পরমহংস মশাই পূর্বতন ঘটনাসমূহ এমন কি বাল্যকালের সকল ঘটনাও স্পষ্ট বলিয়া যাইতেন এবং সে সকলই ঠিক হইত। স্বামীজীরও এই শক্তি আমি দেখিয়াছি। ব্রহ্মানন্দের ভিতরেও অনেক পরিমাণে এই শক্তির বিকাশ পাইয়াছিল।
এই স্থানে 'সংজ্ঞাক্ষেত্র' সম্বন্ধে কিছু জানা আবশ্যক। সংজ্ঞাক্ষেত্রকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম হইল - 'সাধারণ-সংজ্ঞাক্ষেত্র', Conscious plane; দ্বিতীয় হইল - 'অধস্তন-সংজ্ঞাক্ষেত্র', Sub-conscious plane; তৃতীয় বা ঊর্ধ্বতম অবস্থা হইল - 'অতীন্দ্রিয়-সংজ্ঞাক্ষেত্র', Superconscious plane.
পরিদৃশ্যমান বাহ্যিক বস্তুসমূহ 'গুণ'-সমষ্টিতে আবৃত। গুণ হইল পরমাণুর বিভিন্ন প্রকার স্পন্দন। কত প্রকার যে গুণ বা স্পন্দন আছে, তাহা নির্ণয় করা যায় না। এক এক প্রকার স্পন্দন নির্ণয় করাকে, এক এক প্রকার গুণ আবিষ্কার করা বলে। আমরা সব সময় সকল গুণ বুঝিতে পারি না। দেহের স্নায়ুর স্পন্দন যে প্রকার হইবে, বাহ্যিক বস্তুর স্পন্দনও সেই প্রকার বুঝা যাইবে। কিন্তু, দেহের স্পন্দন যদি বাহ্যিক স্পন্দন হইতে উচ্চমাত্রায় বা অধোমাত্রায় হয়, তাহা হইলে সেই প্রকম্পন দিয়া বাহ্যিক স্পন্দন বুঝিতে পারা যায় না; অপর স্তরের স্নায়ু-প্রকম্পন আশ্রয় করিতে হয়। এইরূপে আমরা বহুবিধ প্রকম্পন উপলব্ধি করিতে পারি। এই হইল নিয়ম যাহাতে আমাদের বাহ্যিক বস্তুর জ্ঞান উপলব্ধি হয়। কিন্তু অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে যাইতে, 'বাহ্যিক' ও 'আভ্যন্তরীণ' উভয় জগৎই একীভূত হইয়া যায়। মাত্র স্থূল-স্নায়ুর প্রকম্পনের জন্যই আমরা জগৎকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ বলিয়া দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া থাকি।
স্থূল-স্নায়ুর প্রক্রিয়া যদি নিষ্ক্রিয় হইয়া যায়, তাহা হইলেও সংজ্ঞাক্ষেত্র থাকে; যেমন অজ্ঞান অবস্থায়, বা হঠযোগীদের ভূমধ্যে প্রোথিত করিয়া রাখিলেও সংজ্ঞাক্ষেত্র ঠিক থাকে, মৃত হইয়া যায় না। 'মৃত্যু' হইল - যেখানে সংজ্ঞাক্ষেত্র নষ্ট হইয়া গিয়াছে। আমরা প্রত্যহ বহুবিধ বস্তুর সম্পর্কে আসিয়া থাকি এবং জীবনের বহু সময় এই সব বস্তু দর্শন করি। এইরূপ এক চিত্রের উপর অপর এক চিত্র অনবরত সংস্থাপিত হওয়ায়, পূর্বতন চিত্র বা জ্ঞান, অধস্তন-সংজ্ঞাক্ষেত্রে চলিয়া যায়। এইজন্য সাধারণতঃ আমাদের পূর্ব ঘটনা বা ঘটনাসমূহের জ্ঞান থাকে না। সাধারণভাবে ইহাকে 'বিস্মৃতি' বলা হয়। সাধারণ-সংজ্ঞাক্ষেত্রে অবস্থান করিলে বর্তমান অবস্থার সকল কথা বলা যায়, কিন্তু পূর্বতন ঘটনাসমূহের বিস্মরণ হইয়া থাকে বা অস্পষ্টভাবে স্মরণ থাকে; এই হইল সাধারণ নিয়ম। কিন্তু এক সময়ে বাহ্যিক বস্তুর প্রকম্পনে স্নায়ুর প্রকম্পন সংযুক্ত হওয়ায় যে জ্ঞান উপলব্ধি হয়, তাহা একেবারে বিনষ্ট হয় না; তাহা অন্তরতর প্রদেশে সংস্থাপিত ও সংরক্ষিত হইয়া থাকে। যদি প্রয়াস করিয়া উপযুক্ত উদ্দীপক বা উদ্বোধক ভাব বা কারণ (Fit stimulus বা Suggestive idea) দিয়া সুষুপ্ত স্নায়ুকে বা স্নায়ুপুঞ্জকে সঞ্জীবিত করা যায়, তাহা হইলে পুনরায় সমস্ত ঘটনাবলী পারম্পর্য অনুযায়ী উদ্দীপিত করা যাইতে পারে। বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া দিয়া যদি পূর্বতন মৃতপ্রায় বা সুষুপ্ত স্নায়ুকে বা স্নায়ুপুঞ্জকে পুনরায় জাগ্রত বা জীবিত করা যায়, তাহা হইলে প্রাক্তন সমস্ত বস্তু বা ঘটনা বর্তমানে পরিলক্ষিত হয়। দেশ ও কাল এইরূপ স্থলে বিলুপ্ত হয় এবং এই কারণে, 'অতীত' বলিয়া কোন শব্দ থাকে না, মাত্র 'বর্তমান' এই সংজ্ঞা প্রতীয়মান হয়। কিন্তু পূর্বতন স্নায়ু যদি দূষিত বা নষ্ট হইয়া যায়, তাহা হইলে আর পূর্বস্মৃতি জাগ্রত হয় না। স্নায়ু যে প্রকার প্রকম্পিত হইয়া বাহ্যিক বস্তুর প্রকম্পনকে ধারণ করিয়াছিল বা তাহার সহিত প্রকম্পন সংযোজিত করিয়াছিল, সেই প্রকার পূর্বস্মৃতি জাগ্রত হইয়া থাকে; ধারণকালে যদি অস্পষ্ট ভাব থাকে, তাহা হইলে অস্পষ্ট চিত্র উঠিবে। এইরূপে স্পন্দন যেরূপে সংযুক্ত হইবে, সেইরূপ স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ভাবে অতীত চিত্র পুনরায় উদ্দীপ্ত হইবে। 'স্মৃতি' বা Memory ইহাকেই বলা হয়। পূর্ব ঘটনাসমূহকে সঞ্জীবিত করিবার এক উপায় - পূর্বতন স্নায়ু বা স্নায়ুপুঞ্জ সঞ্জীবিত করা। ইহাকে 'বিপর্যস্ত বা পশ্চাদ্মুখী ধ্যান' বলে।
স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে বলিয়াছিলেন, "পূর্ব দিনের সমস্ত ঘটনা চিন্তা করো; পূর্ব বৎসর কি ঘটিয়াছিল তাহা চিন্তা করো। তাহার পর বাল্যকালে কি করিয়াছিলে চিন্তা করো; তাহার পর ক্রমান্বয়ে পূর্বতন ঘটনাসমূহ চিন্তা করো। তাহা হইলে ক্রমে ক্রমে পূর্বতন সকল ঘটনা স্মৃতিতে আসিবে।" আর একটি কথা তিনি বলিয়াছিলেন, "গ্রন্থে আছে যে, যদি কেহ পূর্বতন চিন্তা বা পশ্চাদ্গামী মনোবৃত্তিকে আরো অধিক দূর লইয়া যাইতে পারে, তাহা হইলে ভ্রূণ-অবস্থায় সে কিরূপ ছিল তাহাও প্রতীয়মান হইবে; কারণ ভ্রূণ-অবস্থাতেও স্নায়ু আছে ও স্নায়ুর প্রক্রিয়া থাকে। আমি শৈশবকালের অবস্থা অনেক অংশে জাগ্রত করিতে পারি। বুদ্ধদেব জাতক গ্রন্থে বলিয়াছেন যে, তিনি পূর্বজন্মের অনেক কথা স্মরণ করিতে পারিয়াছিলেন।"
কয়েক বৎসর পূর্বে আগ্রা ও মথুরায় সাবিত্রী নামে এক জাতিস্মর বালিকার কথা শুনা গিয়াছিল। মথুরায় একটি ব্রাহ্মণীর মৃত্যু হয়। সে স্বামী-পুত্র রাখিয়া মারা যায়। পরে আগ্রায় তাহার জন্ম হয় এবং তখন তাহার নাম হয় সাবিত্রী। সাবিত্রীর বয়স যখন আট-নয় বৎসর তখন সে তাহার নূতন পিতামাতাকে পূর্বজন্মের সকল কথা বলিতে লাগিল। সাবিত্রীর কথা শুনিয়া তাহার পিতা মথুরায় লোক পাঠাইয়া অনুসন্ধান করিয়া দেখিল যে, সকলই ঠিক মিলিয়া যাইতেছে। সাবিত্রী তাহার স্বামী ও পুত্রকে দেখিতে যাইবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিলে তাহার পিতা আরো কয়েকটি লোক সঙ্গে লইয়া ট্রেনে করিয়া মথুরায় চলিল। আগ্রার ভাষা হইতে মথুরার ভাষার কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে। ট্রেনখানি মথুরা ষ্টেশনের নিকট আসিলে সাবিত্রী চিৎকার করিয়া মথুরার ভাষায় বলিতে লাগিল, "মথুরা আ গয়ী, মথুরা আ গয়ী!" সাবিত্রী তাহার পর গাড়ি-ভাড়া করিয়া পিতাকে লইয়া যেন পূর্বপরিচিত রাস্তা দিয়া নিজে মথুরার বাড়িতে আসিল। বাড়িতে ঢুকিয়া বলিল, "এখানে পাতকুয়ো ছিল, কি হল?" স্বামী উত্তর করিল, "পাতকুয়োর মুখে পাথর দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে।" তাহার পর, শয়ন-ঘরে যাইয়া বাক্স দেখাইয়া বলিল, "বাক্সের ভেতর আমার গয়না ছিল, খোলো দেখি।" স্বামী পুনরায় বিবাহ করিয়া সেই সকল অলংকার নূতন স্ত্রীকে দিয়াছিল। তাহার পর সে বলিল, "একটা ঘটির ভেতর করে দেওয়ালের মধ্যে টাকা রেখে গেছি, খোঁড়ো।" দেওয়াল খোঁড়া হইলে টাকা বাহির হইল। তাহার পর, সে তাহার কি অসুখ হইয়াছিল, অসুখের সময় কোন ডাক্তার তাহাকে দেখিয়াছিল, কবে সে মারা গিয়াছিল - প্রভৃতি সকলই বলিল। মথুরায় মৃত্যুর সময় ও আগ্রায় জন্মের সময় দুই-ই মিলিয়া যাইল।
সাবিত্রী তাহার পর তাহার মা-ভাইদের সঙ্গে দেখা করিতে যাইল। নিজেই রাস্তা দেখাইয়া চলিল। সেখানে যাইয়া বাপ, মা, ভাই প্রভৃতি সকলের পায়ে প্রণাম করিল। সাবিত্রী প্রত্যেকের নাম বলিয়া দিতে লাগিল। স্বামী ও শ্বশুরের নাম অপরের কানে বলিল। সাবিত্রীর বাপ-মা কাঁদিতে লাগিল।
মথুরার উকিল-ডাক্তার প্রভৃতি সকলে সভা করিয়া সাবিত্রীকে তাহার পূর্বজন্মের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, সকলই মিলিয়া গেল। অবশেষে, পাছে অতিশয় ক্লান্ত হইয়া মেয়েটির মৃত্যু হয়, এইজন্য তাহার নূতন পিতা তাহাকে লইয়া আগ্রায় ফিরিয়া গেল।
স্নায়ু-বিজ্ঞান অনুযায়ী, স্থূল দেহ নাশ হইলেও সূক্ষ্ম দেহ বা সূক্ষ্ম স্নায়ু সমভাবে থাকে। হিন্দুদিগের যে শ্রাদ্ধক্রিয়া, তাহা হইল এই সূক্ষ্ম শরীরের উদ্দেশে শ্রদ্ধা-নিবেদন। কখনো কখনো এই সূক্ষ্ম স্নায়ু বা সূক্ষ্ম শরীর স্থূল দেহ দিয়া বিকাশ পায়। ইহাকে 'জাতিস্মর হওয়া' বলে। যতদূর জানা গিয়াছে, জাতিস্মর হইলে বেশি দিন শরীর থাকে না।
দেখা যায় যে, সাবিত্রীর সাময়িকভাবে পূর্বতন স্নায়ু সঞ্জীবিত হইয়াছিল মাত্র। কিন্তু জাতিস্মর হওয়া যে সম্ভব, ইহা হইতে তাহা বেশ বুঝা যায়। এই বিষয়ে য়ুরোপীয় দার্শনিকগণ কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা করিতে পারেন নাই।
No comments:
Post a Comment