উচ্চ অবস্থার বা জীবন্মুক্ত পুরুষদিগের একটি বিশেষ লক্ষণ হইল যে, তাঁহাদিগের কণ্ঠস্বরে সাম্যস্পন্দন - Rhythmical vibration থাকে। প্রথমতঃ দেখা যায় যে, সাধক অনবরত অভ্যাস, সাধনা বা তপস্যা দ্বারা অসামঞ্জস্য ভাব পরিত্যাগ করিয়া সামঞ্জস্য বা সাম্য ভাবে উপনীত হইবার প্রয়াস পাইতেছেন। মানুষের সাধারণ অবস্থা হইল - দ্বন্দ্ব অবস্থা। ইহা হইল, 'বিপরীত গতিবাদ'-এর (Law of Opposite Current-এর) কথা। সাধনা বা তপস্যা হইল - নির্দ্বন্দ্ব অবস্থায় যাওয়া। নিম্ন অবস্থায় প্রত্যেক পরমাণু, প্রত্যেক শক্তিরেখা বা গতি ও প্রত্যেক ভাব পরস্পর বিরোধী হইয়া থাকে। কিন্তু উচ্চ অবস্থায় এ সকলই সাম্যভাবে আসিয়া থাকে। সাধারণ অবস্থায় পরমাণুসকল বা স্নায়ুপুঞ্জ দ্বন্দ্ব অবস্থায় প্রকম্পিত বা সঞ্চালিত হইতেছে। এই সকল কারণে চিত্তে নানা প্রকার বিক্ষুব্ধ ভাব আসিয়া থাকে। যখন যে স্নায়ু প্রবল হইতেছে, তখন চিত্তের বৃত্তিও তাহার অনুযায়ী হইতেছে। এইজন্য স্নায়ুপুঞ্জে বা দেহে নানা প্রকার শ্রান্তি ক্লান্তি প্রভৃতি বিকৃত গতির শক্তি বিকাশ পায়। কিন্তু চিত্ত বা চিৎ-শক্তি স্থূল-স্নায়ু হইতে যেরূপ সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে প্রবাহিত হয়, ধীরে ধীরে সেইরূপ সাম্য-অবস্থা প্রকাশ পাইতে থাকে। পরিশেষে সাধক যখন অল্পক্ষণের জন্যই হউক বা অধিকক্ষণের জন্যই হউক পূর্ণমাত্রায় সেই সাম্য-অবস্থায় উপনীত হইয়া থাকেন, তখন তিনি এক স্বতন্ত্র পুরুষ হইয়া যান।
পরমাণুপুঞ্জ বা স্নায়ুপুঞ্জ অ-সাম্যভাবে স্পন্দিত হওয়ায় শরীরে এক প্রকার দাহকারী উত্তাপ অনুভূত হয়, ত্বক যেন অগ্নিশিখায় দগ্ধ হইতেছে বলিয়া বোধ হয়। ক্রমে যে পরিমাণে সাম্য-অবস্থা আসিতে থাকে, সেই পরিমাণে উত্তাপ ত্বক হইতে নিম্ন বা গভীর স্তরের স্নায়ুতে প্রবেশ করে এবং ত্বক-সংলগ্ন স্নায়ুপুঞ্জ শীতল হইয়া যায়; এমন কি, রক্তসঞ্চালন ধীরে ধীরে কমিয়া যাইয়া নাড়ীর গতি পঁয়তাল্লিশ-বেয়াল্লিশ মাত্রা হইয়া যায়। কখনো বা দেখা যায় যে, নাড়ীর বেগ এরূপ কমিয়া গিয়াছে যে, গতি নাই বলিলেই হয়; অর্থাৎ নাড়ী নিষ্ক্রিয় হইয়া শরীরের উত্তাপ শীতল হইয়া যায়। ঠাণ্ডা বা গরম এই দুইটি অবস্থা হইল একই বস্তুর বিভিন্ন প্রকার বিকাশ; কিন্তু শীতল বা স্নিগ্ধ হইল অন্য এক প্রকার অবস্থা। বাহিরের বায়ু অগ্নির ন্যায় উত্তপ্ত হইয়া প্রবাহিত হইলেও স্নিগ্ধ স্নায়ুতে কোনো ক্রিয়া করিতে পারে না, অর্থাৎ গরম বা কষ্ট কিছুই অনুভূত হয় না বা ব্যথিত করিতে পারে না।
আর একটি বিষয় দেখা যায় যে, পরমাণুপুঞ্জ সাম্যভাবে স্পন্দিত হওয়ায় গায়ের বর্ণ অন্যবিধ হইয়া উজ্জ্বল ভাব প্রকাশ পায়। গায়ের চর্ম বন্ধুর ও কর্কশ না হইয়া মসৃণ অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং এক প্রকার স্বচ্ছ আভা প্রকাশ করে। বর্ণ বা রং দিয়া বিচার করিলেও সাম্যস্পন্দনের তারতম্য বেশ বুঝা যায়। এইজন্য সাধকের গায়ের বর্ণ সাধারণ লোকের গায়ের বর্ণ অপেক্ষা উজ্জ্বল হইয়া থাকে; শ্বাসপ্রশ্বাসও সাম্যভাবে হইয়া থাকে, চোখের দৃষ্টি কর্কশ বা রূঢ় না হইয়া, স্নিগ্ধ বা মধুর হইয়া যায়। সাম্যস্পন্দন হইতে উদ্ভূত শক্তি বা আভ্যন্তর চিন্তা চোখ দিয়া বিকাশ পাইয়া থাকে। হাত ও আঙুলের সঞ্চালন মধুর হয় ও আকর্ষণী শক্তিতে পরিপূর্ণ হয়। কণ্ঠস্বরেও এক মাধুর্যপূর্ণ স্নিগ্ধ ভাব ও আকর্ষণী শক্তি বিকাশ পায়। ইহাই হইল সাম্যস্পন্দনের বহির্বিকাশ। চিৎ-শক্তি যেরূপ সূক্ষ্ম স্নায়ু দিয়া পরিচালিত হইবে, সাম্যস্পন্দন-প্রসূত শক্তিরও সেইরূপ বিকাশ হইবে। যাহা 'খণ্ড', তাহা ত্যাগ করিয়া, যাহা 'অখণ্ড', তাহার চিন্তা করিলেই এই ভাব আসিয়া থাকে।
'পিথাগোরিঅ্যান'-দিগের মত হইল যে, সৃষ্টি সাম্যস্পন্দন হইতে উদ্ভূত হইয়াছে; পরে সৃষ্টি অ-সাম্য বা দ্বন্দ্ব অবস্থায় উপনীত হওয়ায় জগতের দুঃখ-কষ্ট বা নানারূপ বিকৃত ভাব উদ্ভূত হইয়াছে; এবং পরিশেষে সৃষ্টি সাম্যস্পন্দনে বা সাম্য-অবস্থায় উপস্থিত হইবে। তাঁহারা ইহাই সৃষ্টি ও দুঃখ-কষ্টের কারণ বলিয়া নির্ণয় করেন। সাম্যস্পন্দনে পরিসমাপ্ত হওয়াকে শান্ত নির্দ্বন্দ্ব বা দ্বন্দ্বাতীত অবস্থা বলা হয়, যাহাকে চলিত কথায় বলে - শান্তি পাওয়া। এই সাম্যস্পন্দন একটি স্বতন্ত্র বিষয়। দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিকদিগের ইহা একটি বিশেষ মত।
সাম্যস্পন্দন যখন কণ্ঠ দিয়া বিকাশ পায়, তখন তাহাকে 'নাদ' বলে। নাদ-ই হইল ব্রহ্ম। স্বামীজীর কণ্ঠ হইতে আমি কয়েক বার এই নাদ নির্গত হইতে শুনিয়াছি। একটি ঘটনার বিষয় এখানে বিশেষ করিয়া উল্লেখ করিতেছি।
লন্ডনে রাত্রিতে রাজযোগের বক্তৃতা হইতেছিল। বক্তৃতা সমাপ্ত হইল। ঘরের মেঝেতে গালিচা ও নরম স্প্রিং-এর সব চেয়ার পাতা। দেড় শত হইতে দুই শত বিশিষ্ট ঘরের স্ত্রী-পুরুষ ভাল ভাল পোষাক পরিয়া তাহার উপর বসিয়া বক্তৃতা শুনিতেছিল। ইংরাজীতে বক্তৃতা হইতেছিল। সকলে একমনে নিবিষ্টচিত্তে তাহা শুনিতেছিলেন। স্বামীজী সাধারণভাবে বক্তৃতা দিয়া যাইতেছিলেন। মুখের ভাব তখন সাধারণ ছিল। সহসা তাঁহার মুখের সাধারণ ভাব বদলাইয়া স্নিগ্ধ অথচ দুষ্প্রেক্ষ্য ভাব হইয়া গেল। চোখের দৃষ্টি অন্য প্রকার হইল। তিনি হাত দুটি তুলিয়া যেন আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। হঠাৎ যেন তাঁহার দেহ হইতে এক নূতন ব্যক্তি আবির্ভূত হইল। অল্পক্ষণ বিরামের পর তাঁহার কণ্ঠ হইতে সাম্যস্পন্দনযুক্ত নাদ নিঃসৃত হইতে লাগিল। সংস্কৃতে তিনি স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করিতে লাগিলেন:
"মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্নঃ সন্ত্বোষধীঃ॥
মধু নক্তমুতোষসো মধুমৎ পার্থিবং রজঃ।
মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা॥
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাঁ অস্তু সূর্যঃ।
মাধ্বীর্গাবো ভবন্তু নঃ॥"1
এক একবার একটি শব্দ করিয়া বিস্ফারিত নেত্রে ঊর্ধ্বদিকে কি যেন প্রত্যক্ষ করিয়া ক্ষণকাল নিস্তব্ধ হইয়া, বিভোর হইয়া যাইতে লাগিলেন ও পুনরায় বলিতে লাগিলেন। এইরূপে স্বস্তিবাচনটি উচ্চারণ করিতে অনেকক্ষণ সময় লাগিল; স্বামীজীর সমস্ত স্নায়ুপুঞ্জ একেবারেই পরিবর্তিত হইয়া গেল। নূতন এক প্রকারের মানুষ তিনি যেন হইয়া গেলেন। তিনি যেন জগতের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। এমন কি যেন সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রস্বরূপ বা কেন্দ্রীয় শক্তিস্বরূপ হইলেন; ঠিক যেন সেই অশরীরী সাম্যস্পন্দন-কেন্দ্র হইতে এই সৃষ্টি উদ্ভূত হইয়াছে! দেহজ্ঞান বা খণ্ডজ্ঞানের ভাব তখন তাঁহার কিছুই ছিল না। দেশ, কাল ও নিমিত্তের অতীতে তিনি চলিয়া গিয়াছিলেন। স্বস্তিবাচনটি সংস্কৃত ভাষায় উচ্চারিত হইতেছিল, এবং কেহই তাহার অর্থ জানিতেন না। কিন্তু যেমনই স্বস্তিবাচনটি বা নাদটি স্বামীজীর কণ্ঠ হইতে নিঃসৃত হইতে লাগিল অমনি চকিতের ভিতর সকলেই অভিভূত হইয়া নিজ নিজ চেয়ার পিছনের দিকে সরাইয়া দিলেন এবং জানু পাতিয়া বসিয়া মাথা নীচু করিয়া দু-হাত জোড় করিয়া আশীর্বাদ লইতে লাগিলেন। সকলেই নিস্তব্ধ, যেন স্বামীজী ব্যতীত ঘরে আর দ্বিতীয় ব্যক্তি কেহ ছিলেন না। সূক্তের অর্থাৎ শ্লোকের প্রত্যেক শব্দ, মাত্রা, যতি ও ছন্দ সমস্তই স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইতেছিল। নাদ বা সাম্যস্পন্দন ঠিক যেন ঘরের হাওয়ার ভিতর দুলিয়া দুলিয়া ফিরিতে লাগিল। ইহা এত আশ্চর্য বিষয় ও এত উচ্চ অবস্থার কথা যে ভাষা দিয়া বর্ণনা করা যায় না। ইহা হইল প্রত্যক্ষ বা জীবন্ত শক্তি। কেহই স্বস্তিবাচনটির অর্থ জানিতেন না; কিন্তু নাদ বা সাম্যস্পন্দনের এমনই প্রভাব বা শক্তি, যেন শ্রোতৃবৃন্দকে বা দেহগুলিকে বলিল, "উচ্চ আসনে বসিয়া থাকিবার সময় নয়, সকলে এই বাণীর কাছে নত হও, মাথা নত করিয়া থাক।" নাদ যেন সহসা দেহগুলিকে উলটাইয়া ফেলিয়া দিল। স্বামীজীর পূর্ব অবস্থা আর ছিল না - স্বতন্ত্র ব্যক্তি, স্বতন্ত্র দৃষ্টি, স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর! তাহার পর চিত্ত নামিয়া আসিলে, তিনি সাধারণভাবে ইংরাজীতে স্বস্তিবাচনটির অর্থ বুঝাইয়া দিলেন - Blissful is the air. Blissful is the water of the river ইত্যাদি।
ইহাকেই বলে 'নাদব্রহ্ম' বা 'সাম্যস্পন্দন'। পরমহংস মশাই-এর ভিতর এই ভাবটি অনেকবার দেখিয়াছি। উচ্চ অবস্থার সাধক বা সিদ্ধ পুরুষগণের ইহা একটি বিশেষ লক্ষণ।
1. মধুবাতা ঋতায়তে (মধুর বাতাস বহিতেছে); মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ (সিন্ধুসকল অর্থাৎ নদীসকল মধু ক্ষরণ করিতেছে); মাধ্বীঃ নঃ সন্তু ওষধীঃ (আমাদের ওষধীলতাসকল মধুময়ী, অর্থাৎ অমৃতস্রাবিণী হউক)।
মধু নক্তম্ উত উষসঃ (রাত্রিসকল এবং প্রভাতসকল মধুময় হউক); মধুমৎ পার্থিবং রজঃ (পৃথিবীস্থ ধূলিকণাসকলও যেন মধুময় হয়); মধু দ্যৌঃ অস্তু নঃ পিতা (হে পিতঃ, আমাদের আকাশ মধুস্রাবী হউক; কিংবা আমাদের স্বর্গস্থিত পিতৃপুরুষগণ মধুময়, অর্থাৎ আনন্দময় হউন)।
মধুমান্ নঃ বনস্পতিঃ (আমাদের বৃক্ষ মধুমান্ অর্থাৎ মধুর ফলপ্রসবী হউক); মধুমান্ অস্তু সূর্যঃ (সূর্য মধুর কিরণবর্ষী হউক); মাধ্বীঃ গাবঃ ভবন্তু নঃ (আমাদের গাভীসকল মধুস্রাবিণী হউক)।
বৈদিক ভাষা সংস্কৃত ভাষা হইতে কিঞ্চিৎ পৃথক্।↩
No comments:
Post a Comment