা হইয়াছিল। উৎসবে বেশ লোক হইয়াছিল। পরমহংস মশাই বেলা সাড়ে তিনটা কি চারটার সময় রামদাদার বাড়িতে আসিলেন। তিনি দক্ষিণ দিকের উঠানটির পূর্ব দিকের ছোট দালানটিতে গালিচার উপর বসিলেন। উঠানে জাজিম পাতিয়া দেওয়া হইয়াছিল। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মশাই আসিয়া জাজিমের উপর বসিলেন। তাঁহার পরনে সাদা ধুতি; গায়ে একটি সাদা পিরান ও একখানি উড়ুনি। তখন তাঁহার জোয়ান বয়স, চল্লিশ কি বেয়াল্লিশ বৎসর হইবে। তিনি তখন নব বিধান হইতে সাধারণ সমাজে চলিয়া আসিয়াছেন। সুরেশ মিত্তির অফিস হইতে তাড়াতাড়ি আসিয়া পরমহংস মশাইকে দেখিতে আসিলেন। পরমহংস মশাই ও গোস্বামী মশাই নানা প্রকার কথা কহিতে লাগিলেন। কি কথা হইয়াছিল, আমার কিছুই স্মরণ নাই। তবে এইমাত্র স্মৃতি আছে যে, সকলেই যেন মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া পরমহংস মশাই-এর কথা শুনিতে লাগিলেন। তর্কবিতর্ক বা বাদানুবাদ কিছুই ছিল না; সকলেই একমনে তাঁহার কথা শুনিতে লাগিলেন। দেখিলাম যে, কী একটি শক্তি আসিয়া সকলকে অভিভূত করিয়া অন্যত্র লইয়া যাইতে লাগিল।

আমি বার বার এই কথাই বলিতেছি যে, পরমহংস মশাই-এর কথাবার্তা অপেক্ষা তাঁহার ভিতর হইতে যে একটি শক্তি বাহির হইত, তাহা অনেক উচ্চ স্তরের বস্তু। অল্প সময়ের ভিতর, ভাষা, শব্দ, উপস্থিত ব্যক্তি ও স্থান - এই সকল চিন্তা দূর হইয়া যাইত; মনটা যেন অন্য কোথায় চলিয়া যাইত, ঠিক যেন তিনি কেন্দ্র বা বিন্দু এবং শ্রোতৃবর্গ পরিধি। এইজন্য তাঁহার কথাবার্তা তত কিছু মনে থাকিত না, মাত্র একটি আনন্দের স্মৃতি থাকিত। ইহা চাপল্যের ভাব নয় বা উল্লাসের ভাবও নয়; অতি গম্ভীর, স্নিগ্ধ ও প্রাণস্পর্শী একটি ভাব বা শক্তি, যাহা তিনি ইচ্ছামাত্র নিজ দেহ হইতে বিকিরণ করিতে পারিতেন। এই ভাব বা শক্তির তুলনায় আনুষঙ্গিক ব্যাপারসমূহ অতি তুচ্ছ।

দেখিয়াছি যে, সাধারণ অবস্থায় পরমহংস মশাই একটি পাড়াগেঁয়ে অশিক্ষিত ব্যক্তির মতো। কথাবার্তার ভাষা কলিকাতার মতো নয়, পাড়াগেঁয়ে লোকের মতো এমন কি, দূষণীয়। কলিকাতার শিক্ষিত সমাজে বিগর্হিত অনেক শব্দ তিনি ব্যবহার করিতেন এবং তাঁহার আচার-ব্যবহারেও শিক্ষিত সমাজের বিগর্হিত ভাব বিদ্যমান থাকিত। মনে হইত, একটা বোকা-হাবা লোক, জগতের কিছুই বোঝে না। কিন্তু তিনি যখন মনটা উপরে তুলিতেন, তাহার খানিকক্ষণ পরে, তাঁহার মুখের ভাব, কণ্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গী ও চেহারা এমন পরিবর্তিত হইয়া যাইত ও তাঁহার শরীর হইতে এমন একটি শক্তি বাহির হইত যে, বেশ স্পষ্ট অনুভব করা যাইত - সকলে এক অতি মহান পুরুষের কাছে বসিয়া আছি। নিজেদের অপেক্ষা তিনি যে কত উচ্চ স্তরের লোক, তাহা কিছুই নির্ণয় করা যাইত না। তিনি যে ধীশক্তিসম্পন্ন এক অদ্ভুত পণ্ডিত পুরুষ - ইহা নয়; ইহারও উচ্চে - প্রচলিত সকল প্রকার ভাব ও চিন্তার বহু উচ্চে তিনি উঠিতেন; অন্য এক প্রকার লোক তিনি হইয়া যাইতেন। জগৎকে বা সৃষ্টিকে তিনি যে এক নূতন দিক হইতে দেখিতেছেন, এবং যাহা দেখিতেছেন, তাহা যে নিশ্চিত ও দৃঢ়, ইহা বেশ স্পষ্ট বুঝা যাইত। বলা বাহুল্য, তাঁহার চিন্তাশক্তি ও অপরের চিন্তাশক্তির মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। সাধারণ লোক পুস্তকাদি পড়িয়া থাকে ও তর্ক-যুক্তি ইত্যাদি দিয়া সাধারণভাবে চিন্তা করে এবং কথায় মারপ্যাঁচ করিয়া থাকে। ইহাতে শ্রোতার বা প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরক্তিভাব আসে। ইহাই হইল সাধারণ লোকের কথাবার্তা কহিবার তাৎপর্য। কিন্তু দেখিতাম যে, পরমহংস মশাই অ-চিন্তিতভাবে জগতের ব্যাপারসমূহ অন্য দিক হইতে দেখিতেন, যাহা পূর্বে কাহারো দৃষ্টিগোচর হয় নাই। জগতের নানা সম্পর্ক, চিন্তা, ভাব ও কারণ - এই সকল তিনি নূতন ধরনে দেখিতেন, এবং সেইগুলি তিনি শ্রোতাদের বুঝাইয়া দিতেন! শুধু বুঝাইয়া দিতেন তাহা নয়, স্পষ্ট ধারণা করাইয়া দিতেন, এবং সেগুলি যে সত্য, তাহা বিনা তর্ক-যুক্তিতে প্রমাণ করাইয়া দিতেন, ভাবগুলি ঠিক যেন রূপ ধারণ করিত। সকলে যে এক অতীন্দ্রিয় অবস্থা লাভ করিত ইহা বেশ অনুভব করিতে পারিত। তিনি যেন নিজের শক্তি দিয়া সকলের মনকে ভিতর হইতে কাড়িয়া লইয়া যাইতেন এবং জগৎটাকে এক নূতন দিক হইতে দেখাইতেন। এই ভাবটি আমি সর্বদাই অনুভব করিতাম। এইজন্য কথাবার্তা বা আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহে কখনো মন দিতে পারিতাম না। বহু কষ্টে ধ্যান-জপে যে অবস্থা পাওয়া যায় তাহা যেন তাঁহার পক্ষে নিম্ন স্তরের ক্ষেত্র বা স্বাভাবিক অবস্থা ছিল। এইজন্য তিনি সর্বদাই বলিতেন "অখণ্ড সচ্চিদানন্দ"। খণ্ড বা বিচ্ছিন্নভাবে কিছুই নাই, সমস্তই একীভূত।

No comments:

Post a Comment