Saturday, April 28, 2018

প্রদর্শিকা

'অব্যক্ত' বা 'অখণ্ড' শক্তি মানুষের বোধের অতীত। অখণ্ড শক্তির বিষয় আমরা চিন্তা করিতে পারি না, কিন্তু তাহার সহিত একীভূত হইয়া যাইতে পারি। অব্যক্ত বা অখণ্ড শক্তিকে আমরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া থাকি কারণ মানুষের চিত্তে এইরূপ তিন অবস্থা হয়। অবশ্য ইহা আমাদের কল্পনা মাত্র। অখণ্ড শক্তির নিম্ন-স্তর হইল শক্তির সাম্য-অবস্থা - Equilibrium state of Energy। সাম্য অবস্থার নিম্ন-স্তর হইল চঞ্চল অবস্থা - Active state of Energy। চঞ্চল অবস্থা হইতে পার্থক্য দেখাইবার জন্য সাম্য অবস্থা বলা হয়; যেন চঞ্চল অবস্থা ধীরে ধীরে উপশান্ত হইয়া অখণ্ড-ভাব আসিবার উপক্রম হইতেছে। অখণ্ড ও খণ্ড - এই দুই ভাগের মধ্যবর্তী অবস্থাকে সাম্য-অবস্থা বলা হয়। সাম্য-অবস্থা পর্যন্ত এক প্রকার চিন্তাশক্তি থাকে; তাহার পর চিন্তাশক্তি বিলুপ্ত হয়। 'চিন্তা' হইল বিভিন্ন কম্পন বা প্রকম্পনের পরিমাণ, দ্বিধাবিভক্ত বা নানা খণ্ডে বিভক্ত এবং দেশ-কাল-নিমিত্তের অন্তর্ভুক্ত। এইজন্য চিন্তা সেখানে চলিতে পারে না।

শক্তির চঞ্চল বা সক্রিয় অবস্থা হইতেই শক্তির বিষয় আমাদের কিঞ্চিৎ বোধগম্য হয়। এই সক্রিয় শক্তি বহু ভাগে বিভক্ত হইয়া যায়, যেন এক-একটি যতি বা রেখা বা সূত্র প্রধাবিত হইতেছে। শক্তি যখন সক্রিয় বা চঞ্চল-ভাবে থাকে, তখন ইহার প্রধাবমান অবস্থা হইতে স্পন্দন উদ্ভূত হয়। এই স্পন্দন হইতে 'গুণ' উদ্ভূত হয়; এবং গুণ, দুই-এর অধিক বিন্দুতে বা ক্ষেত্রে সমাহিত হইলেই 'রূপ' বা 'অবয়ব' বা 'পরমাণু' সৃষ্টি হয়, ইহাকে রূপ বা অবয়বের অবস্থা বা পরমাণুর অবস্থা বলা হয়। একরৈখিক বা একমাত্রিক পরমাণু আমাদের চিন্তার অতীত। দুই-রেখা-যুক্ত বা দুইমাত্রাবিশিষ্ট পরমাণুও আমাদের চিন্তার অতীত। তিন রেখা বা তিন মাত্রাযুক্ত পরমাণুই আমাদের চিন্তার গোচর, কিন্তু ইহা আমরা দেখিতে পাই না। এইজন্য এই পরমাণুকে 'চিৎ-জড়-গ্রন্থি' বলা হয়। ইহা একভাবে হইল 'চিৎ', অপরভাবে হইল 'জড়'। অবয়ব আছে, এইজন্য 'জড়' বলা হইল কিন্তু অবয়ব দেখিতে পাওয়া যায় না, কেবল চিন্তাশক্তির অধীন, এইজন্য ইহাকে বলা হইল 'চিৎ'।

এইরূপে সক্রিয় শক্তি বহু ভাগে বিভক্ত হইয়া স্পন্দিত হওয়ায় পরমাণু উৎপন্ন হয়। পরমাণু হইল a bit of Energy enveloped with Energy and is propelled by Energy, অর্থাৎ পরমাণু - শক্তির এক কণা, শক্তির দ্বারা আবরিত এবং শক্তির দ্বারা প্রধাবিত। অর্থাৎ 'জড়' ও 'চেতন' একই বস্তু, কেবল প্রক্রিয়া ও বিকাশের তারতম্যে ভিন্ন বলিয়া মনে হয়। য়ুরোপীয় দার্শনিক মতে 'জড়' এক বস্তু এবং 'চেতনা' বা 'শক্তি' অপর এক বস্তু। কিন্তু এ স্থলে দেখা যাইতেছে যে 'চেতন' বা 'শক্তি' ও 'জড়' একেরই নামান্তর, কোনো প্রভেদ নাই। একটি হইল পরিদৃশ্যমান, অপরটি হইল অতীন্দ্রিয়গ্রাহ্য, এই মাত্র প্রভেদ।

প্রকম্পনই হইল সৃষ্টির আদি কারণ।

প্রত্যেক পরমাণুর অবিরত কম্পন বা প্রকম্পন হইতেছে। 'দেহ' হইল প্রকম্পমান পরমাণুর স্রোত; উহা বহির্দেশ হইতে বহু ছিদ্র দিয়া এক কেন্দ্রে আগমন করিতেছে, এবং বহু ছিদ্র দিয়া অপসারিত হইতেছে। প্রত্যেক পরমাণু নূতনভাবে আসিতেছে এবং পুরাতন সকল পরমাণুই পরিবর্তিত হইতেছে। অনবরত এই পরিবর্তনের মধ্যে যাহাই স্থিত, তাহাকেই 'দেহ' বলিয়া থাকি।

পরমাণুপুঞ্জ একত্রিত হইয়া এক রেখায় অবস্থান করিলে তাহাকে 'স্নায়ু' বলা হয়। খড়ের আঁটি যেমন একত্রীভূত করিয়া রাখা হয়, স্নায়ুপুঞ্জ ঠিক সেইরূপ অবস্থান করে। স্নায়ুপুঞ্জকে স্তরে স্তরে বিভক্ত করা যাইতে পারে; যেমন, স্থূল-স্নায়ু, সূক্ষ্ম-স্নায়ু, কারণ-স্নায়ু, মহাকারণ-স্নায়ু প্রভৃতি অনেক প্রকার। স্থূল-স্নায়ু, অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ু হইতে ক্রমে ক্রমে ঘনীভূত হইয়া উদ্ভূত হয়।

প্রত্যেক স্নায়ু এক এক প্রকার উদ্দেশ্যে বা এক এক প্রকার ক্রিয়ার জন্য গুণবিশিষ্ট হইয়াছে। দুই গুণ বা দুই ক্রিয়া এক স্নায়ুতে হইতে পারে না।

স্নায়ু হইল অন্তঃশূন্য। অন্তঃশূন্য হইলেও কিন্তু শূন্য স্থানে অতিসূক্ষ্ম পরমাণুসমূহের প্রকম্পন বা ধ্বংসন হওয়ার জন্য উহাদিগের অন্তর্নিহিত শক্তি বিকাশ পায়। এক বা বহু স্নায়ু হইতে এইরূপ শক্তিরেখা বহির্গত বা সঞ্চালিত হওয়ায়, একটি স্রোত বা প্রবাহ সৃষ্টি হয়। এই স্রোত বা প্রবাহ হইল 'মন'।

ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রমতে 'মন' ছয়টি স্তরে বিভক্ত। ইহাদিগকে 'লোক' বলা হয়। ইহাদের মধ্যে প্রথম পাঁচটি, যথা - কামলোক, রূপলোক, ভাবলোক, জ্ঞানলোক ও আনন্দলোক। সর্বোচ্চ স্তর হইল 'অনুত্তর সম্যক্ সম্বোধি' বা 'পূর্ণ পরাজ্ঞান'-এর অবস্থা।

আমরা মনকে যে প্রকার স্নায়ু - স্থূল, সূক্ষ্ম, অতিসূক্ষ্ম, কারণ, মহাকারণ প্রভৃতির ভিতর দিয়া প্রধাবিত করিতে সমর্থ হই, অব্যক্ত বা অখণ্ড শক্তিকেও ঠিক সেইরূপ আখ্যা দিয়া থাকি বা বর্ণনা করিয়া থাকি। সেইজন্য যাহা অখণ্ড, তাহাও পরিশেষে খণ্ড বা জড়বৎ বলিয়া পরিদৃশ্যমান হয়; আর এইজন্য বিভিন্ন ব্যক্তির চিন্তাধারা ও মনোবৃত্তির মধ্যে এত তারতম্য দৃষ্ট হইয়া থাকে।

স্নায়ুর স্পন্দনের অতীত যে কি আছে বা কি অবস্থা, তাহা আমাদের বোধগম্য বা ধারণা হইতে পারে না; কারণ আমাদের সমস্ত জ্ঞান ইন্দ্রিয়গোচর বা অতীন্দ্রিয় যাহাই হউক না কেন, কোনো-না-কোনো স্নায়ু-প্রকম্পন দ্বারা উপলব্ধ হয়। যিনি যে পরিমাণে মনকে সূক্ষ্ম স্নায়ুর ভিতর দিয়া প্রধাবিত করিতে পারিবেন বা সূক্ষ্ম-স্নায়ু জাগ্রত করিতে পারিবেন, তিনি সেই পরিমাণে বিশাল ভাব উপলব্ধি করিতে পারিবেন। যিনি যে পরিমাণে মনকে স্থূল-স্নায়ু দিয়া প্রধাবিত করিবেন বা স্থূল-স্নায়ুতে অবস্থান করিবেন অর্থাৎ মনকে স্থূল-স্নায়ুতে রাখিবেন, তিনি সেই পরিমাণেই বিচ্ছিন্ন ও নিকৃষ্ট ভাবে জগৎকে দেখিতে থাকিবেন। এই সকল কারণে মনকে 'উচ্চ' বা 'নীচ' শব্দে বিভক্ত করা হয়।

মোট কথা, চেষ্টা বা শক্তি নিয়োগ, চলিত কথায় যাহাকে 'সাধনা' বলা হয়, তাহার দ্বারা যিনি যত স্নায়ু জীবিত বা সজীব করিতে পারিবেন বা রুদ্ধ স্নায়ুমুখসমূহ উদ্ঘাটন করিতে পারিবেন এবং উহাদিগের অভ্যন্তরস্থিত নালীর ভিতর দিয়া অতিসূক্ষ্ম পরমাণুসমূহের সাহায্যে শক্তি প্রধাবিত করিতে পারিবেন তাঁহার মনোবৃত্তি বা মনের পরিধি সেই প্রকার হইবে।

এই কয়েকটি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মত স্মরণ রাখিয়া পরমহংস মশাই-এর ক্রিয়াকলাপ অনুশীলন করিলে, আমরা তাঁহাকে এক আশ্চর্য ব্যক্তিরূপে দেখিতে পাই।

No comments:

Post a Comment