Friday, May 11, 2018

পরমহংস মশাই ও নরেন্দ্রনাথ

পরমহংস মশাইকে কেহ কেহ ভক্তি করিতেন, তাঁহার জন্য উৎসবাদি করিতেন ও দক্ষিণেশ্বরে দ্রব্যাদি পাঠাইতেন, কিন্তু নরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি যুবকগণের উপর তাঁহার এক বিশেষ আকর্ষণ ছিল; এইজন্য তিনি তাঁহাদিগকে এত খুঁজিয়া বেড়াইতেন এবং পরিশেষে যুবা রাখালকে কাছেও রাখিয়াছিলেন।

গুরুভক্তি ও গুরুর আদেশ পালন - এই দুইটির ভিতর বিশেষ পার্থক্য আছে। সাধারণ ভক্তেরা গুরুর দেহটিকেই শ্রেষ্ঠ বস্তু বলিয়া গণ্য করেন এবং গুরুর প্রতি যতটুকু ভক্তি করা প্রয়োজন বলিয়া তাঁহারা মনে করেন, ঠিক ততটুকু ভক্তি করিয়াই নিজেদের কার্যে ব্যস্ত থাকেন; তাঁহাদের গুরুভক্তি বা কার্য সেখানেই শেষ হইয়া থাকে। এই শ্রেণীর ভক্তেরা নীচেই পড়িয়া থাকেন, উচ্চ অবস্থায় আর উঠিতে পারেন না; এমন কি, কালে মুমূর্ষু জড়পিণ্ডবৎ হইয়া যান।

অধিকাংশ লোকই কেবল গুরুভক্তি দেখাইয়া কর্তব্য শেষ করিতেন; কিন্তু নরেন্দ্রনাথ-প্রমুখ কয়েকজন মাত্র যুবক, গুরুর আদেশ পালন করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, গুরুভক্তি অপেক্ষা গুরুর আদেশ পালন করাই শ্রেষ্ঠ। এ বিষয়ে অনেক কিছু চিন্তা করিবার ও বলিবার আছে। ইহা নিজে নিজে বুঝিয়া লওয়া উচিত।

যাহা হউক, পরমহংস মশাই, প্রথম হইতেই নরেন্দ্রনাথ-প্রমুখ যুবকগণের যে কিরূপ শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল, তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। এইজন্য যাঁহারা তাঁহাকে মাত্র ভক্তি করিতেন, তাঁহাদের অপেক্ষা যাঁহারা ভবিষ্যতে তাঁহার আদেশ পালন করিবেন, তাঁহার ভাবসমূহ জগৎকে দিবেন ও কার্যে পরিণত করিবেন, তাঁহাদিগকে প্রথম হইতেই তিনি বিশেষ আপনার করিয়া লইয়াছিলেন; তাঁহাদের উপরই তাঁহার বিশেষ টান ছিল। অপর সকলকে তিনি ভক্ত হিসাবে ভালবাসিতেন মাত্র।

এ বিষয়ে এক দিনকার একটি ঘটনা উল্লেখ করিতেছি। শুনিয়াছি যে, নরেন্দ্রনাথ পরমহংস মশাই-এর নিকট যাইবার কিছু কাল পরে, কোনো এক যুবক আর একজনের সহিত দক্ষিণেশ্বরে যান। যুবকটির সঙ্গে যে লোকটি ছিলেন তাঁহার কাছে নরেন্দ্রনাথের কুশল সংবাদ পাইয়া পরমহংস মশাই বলিলেন, "লরেন অনেক দিন আসেনি, দেখতে ইচ্ছে হয়েছে এক বার আসতে বলো।" পরমহংস মশাই-এর সহিত কথাবার্তা কহিয়া, রাত্রে তাঁহারা তাঁহার ঘরের পূর্বদিকের বারাণ্ডায় উভয়ে শয়ন করিলে কিছু কাল পরেই, পরমহংস মশাই বালকের মতো তাঁহার পরনের কাপড়খানি বগলে করিয়া তাঁহাদের একজনকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "তুমি কি ঘুমোচ্ছ?" যাঁহাকে ডাকিয়া পরমহংস মশাই জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি উত্তর করিলেন, "আজ্ঞে না।" পরমহংস মশাই বলিলেন, "দেখ, লরেনের জন্য প্রাণের ভেতর যেন গামছা-নেংড়ানোর মতো মোচড় দিচ্ছে!" সে-রাত্রিতে নাকি পরমহংস মশাই-এর নরেন্দ্রনাথের জন্য উৎকণ্ঠ ভাব কিছুমাত্র কমে নাই। কারণ তিনি কিছুক্ষণ শয়ন করিবার পর, আবার আসিয়া ঐ কথাই বলিতে লাগিলেন। যেন, নরেন্দ্রনাথের অদর্শনের জন্য বড়ই ব্যথিত হইয়া পড়ায় তাঁহার ঘুম হইতেছিল না।

পরমহংস মশাই, আমাদের গৌরমোহন মুখার্জী ষ্ট্রীটের বাড়িতে, নরেন্দ্রনাথকে মাঝে মাঝে খুঁজিতে আসিতেন; কিন্তু কখনো বাড়ির ভিতর প্রবেশ করেন নাই, রাস্তায় অপেক্ষা করিতেন। তিনি বাড়ির একটু কাছে আসিলে, অনেক সময় আমি অগ্রসর হইয়া যাইতাম। আমায় বলিতেন, "লরেন কোথায়, লরেনকে ডেকে দাও।" আমি তাড়াতাড়ি আসিয়া দাদাকে সন্ধান করিয়া ডাকিয়া দিতাম। অনেক সময় পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথের সহিত কথাবার্তা কহিয়া তাহাকে ডাকিয়া লইয়া যাইতেন।

পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথকে আদর করিয়া 'শুকদেব' বলিয়া ডাকিতেন; শুকদেব যেন দ্বিতীয় বার জগতে আসিয়াছেন। নরেন্দ্রনাথ শুকদেবের মতো জ্ঞানী হইবে, জগতে সমস্ত কার্য করিবে, কিন্তু জগৎকে ছুঁইবে না, প্রভৃতি বহুবিধ অর্থে তিনি নরেন্দ্রনাথকে শুকদেব বলিতেন। বাবা এই কথা শুনিয়া আনন্দিত হইয়া বলিতেন, "হ্যাঁ, হয়েছে বটে, ব্যাসদেবের বেটা শুকদেব। ম্যাক্নামারার বেটা কফিন-চোর!" - অর্থাৎ, ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেব মহৎ হইয়াছিলেন, এ কথা সত্য; কিন্তু বড়সাহেব ম্যাক্নামারার পুত্র হইল কিনা শবাধার-চোর! নরেন্দ্রনাথ সেই রকম হইবে! তখনকার দিনে 'কফিন-চোর' কথাটির বড় প্রচলন ছিল। নরেন্দ্রনাথ যে ভবিষ্যতে একজন শ্রেষ্ঠ লোক হইবে, এই কথা শুনিয়া আনন্দিত হইয়া তিনি বিদ্রূপ করিয়া এইরূপ বলিতেন। তিনি বিরক্ত হইতেন না, বরং খুশি হইতেন।

নরেন্দ্রনাথ ছুটি পাইলে, নিজে নৌকা বাহিয়া দক্ষিণেশ্বরে যাইত। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝড়ের সময় নরেন্দ্রনাথ গঙ্গা দিয়া নৌকা বাহিয়া যাইত, এইজন্য, বাবা অনেক সময় বিরক্ত হইতেন। তিনি বলিতেন, "যাতায়াতের একখানা গাড়ি করে গেলেই তো হয়। এ রকম ঝড়-তুফানে গঙ্গা দিয়ে যাবার কি দরকার? রাম তো টানা গাড়ি করে যায়। - একেই বলে ডানপিটে ছেলের মরণ গাছের আগায়। এ রকম ডানপিটেমি করার কি দরকার?" কিন্তু নরেন্দ্রনাথ এ সকল কথায় বিশেষ কান না দিয়া, নিজের মনোমত দুই-একটি বন্ধু সঙ্গে লইয়া নৌকা করিয়া অনেক সময় দক্ষিণেশ্বরে যাইত। হেদোর পুকুরে নরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি সকলে নৌকার দাঁড় টানিতে বেশ পারদর্শী হইয়াছিল। আহিরীটোলার ঘাটে একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া, অনেক সময় নিজেরাই মাঝিদের দাঁড় লইয়া টানিতে টানিতে দক্ষিণেশ্বরে যাইত। এইরূপ যাওয়াতে কতকটা নৌকা বাহিয়া আমোদ করা হইত এবং পরমহংস মশাইকে দর্শন করিতে যাওয়াও হইত।

তখনকার দিনে দক্ষিণেশ্বরে গাড়ি করিয়া যাইবার পথ অতি কষ্টকর ছিল। গরাণহাটা হইতে বরানগরের বাজার পর্যন্ত গাড়ি যাইত, তাহার পর, সমস্ত পথটা হাঁটিয়া যাইতে হইত। আলমবাজার ও দক্ষিণেশ্বর প্রভৃতি স্থানসমূহ একেবারে পাড়াগাঁ ছিল। মাঝে মাঝে গোলপাতার ঘর, ফাঁকা মাঠ, জঙ্গল ও পুকুর; এখনকার মত এত বসতি ছিল না। দক্ষিণেশ্বর সামান্য একটি ছোট গ্রামের মতো ছিল। আমরা গিরিশবাবুর ঘর হইতে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির সর্বদাই দেখিতে পাইতাম। কারণ, তখন মাঝখানে উঁচু ঘর-বাড়ি ইত্যাদি বিশেষ কিছু ছিল না। গিরিশবাবু ও অপর সকলে সন্ধ্যার সময় উত্তর দিকে মুখ করিয়া দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরকে প্রণাম করিতেন। এখন অনেক বাড়ি হওয়ায়, গিরিশবাবুর বাড়ি হইতে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির আর দেখা যায় না। ইহা হইল ১৮৮৩ বা ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের কথা।

নরেন্দ্রনাথ কোনো কথা মানিয়া লইবার পাত্র ছিল না। তর্ক-যুক্তি ও বিশেষ বিচার না করিয়া, সে কখনো অপরের কোনো কথা গ্রাহ্য করিয়া লইত না। পান্তাভেতে মুমূর্ষু ভাব তাহার ভিতর আদৌ ছিল না। পরমহংস মশাই-এর কাছে যে সকল মুমূর্ষু ভক্ত যাইতেন, তাঁহারা বলিতেন, "এ ছোঁড়া কি দাম্ভিক! বড়মানুষের বেটা, কলেজে পড়ে, তাই এত অহঙ্কার।" হরমোহন মিত্রের নিকট শুনিয়াছি যে, কথাপ্রসঙ্গে পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথকে এক দিন বলিয়াছিলেন, "তুই যদি কথা না শুনিস, তবে এখানে কি করতে আসিস?" নরেন্দ্রনাথ অমনি চট্ করিয়া জবাব দিল, "তোমার কাছে আবার শিখবো কি? তুমি কী-বা পেয়েছো, তোমার কাছে শেখবার বিশেষ এমন কী আছে?" পরমহংস মশাই তাহাতে বলিলেন, "তোর শেখবার যদি কিছু না থাকে, তবে এমন ঝড়-ঝাপটে আসিস কেন?" নরেন্দ্রনাথ অমনি উত্তর করিল, "তোমায় ভালবাসি বলে দেখতে আসি।" পরমহংস মশাই সমাধিস্থ হইয়া নরেন্দ্রনাথকে জড়াইয়া ধরিলেন। তাহার পর বলিতে লাগিলেন, "দেখ, সকলেই কিছু স্বার্থের জন্য আসে, যে যার অভীষ্টসিদ্ধির জন্যে আসে। লরেন কিন্তু ভালবাসে বলে আসে, ওর কোনো অভীষ্ট এখানে নেই। এ হল নিঃস্বার্থ ভালবাসা। আর সকলে যারা আসে, তারা কোনো আকাঙ্ক্ষা করে আসে।" উপস্থিত ব্যক্তিসকল প্রথমে নরেন্দ্রনাথের প্রতি বিশেষ বিরক্ত হইয়াছিলেন; তাঁহারা ভাবিয়াছিলেন যে, দাম্ভিক ছোঁড়াটা পরমহংস মশাই-এর মুখের উপর চটপট উত্তর করে। কিন্তু পরমহংস মশাই যখন নরেন্দ্রনাথকে প্রশংসা করিলেন, তখন সকলে নীরব হইয়া রহিলেন।

নরেন্দ্রনাথ সব সময় পরমহংস মশাইকে বলিত, "তুমি মুক্খু লোক, লেখাপড়া জান না, তোমার কাছে আবার দর্শনশাস্ত্রের কথা কি শিখবো? আমি এ সব বিষয় ঢের জানি।" কখনো কখনো তর্কের ছলে তাহার কথার মাত্রা আরো বাড়িয়া যাইত। অপরে ইহাতে বিরক্ত বা মনঃক্ষুণ্ণ হইতেন। পরমহংস মশাই হাসিতে হাসিতে বলিতেন, "ও আমাকে গাল দেয়, কিন্তু ভেতরে যে শক্তি আছে, তাকে গাল দেয় না।" পরমহংস মশাই-এর কী গুণগ্রাহী ভাব, কী উদার ভাব! সংকীর্ণ ভাব, গুরুগিরির ভাব - এ সব কিছুই তাঁহার ছিল না। এইজন্য, তিনি ঝাঁজালো ও তেজী নরেন্দ্রনাথের এত প্রশংসা করিতেন এবং তাহাকে এত ভালবাসিতেন। ইহাকেই বলে কদর দান, গুণের আদর করা।

নরেন্দ্রনাথ এইরূপ ঝাঁঝালো মেজাজে পরমহংস মশাই-এর সহিত সমান সমান ভাবে তর্ক করিত। পরমহংস মশাইও তাহাতে হাসিয়া আনন্দ করিতেন। এক ব্যক্তি নরেন্দ্রনাথের অনুকরণ করিয়া পরমহংস মশাই-এর সহিত কথা কহিতে গিয়াছিলেন। পরমহংস মশাই অমনি বিরক্ত হইয়া বলিয়াছিলেন, "লরেন বলে - লরেন বলতে পারে, তা বলে তুই বলতে যাস নি। তুই আর লরেন এক না।" এই বলিয়া তাঁহাকে ধমক দিয়াছিলেন!

দেখা গিয়াছে যে, অতি শৈশবকাল হইতেই নরেন্দ্রনাথ কাহারো কথা অল্পতেই মাথা পাতিয়া লইত না বা নিজ অপেক্ষা অপর কাহাকে সহজে বড় বলিয়া মনে করিত না। এইরূপ ভাবই তাহার স্বাভাবিক শক্তির পরিচায়ক। সর্বদাই তাহার ভিতর এই একটি ভাব ছিল - যত বড় লোকই আসুক না কেন, সে নিজের ভিতর হইতে শক্তি উদ্বুদ্ধ করিয়া, সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তির তুল্য শক্তি দেখাইতে পারে; এমন কি, প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তি অপেক্ষা আরো অধিক শক্তি বিকাশ করিতে পারে। নরেন্দ্রনাথ নিজ হইতে উচ্চতর ব্যক্তিকে বিশেষ সম্মান করিত, নিম্নতর ব্যক্তিকে স্নেহ করিত, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহ্য করিতে পারিত না; প্রতিদ্বন্দ্বীকে যতক্ষণ পর্যন্ত না বিধ্বস্ত বা পরাভূত করিতে পারিত, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হইত না। ইহা হইল তাহার শক্তিমত্তার বিশেষ লক্ষণ। নীচু বা অবনত হওয়া তাহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। কিন্তু সাধারণ হইতে সে যে উচ্চ - এ বোধ থাকিলেও, কাহাকেও অবজ্ঞা বা অসম্মান দেখানোও তাহার রীতি ছিল না। অপরকে সম্মান করিব, শ্রদ্ধা করিব, কিন্তু নিজের প্রাধান্য ও শক্তি বা ব্যক্তিত্ব অটুট রাখিব, এই ছিল তাহার ভাব। যাঁহারা দুর্বলমস্তিষ্ক ছিলেন তাঁহারা নরেন্দ্রনাথের এই ভাব বুঝিতে না পারিয়া অনেক সময় বলিতেন, "নরেন অতি দাম্ভিক, অহংকারী; হামবড়াইগিরি তার বড্ড বেশি।"

জগতের কাছে আমি ভিক্ষা লইতে আসি নাই, আমি জগৎকে ভিক্ষা দিব, আমার অফুরন্ত ভাণ্ডার আছে, এই ছিল নরেন্দ্রনাথের আশৈশব ভাব। শুনিয়াছি, পরমহংস মশাই এক দিন আহ্লাদ করিয়া নরেন্দ্রনাথকে একটি জিনিস দিতে গিয়াছিলেন। নরেন্দ্রনাথ অমনি বলিয়া উঠিল, "তোমার কাছে জিনিস নেবো কেন আমি? আমার কিসের অভাব? তুমি এ জিনিস অপরকে দাও গে যাও, আমি নেবো না।" এই সামান্য কথাগুলিতেই নরেন্দ্রনাথের মনোভাব বুঝা যায়।

বুদ্ধের জীবনী পাঠ করিলে দেখা যায় যে, যখন তিনি কুমার সিদ্ধার্থরূপে নিজ গৃহে ছিলেন বা যখন তিনি তাপস গৌতমরূপে বিচরণ করিতেন এবং নিজের এক মুষ্টি অন্নও জুটিত না, উভয় অবস্থাতেই তাঁহার উচ্চ ভাব ও ওজস্বী ভাব ছিল। এইজন্য লোকে তাঁহাকে 'সুন্দর শ্রমণ' 'মহাশ্রমণ' বলিত।

সুপুরুষ-সন্ন্যাসী, মহাসন্ন্যাসী বা মহাত্যাগী হওয়া এক কথা, আর ভিখারী হওয়া আর এক কথা। কোনো কিছু দিয়া ইহার পরিমাপ করা যায় না কারণ ইহা হইল মনের বৃত্তি। একজন সর্বত্যাগী, গাছের তলায় পড়িয়া থাকা সত্ত্বেও তাহার রাজকীয় ভাব দীপ্ত থাকে; আর এক জনের বহু বিত্ত থাকিলেও তাহার ভিখারীর ভাব দূর হয় না। নরেন্দ্রনাথ পরমহংস মশাই-এর কাছে যাইত ভিখারীর ভাবে নয়; য়ুরোপীয় দর্শনশাস্ত্রাদিতে যাহা পাঠ করিয়াছিল তাহা কতদূর সত্য, মিলাইয়া লইবার জন্য পরমহংস মশাই-এর কাছে যাইত এবং তর্ক-যুক্তি ও বাদানুবাদ করিয়া সেই সকল মতের সিদ্ধান্ত করিয়া লইত।

এক দিন নরেন্দ্রনাথ একটি যুবককে বলিয়াছিল, "ওঁর কাছে যাই, সমাজ বা অন্য বিষয় শেখবার জন্যে নয়। এ সব বিষয় ওঁর কাছে শেখবার কিছুই নেই। এ সব বিষয় আমি ঢের পড়েছি, ঢের জানি, তবে দেখ, ওঁর কাছে Spirituality - ব্রহ্মজ্ঞান শিখতে হবে। এটা ওঁর কাছে আশ্চর্যরকম আছে।"

বোধিসত্ত্বের আরাড়কালাম, রামপুত্র রুদ্রক প্রভৃতি পণ্ডিতগণের সহিত বিচারের বিষয় পাঠ করিলে, পরমহংস মশাই-এর সহিত নরেন্দ্রনাথের বিতর্ক অনুরূপ বলিয়া বোধ হয়।

অপ্রিয় হইলেও, নরেন্দ্রনাথ তর্ককালে দুই-একটি কড়া কথা বলিয়া ফেলিত। উপস্থিত-উত্তর দেওয়ার ক্ষমতাও ছিল তাহার অতি আশ্চর্যরূপ - দৈবশক্তির মতো। এইজন্য, কেহ তাহার সহিত তর্ক করিতে সাহস করিত না।

এক দিন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের সহিত নরেন্দ্রনাথের তর্ক হইতেছিল। ডাক্তার সরকার তর্কের সময় অনেক পুস্তকের নাম করিতে লাগিলেন। নরেন্দ্রনাথ চট্ করিয়া বলিয়া উঠিল, "মশাই, আপনি কি বইটা পড়েছেন, না দেখেছেন?" ইহাতে ডাক্তার সরকার হঠাৎ কিছু উত্তর দিতে পারিলেন না। তখন নরেন্দ্রনাথ আবার প্রশ্ন করিল, "না, জিগ্গেস করছি, বইটা মাত্র উলটে দেখেছেন, না পড়েছেন?" অবশেষে, ডাক্তার সরকার অপ্রতিভ হইয়া স্বীকার করিলেন যে, তিনি পুস্তকের খানিক অংশ মাত্র পড়িয়াছেন। নরেন্দ্রনাথ অমনি পুস্তকের অনেক স্থান উদ্ধার করিয়া ডাক্তার সরকারকে শুনাইতে লাগিল এবং বলিল, "আমি ঐ বইখানা অনেক দিন আগে পড়েছি।" ডাক্তার সরকার আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলেন, "এত অল্প বয়সের ছেলে যে এত পড়েছে, তা আমি কখনো জানতুম না।"

কাশীপুরের বাগানে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল। গিরিশবাবুও এই সময় উপস্থিত ছিলেন। গিরিশবাবু খুব পণ্ডিত লোক। তিনিও অবাক হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, নরেন্দ্রনাথ এই অল্প বয়সে কি করিয়া এত বই পড়িয়াছে! - এখানে জানা আবশ্যক যে, নরেন্দ্রনাথ ইংরেজী সাহিত্যে ও য়ুরোপীয় দর্শনশাস্ত্রে বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। কি ইতিহাস, কি সাহিত্য, কি কাব্য, কি জ্যোতিষ, কি দর্শনশাস্ত্র প্রভৃতি বহু বিষয়ে সে সুপণ্ডিত ছিল।

পরমহংস মশাই কখনো কখনো আনন্দ করিয়া এই রকম তর্ক-বিতর্কের সময়ে কথাবার্তা কহিতে যাইতেন। নরেন্দ্রনাথ ছিল রুদ্রমূর্তি, তাহার কাছে খাতির-আবদার বড় চলিত না। সে নিজের ব্যক্তিত্বের পরিমাণ বুঝিত। তখন অনেক সময় নরেন্দ্রনাথ মুখঝামটা দিয়া পরমহংস মশাইকে বলিত, "তুমি দর্শনশাস্ত্রের কি জান? তুমি তো একটা মুক্খু লোক।" পরমহংস মশাই আনন্দিত হইয়া হাসিতে হাসিতে বলিতেন, "লরেন আমাকে যত মুক্খু বলে, আমি তত মুক্খু লই!" তিনি নিজের বাঁ-হাতের চেটোতে ডান হাতের আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিতেন, "আমি অক্ষর জানি।" অর্থাৎ অক্ষর চেনা পর্যন্ত তাঁহার বিদ্যালাভ হইয়াছিল।

এ স্থলে ইহা বিশেষ দ্রষ্টব্য যে, পরমহংস মশাই-এর সহিত নরেন্দ্রনাথের মতো কেহ কথা কহিতে সাহস করিত না। মাত্র নরেন্দ্রনাথই নির্ভীক হইয়া পরমহংস মশাইকে এরূপ কথা বলিত। সাধারণ ভক্তেরা নরেন্দ্রনাথের এইরূপ কথাবার্তা অনেক সময় পছন্দ করিত না ও উহার ভাব বুঝিতে পারিত না। এক প্রদীপ হইতে অপর এক প্রদীপ জ্বালিয়া লইবার সময় একটি চিড়বিড় শব্দ হয় এবং পরে, উভয় প্রদীপের শিখা একই প্রকার হইয়া যায়, ইহা অনেকেই বুঝিতে পারিত না। যাহারা কৃপা-ভিখারী, তাহারা নরেন্দ্রনাথের এইরূপ আচরণে ও কথাবার্তায় অনেক সময় বিরক্তই হইত; কারণ, এই সকল ব্যাপার হইল তাহাদিগের ধারণার অতীত। Self-assertion - আত্ম-প্রতিষ্ঠা যে অন্যবিধ ভাব, তাহা তাহারা বুঝিতে পারিত না। তাহারা মনে করিত, নির্জীব ও মুমূর্ষু হইয়া কথা শুনিয়া যাওয়াই শ্রেয়। কৃপা-ভিখারী হওয়া - এই ভাবটি নরেন্দ্রনাথ অত্যন্ত ঘৃণা করিত। নিজের ব্যক্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখিয়া ও নিজের প্রাধান্য বজায় রাখিয়া অপরকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করাই ছিল নরেন্দ্রনাথের চরিত্রের বিশেষ লক্ষণ। এইজন্য অপর ভক্তগণের সহিত তাহার মিল হইত না। নরেন্দ্রনাথ রুদ্রভাব দিয়া প্রগাঢ় শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখাইত। ইহাই হইল ক্ষাত্রশক্তি। পূর্বকালে ক্ষত্রিয়েরা গুরুকে যুদ্ধে পরাভব করিয়া গুরুর সম্মান প্রচার করিতেন। মহাভারতে ও টড-এর রাজস্থান গ্রন্থের উদয়পুরের উপাখ্যানে এইরূপ ক্ষাত্রশক্তির অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। নরেন্দ্রনাথের রুদ্র অংশে জন্ম; রুদ্র তাহার মূর্তি। রুদ্র অংশে জন্মগ্রহণ না করিলে, রুদ্রের ভাব কেহ বিকাশ করিতে পারে না। ইহা অপরের অনুকরণ করিতে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র।

নরেন্দ্রনাথ যে ভবিষ্যতে সর্ববিজয়ী হইবে, পরমহংস মশাই পূর্বেই তাহার আভাস পাইয়াছিলেন। এইরূপ মুখঝামটার ভিতরও নরেন্দ্রনাথের যে তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধা আছে তাহা বুঝিতে পারিয়া তিনি আনন্দ করিতেন; এই সময়কার কথাবার্তা যদি কেহ চেষ্টা করিয়া লিপিবদ্ধ করেন তো, তাহা হইলে একখানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ হইতে পারে।

১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ২৫শে ফেব্রুয়ারী আমার বাবার হঠাৎ মৃত্যু হয়। পূর্বের দিন চাকর, সরকার প্রভৃতি অনেক লোকজন ছিল; কিন্তু পর দিন আমরা একেবারে গরিব হইয়া পড়ি, কিছুই সংস্থান ছিল না। সংসারের সকল ভার নরেন্দ্রনাথের উপর পড়িল। সে তখন আইন পড়িতেছিল এবং এক অ্যাটর্নির আর্টিক্ল্ড ক্লার্ক হইয়াছিল। কিন্তু সেখান হইতে কিছু পাইবার আশা ছিল না। সংসার কি করিয়া চলিবে এই চিন্তায় নরেন্দ্রনাথ উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িল। এইরূপ ভাবনায় তাহার মাথার ভিতর সর্বদা যন্ত্রণা হইত বলিয়া, মাথা ঠাণ্ডা করিবার উদ্দেশ্যে সে কর্পূরের নাস লইত। বাল্যকাল হইতেই তাহার নাস লওয়ার বদ্ অভ্যাস ছিল।

এই সময় গরমিকালে একদিন পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে আসেন। তিনি নরেন্দ্রনাথকে ডাকিয়া লইয়া যাইবার জন্য অনেক লোককে পাঠাইলেন; কিন্তু নরেন্দ্রনাথের অভিমান হওয়ায় কিছুতেই তাঁহার কাছে যাইল না। বাহিরের ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া সে একাকী বসিয়া রহিল, দরজা খুলিল না। তিন-চার জন লোক আসিয়া ফিরিয়া গেল। অবশেষে সন্ধ্যার সময় দেবেন মজুমদার মশাই নরেন্দ্রনাথকে ডাকিতে আসিলেন। দেবেনবাবুর কী অমায়িক ভাব, নরেন্দ্রনাথের প্রতি কী তাঁহার ভালবাসা! তিনি মিষ্ট ভাষায় বুঝাইয়া নরেন্দ্রনাথকে অনুনয় করিলে, নরেন্দ্রনাথ যাইতে বাধ্য হইল। সে কোঁচার কাপড় গায়ে দিয়া, চটি-জুতা পরিয়া, রামদাদার বাড়িতে গেল। বৈঠকখানার দক্ষিণদিকের দরজার কাছে, পরমহংস মশাই-এর গালিচাখানির সম্মুখে গিয়া সে বসিল। তখনো তাহার অভিমান ছিল, কিন্তু শিষ্টাচারের খাতিরে পরমহংস মশাইকে ঢিপ করিয়া একটি গড় করিল - প্রণাম করিতে হয়, সেইজন্য প্রণাম করিল মাত্র। পরমহংস মশাই অতি সস্নেহে নরেন্দ্রনাথের মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে বলিতে লাগিলেন, "তুমি আস নি কেন এতক্ষণ? তুমি না এলে যে আসর জমে না। আমরা হলুম নর, তুমি যে নরের ইন্দ্র।" এইরূপ অনেক মিষ্ট কথায় তিনি তাহাকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন। লোকজন অনেক হওয়ায় ঘরটি বড় গরম হইয়াছিল। নরেন্দ্রনাথ মিনিট কয়েক ঘরে থাকিয়া বলিল, "ঘরটা বড় গরম, আমি বাইরে গিয়ে বসি।" এই বলিয়া সে রাস্তার বেঞ্চিতে গিয়া হাওয়ায় বসিল। অল্পক্ষণ পরেই তাহার মাথার যন্ত্রণা কমিয়া গেল। নরেন্দ্রনাথের প্রতি পরমহংস মশাই-এর কী ঐকান্তিক ভালোবাসা! এত লোক উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতেন এবং তাঁহার সেবা করিতেন, কিন্তু তাহা হইলেও পরমহংস মশাই-এর মন তত প্রসন্ন ছিল না। কারণ, নরেন্দ্রনাথ উপস্থিত না থাকাতে তিনি একেবারে চঞ্চল হইয়া পড়িয়াছিলেন, যেন কোনো কিছু তাঁহার ভাল লাগিতেছিল না।

আমাদের এই সময়কার অবস্থার একটি ঘটনা উল্লেখ করিতেছি।

মা একখানি চেলির কাপড় পরিয়া আহ্নিক করিতেন। কাপড়খানি ছিঁড়িয়া যাওয়ায় তিনি নরেন্দ্রনাথকে বলেন যে, একখানি চেলির বা গরদের কাপড় হইলে তাঁহার আহ্নিক করার সুবিধা হয়। নরেন্দ্রনাথের তখন কোনো কাজ-কর্ম ছিল না, কোথা হইতে সে কাপড় দিবে? কাপড় দিবার ক্ষমতা নাই জানিয়া নরেন্দ্রনাথ মাথা হেঁট করিয়া মা'র সম্মুখ হইতে বিষণ্ণ হইয়া চলিয়া গেল, কোন কথার উত্তর দিল না।

এক মারোয়াড়ী ভদ্রলোক এই সময়ে পরমহংস মশাইকে একখানি গরদের কাপড় ও একটি বিকানিরের মিছরির থালা দিয়া প্রণাম করিয়া যান। থালাখানির মাঝখানে ডুমো ডুমো মিছরি দিয়া ভরতি করা। এখন সে রকম মিছরির থালা আর দেখিতে পাওয়া যায় না। খুব উৎকৃষ্ট জিনিস বলিয়াই মারোয়াড়ী ভদ্রলোকটি উহা পরমহংস মশাইকে দিয়াছিলেন। নরেন্দ্রনাথ ইহার দুই-এক দিন পরে দক্ষিণেশ্বরে যায়। পরমহংস মশাই জিদ করিতে লাগিলেন, "গরদের কাপড়, মিছরির থালা তুই নিয়ে যা।" নরেন্দ্রনাথ তাঁহার কথায় কিছুতেই সম্মত হইল না। অবশেষে পরমহংস মশাই বলিলেন, "তুই গরদখানা নে, তোর মা পরে আহ্নিক করবেন!" এই কথা শুনিয়া নরেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সে ভাবিতে লাগিল - ঠিক কথাই তো, বাড়িতে ঠিক এই কথাই তো হইয়াছিল। তখন সে আপত্তি না করিয়া নীরব হইয়া রহিল। কিন্তু জিনিসটি নিজে হাতে লইল না, চলিয়া আসিল।

দুই-এক দিনের মধ্যেই পরমহংস মশাই রামলালদাদাকে বলিলেন, "রামলাল, তুমি শীগ্গির করে খেয়ে নাও। এই গরদখানা আর মিছরির থালাখানা শিমলেয় গিয়ে নরেনের মা'র হাতে দিয়ে আসবে, অপরের হাতে দিও না।"

রামলালদাদা তাঁহার নির্দেশমতো শিমলায় আসিলেন। তখন গরমিকাল, বড় রৌদ্র, বেলা এগারোটা হইয়া গিয়াছিল। তিনি আসিয়া আমাকে বাহিরের ঘরে ডাকিয়া সমস্ত কথা বলিলেন। আমি অগত্যা মাকে ডাকিয়া আনিলাম। রামলালদাদা মা'র কাছে সমস্ত কথা বলিয়া তাঁহার হাতে সেই গরদের কাপড়খানি ও মিছরির থালাখানি দিলেন। মা হাসিয়া বলিলেন, "এখানে কথা হয়েছে, আর দক্ষিণেশ্বরে তখনই টেলিগ্রাফ হল!"

অবশেষে আমাদের সংসারে অতিশয় কষ্ট আসিল। নরেন্দ্রনাথ তাহাতে একেবারে বিচলিত হইয়া পড়িল। কি উপায়ে সে যে সংসার চালাইতে পারিবে, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া একেবারে বিষণ্ণ হইয়া পড়িল। এই সময় সে কাহারো সহিত মিশিত না। তাহার পূর্বকার প্রফুল্ল ভাব একেবারে চলিয়া গেল; সে ম্লান হইয়া পড়িল। একদিন সে দক্ষিণেশ্বরে পরমহংস মশাইকে বলিল, "আপনি মাকে বলুন, যাতে আমার মা-ভাইদের খাওয়া-পরার কষ্ট দূর হয়। এত কষ্ট আর সহ্য করা যায় না!" পরমহংস মশাই বলিলেন, "তুই মা কালীকে প্রণাম করে যা চাইবি, তাই পাবি।" নরেন্দ্রনাথ কালীর মন্দিরে যাইয়া সংসারের অভাবমোচনের জন্য মা কালীর কাছে প্রার্থনা করিবে, এইরূপ মনস্থ করিয়া পরমহংস মশাই-এর ঘর হইতে বাহির হইল। উঠান দিয়া যাইবার সময় সে এক প্রকার গাঢ় নেশায় অভিভূত হইয়া পড়িল। মন্দিরে যাইয়া মা কালীকে প্রণাম করিয়া সংকল্পিত ইচ্ছাসকল ভুলিয়া গিয়া বলিতে লাগিল, "মা, আমায় বিবেক-বৈরাগ্য দাও।" তাহার পর, পরমহংস মশাই-এর ঘরে ফিরিয়া আসিলে তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "কি রে, মা'র কাছে প্রার্থনা করেছিস?" নরেন্দ্রনাথ বলিল, "মশাই, ভুলে গেছি।" পরমহংস মশাই বলিলেন, "যা, ফের যা।" নরেন্দ্রনাথ পুনরায় গিয়া সকল কথা ভুলিয়া গিয়া বলিল, "মা, আমায় বিবেক-বৈরাগ্য দাও।" নরেন্দ্রনাথ মন্দির হইতে ফিরিয়া আসিলে পরমহংস মশাই পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, "কিরে, বলেছিস তো?" নরেন্দ্রনাথ উত্তর করিল, "না মশাই, ভুলে গেছি।" পরমহংস মশাই পুনরায় তাহাকে মন্দিরে মা কালীর কাছে যাইয়া প্রণাম করিয়া প্রার্থনা করিতে বলিলেন। নরেন্দ্রনাথও তাঁহার নির্দেশমতো মন্দিরে গিয়া প্রার্থনা করিল; কিন্তু সেই একই প্রার্থনা - "মা, আমায় বিবেক-বৈরাগ্য দাও।" মন্দিরের বাহিরে আসিয়া সে ভাবিল, নিশ্চয়ই পরমহংস মশাই-এর জন্য এইরূপ ভুল হইতেছে। পরমহংস মশাই-এর কাছে ফিরিয়া আসিয়া সে বলিল, "আমি মা কালীকে প্রণাম করতে গিয়ে সব ভুলে গেলুম, এখন আপনাকে মাকে জানাতে হবে।" এইরূপ করিবার জন্য পরমহংস মশাইকে সে ধরিয়া বসিল। পরমহংস মশাই তখন বলিলেন, "তা আমি কি করবো? তুই বলতে পারলি নি, তোর মনে এল না? - ওরে, তোর অদেষ্টে সংসার-সুখ নেই, তা আমি কি করবো! যা হোক, তোদের সংসারে মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না।"

নরেন্দ্রনাথ ইহার পর হইতে সংসারের জন্য আর চিন্তা করিত না বা করিবার সামর্থ্যও তাহার ছিল না। সংসারের কষ্ট আরো ভীষণ হইয়া উঠিল। নরেন্দ্রনাথ পরমহংস মশাইকে সংসারের কোনো কিছু কথা আর না বলিলেও, পরমহংস মশাই কিন্তু মনে মনে এ বিষয় চিন্তা করিতেন, এবং অপরের কাছে নরেন্দ্রনাথের সংসারের অনটনের কথা বলিয়া দুঃখ করিতেন। নরেন্দ্রনাথের সংসারের অতিশয় কষ্ট জানিয়া মাস্টারমশাই1 এই সময় একশত টাকা দিয়াছিলেন। তাহাতে মাসতিনেক কোনো রকমে চলিয়াছিল। এই জন্য পরলোকগত মাস্টারমশাই-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। এ কথা অপর কেহই জানেন না। এখন এ সকল কথা অপ্রকাশিত রাখিবার প্রয়োজন নাই।

ভবিষ্য জীবনে নরেন্দ্রনাথ যে কি করিবে, তাহা এ সময়ে সে স্থির করিতে পারিতেছিল না। বাহ্যিক ও আনুষঙ্গিক ঘটনাসমূহ এক প্রকার, আবার নিজের ভিতরটা আর এক প্রকার জিনিস চাহিতেছে। এইরূপ সংযোগক্ষেত্রে সে যে কোন্ পথে যাইবে, তাহা বুঝিতে পারিতেছিল না। পরমহংস মশাই কিন্তু তাহার ভবিষ্য জীবন সম্বন্ধে একটু আভাস দিয়াছিলেন। কালীর মন্দিরে প্রার্থনারূপ ব্যাপারটি নরেন্দ্রনাথের জীবনের স্রোত এক বিশেষ দিকে ফিরাইয়া দিয়াছিল। নরেন্দ্রনাথ মা কালীকে প্রণাম করিয়া যাহা আকাঙ্ক্ষা করিয়াছিল তাহাই তাহার ভবিষ্য জীবনে ফলিয়াছিল। আর পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথের বিষয় যাহা ইঙ্গিত করিয়াছিলেন, তাহাও সত্য হইয়াছিল। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ তখন বুঝিতে পারে নাই যে, তাহার ভবিষ্য জীবন কিরূপ হইবে বা তাহাকে কি কাজ করিতে হইবে।

সামান্য নরেন্দ্রনাথ কি করিয়া বিশ্ববিশ্রুত বিবেকানন্দ হইল - এ বিষয়টি বিশেষ করিয়া চিন্তা করা আবশ্যক। বিবেকানন্দের জীবনের প্রত্যেক ঘটনা বা প্রত্যেক সোপান, বিবেকানন্দের মনোবৃত্তির পরিবর্তন, প্রভৃতি সকল বিষয় বিশেষ করিয়া অনুধ্যান করা আবশ্যক। বিবেকানন্দ আকাশ হইতেও পড়েন নাই বা এক দিনেও তৈয়ার হন নাই। জীবনে উচ্চে উঠিতে হইলে, ধাপে ধাপে উঠিতে হয়। নানা প্রকার ঝঞ্ঝা ও বিপদ, নানা প্রকার বাধা-অন্তরায় অতিক্রম করিয়া উচ্চে উঠিতে হয়। এই ঝঞ্ঝা ও বিপদ বা অন্ধকারে কাহারো কিছু ভয় করিবার নাই। জীবনের স্রোত এই রকমই হইয়া থাকে, হতাশ হইবার কারণ নাই। জীবনের পথ অতীব কণ্টকাকীর্ণ, দুর্গম ও অন্ধকারময়। প্রত্যেককেই এই পথ দিয়া চলিতে হয়। কিন্তু একাগ্রতা ও আত্মনির্ভরতা থাকিলে, সাধারণ লোকেও অনেক উচ্চে উঠিতে পারে।

পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথকে যে কি চক্ষে দেখিতেন, তাহা আরো দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করিলেই বুঝা যাইবে।

এক দিন একজন লোক পরমহংস মশাইকে বলিয়াছিলেন, "আপনি নরেনকে এত ভালবাসেন কেন? নিজের ছোট হুঁকোয় করে নরেনকে তামাক খেতে দিলেন, হুঁকোটা যে এঁটো হয়ে গেল। ও যে হোটেলে খায়, ওর এঁটো কি খেতে আছে?" এইরূপ মাতব্বরী করিয়া তিনি কথা বলিতে লাগিলেন। পরমহংস মশাই তাঁহার কথা শুনিয়া বড় বিরক্ত হইয়া বলিলেন, "ওরে শালা, তোর কি রে? নরেন হোটেলে খাক বা যাই খাক, তাতে তোর কি? তুই শালা যদি হবিষ্যিও খাস, আর নরেন যদি হোটেলে খায়, তা হলেও তুই নরেনের সমান হতে পারবি নি।" এইরূপ তাঁহাকে খুব ভর্ৎসনা করিলেন।

এক দিন এক মারোয়াড়ী ব্যক্তি পরমহংস মশাইকে খুব ভাল কালাকান্দ বরফি দিয়া যান। যুবা যোগেন বলিল, "দিন না মশাই, আমি খাব।" পরমহংস মশাই বলিলেন, "ওদের সংকল্প করা জিনিস, ও খাস নি পেট ছেড়ে দেবে; ও শুধু নরেন খেতে পারে।" যুবা যোগেন বলিল, "আমরা সব খেতে পারি, আমাদের ওতে কিছু আসে যায় না। নরেন কায়েতের ছেলে, ও যদি খেয়ে সহ্য করতে পারে তো, আমরা সাবর্ণ-চৌধুরী2 বামুন, জমিদার, সব সহ্য করতে পারি।"

যোগেনের বাড়ি কালীমন্দিরের নিকটেই ছিল। একদিন যোগেনের পিতা চৌধুরী মশাই, মন্দিরের বাগানে আসিয়া নেবু তুলিয়া লইতে ছিলেন। পরমহংস মশাই জিজ্ঞাসা করিলেন, "যোগেন আসে না কেন?" চৌধুরী মশাই বলিলেন, "তার পেট ছেড়ে দিয়েছে, তাই নেবু নিয়ে যাচ্ছি।"

কয়েক দিন পর যুবা যোগেন আসিলে, পরমহংস মশাই বলিলেন, "দেখলি, মারোয়াড়ীদের সংকল্প করা জিনিস খেলে পেট ছেড়ে দেয়!"

মারোয়াড়ীদের সংকল্প করা জিনিস পরমহংস মশাই নিজেও খাইতেন না এবং একমাত্র নরেন্দ্রনাথ ব্যতীত আত্মগোষ্ঠীর অপর কাহাকেও দিতেন না। তিনি বলিতেন, "নরেন খেতে পারে; ওর ভেতরে আগুন জ্বলছে, কাঁচা কলাগাছ দিলেও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।"

আর একটি ঘটনার উল্লেখ করিতেছি।

হৃদু মুখুজ্যের কাছে শুনিয়াছিলাম যে, পরমহংস মশাই বলিয়াছিলেন, "দেখ্, যখন আমি খাবারের আগভাগ অপরকে দিয়ে খাব, তখন জানবি যে আমার দেহ আর বেশি দিন থাকবে না।" এই কথা শ্রীশ্রীমাঠাকরুন3 ও হৃদু মুখুজ্যে জানিতেন। পরমহংস মশাই নিজের আহার করিবার জিনিস নিবেদন করিয়া প্রথমে নিজে আগভাগ লইতেন, পরে অপরকে দিতেন। হৃদু মুখুজ্যে বলিয়াছিলেন, "এক দিন নরেন দক্ষিণেশ্বরে গেছে। বিকেলে মামাকে জল খাওয়ার জন্যে গুটিকতক সন্দেশ দেওয়া হয়েছে। মামা আগে নরেনকে সন্দেশ খেতে দিলেন। আমার বুকটা কেঁপে উঠল। আমি বুঝতে পারলুম, তিনি আর দেহ রাখবেন না। এই কথা মাঠাকরুনকে জানালুম; তিনিও বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। পরে দেখলুম, তাঁর কথা ঠিক হয়েছে। অল্প দিন পরেই তিনি অসুস্থ হলেন; তাঁর দেহ গেল।" হৃদু মুখুজ্যে বড় ব্যথিত হইয়া এই বিষয়টি আমাকে কয়েক বার বলিয়াছিলেন। এ স্থলে জানা আবশ্যক যে, পরমহংস মশাই অপর কাহাকেও খাবারের আগভাগ দেন নাই।

হৃদু মুখুজ্যের কথাবার্তা শুনিয়া ও ভাব-ভঙ্গী দেখিয়া বুঝিয়াছিলাম যে, পরমহংস মশাই যেন নরেন্দ্রনাথের ভিতর আপনার প্রতিবিম্ব, প্রতিরূপ বা সত্তা দর্শন করিয়াছিলেন। সেইজন্য অপর দেহকে বা দেহের অভ্যন্তরস্থিত সত্তাকে খাদ্যদ্রব্য প্রদান করিয়াছিলেন। ইহা যে ভুল, এ কথা বলা যায় না। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হইল, নিজের দেহ বা আধার চলিয়া যাইলে, নিজ সত্তাকে অপর আধার বা শরীরে বিদ্যমান রাখা। ইহা হইল Continuance of one's own existence - নিজ সত্তার ধারাবাহিকতা। গুরুপরম্পরায় এই শক্তি আধার হইতে আধারে চলিয়া আসিতেছে, আসিবেও। ভালবাসা, স্নেহ-মমতা, কৃপা করা যাহাকে বলে, ইহা সেরূপ নয়। ইহা হইল Self-reflection - আত্মপ্রতিবিম্ব বা আত্মপ্রতীক সম্মুখে দেখা। একই শক্তি বা একই সত্তা, দুই আধারে সমানভাবে রহিয়াছে। একটি শক্তি অপর শক্তির প্রতিবিম্ব মাত্র, ভিন্ন আধারে অবস্থান করিতেছে মাত্র। এইজন্য পরমহংস মশাই নিজ আহারের আগভাগ নরেন্দ্রনাথকে দিয়াছিলেন। সাধারণ লোকে ইহাকে বাহ্যিক অনুষ্ঠান বা প্রক্রিয়া মাত্র বলিয়া বুঝিবে। কিন্তু চিন্তা করিলে ইহার ভিতর যে নিগূঢ় অর্থ আছে, তাহা বেশ স্পষ্ট বুঝা যায়। "প্রবর্তিতো দীপ ইব প্রদীপাৎ" অর্থাৎ একটি প্রদীপ হইতে অপর একটি প্রদীপ জ্বালাইয়া লইলে, উভয়ের মধ্যে যেমন কোনো পার্থক্য থাকে না ইহাও ঠিক সেইরূপ।

পরমহংস মশাই যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই হইল। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে, গরমিকালে পরমহংস মশাই-এর শরীর অসুস্থ হয়। চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে দক্ষিণেশ্বর হইতে কলিকাতায় আনা হইল। প্রথমে বলরামবাবুর বাড়িতে ও শ্যামপুকুরের একটি বাড়িতে তাঁহাকে আনিয়া রাখা হইয়াছিল। শেষকালে, তাঁহাকে কাশীপুরের বাগানে আনা হয়। প্রকৃতপক্ষে কাশীপুরের বাগানেই পরমহংস মশাই-এর আত্মগোষ্ঠী বিশেষরূপে গড়িয়া উঠিয়াছিল। এই গোষ্ঠী, ত্যাগী ভক্ত ও সাধারণ ভক্ত, এই দুই ভাগে বিভক্ত হইয়াছিল। পরে ইঁহারা সন্ন্যাসী ও গৃহী ভক্ত নামে অভিহিত হন। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে, এই কাশীপুরের বাগানেই পরমহংস মশাই দেহরক্ষা করেন।


1. শ্রীযুত মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত।

2. সাবর্ণি গোত্র।

3. শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী, শ্রীসারদামণি দেবী।

No comments:

Post a Comment