নীচুকার বৈঠকখানায় বসিয়া থাকিবার সময় হউক, উঠানে কীর্তন করিবার সময় হউক, বা খাওয়ার সময়ই হউক পরমহংস মশাই-এর একটি অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি দেখিতে পাইতাম। পরমহংস মশাইকে স্থির হইয়া দেখা - ইহাই যেন আমাদের প্রধান কাজ ছিল। তাঁহার কথাবার্তা অনেক সময় আমাদের মনে থাকিত না। দেখিতাম এই তো সামান্য একজন পাড়াগেঁয়ে লোক আর আমরা কলিকাতার শিক্ষিত লোক সেই পাড়াগেঁয়ে লোকের কাছে বসিয়া আছি। আমাদের অনেকের মনে এরূপ ভাবও ছিল যে, আমরা কলিকাতার শিক্ষিত বড়ঘরের ছেলে কেবল রামডাক্তারের খাতিরে বা তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য তাঁহার গুরু - এই সামান্য লোকটাকে দেখিতে আসিয়াছি। কিন্তু দেখিতাম যে, পরমহংস মশাই-এর শরীর হইতে কি একটি আভা (Effluvium) বা শক্তি বাহির হইত। শক্তি বা আভা কেন্দ্র হইতে বাহির হইয়া সমস্ত ঘরটি ভরিয়া ফেলিত, তাহার পর সম্মুখের দালানটি ভরিয়া দিত। এমন কি সেই আভা বা শক্তি জানালার গরাদের মধ্য দিয়া বাহির হইয়া গিয়া রাস্তায় যেন ঢেউ খেলিত। আমি অনেক সময় এইটি দেখিতে পাইতাম। সেই সময়কার অনেকেই ইহা বিশেষ করিয়া দেখিয়াছেন এবং এ বিষয়ে কথাবার্তাও হইত। প্রথম যেন কি একটি শক্তি বা আভা আসিয়া ত্বক স্পর্শ করিত। ক্রমে সেই শক্তিটি মাংসের ভিতর ঢুকিতে শুরু করিত এবং তাহার পর ধীরে ধীরে, হৃদয়ের কাছে আসিতে থাকিত, ইহা বেশ অনুভব করা যাইত। তখন নিজের অন্তরস্থিত শক্তি বা ব্যক্তিত্বের সহিত বাহ্যিক এই শক্তির প্রবল দ্বন্দ্ব চলিত। অবশেষে বাহ্যিক শক্তি অভ্যন্তরীণ শক্তিকে পরাভূত করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিত; তাহার পর ব্যক্তিত্ব বা নিজের কোনো একটি শক্তি বা ক্ষমতা - এ সব কিছুই থাকিত না। কী যেন একটি শক্তিতে আচ্ছন্ন হইয়া যাইতাম! নিজের স্বাভাবিক যে সকল চিন্তা, ঘর-বাড়ির চিন্তা - এই সকল কিছুই থাকিত না। মন যেন কোথায় চলিয়া যাইত। দেহ ছাড়িয়া মনটা বা ভিতরটা যেন অন্য এক রাজ্যে চলিয়া যাইত। কাহারই বা দেহ, কাহারই বা মন; কাহারই বা বাসনা, কাহারই বা সংকল্প! জগৎ ও জগতের ক্রিয়াসমূহ দূরে পড়িয়া রহিয়াছে - একটা ছবির মতো। জগতের জন্য আকাঙ্ক্ষা, মায়া-মমতা কিছুই নাই; এমন কি নিজের হাত-পা দেহ যে আছে সে বোধও থাকিত না। বিদেহ বা অশরীরী অবস্থা যেন হইয়া যাইত। চিন্তা, বাসনা ও তর্ক-যুক্তি অতি তুচ্ছ বলিয়া বোধ হইত। এমন কি জপ-ধ্যানও যাহাকে ভগবৎ-লাভ বা সত্যলাভের অতি শ্রেষ্ঠ উপায় বলা হইয়া থাকে, তাহাও বন্ধন বলিয়া মনে হইত। শ্রদ্ধেয় নাগ মশাই1 একবার বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মশাইকে বলিয়াছিলেন, "এখানে2 এসেছ, চোখ বুজে বসে আছ কেন? দেখতে এসেছ, চোখ খুলে দেখ।" কথাটি অতি সত্য। জপ-ধ্যানও সেখানে বন্ধন বা অন্তরায় হইয়া যাইত। এইরূপ অশরীরী ভাব সকলের ভিতর তিন দিন পর্যন্ত থাকিত; ঠিক হিসাব মতো বলিলে, আড়াই দিন থাকিত। জগৎটাকে যেন দেখা যাইতেছে - পূর্বের ঘর-দুয়ার ইত্যাদি সব-কিছুই, কিন্তু অ-সংলগ্নভাবে। যাহা করিবার হাত-পায়ে তাহা করা যাইতেছে, কাজে কোন ভুল হইতেছে না, কিন্তু মনটা যেন অন্য স্তরে চলিয়া গিয়াছে। তাহার পর ধীরে ধীরে, এই শক্তিটি চলিয়া যাইত এবং স্বাভাবিক অবস্থায় আসিয়া যে-যাহার কাজ করিত।
একটি বিষয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, এক জন আর এক জনের গায়ের উপর কি যেন একটি আভা রহিয়াছে দেখিতে পাইত। এই আভা থাকার দরুন পরস্পরের মধ্যে একটি অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি আসিয়াছিল। ইহা ভালবাসা নয়; ভালবাসা ইহার কাছে অতি তুচ্ছ জিনিস। পরমহংস মশাই-এর প্রতি যেমন একটি আন্তরিক আকর্ষণ হইয়াছিল, পরস্পরের প্রতিও সেইরূপ আকর্ষণ হইয়াছিল। এইজন্য, পরমহংস মশাই-এর একটি আত্মগোষ্ঠী গড়িয়া উঠিয়াছিল; আর, এইজন্যই বাহিরের লোকেরা তাঁহার কাছে যাইতে তত ইচ্ছা করিত না। পরস্পরের সহিত না দেখা হইলে বড় কষ্ট বোধ হইত। দুই-তিন জন একসঙ্গে বসিয়া পরমহংস মশাই-এর সম্বন্ধে কথাবার্তা কহাই বড় আনন্দের বিষয় ছিল। রাস্তায় পরস্পরে দেখা হইলেই পরমহংস মশাই-এর কথাই হইত; সংসারের কথাবার্তা হইত না! অফিস হইতে আসিয়া মুখ-হাত-পা না ধুইয়াই দুই-তিন জনে বসিয়া বিভোর হইয়া পরমহংস মশাই-এর বিষয় কথাবার্তা কহিত। অন্য কোনো কথা, সামাজিকতা বা পূর্ব বন্ধুদিগের সহিত মেলামেশা - এ সব আর ভাল লাগিত না। নিজেরা যেন অন্য এক রাজ্যের লোক। বাহিরের জগতের দিকে মন রাখিবার আর কাহারো ক্ষমতা রহিল না। পরস্পরে বসিয়া যে কথাবার্তা হইত তাহার অন্য কিছু উদ্দেশ্য আছে বলিয়া কেহই জানিত না; কেবল পরমহংস মশাই-এর সম্বন্ধে কথাবার্তা কহাই উদ্দেশ্য। এইরূপ কথাবার্তা কহিতে কহিতে রাত্রি অধিক হইয়া যাইত; কিন্তু একে অপরকে ছাড়িতে পারিত না। রাত্রিতে একজন অপরকে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতে যাইত, আবার সে ব্যক্তি নিজ বাড়ির দরজা হইতে ফিরিয়া তাহাকে পৌঁছাইয়া দিতে আসিত। এইরূপ অধিক রাত্রি বা প্রায় সমস্ত রাত্রি পর্যন্ত উভয়ে পায়চারি করিত; কেহ কাহাকেও ছাড়িয়া যাইতে পারিত না। প্রত্যেক লোক বোধ করিত যে, পরমহংস-মশাই-মিশ্রিত-আঠা লাগানো রহিয়াছে বলিয়া কেহ কাহাকেও ছাড়িয়া যাইতে পারিতেছে না। এ বিষয় কাহারো সন্দেহ করিবার কিছুই নাই; ইহা আমরা স্পষ্ট অনুভব করিয়াছি।
এইরূপ আচ্ছন্নভাবে থাকিতে কাজ-কর্মের কোনো ব্যাঘাত হইত না, বরং অল্প সময়ের মধ্যে নির্ভুল কাজ হইত। ইহাকে উদ্ভ্রান্ত হওয়া বলা যায় না; অজ্ঞাতসারে ভাব-সমাধি হওয়া বলা যায়। জপ-ধ্যান করিয়া যেরূপ উচ্চ অবস্থায় উঠা যায়, অজ্ঞাতসারে তাহাই হইত। পরমহংস মশাই যে কিরূপ ও কত দূর তাঁহার সূক্ষ্ম বা কারণ শরীর বিকিরণ করিতে পারিতেন, ইহা তাহারই নিদর্শন। অবশ্য ইহা জানিতে হইবে যে সব সময় তিনি নিজ দেহ হইতে এই শক্তি বাহির করিতেন না। কারণ অধিকাংশ সময়েই তিনি সাধারণ লোকের মতো সাধারণভাবেই থাকিতেন; সাধারণ লোক হইতে মাত্র কিছু তফাৎ এই যা। কিন্তু তিনি নিজে যখন উচ্চ স্তরে উঠিতেন এবং যখন তিনি ইচ্ছা করিতেন তখন তাঁহার দেহ হইতে এই আভা বা শক্তি বাহির হইত।
বৌদ্ধ গ্রন্থে এইরূপ উচ্চ অবস্থায় অবস্থিতিকে, আনন্দময় লোকে অবস্থান বলা হইয়াছে; ইহা ভাবলোক ও জ্ঞানলোকে অবস্থানের বহু ঊর্ধ্বে বা উচ্চে। এই অবস্থাটি পাওয়া অতীব দুর্লভ। বোধ হয় সাধারণ লোক নিজের চেষ্টায় এই অবস্থা জীবনে দু-চার বার পাইতে পারে মাত্র। কিন্তু পরমহংস মশাই-এর শরীর হইতে যখন এই শক্তি বাহির হইত তখন সকলে অযাচিতভাবে এই অতীব দুর্লভ অবস্থা লাভ করিত। নরেন্দ্রনাথ যখন দক্ষিণেশ্বরে প্রথম গিয়াছিল, তখন পরমহংস মশাই হঠাৎ এই শক্তি নরেন্দ্রনাথের উপর প্রক্ষেপ করিয়া ছিলেন। নরেন্দ্রনাথের ভিতরটা তখন দেহ ছাড়িয়া যেন কোথায় উঠিয়া যাইতে লাগিল। রামদাদার বাড়িতে পরমহংস মশাই-এর এই ভাব বিকাশ বা শক্তি বিকাশ, যাহাকে বলে চকিতের ভিতর বিদেহ বা অশরীরী করিয়া দেওয়া, অনেক সময় অনুভব করিতাম। পরমহংস মশাইকে দেখিয়াছেন এমন লোক যদি আজও জীবিত থাকেন তো তাঁহারা এ বিষয়টি স্মরণ করিতে ও অনুভব করিতে পারিবেন।
স্যামুএল বিল-এর গ্রন্থে আছে যে, এক দিন প্রাতঃকালে গৌতম রাজগৃহে যাইয়া পথে ভিক্ষা করিতে লাগিলেন। গৌতমকে দেখিয়া আশ-পাশের লোকজন সকলেই অবাক হইয়া গেল; তাহারা নিজ নিজ কাজ-কর্ম ভুলিয়া গিয়া পরস্পর পরস্পরের প্রতি চাওয়া চাহি করিতে লাগিল। দাঁড়িপাল্লা লইয়া যাহারা জিনিস বিক্রয় করিতেছিল, পাল্লাটি তাহাদের হাতেই স্থির হইয়া রহিল; যাহারা পয়সা গণিয়া লইতেছিল, পয়সা তাহাদের হাতেই রহিয়া গেল; যাহারা মদ্যপান করিতেছিল, তাহাদের পাত্র হাতেই অচল হইয়া রহিল। স্ত্রীলোকেরা দরজার ফাঁক দিয়া, জানালা হইতে উঁকি মারিয়া, কেহ বা বারাণ্ডা হইতে, কেহ বা ছাদ হইতে এই অজ্ঞাত লোকটির দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চাহিয়া রহিল; কেহ কেহ বলিতে লাগিল ইনি নিশ্চয় দেবরাজ। কেহ বলিল, ইনি শত্রু, নরকায় ধারণ করিয়া পৃথ্বীতলে ভ্রমণ করিতেছেন; কেহ কেহ বা - সূর্যদেব, চন্দ্রদেব ইত্যাদি আখ্যা দিল। ওদিকে রাজা সেনিয় বিম্বিসার3 তোরণ হইতে অনিমেষ নেত্রে যুবা সন্ন্যাসীকে দেখিতে দেখিতে মনে নানা চিন্তা করিতে লাগিলেন।
এই যেমন একটি আকর্ষণী শক্তির উপাখ্যান আছে, পরমহংস মশাইকে আমরাও ঠিক এইরূপ দেখিয়াছিলাম। গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধ, চৈতন্য প্রভৃতি মহাপুরুষদিগের এইরূপ আকর্ষণী শক্তি ছিল। একটি উক্তি আছে: There is a divinity that hedges round a saint, অর্থাৎ সিদ্ধ মহাপুরুষদিগকে একটি দেবশক্তি আবরিত করিয়া রাখে। অপর মহাপুরুষগণের বিষয় গ্রন্থে পড়িয়াছি মাত্র, কিন্তু পরমহংস মশাই-এর জীবনে ইহা আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। দু-একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করিতেছি।
তখনকার দিনে এত ডাক্তারখানা ছিল না। শিমলা অঞ্চলে 'বাঘওয়ালা ডাক্তারখানা'-ই4 এক প্রধান ডাক্তারখানা ছিল। এক ব্যক্তির বাইশ বৎসরের একটি ছেলের টাইফয়েড অসুখ করিয়াছিল। টাইফয়েড রোগে তখন লোকে বড়-একটা বাঁচিত না; লোকটি প্রেসক্রিপসন লইয়া, হন্তদন্ত হইয়া, ডাক্তারখানায় ওষুধ আনিতে যাইতেছিল। লোকটিকে দেখিতে কালোপানা; দোহারা, লম্বা-চওড়া চেহারা; বয়স, পঁয়তাল্লিশ কি পঞ্চাশ হইবে। লোকটি আমাদের পাড়ার নয়। আমরা তাহাকে চিনিতাম, কিন্তু তাহার সহিত আমাদের আলাপ-পরিচয় ছিল না। বোধ হয় তাহার বাড়ি ছিল জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। সড়ক দিয়া যাইলে ওষুধ আনিতে অনেক দেরি হইবে সেইজন্য সে সিংহীদের পুকুর-পাড় দিয়া, রামদাদার বাড়ির সম্মুখের গলি দিয়া তাড়াতাড়ি যাইতেছিল। রামদাদার বাড়ির দরজায় আসিয়া সে দেখিল যে, রাস্তায় বেঞ্চি পাতিয়া অনেক ভদ্রলোক বসিয়া আছেন, যেন বাড়িতে লোকজন খাওয়ানো হইবে। ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া লোকটি জিজ্ঞাসা করিল, "আজ এখানে কি গো?" উপস্থিত এক জন বলিলেন, "এখানে দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস মশাই এসেছেন।" লোকটি বলিল, "কোনটি?" তখন তাহাকে বলা হইল যে, গালিচার উপর যিনি বসিয়া আছেন তিনিই হইতেছেন দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস মশাই। লোকটি রাস্তা হইতে জানালার গরাদের ভিতর দিয়া খানিকক্ষণ উঁকি মারিয়া দেখিল। ঠিক সেই সময় পরমহংস মশাই-এর গা হইতে আকর্ষণী শক্তি বাহির হওয়াতে যেমনই তাহা অচেনা লোকটির গায়ে লাগিল, অমনি সে অভিভূত হইয়া পড়িল। ভিতরে বসিবার আর জায়গা ছিল না, কাজেই, সেই লোকটি বাহিরে বসিয়া রহিল। তাহার পর সকলে যখন তেতলায় খাইতে গেল সেও দ্বিধা না করিয়া খাইতে গেল। আহার করিয়া সকলে নামিয়া আসিল। রাত্রে যখন পরমহংস মশাই ফিরিয়া গেলেন এবং সকলে যে যার বাড়িতে যাইতে লাগিল, তখন তাহার হুঁশ হইল যে, রাত্রি এগারোটা সাড়ে-এগারোটা বাজিয়া গিয়াছে, তাহাকে ওষুধ আনিতে যাইতে হইবে, ডাক্তারখানা হয়তো বন্ধ হইয়া গিয়াছে, বাড়ির লোকেরাই বা কি ভাবিবে!
পাড়ার একটি যুবক মদ-ভাঙ খাইয়া বেড়াইত। সে ওভারসীয়ার-এর কাজ করিত। নগদ টাকা যাহা পাইত তাহাতে সে মদ খাইত। রামদাদা এক দিন তাহাকে বলিয়াছিলেন, "আরে, তুই তো মদ খেয়ে বেড়াস, তোর চাট জোটে কি?" সে মাতাল লোক সরলপ্রাণে বলিল, "রামদাদা, বলতে কি চাটের পয়সা জোটে না, শুধু মদ খেয়ে বেড়াই।" রামদাদা উপহাসের ছলে তাহাকে বলিলেন, "তুই আজ সন্ধ্যের সময় আসিস। তোকে লুচি-আলুর দমের চাট খাওয়াবো।" মাতাল এই শুনিয়া তো ভারি খুশি। কাছেই তাহার বাড়ি। সন্ধ্যার সময় আসিয়া বাহিরের বেঞ্চির কাছটিতে বসিয়া রহিল এবং খাতিরে, ঘরের ভিতর গিয়া পরমহংস মশাইকে একটা প্রণামও করিয়া আসিল; আর ক্রমাগত বকিতে লাগিল, "লুচি আলুর দমের চাট কখন দেবে? লুচি আলুর দমের চাট কখন দেবে?" তাহার পর সকলের সঙ্গে সেও উপরে গিয়া খাইয়া আসিল। কিন্তু, সে এমন চাট খাইয়া আসিল যে, চিরজীবনের মত চাট খাইল! সে যে সময় আসিয়াছিল, সেই সময় পরমহংস মশাই-এর দেহ হইতে আকর্ষণী শক্তিটি বাহির হইয়াছিল। শক্তিটি তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। পরে সে ক্রমাগত খবর লইত "পরমহংস মশাই আবার কবে আসবেন?" যদিও তাহার মদ খাওয়ার অভ্যাসটা কিছু দিন রহিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তাহার ভিতরটা বদলাইয়া যাইতে লাগিল।
এই লোকটি নাগপুরে পরে চাকরি করিতে গিয়াছিল। কয়েক বৎসর সে শিমলায় ছিল না। এক বার নাগপুর হইতে ফিরিয়া আসিয়া সে দেখিল যে, পাড়ায় পুরানো লোক আর বড় কেহ নাই, অনেকেই মারা গিয়াছে। সে তাহার আত্মীয়দের সহিত দেখা করিয়া আসিয়া সকাল বিকাল আমার কাছে বসিয়া থাকিত আর বলিত, "ভাই, তাঁর কথা বল, আর জগতে কিছু ভাল লাগে না। আমি মাতাল লোক ছিলুম, লুচি আলুরদমের চাট খেতে গিয়েছিলুম; কিন্তু তিনি কী করে দিলেন? তাঁকে ছাড়া আর কিছু মনে আসে না! হায়, এমন অমূল্য রতন হাতে পেয়ে তখন কিছু বুঝি নি, লুচি আলুর দমই শ্রেষ্ঠ মনে করেছিলুম!"
এই লোকটির নাম বিহারী ঘোষ। পরে সে নাকি নাগপুরে একটি ঠাকুরঘর করিয়াছিল।
1. শ্রীযুত দুর্গাচরণ নাগ।↩
2. শ্রীরামকৃষ্ণ সমীপে।↩
3. 'বিম্বিসার' পালি সাহিত্যে - 'সেনিয় বিম্বিসার', এবং জৈন আগম গ্রন্থে - 'সেনিয়' (শ্রেণিক) অথবা 'ভিম্ভসার' (= বিম্বসার) নামে সুপরিচিত। অশ্বঘোষের 'বুদ্ধচরিত'-এ তিনি 'শ্রেণ্য বিম্বিসার' নামে অভিহিত হইয়াছেন। তাঁহার শ্বেত পতাকা ছিল বলিয়া পালি 'থেরগাথা' নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে তিনি 'পণ্ডরকেতু' (= পাণ্ডরকেতু শ্বেতকেতু) আখ্যায় ভূষিত হইয়াছেন।
পালি অর্থকথাকারগণের মতে - (১) 'সেনিয়' বিম্বিসারের খ্যাতি মাত্র; (২) বিম্বিসার সেনিয়-গোত্রীয়; অথবা (৩) তাঁহার বৃহৎ সৈন্যবল ছিল বলিয়া তাঁহাকে সেনিয় আখ্যা প্রদত্ত হয়। কিন্তু সংস্কৃত শ্রেণ্য বা 'শ্রেণিক' পদ হইতে এরূপ কোনো কল্পনা সিদ্ধ হয় না।
বিম্বিসার নামের ব্যুৎপত্তি সম্বন্ধেও চারি প্রকার মত বৌদ্ধ সাহিত্যে দৃষ্ট হয়: (১) 'বিম্বি' অর্থে সোনা, এবং তাঁহার দেহকান্তি সোনার ন্যায় দীপ্তিমান ছিল বলিয়া তাঁহার নাম হয় বিম্বিসার; (২) মাতার নাম 'বিম্বী', এবং বিম্বীর সার বা হৃদয়ের ধন বলিয়া তাঁহার নামকরণ হয় বিম্বিসার, অথচ তাঁহার পূর্ব ব্যক্তিগত নাম ছিল 'মহাপদ্ম' (রকহিল প্রণীত 'লাইফ অভ্ দি বুদ্ধ' দ্রঃ); (৩) তিনি দেখিতে 'বিম্ব' বা উদীয়মান সূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান ছিলেন, ইহাই তাঁহার বিম্বিসার নামের বিশেষত্ব; এবং (৪) বিম্বিসার একটি অর্থহীন ব্যক্তিগত নাম মাত্র।
অমরকোষের মতে, 'বিম্ব' শব্দে সূর্যের দেহ অথবা চন্দ্রের দেহ বুঝায়। বিম্বিসার নামের পূর্বোক্ত তৃতীয় ব্যুৎপত্তি গ্রহণ করিলে, বিম্বিসারের পরিবর্তে বিম্বসার নামই সার্থক হয়। এক্ষেত্রে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে, রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত 'ললিত-বিস্তর' গ্রন্থে বিম্বিসার এবং বিম্বসার - উভয়বিধ পাঠই পাওয়া যায়। বলা অনাবশ্যক যে, জৈন ভিম্বসার আখ্যা বিম্বসার নামেরই পরিপোষক। জৈন ভাষ্যকারগণের মতে, 'ভাসস্ত দীপ্যমান' অর্থে ভিম্ভসার।↩
4. এই ডাক্তারখানায় একটি পূরিত ব্যাঘ্র (Stuffed tiger) থাকিত এইজন্য সাধারণে ইহাকে বাঘওয়ালা ডাক্তারখানা বলিত।↩
No comments:
Post a Comment