Monday, April 23, 2018

দ্রুত চিন্তাস্রোতে

চোখ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় - নরনেত্র, ঋষিনেত্র ও দেবনেত্র। নরনেত্র হইল - সাধারণতঃ যে সকল চোখ দেখা যায়। এইরূপ চোখের দৃষ্টিতে সাধারণ ভাব থাকে। ঋষিনেত্রের দৃষ্টিতে ব্যক্ত হইতে অব্যক্তে যাওয়ার ভাব প্রকাশ পায়। দেবনেত্রের দৃষ্টিতে অব্যক্ত হইতে ব্যক্তে আসার ভাবটি প্রকাশ পায়। শিবের নেত্র হইল ঋষিনেত্র। দুর্গার নেত্র হইল দেবনেত্র। চলিত কথায়, দেবনেত্রকে শঙ্খ, পদ্ম ও মীন নেত্র বলা হয়। শঙ্খনেত্র হইল শঙ্খকে লম্বাদিকে দুই ভাগ করিলে যেরূপ দেখিতে হয় সেইরূপ। পদ্মনেত্র হইল, পদ্মফুলের পাপড়ির মতো দেখিতে। মীননেত্র হইল দুইটি মাছ যেন মুখোমুখি হইবার চেষ্টা করিতেছে। বাংলাদেশের বিগ্রহে, বিশেষতঃ স্ত্রীবিগ্রহে, পদ্মনেত্র প্রযুক্ত হয়; কখনো বা শঙ্খনেত্র প্রযুক্ত হয়। রাজযোগের ভাষায়, শঙ্খনেত্রের দৃষ্টি হইল নাসিকার অগ্রভাগে; পদ্মনেত্রের দৃষ্টি হইল নাসিকার মূলে; মীননেত্রের দৃষ্টি হইল ভ্রূর মধ্যে। এ সকলই দেবনেত্রের লক্ষণ, অর্থাৎ যেন অব্যক্তকে ব্যক্ত করিতেছে।

নরেন্দ্রনাথের নানারূপ ভাবের সময় যাঁহারা চোখের দৃষ্টি নিরীক্ষণ করিয়াছেন, তাঁহারা দেবনেত্র সম্বন্ধে ভাল বুঝিতে পারিবেন। নরেন্দ্রনাথের চোখের দৃষ্টি সাধারণ অবস্থায় ঋষিনেত্রের দৃষ্টির মতো ছিল। শিবনেত্র যে কত প্রকার হয়, ব্যক্ত হইতে অব্যক্তে চলিয়া যাইবার কালে চোখের দৃষ্টি যে কত প্রকার হয়, নরেন্দ্রনাথের চোখের দৃষ্টি দেখিয়া তাহার আভাস পাওয়া যাইত। দেহ ও দেহজ্ঞান ত্যাগ করিয়া সমাধিস্থ অবস্থায় যাইলে, চোখের দৃষ্টি কিরূপ হয়, নরেন্দ্রনাথের চোখে তাহা বিশেষরূপে পরিস্ফুট হইত। মহাশক্তিপূর্ণ, আজ্ঞাপ্রদ, স্তব্ধকারী ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, দূরত্ব ও প্রতিবন্ধসমূহ ভেদ করিয়া যেন অগ্রগামী হইতেছে। এইজন্য বক্তৃতাকালে তাঁহার চোখের দৃষ্টিতেই অনেকে জড়সড় হইয়া যাইত, তিনি যেন অধিনেতা বা অধিনায়করূপে জগৎকে আদেশ করিতেছেন; প্রখর দৃষ্টি, দুর্দমনীয় তেজ - বাধা-বিঘ্ন কিছুই গ্রাহ্য করিতেছেন না; সমস্ত জগৎকে তিনি চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া যেন নূতনভাবে গঠন করিবেন - ঠিক এই ভাবটি তাঁহার চোখের দৃষ্টিতে প্রকাশ পাইত।

পরমহংস মশাই-এর দৃষ্টি ছিল শান্ত স্নিগ্ধ, কিন্তু অতি উচ্চ মার্গের। কত উচ্চ মার্গের বা উচ্চ অবস্থার, কোন্ স্তরের ও কিরূপ তাহার ভাব, তাহা কিছুতে বুঝিতে পারিতাম না কিন্তু দেখিতাম যে, তাঁহার কাছে যাইতে বা তাঁহার চরণ স্পর্শ করিতে কাহারো সাহস হইত না। রামদাদার বাড়িতে বা শিমলাতে যখন তিনি আসিতেন তখন কাহাকেও তাঁহার চরণ স্পর্শ করিতে দেখিয়াছি বলিয়া আমার স্মরণ হয় না। তাঁহাকে ভাল লাগিত, দেখিতে ইচ্ছা করিত কিন্তু একটু তফাৎ হইতে। তিনি যখন ঘরে বসিয়া থাকিতেন তখন একঘর লোক থাকিত; কিন্তু কোনো প্রকার চপল ভাব প্রকাশ পাইত না, এমন কি, কোনো ব্যক্তি অঙ্গসঞ্চালন পর্যন্তও করিত না। কোন্ এক স্নিগ্ধ, অসীম ব্যোমে তিনি সকলের মনকে লইয়া যাইতেন, তাহার কিছুই বুঝা যাইত না। প্রশ্ন করা তো দূরের কথা, এমন কি কেহ মাথা বা ঘাড় নাড়িতেও পারিত না। এইজন্য পরমহংস মশাই-এর চোখের দৃষ্টি যে কত প্রকার হইত, তাহা সেই সময় ঠিক বুঝিতে পারিতাম না, কিন্তু সাধারণ লোকের দৃষ্টি হইতে উহার যে সম্পূর্ণ পৃথক ভাব - অন্তর্দৃষ্টি, এইটাই দেখিতাম। কেহ যেন ইহা সাধারণ লোকের দৃষ্টির সহিত তুলনা না করেন। দেহ ছাড়িয়া মন যখন অন্য স্থানে চলিয়া যাইতেছে, তখন যেমন দৃষ্টি হয়, ঠিক সেইরূপ দৃষ্টি হইয়া চোখের তারা অন্য প্রকার হইয়া যাইত। যে অবস্থায় তাঁহার মন থাকিত, সেই অনুযায়ী তাঁহার চোখের দৃষ্টি ও তারা পরিবর্তিত হইয়া যাইত।

পরমহংস মশাই-এর চোখ মিটমিট করার কারণ বুঝিতে হইলে বলিতে হইবে, তাঁহার চিন্তাস্রোত ও চিন্তাধারা এত দ্রুতবেগে চলিত যে, দেহের সমস্ত স্নায়ু নানাভাবে স্পন্দিত হইত; এই স্রোত বা ধারা প্রকাশ বা বিকাশের নিমিত্ত চোখের পাতা অনবরত পড়িত। স্নায়ুদৌর্বল্য হইলে চোখ মিটমিট করে এবং একরকম ব্যামোও আছে তাহাতে চোখ মিটমিট করে; ইহা সেরূপ নয়। দেখিতাম যে, প্রথমে তিনি অতি সাধারণ লোকের মতো বসিয়া আছেন ও কথা কহিতেছেন; কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই যখন কথাটি জমিয়া যাইল এবং উচ্চ দিকে কথা চলিল, তখন সহসা তাঁহার কণ্ঠের স্বর, মুখের ভঙ্গী ও চোখের দৃষ্টির পরিবর্তন হইতে লাগিল।

ইহা যে কিরূপ অবস্থা বা কত উচ্চ দিকে যাইত, তাহা কিছুই বলিতে পারা যায় না। তবে দেখিতাম যে, পূর্বে যিনি সাধারণ ব্যক্তির মতো ছিলেন, সহসা তিনি পরিবর্তিত হইয়া অপর এক ব্যক্তি হইলেন। এইরূপ দ্রুত চিন্তাস্রোতে সমস্ত সূক্ষ্ম-স্নায়ু প্রকম্পমান হওয়ায় চোখের পাতা অনবরত নড়িত এবং পরে স্থির হইয়া যাইত। তখন আর চোখের পাতা পড়িত না, চোখের চাহনি অন্য প্রকার হইয়া যাইত - স্থির ও নিশ্চল। ইহা বর্ণনা করা কাহারো সাধ্য নয়। আমি এ স্থলে কিছু আভাস দিতে প্রয়াস পাইলাম মাত্র। রাজযোগের চরম অবস্থায় পৌঁছিলে এইরূপ হইয়া থাকে।

No comments:

Post a Comment