Sunday, April 15, 2018

সবিকল্প সমাধিতে

রামদাদার বাড়ির উঠানে পরমহংস মশাই-এর কীর্তনকালে, রামদাদা ও মনোমোহনদাদা অঙ্গসঞ্চালন করিয়া ও ভজনগান করিয়া ভাবকে প্রবুদ্ধ করিবার ও মনকে ঊর্ধ্বে তুলিবার চেষ্টা করিতেন। শারীরিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে তাঁহারা মনকে ভাবরাজ্যে বা ভাবলোকে তুলিবার প্রয়াস পাইতেন। ইহাই সাধারণ কীর্তনের প্রথা। কিন্তু পরমহংস মশাই-এর কীর্তনের মধ্যে অন্য এক প্রকার ভাব দেখিতাম। ভাবের আধিক্য হওয়ায় তাঁহার অঙ্গসঞ্চালন হইত; ভাবরাশি তাঁহার স্নায়ুপুঞ্জকে পরিপূর্ণ করিত। দেহ ভাবরাশির শক্তি ধারণ করিতে পারিত না বলিয়া, কখনো বা অঙ্গসঞ্চালন হইত, কখনো বা দেহ নিস্পন্দ হইয়া যাইত। সেই সময় তাঁহার মুখ হইতে এক প্রকার আভা বাহির হইত। মুখের শ্রী যেন দেখিতে ইচ্ছা করিত কিন্তু তাহা এত গম্ভীর, উচ্চ ও অসাধারণ যে, তাহা অনেকক্ষণ দেখিতেও পারা যাইত না। সেই সময় কেহ তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারিত না বা তাঁহার কাছেও অগ্রসর হইতে পারিত না। দেখিতাম যে, তিনি কীর্তনের সময় ভাবলোকের বিষয় শব্দ না দিয়া অঙ্গসঞ্চালন করিয়া প্রকাশ করিতে প্রয়াস পাইতেন। ভাবসকল যেন পুঞ্জীভূত ও জীবন্ত হইয়া তাঁহার দেহ বা সূক্ষ্ম-স্নায়ুপুঞ্জের ভিতর প্রবেশ করিত এবং সেইজন্য তাঁহার অঙ্গসঞ্চালন হইত। অঙ্গসঞ্চালন দ্বারা যে মনের উচ্চতর ভাব প্রকাশ করা যায়, তাহা এই প্রথম দেখিয়াছিলাম। গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যেরও ঠিক এইরূপ হইত।

সাধারণ লোকের কীর্তন হইল 'গতি' হইতে 'ভাব'-এ - From Motion to Ideas. পরমহংস মশাই-এর কীর্তন হইল ভাব হইতে গতিতে - From Ideas to Motion. এইজন্য সাধারণ লোকের কীর্তন ও নৃত্যের সহিত তাঁহার কীর্তন ও নৃত্যের বিশেষ পার্থক্য আছে। সাধারণ লোকের নৃত্য হইল 'নরনৃত্য'। পরমহংস মশাই-এর নৃত্য হইল 'দেবনৃত্য', যাহাকে চলিত কথায় বলে 'শিবনৃত্য'। ইহার সহিত চপল ভাবের কোন সংস্রব নাই। ইহা হইল অতি উচ্চমার্গে অবস্থানের কথা বা উচ্চ অবস্থার কথা। এই নৃত্য দেখিতে দেখিতে সকলেই নিশ্চল ও বিভোর হইয়া যাইত, যেন, সকলের মনকে তিনি একেবারে ভাবলোকে লইয়া যাইতেন। অত লোক থাকিলেও কেহই কথাবার্তা বা নড়াচড়া করিতে পারিত না; সকলেই যেন নির্বাক, নিস্পন্দ পুত্তলিকার ন্যায় স্থির হইয়া থাকিত, সকলেই অভিভূত ও তন্ময় হইয়া পড়িত, সকলেরই মন তখন উচ্চ স্তরে চলিয়া যাইত। সাধারণ কীর্তনে চপল ভাব থাকে ও মনের গতি চঞ্চল হয় কিন্তু এই কীর্তনে সকলেই যেন স্থির হইয়া যাইত। চাঞ্চল্যের ভিতর - স্থির ভাব, স্পন্দনের ভিতর - নিস্পন্দ ভাব!

এই সময় পরমহংস মশাই-এর দেহ হইতে যেন আর একটি ভাবদেহ বিকাশ পাইত। ইহা যে কত উচ্চ অবস্থার বিষয়, তাহা কেহ নির্ণয় করিতে পারিত না; কিন্তু ইহা যে অতি উচ্চ অবস্থার বিষয় - এইটা সকলেই অনুভব করিত। পরমহংস মশাই যেন ভাবমূর্তি ধারণ করিতেন এবং স্বয়ং চাপ-জমাট ভাবমূর্তি হইয়া সকলের ভিতর অল্পবিস্তর সেই ভাব উদ্বোধিত করিয়া দিতেন। জীবন্ত ভাব কাহাকে বলে, আর কি করিয়া তাহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, তাহাই দেখিতাম। কীর্তনেও যে গভীর ধ্যান হয়, এইটি সর্বদাই অনুভব করিতাম। এইজন্য কীর্তনের সময়, কি গীত বা ভজন-গান হইত, গানের ভাষাই বা কি, তাহা কাহারো স্মরণ থাকিত না বা আনুষঙ্গিক অন্য কোনো ব্যাপারের বিষয়ও মনে থাকিত না। সকলের দৃষ্টি পরমহংস মশাই-এর প্রতি নিবদ্ধ থাকিত। পরমহংস মশাই কিরূপে স্তরে স্তরে নরকায় হইতে দেবদেহে যাইতেন এবং কিরূপে এই দেহের প্রক্রিয়া হয় বা শক্তি-বিকিরণ হয়, তাহাই সকলে লক্ষ্য করিতাম। বেশ স্পষ্ট দেখিতাম যে, সাধারণ মানুষের অবস্থা হইতে কয়েক মিনিটের ভিতর তিনি অপর এক ভাব ধারণ করিয়া অন্য এক ব্যক্তি হইয়া যাইতেন। মানুষের দেহের ভিতর হইতে ভাবদেহ বা দেবদেহ উদ্বুদ্ধ হইত; সর্বত্রই যেন এক মহাশক্তি বা স্পন্দন বিকীর্ণ হইত।

একটি বিষয় আমি বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিতাম যে, কীর্তনকালে পরমহংস মশাই-এর পদসঞ্চালন প্রথম যে পরিধির ভিতর হইত, তাহার পর উহা এক ইঞ্চি আগেও যাইত না বা পিছনেও যাইত না, ঠিক যেন কাঁটায় কাঁটায় মাপ করিয়া তাঁহার পদসঞ্চালন হইত।

বরাহনগর মঠে নরেন্দ্রনাথের এইরূপ পদসঞ্চালন দেখিয়াছিলাম। কোনো কার্যবশতঃ নরেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিবার জন্য আমি একদিন বিকালবেলা প্রায় চারটার সময় বরাহনগর মঠে যাই। গিয়া দেখিলাম যে, বাহিরের বারাণ্ডাতে নরেন্দ্রনাথ অনবরত পায়চারি করিতেছেন, - চক্ষু স্থির, দৃষ্টি উপরের দিকে, কোনো হুঁস নাই, যেন দেহ হইতে মন অনেকক্ষণ বাহির হইয়া গিয়াছে; অভ্যাসবশতঃ পা আপনিই চলিতেছে, নিয়মিত স্থানের মধ্যে পদবিক্ষেপ হইতেছে, একটুও এদিক-ওদিক হইতেছে না। এরূপ দেখিয়া আমার ভয় হইল। ভিতরকার দালানে গিয়া দেখিলাম সেখানে রাখাল মহারাজ, নিরঞ্জন মহারাজ1, শরৎ মহারাজ2 ও আর সকলে রহিয়াছেন। সকলেই মহা উদ্বিগ্ন, কি করিবেন যেন স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। নরেন্দ্রনাথ নাকি দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর হইতে এইরূপভাবেই পায়চারি করিতেছেন এবং কয়েক দিন ধরিয়া তিনি নাকি অনবরত জপ-ধ্যান করিতেছিলেন ও সবিকল্প-নির্বিকল্প সমাধি ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথাবার্তা ও আলোচনায় মগ্ন ছিলেন। রাখাল মহারাজ আমাকে একান্ত কাতরভাবে অনুনয় করিয়া বলিলেন, "ভাই, আমরা কেউ এগুতে সাহস পাচ্ছি না, তুমি সুমুখে গিয়ে খুব চেঁচামেচি করে নরেনের মনকে নামিয়ে আনো।" এই বলিয়া রাখাল মহারাজ আমাকে খুব অনুনয় করিতে লাগিলেন। এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিল তখনো নরেন্দ্রনাথের কোনো হুঁশ নাই, অগত্যা আমি খুব চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলাম। অনেকক্ষণ ধরিয়া ডাকিতে ডাকিতে ক্রমে তাহার পদবিক্ষেপ-গতি স্থগিত হইয়া আসিল। ধীরে ধীরে তার মন দেহে ফিরিয়া আসিল। অন্য কোনো সময় নরেন্দ্রনাথের এইরূপ অবস্থা হইয়াছিল কিনা আমার জানা নাই।

বৌদ্ধ গ্রন্থে আছে যে, ভগবান বুদ্ধদেব সিদ্ধ হইয়া সাত দিন এবং সাত রাত্রি একস্থানে পদসঞ্চালন করিয়াছিলেন, তাহার পর তাঁহার দেহ শ্রান্ত হইয়া ভূমিতে পড়িয়া যায়। ইহাকে 'চঙ্ক্রমণ' বলে। চঙ্ক্রমণ অর্থে পায়চারি করা বুঝায়। চলিত বাংলায় ইহাকে 'চানকানো' বলে। বুদ্ধদেবের চঙ্ক্রমণের স্থানে বুদ্ধগয়ার মন্দিরে একটি লম্বা পিল্পা গাঁথা আছে। বৌদ্ধ গ্রন্থে বলা হইয়াছে যে, বুদ্ধদেবের এক একটি পদবিক্ষেপে এক একটি পদ্মফুল ফুটিয়া উঠিয়াছিল। 'পদ্ম' অর্থে 'ধর্ম' বুঝায়। এইজন্য পরবর্তী কালে ভক্তেরা ইহার নানারূপ অলৌকিক ব্যাখ্যা করিয়াছেন। কিন্তু স্নায়ুবিজ্ঞান ও রাজযোগে ইহাকে এক প্রকার সবিকল্প সমাধি বলা হয়।

এইরূপ সবিকল্প সমাধির লক্ষণ হইল যে পদবিক্ষেপের পরিমাপ প্রথম বারে যতখানি হয়, পরে তাহা অতিক্রম করিয়া এক ইঞ্চিও আগুপাছু হয় না। এইরূপ অবস্থায় সর্বত্রই সাম্যস্পন্দন হইয়া থাকে। শরীরের স্নায়ুপুঞ্জের যেরূপ স্পন্দন হয়, পদবিক্ষেপেও সেইরূপ স্পন্দন হইয়া থাকে। আর একটি লক্ষণ হইল যে, চোখের দৃষ্টি অন্য প্রকার হইয়া যায়। চোখের তারা এমন অবস্থায় আসে যে, তাহাতে দৃষ্টি অন্তর্মুখী হইয়া যায়। এই অবস্থায় মন বা চিন্তাশক্তি শরীরের বিভিন্ন স্থূল-স্নায়ুপুঞ্জ স্তরে স্তরে ত্যাগ করিয়া, অতি সূক্ষ্মস্নায়ু বা সূক্ষ্মতম স্নায়ুতে চলিয়া যায়। এইজন্য স্থূল-স্নায়ু বা বিকাশমুখী স্নায়ুর কোনো প্রক্রিয়া থাকে না; কেবল প্রথম অবস্থায় যেরূপভাবে পদসঞ্চালন বা দেহের ক্রিয়াদি হয়, তাহাই থাকিয়া যায় - যাহাকে Initial impetus বা প্রাথমিক আবেগ বা শক্তি-প্রয়োগ করা বলা হয়, সেইটুকুই থাকিয়া যায়।

পরমহংস মশাই-এর কীর্তনও ঠিক এইরূপ। ইহা সাধারণ কীর্তনের মতো নহে - সকলে মিলিয়া উল্লম্ফন, আবর্তন, হস্তাদি সঞ্চালন, প্রভৃতি ব্যাপার নহে। এই কীর্তনকালে, উপস্থিত সকল লোকই দূরে দাঁড়াইয়া দেখিত মাত্র। এই কীর্তন হইল - সবিকল্প সমাধি। এই সময় পরমহংস মশাই-এর ঘাড় ডান দিকে একটু বাঁকিয়া যাইত এবং তিনি হাত দুইটি সম্মুখে প্রসারিত করিয়া সুমুখ ও পিছনে চলাচল করিয়া স্থির হইয়া এক স্থানে দাঁড়াইয়া থাকিতেন, একেবারে নিস্পন্দ ও নিশ্চল! সবিকল্প সমাধি হইতে তিনি নির্বিকল্প সমাধিতে যাইতেন। সাধারণ ভাষায় ইহাই হইল পরমহংস মশাই-এর কীর্তন। কিন্তু ইহা সাধারণ কীর্তন নহে, ইহা এক স্বতন্ত্র ব্যাপার।

পরমহংস মশাই-এর এই কীর্তনের ব্যাপার লইয়া অনেক কথা বলা যাইতে পারে। কিন্তু ইহা কেবল বলিবার বা পড়িবার বিষয় নয়, চিন্তা বা ধ্যান করিবার বিষয়। এই কীর্তন সম্বন্ধে কিছু বুঝিতে হইলে, প্রত্যেককেই ইহা নিজে চিন্তা বা ধ্যান করিয়া উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিতে হইবে, কারণ ইহা ভাষার ব্যাপার নয়।


1. স্বামী নিরঞ্জনানন্দ।

2. স্বামী সারদানন্দ।

No comments:

Post a Comment