Thursday, April 5, 2018

ভাব দর্শনে

দর্শনশাস্ত্রের বা রাজযোগের সূত্র হইতেছে - The first impression of truth comes in the form of pictures অর্থাৎ 'সত্য' প্রথমে চিত্ররূপে সম্মুখে আসিয়া থাকে।

পরমহংস মশাই যখন মনকে অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে লইয়া যাইতেন, তখন তাঁহার নিকট জগৎ অন্যরূপে প্রতীয়মান হইত। এইজন্য অতি জটিল প্রশ্ন করিলেও তিনি নূতন সত্য বা ভাব সম্বন্ধে অনবরত বলিয়া যাইতেন। এ বিষয়ে একটি গল্প বলিতেছি। গল্পটি আমি চুনীলাল বসুর1 কাছে শুনিয়াছিলাম।

একবার শিখ সেপাইরা পরমহংস মশাইকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, "মশাই, আমরা সিপাইগিরি করি, মারপিট করাই আমাদের ব্যবসা, সরকারী হুকুমে আমাদের যাকে গুলি মারতে বলবে, তাকেই মারতে হবে। এরূপ অবস্থায় আমরা সংসারে কি রকমে থাকবো?" পরমহংস মশাই এই প্রশ্নটির বিষয় চিন্তা করিতেই দেখিতে পাইলেন যে, সম্মুখে একটি ঢেঁকি আসিয়া ধান ভানিতে লাগিল। পরমহংস মশাই সেপাইদের বলিলেন, "দেখ, ঢেঁকি যেন অনেক মাথা নাড়ে অনেক উঁচু-নীচু ওঠে, গড়ের ভিতর অনেক ধান ভানে, অনেক কাজ করে, কিন্তু দু-পাশের দুটো কাঠি দুটো খোঁটাতে আটকানো থাকে, তাতে কোনো ব্যতিক্রম হয় না - ঠিক এইভাবে মন রেখে কাজ করো।" এই উদাহরণ শুনিয়া শিখেরা খুব আনন্দ করিতে লাগিল। তাহারা বলিল যে এইরূপ উদাহরণ তাহারা কখনো শুনে নাই।

চিন্তা বা তর্ক-যুক্তি স্থূল অবস্থায় আবশ্যক হয়। একটি মন বলিতেছে - 'হ্যাঁ', অর্থাৎ সম্মতি দিতেছে। আর একটি মন বলিতেছে - 'না', অর্থাৎ আপত্তি তুলিতেছে। ইহা হইল দ্বন্দ্ব অবস্থা। এরূপ স্থলে তর্ক-যুক্তির আবশ্যক হয় কারণ, অনিশ্চিত ভাব বা সন্দেহ রহিয়াছে। এইরূপ অবস্থায় কখনই কোনো নির্ধারিত মীমাংসা হয় না। স্থূল-স্নায়ুর প্রক্রিয়ায় অনিশ্চিত ভাব থাকায় সন্দেহ ও দ্বিধা আসিয়া থাকে। ইহাই হইল তর্ক-যুক্তির কারণ। তর্ক-যুক্তি হইল নিম্নস্তরের বিষয়। কিন্তু সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা কারণ-স্নায়ু দিয়া চিৎ-শক্তি প্রধাবিত হইলে ভাবসকল বিগ্রহ বা মূর্তি ধারণ করিয়া সম্মুখে দাঁড়ায়। ইহা হইল 'ভাব-দর্শন' বা Visualisation of ideas।

পরমহংস মশাই-এর কথায় তর্ক-যুক্তি থাকিত না। তিনি স্পষ্টরূপে সকল ভাবই দেখিতেন এবং দৃষ্ট ভাবসমূহ ভাষা দিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিতেন, কিন্তু অনেক সময় ভাবগুলি এত সূক্ষ্ম কারণ বা মহাকারণ-স্নায়ুর অভ্যন্তরস্থিত শক্তি হইতে প্রতিবিম্বিত হইত যে, তিনি নিজে সেগুলি স্পষ্ট দেখিতে পাইতেন, কিন্তু তাহা বিকাশ করিতে পারিতেন না।

সাধারণতঃ লোকে প্রথমে গ্রন্থাদি পাঠ করে, তাহার পর তর্ক-যুক্তি করে, অবশেষে মীমাংসায় আসিয়া থাকে এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতি বা দর্শন করিতে প্রয়াস পায়। প্রচলিতরূপে তর্ক-যুক্তি করিয়াই সাধারণত লোকে ক্ষান্ত হয় এবং মনে করে যে, এইরূপ করায় একটি বড় কাজ হইল। কিন্তু দর্শনের কাছে এই সকল তর্ক-যুক্তি বালকোচিত চাপল্যের মতো বোধ হয়। Philosophy বা 'জ্ঞান-লিপ্সা' হইল গ্রীকদিগের ব্যবহৃত শব্দ। ভারতীয়দিগের ব্যবহৃত শব্দ হইল - 'দর্শন', অর্থাৎ যাহা স্পষ্ট দেখা যায়। এইজন্য কতকগুলি গ্রন্থ পাঠ করিলেই বা তর্ক-যুক্তি করিলেই 'দর্শন' হয় না, বা 'দার্শনিক'-ও হওয়া যায় না। ভাবসমূহকে যিনি স্পষ্ট দেখেন, তিনিই 'দার্শনিক'। পরমহংস মশাই ছিলেন অতি উচ্চ অবস্থার দার্শনিক।


1. অপর নাম নারায়ণ।

No comments:

Post a Comment