Friday, May 18, 2018

কেশববাবুর শ্রদ্ধা-ভক্তি

এক দিন রামদাদার সহিত কেশববাবুর সাক্ষাৎ হইয়াছিল। কেশববাবু রামদাদাকে বলিলেন, "ওঁকে 'গ্লাস-কেস'-এর ভেতর রেখে দূর থেকে দেখতে হয়, নাট-ঘাঁট করতে নেই।" - অর্থাৎ পরমহংস মশাই অতি উচ্চ অবস্থার লোক, তাঁহাকে হাটে-ঘাটে লইয়া গিয়া কথাবার্তা কহা ঠিক নয় বা তাঁহাকে লইয়া ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক নয়। কারণ, সাধারণ লোকে তাঁহার অতি উচ্চ ভাবসকল বুঝিতে পারিবে না, হয়তো বা কেহ কিছু অবজ্ঞা করিবে, আর তাহা হইলে পরমহংস মশাইকে যাঁহারা শ্রদ্ধা-ভক্তি করেন, তাঁহাদের প্রাণে ব্যথা লাগিবে। তিনি এত উচ্চ অবস্থার লোক যে জগতে এ অবস্থার লোক অতি অল্পই আসিয়াছেন। সেইজন্য, তাঁহাকে সার্শির ভিতর রাখিয়া এক আশ্চর্য অদ্ভুত পুরুষ জ্ঞানে দূর হইতে দেখাই ভাল, অতি সসম্ভ্রমে দূর হইতেই তাঁহার কথা শুনিতে হয়।

পরমহংস মশাই-এর প্রতি কেশববাবুর যে কিরূপ শ্রদ্ধাভক্তি ছিল এবং তিনি যে তাঁহাকে কিরূপ উচ্চ অবস্থার লোক বলিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার এই উক্তি হইতেই বেশ বুঝা যায়।

প্রসঙ্গক্রমে, কেশববাবুর প্রতি আমাদের কিরূপ আকর্ষণ ছিল এবং আমরা তাঁহাকে কিরূপ শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতাম, তাহা এ স্থলে উল্লেখ করিতেছি।

সম্ভবতঃ, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মাঘোত্সবের সময়, বিকালবেলা, কেশববাবু শেষ বার কোম্পানির বাগানে (বিডন গার্ডেন-এ) বক্তৃতা দিয়াছিলেন। বাগানে তখন একটি 'ব্যাণ্ডষ্ট্যাণ্ড' বা বাজনা বাজাইবার জন্য একটি ইটের চবুতর বা মঞ্চ গাঁথা ছিল। কেশববাবু সেখানে দাঁড়াইয়া বক্তৃতা দিতে লাগিলেন। আমরা অনেকেই বক্তৃতা শুনিতে গিয়াছিলাম। কেশববাবুর শেষ বাণী হইল - "মাতবি তো মেতে যা।" তাহার পর তিনি সদলবলে কোম্পানির বাগান হইতে বিডন ষ্ট্রীট দিয়া আসিতে লাগিলেন। আমরাও অনেকে পিছনে পিছনে আসিতে লাগিলাম। দলটি পরে দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া যাইল। কেশববাবু একটি দল লইয়া মাণিকতলা ষ্ট্রীট দিয়া সুরেশ মিত্তিরের বাড়ির দিকে আসিতে লাগিলেন। আমরা অনেকে তাঁহার দলে ছিলাম। কেশববাবুর হাতে রামদাদার তৈয়ার করানো সর্বধর্ম-চিহ্ন-দণ্ডটি1 ছিল। সুরেশ মিত্তিরের বাড়িতে আসিলে, তিনি চিহ্ন-দণ্ডটি অপরের হাতে দিয়া খোলটি নিজের গলায় ঝুলাইয়া, উঠানে ও ঠাকুরদালানে কীর্তন গাহিতে লাগিলেন। গানটি হইল:

"চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেম-চন্দ্রোদয় রে।
(জয় দয়াময়! জয় দয়াময়! বল, জয় দয়াময়!)
উথলিল প্রেমসিন্ধু কি আনন্দময়।" ইঃ।

গানটি খুব জমিয়া গিয়াছিল। নরেন্দ্রনাথ এই গানটি অনেক সময় গাহিত। সুরেশ মিত্তিরদের বাড়ি হইতে কেশববাবুর দল গানটি গাহিতে গাহিতে শিমলা ষ্ট্রীট দিয়া বড় রাস্তায়, কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীটে পৌঁছিল। এদিকে প্রতাপবাবু অপর দলটি লইয়া গান গাহিতে গাহিতে বড় রাস্তা দিয়া আসিলেন। প্রতাপবাবুর দলের গানটি আমার স্মরণ নাই। কেশববাবুর দলের গানটি খুব লোকরঞ্জক হইয়াছিল। আমরা সঙ্গে সঙ্গে খানিক দূর পর্যন্ত গিয়া রাত্রি হওয়ায় বাড়িতে ফিরিয়া আসিলাম।

এই ঘটনা হইতে বেশ বুঝা যায় যে, পরমহংস মশাই-এর ভক্তদিগের সহিত কেশববাবুর কিরূপ সদ্ভাব ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং পরস্পরের প্রতি কিরূপ আকর্ষণ ছিল।

কেশববাবুর প্রতি আমাদের কিরূপ শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল, সে বিষয় আর একটি ঘটনার উল্লেখ করিলেই পর্যাপ্ত হইবে, যদিও ঘটনাটি খুব বিষাদময়।

কেশববাবু দেহরক্ষা করিলে পর যখন সমারোহ করিয়া তাঁহার শব লইয়া যাওয়া হইতেছিল, তখন আমরা সকলে "ব্রহ্মকৃপাহি কেবলম্" উচ্চারণ করিতে করিতে আসিয়া সাধারণ সমাজের সম্মুখে কৌচ নামাইলাম। একখানি কৌচে কেশববাবুর দেহ রাখা হইয়াছিল। শীতকাল, এইজন্য গায়ে একখানি সাদা আলোয়ান দেওয়া হইয়াছিল। মুখ অনাবৃত ছিল, ঠিক যেন নিদ্রা যাইতেছেন - স্থির প্রশান্ত বদন, কোনো বিকৃত ভাব নাই, কেবল চোখে চশমা ছিল না, সাধারণ অবস্থা হইতে এই যা তফাৎ। তাহার পর লোক বাড়িতে লাগিল। আমরা শব লইয়া ব্রহ্মনাম উচ্চারণ করিতে করিতে, ধীরে ধীরে, বেথুন কলেজের পাশ দিয়া বিডন ষ্ট্রীট হইয়া বিডন গার্ডেন-এর কাছে যাইলাম। বেলা তখন সাড়ে-তিনটা কি চারটা হইবে। লোকসংখ্যা ও গাড়ির সংখ্যা আরো অধিক হইল। আমি নিমতলা ঘাট ষ্ট্রীটে আর অগ্রসর হইতে পারিলাম না। নরেন্দ্রনাথ কিন্তু বরাবর সঙ্গে সঙ্গে গিয়াছিল এবং শবদাহ শেষ হইতে রাত্রিতে ফিরিয়াছিল।


1. ইহাতে বিভিন্ন ধর্মের প্রতীক লাঞ্ছিত ছিল।

No comments:

Post a Comment