পরমহংস মশাই-এর সমস্ত কথা কেহই মনে রাখিতে পারেন নাই, রাখা সম্ভবও নয়। কারণ প্রথমে তিনি ভাষা ও শব্দ দিয়া একটি উপাখ্যান বলিতে আরম্ভ করিতেন; উপাখ্যানটি বলিবার অল্পক্ষণ পরেই, উহার ভিতর যে ভাবটি আছে, সেইটি তিনি স্বয়ং হইয়া যাইতেন বা উহার রূপ পরিগ্রহ করিতেন। তিনি যে সকল কথা বলিতেন, তাহা ঠিক যেন একটি জীবন্ত ভাব হইয়া সকলের সম্মুখে আসিতে থাকিত। তখন অনুভব করিতাম যে, ভাবও খণ্ড ও তুচ্ছ জিনিস। ভাবেরও বহু ঊর্ধ্বে, শক্তিতে, সকলের মনকে তিনি লইয়া যাইতেন। সে সময়ে কাহারো আর চিন্তা, তর্ক, যুক্তি, সন্দেহ, দ্বিধা, প্রভৃতি মনের ক্রিয়াসমূহ থাকিত না। সকলেই নিঝুম, নির্বাক্ ও নীরব, যেন ভিন্ন জগতে ভিন্ন ক্ষেত্রে চলিয়া যাইত। 'হাঁ' বা 'না' বলিয়া কোনো শব্দও থাকিত না। সব এক হইয়া যাইত। সকলকে এক অসীম অনন্ত শক্তিতে তিনি লইয়া যাইতেন, যাহাকে বলে - মনটাকে সবিকল্প সমাধিতে লইয়া যাওয়া। শব্দ ও ভাব, পর পর অতিক্রম করিয়া, তিনি এক অসীম শক্তির সহিত মিশিয়া সমাধিস্থ হইয়া যাইতেন। এইজন্য তাঁহার ভাষা, শব্দ ও উপাখ্যান তত মনে রাখা যাইত না।
দেখিয়াছি যে স্বামী বিবেকানন্দও লন্ডনে বক্তৃতাকালে প্রথমে একটি উপাখ্যান শুরু করিতেন; কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই, উপাখ্যানের ভিতর যে ভাবটি থাকিত, তাহা জাগ্রত করিতেন, অবশেষে এক মহান শক্তিতে সকলের মনকে লইয়া যাইতেন। এইজন্য বক্তৃতার তর্ক-যুক্তির দিকে কাহারো দৃষ্টি থাকিত না এবং তাঁহার সকল কথাও কাহারো মনে থাকিত না।
শক্তি-সঞ্চারণকারী এইরূপ ব্যক্তি যে কত উচ্চ অবস্থার মহাপুরুষ বা এই শক্তিকেন্দ্র বা উৎসক্ষেত্র যে কত উচ্চ, তাহা অনুমান করা যায় মাত্র, কিন্তু মাপকাঠি দিয়া পরিমাপ করা যায় না। মাপকাঠি দিয়া সাধারণ লোকের মনের অবস্থা পরিমাপ করা যায়, কিন্তু এত উচ্চ অবস্থার মহাপুরুষের মনের অবস্থার বিষয় কোনো মাপকাঠি দিয়া পরিমাপ করা যায় না। কারণ এইরূপ অবস্থায় তাঁহার মনের সকল প্রকার ক্রিয়াই একেবারে চলিয়া যায়। এইজন্য শক্তিকেন্দ্র বা উৎসক্ষেত্র যে কত ঊর্ধ্বে, তাহা কেহ নির্ণয় করিতে সমর্থ হয় না।
'ভাব' আর 'শক্তি' একই - এই যে দার্শনিক মত, এই তথ্যটি পরমহংস মশাই-এর জীবন দেখিয়া বুঝিতে পারা যায়। জগতে ইহা একটি নূতন ব্যাপার।
No comments:
Post a Comment