পূর্বে তরকারিতে নুন দেওয়া হইত না। আলুনি তরকারি হইত এবং পাতে পাতে নুন দেওয়া হইত। কিন্তু রামদাদার বাড়িতে নুন দেওয়া তরকারি চলিত এবং সকল শ্রেণীর ও সকল বর্ণের লোকই একসঙ্গে আহার করিত। অপর স্থানে লুচি ও নিরামিষ তরকারি হইলেও সকলে একসঙ্গে আহার করিত না। কিন্তু, রামদাদার বাড়িতে যখন পরমহংস মশাই আসিতেন তখন সকল বর্ণের লোকেই একসঙ্গে আহার করিতে বসিত। তখনকার দিনে এইটি বড় নূতন ব্যাপার; কারণ তখনকার দিনে খাওয়া-দাওয়া একটা বিষম সমস্যার বিষয় ছিল। সামাজিক ব্যাপারে এ সব কিছু চলিত না। এ বিষয়ে পরমহংস মশাই এক বার বলিয়াছিলেন যে, ভক্তের ভিতর জাত নাই; যাহারা ভক্ত তাহারা একসঙ্গে আহার করিতে পারে।
আরো দেখিতাম যে নিমন্ত্রণ না করিলেও অনেকে আসিতেন ও আগ্রহ করিয়া আহার করিয়া যাইতেন; এমন কি, বৃদ্ধ লোকেরাও পরমহংস মশাই আসিবেন শুনিলে, তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিয়া আহারও করিয়া যাইতেন। পরমহংস মশাই-এর এমন একটি আকর্ষণী শক্তি ছিল যে, অনিমন্ত্রিত হইয়াও কেহ দ্বিধা না করিয়া সকল লোকের সহিত একসঙ্গে আহার করিত। অন্য প্রকার আহার না করিলেও লুচি-তরকারি খাইত। এইরূপ খাওয়া শিমলাতে তো ছিলই না এমন কি কলিকাতার অন্য কোনো স্থানেও ছিল না। কলিকাতায়, তখনকার দিনে, ইহাতে একটা মহা হই-চই পড়িয়া গিয়াছিল।
এইরূপে ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে পরমহংস মশাই তাঁহার কাজ করিতে লাগিলেন, কোনো তর্ক-যুক্তি বা হুকুম চালাইয়া নয়, কিন্তু তিনি সকলের মন এত উচ্চ স্তরে তুলিয়া দিতেন যে, সামাজিক বন্ধন, খুঁটিনাটি - এ সব কিছুই মনে থাকিত না। এক অসীম, অনন্ত, মহা উচ্চ স্থানে তিনি মনটাকে তুলিয়া দিতেন যেখানে এরূপ সামাজিক ভাব কিছু থাকিত না; গোঁড়ামির ভাব একেবারেই থাকিত না।
আমরা প্রণাম করার প্রথাকে কু-সংস্কার বলিয়া উঠাইয়া দিয়াছিলাম। আমরা বলিতাম, "ওটা ডৌলের প্রথা, ওটার কোনো আবশ্যক নেই।" পরমহংস মশাই-এর সংস্পর্শে আসিয়া আমরা পরস্পরকে দুই হাত তুলিয়া প্রণাম করিতে শিখিলাম। প্রথম প্রথম প্রকাশ্যে যদিও ঐভাবে প্রণাম করিতে বাধ বাধ ঠেকিত, কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা পরস্পরকে প্রণাম করিতে শিখিলাম। পরমহংস মশাই নিজে প্রণাম করিয়া সকলকে প্রণাম করিতে শিখাইলেন। এই বিষয়ে শ্রদ্ধেয় গিরিশবাবুর উপাখ্যানটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গিরিশবাবু এক দিন বৈকালবেলা বাগবাজার বোসপাড়ার গলির মোড়ে রকের উপর বসিয়াছিলেন এমন সময় পরমহংস মশাই গাড়ি করিয়া সেখান দিয়া যাইতেছিলেন। গিরিশবাবু তাঁহাকে দেখিয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া প্রণাম করিবার পূর্বেই পরমহংস মশাই তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। গিরিশবাবু আবার প্রণাম করিতে যাইলে পরমহংস মশাই পুনরায় তাঁহার পূর্বে প্রণাম করিলেন। বারংবার এইরূপ করায়, গিরিশবাবু প্রণাম করিতে ক্ষান্ত হইলেন। পরমহংস মশাই কিন্তু নিবৃত্ত না হইয়া, তাহার পরেও গিরিশবাবুকে প্রণাম করিলেন। গিরিশবাবু তখন মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, "দক্ষিণেশ্বরের পাগলা বামুনটার সঙ্গে আর প্রণাম করা চলে না। ওটা পাগলা বামুন, ওর ঘাড় ব্যথা হয় না।"
এই ঘটনাটি উল্লেখ করিবার সময় গিরিশবাবু বলিয়াছিলেন, "রাম অবতারে ধনুর্বাণ নিয়ে জগৎ-জয় হয়েছিল, কৃষ্ণ অবতারে বাঁশির ধ্বনিতে জগৎ-জয় হয়েছিল, কিন্তু রামকৃষ্ণ অবতারে প্রণাম অস্ত্র দিয়ে জগৎ-জয় হবে।"
কথাপ্রসঙ্গে এক স্থানে উল্লেখ করিয়াছি যে, পূর্বে লোক-জন মরিলে সহজে কেহ শবদাহ করিতে যাইত না। সকলেই দরজা বন্ধ করিয়া ঘুমাইত। ডাকিলে কেহ সাড়া দিত না। সে এক বীভৎস ব্যাপার! নরেন্দ্রনাথ এই সময় অনেক শব কাঁধে লইয়া দাহ করিতে গিয়াছিল; কিন্তু সে এই কাজ ঠিক যে পরমহংস মশাই-এর প্রভাবে করিয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না। বাবা ইহাতে রাগ করিতেন। কতিপয় সঙ্গী লইয়াও নরেন্দ্রনাথ এইরূপ শবদাহ সমাধা করিত। বলিবামাত্রই, নরেন্দ্রনাথ ও তাহার কতিপয় সঙ্গী ভিন্ন বর্ণের লোকের শব দাহ করিতে যাইত। বিপন্নের সেবা করাই ছিল এইরূপ কাজ করার প্রধান উদ্দেশ্য। এইরূপ সামান্য শুরু হইতেই লোকের ভিতর ভাব বদলাইতে লাগিল। জাতাজাতির কঠোরতা এই সময় হইতেই কিঞ্চিৎ কমিতে লাগিল। নরেন্দ্রনাথ হইল শিমলার এক বড়ঘরের ছেলে, যুবকদিগের অধিনেতা, এইজন্য নরেন্দ্রনাথের উপর কেহ কথা কহিতে বিশেষ সাহস করিত না। এই সকল বিষয় এখন অতি তুচ্ছ বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু তখনকার দিনে এই সকল ব্যাপার অতি গুরুতর বলিয়া বিবেচিত হইত।
যাহা হউক, এইরূপ অনেকগুলি নূতন ভাব বা নূতন প্রথা অজ্ঞাতসারে আমাদের ভিতর আসিতে লাগিল। কিন্তু তখনো আমরা প্রচলিত ভাবসমূহের ভিতরেই ছিলাম। এখন ইহা শুনিলে অবশ্য অনেকেই হাসিবেন কিন্তু আমি পুরানো কলিকাতার সমাজের কথা বলিতেছি এবং এখনকার সমাজ কি করিয়া পরমহংস মশাই-এর প্রভাবে পরিবর্তিত হইয়াছে, তাহার কথাই বলিতেছি। পরমহংস মশাই ভালবাসা দিয়া অজ্ঞাতসারে সমাজে এক চেতনা আনিয়া দিয়াছিলেন, তখন ইহা কাহারো চোখে ঠেকে নাই। অপরে তর্ক-যুক্তি ও বক্তৃতা দিয়া যে সকল সামাজিক প্রথা বা আচার-ব্যবহার পরিবর্তন করিতে পারেন নাই, পরমহংস মশাই ধীরে ধীরে, নিজ প্রভাব দিয়া সেই সকল প্রথা বা আচার-ব্যবহার অনেক পরিমাণে পরিবর্তন করিয়াছিলেন, অথচ যাঁহারা গোঁড়া লোক ছিলেন, তাঁহারাও ইহার বিরুদ্ধে কিছু বলিতে পারেন নাই।
No comments:
Post a Comment