পরমহংস মশাই-এর দূর হইতে দর্শন, শ্রবণ প্রভৃতি করিবার শক্তি প্রবল ছিল। তাঁহার এই শক্তি অনেকেই দেখিয়াছেন। এ বিষয়ে অনেক উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু এ স্থলে দু-একটি মাত্র উল্লেখ করিতেছি।
স্বামী সারদানন্দের নিকটে শুনিয়াছিলাম যে, শ্যামপুকুরে অবস্থানকালে পরমহংস মশাই নাকি একটি জ্যোতি বা আলোক-রেখা দ্বারা সুরেশ মিত্তিরের বাড়ি দুর্গাপূজা দেখিয়াছিলেন।
পরমহংস মশাই যে আমার মা'র জন্য গরদের কাপড় ও মিছরির থালা পাঠাইয়াছিলেন, তাহাও এ স্থলে উল্লেখযোগ্য।
সাধারণতঃ, আমরা কতিপয় স্থূল-স্নায়ু দিয়া দর্শন ও শ্রবণ করিয়া থাকি। ইহাই হইল সাধারণভাবে দর্শন ও শ্রবণ করিবার উপায়। এইজন্য বিশেষভাবে কোনো বস্তুকে দর্শন করিতে হইলে চোখে জোর দিতে হয়, তাহা হইলে বস্তু কিঞ্চিৎ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। আরো বিশেষ করিয়া নিরীক্ষণ করিতে হইলে, আমরা যে পরিমাণে চোখের স্নায়ুতে শক্তি প্রয়োগ করি, দৃষ্টিও সেই পরিমাণে অধিক হইয়া থাকে। এ সকলই হইল স্থূল-স্নায়ুপ্রক্রিয়া। কিন্তু যদি অভ্যাস করিয়া অর্থাৎ জপ-ধ্যান ইত্যাদি প্রক্রিয়া দ্বারা মুমূর্ষু বা সুষুপ্ত সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহকে সঞ্জীবিত বা জাগ্রত করিতে পারা যায়, তাহা হইলে যে পরিমাণে সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহ জাগ্রত হইবে, স্নায়ুপ্রধাবিত শক্তিও সেই পরিমাণে দূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইবে। কারণ নিয়ম হইতেছে: সমজাতীয় স্পন্দন সমজাতীয় স্পন্দনকে আকর্ষণ করিয়া থাকে - Similar vibration catches similar vibration. বস্তুর ত্বক-শক্তি বা Peripheral energy যে প্রকারে স্পন্দিত হইতেছে, চোখের স্থূল-স্নায়ুসমূহও সেই প্রকারে স্পন্দিত হইতেছে। সেইজন্য চোখের স্নায়ুর স্থূল-স্পন্দন দ্রব্যের স্থূল-স্পন্দনকে আকর্ষণ করিতেছে বা উহার সহিত একীভূত হইয়া যাইতেছে। কিন্তু সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা অতিসূক্ষ্ম-স্নায়ু যখন প্রকম্পিত হয়, তখন তাহা হইতে প্রসূত সূক্ষ্ম-স্পন্দন বা অতিসূক্ষ্ম-স্পন্দন বা শক্তি বস্তুস্থিত সূক্ষ্ম বা অতিসূক্ষ্ম পরমাণু-স্পন্দনকে আকর্ষণ করে অর্থাৎ উভয় স্পন্দন সমজাতীয় ও সমগুণান্বিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ও একীভূত হইয়া যায়। এইরূপ সূক্ষ্ম-স্নায়ুপ্রসূত যে স্পন্দন, তাহা দেশ, কাল ও নিমিত্তের অতীত। এইজন্য দূর হইতে দর্শন, দূর হইতে শ্রবণ প্রভৃতি হইয়া থাকে। ইহা অলৌকিক বা আজগুবী নয়। এইরূপে যে পরিমাণে সূক্ষ্ম-স্নায়ুকে জাগ্রত করিতে পারা যাইবে এবং তাহার ভিতর সূক্ষ্ম শক্তি প্রধাবিত করা যাইতে পারিবে, পরিদৃশ্যমান জগৎও সেই পরিমাণে অন্য প্রকার দেখিতে হইবে। ক্রমে সূক্ষ্মতম স্নায়ুতে যাইলে 'বাহ্যিক' বা 'আভ্যন্তরীণ' বলিয়া কোনো শব্দই থাকে না, সব একীভূত হইয়া যায়। দর্শনশাস্ত্র, বিজ্ঞানশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্র - এই তিন শাস্ত্রই এক হইয়া যায়, প্রক্রিয়া ও প্রয়োগের তারতম্য থাকে মাত্র।
স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে এক দিন রাত্রে রাজযোগের এই অংশটি ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। তিনি শ্রোতৃবৃন্দকে বলিলেন, "যার যা প্রশ্ন বা মনের কথা আছে, লিখে নিজের ইজেরের পকেটের ভেতর রেখে দিন। আমি সকলের মনের কথা বলে দিচ্ছি।" সকলে সেইরূপই করিলেন। অনেকের প্রশ্ন তিনি হুবহু বলিয়া দিতে লাগিলেন। তিনি বক্তৃতাকালে বলিয়াছিলেন যে, যাহার যে ইন্দ্রিয় যে পরিমাণে সবল, তাহার শক্তি-বিকাশ প্রথম সেই ইন্দ্রিয় দিয়া হইবে এবং পরিশেষে - অপর সকল ইন্দ্রিয় দিয়া বিকাশ পাইবে। যাহার দৃষ্টিবিষয়ক স্নায়ুপুঞ্জ - Optical nerves সবল, তাহার এই শক্তি বা সূক্ষ্ম-স্নায়ুবিকাশ প্রথম চক্ষু দিয়া হইবে; যাহার কর্ণবিষয়ক স্নায়ুপুঞ্জ - Auricular nerves সতেজ, তাহার সূক্ষ্ম-স্নায়ুপ্রক্রিয়া প্রথম কর্ণেই হইবে; যাহার ঘ্রাণবিষয়ক স্নায়ুপুঞ্জ - Olfactory nerves প্রবল, তাহার সূক্ষ্ম-স্নায়ুপ্রক্রিয়া প্রথম নাসিকা দিয়া হইবে।
পরমহংস মশাই-এর ও স্বামীজীর এইরূপ শক্তিবিকাশ বহু বার দেখিয়াছি। দর্শনশাস্ত্র বা বিজ্ঞানশাস্ত্র প্রত্যেক ব্যাপারেরই কারণ অনুসন্ধান করিয়া থাকে এবং যত দূর সম্ভব কারণ-নির্দেশ করিবার চেষ্টা করিয়া থাকে। এই সকল ব্যাপারের কারণ সম্বন্ধে যাহা বুঝিয়াছি, তাহার আভাস এই স্থলে দিলাম।
No comments:
Post a Comment