আমি নিরঞ্জন মহারাজের কাছে শুনিয়াছিলাম যে, তিনি প্রথম অবস্থায় অফিসে চাকরি করিতেন। তিনি কয়েক বার দক্ষিণেশ্বরে যাইয়া পরমহংস মশাই-এর সহিত সাক্ষাৎ করেন। একদিন পরমহংস মশাই তাঁহার জিহ্বায় কি লিখিয়া দিয়া জপ করিতে বলেন। তখন তাঁহার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হইল না। পরে বাড়ি আসিলে তিনি দেখেন যে দেহের অভ্যন্তরে অনবরত জপ চলিতেছে। ঘরে প্রদীপ নিবাইয়া চোখ বন্ধ করিয়া শুইলেও চোখের উপর যেন জ্যোতির্বিন্দুসমূহ নড়িতেছে। স্নান-আহার, কাজ-কর্ম করা, প্রভৃতি সকল অবস্থার মধ্যেই জপ চলিতেছে। এইরূপ জপ তিন দিন তিন রাত্রি হইতে লাগিল। তিনি জপ-ধ্যানে অনভ্যস্ত ছিলেন, এইজন্য ভয় পাইয়া মনে করিলেন যে, মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়াছে। অবশেষে তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাইয়া পরমহংস মশাইকে বলিলেন, "মশাই এ কি করেছেন? আমি যে ঘুমুতে পারি না, অন্য কোনো চিন্তা করতে পারি না।" পরমহংস মশাই সেই শক্তি তুলিয়া লইয়া হাসিয়া বলিলেন, "একে বলে - অজপা জপ।"
এই 'অজপা জপ' কি? - প্রথমতঃ সাধক জিহ্বা দিয়া জপ করে, তাহার পর মন দিয়া জপ করে। ইহা হইল সাধারণভাবে জপ করা বা জপ করিবার চলিত প্রথা। কিন্তু মন বা চিৎ-শক্তি যখন খুব গভীর স্নায়ুতে চলিয়া যায়, তখন প্রথম যে শক্তি প্রয়োগ করা হইয়াছিল বা যে Impetus দেওয়া হইয়াছিল, সেই প্রথম পরিচালিত বা প্রধাবিত শক্তি, নিজ শক্তিবলে উদ্বুদ্ধ হইয়া অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে নিরন্তর সমভাবে প্রধাবিত হয়। এইরূপ অবস্থায়, বাহ্যিক স্নায়ু বা বাহ্যিক মন, অবস্থা অনুযায়ী সাময়িকভাবে নানা কার্য করিয়া থাকে; কিন্তু আভ্যন্তরীণ স্নায়ু বা আভ্যন্তরীণ মনও ভিন্ন গতিতে ভিন্ন চিন্তা ও ভিন্ন ক্রিয়া করিয়া থাকে। ইহা হইল মনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা - Bifurcation of mind।
স্বামীজী লন্ডনে রাজযোগের বক্তৃতাকালে এই বিষয়ে অনেক কথা বলিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন যে, এই অবস্থায় স্থূল-স্নায়ুক্রিয়া এক প্রকার হইবে এবং অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুক্রিয়া আর এক প্রকার হইবে; অর্থাৎ সাময়িকভাবে নিজেকে বিদেহ হইয়া যাইতে হয়। এই অবস্থায় সূক্ষ্ম-মন বা সূক্ষ্ম-স্নায়ুপ্রসূত শক্তি স্থির দ্রষ্টারূপে অবস্থান করে। এইজন্য তখন সূক্ষ্ম-মন জগৎকে অন্য প্রকারে দেখে বা ভাবলোকে অবস্থান করিয়া ভাবসমূহকে প্রত্যক্ষ দর্শন করে।
এই দর্শন হইল - স্থির, নিশ্চল ও গম্ভীর। অপর কথায় ইহাকে বিভোর বা তন্ময় অবস্থা বলা হইয়া থাকে। উদ্ভ্রান্ত অবস্থা ইহা নয়। উদ্ভ্রান্ত-চিত্ততা হইল বিকৃত অবস্থা - স্থূল-স্নায়ুর গতিরোধ হওয়ায় চিৎ-শক্তি বিভিন্ন শাখায় ও বিভিন্ন স্রোতে প্রধাবিত হইয়া থাকে; ইহা হইল স্নায়ুদৌর্বল্যের চিহ্ন। কিন্তু মনকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া চিন্তাস্রোতকে জাগ্রত করা বা বিদেহ হওয়া হইল অতি উচ্চ অবস্থার কথা। মন যখন দ্বিধাবিভক্ত হয়, তখন জগতের সম্পর্কসমূহ স্থূল-স্নায়ু দিয়া পূর্বে যেরূপ পরিলক্ষিত হইয়াছিল, সেইরূপ হয় না; তখন নূতন ভাব ও নূতন চিন্তা আসিয়া থাকে এবং জগতের বস্তুসমূহের মধ্যে নূতন প্রকার সম্পর্ক স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। ইহা হইতে আরও সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে মনকে তুলিলে, বাহ্যিক বিকাশ করিবার শক্তি বা স্থূল-স্নায়ুপ্রক্রিয়াসমূহ ক্রমশঃ নিষ্ক্রিয় হইয়া অবশেষে, বিলুপ্ত হইয়া যায়; তখন খণ্ড চিন্তাশক্তি বা খণ্ড রূপসমূহ বিলুপ্ত হইয়া একীভূত হইয়া যায়।
স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে এক রাত্রে বলিয়াছিলেন, "I meditated even on the tips of my fingers." - অর্থাৎ আমি আঙুলের অগ্রভাগ দিয়াও জপ করিয়াছি। সাধারণ লোকে মনে করিবে যে, জপ জিহ্বা দিয়া হয়, মন দিয়া হয়, কিন্তু আঙুলের অগ্রভাগ দিয়া জপ হয় - ইহা কিরূপে সম্ভব?
এই বিষয়টি বুঝিতে হইলে বহুবিধ দার্শনিক মত ও প্রক্রিয়া জানা আবশ্যক। প্রথম প্রশ্ন হইল, 'মন' কাহাকে বলে? - য়ুরোপীয় দর্শনশাস্ত্রে 'মন' যে কি বস্তু বা পদার্থ, তাহা কিছু নির্ণয় করা হয় নাই। এজন্য বিভিন্ন য়ুরোপীয় দার্শনিকগণ নিজ নিজ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী নিজ নিজ মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু স্নায়ু-বিজ্ঞান অনুযায়ী চিন্তা করিলে ইহা বলিতে পারা যায় - Nerves are supposed to be hollow canals and the finest atomic particles inside the hollow canals, by constant oscillation or combustion, give out the imbedded energy, which in its onward course, forms a current called 'mind'. - অর্থাৎ, স্নায়ুসমূহ ফাঁপা বা শূন্যগর্ভ বলিয়া বিবেচিত। কিন্তু একেবারে শূন্যভাব প্রকৃতির বিরোধী; এইজন্য এই স্নায়ু বা নালীসমূহের ভিতর পরমাণুসমূহ - অণু, দ্ব্যণুক ও ত্রসরেণুসকল অবস্থান করে। কিন্তু, পরমাণু কখনো স্থির, নিশ্চল ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকিতে পারে না, এইজন্য উহা নিরন্তর স্পন্দিত হইতেছে। পরমাণুর এই স্পন্দনজনিত হউক, বা দহনজনিত হউক - উহার অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ হইয়া থাকে। পরমাণুপ্রসূত এইরূপ শক্তিধারা এক বা ততোধিক সূক্ষ্ম স্নায়ুপুঞ্জ দিয়া সঞ্চালিত ও প্রধাবিত হইলে সমষ্টিভাবে এক শক্তিরেখা উদ্ভূত হয়। ইহাকেই 'মন' বলা হয়। রাজযোগে চিত্তকে মন-উপাদান - Mind stuff বলা হইতেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হইল, মনের অবস্থান কোথায়? প্রাচীন য়ুরোপীয় মত হইল, মন মস্তিষ্কে থাকে। কাহারো মতে, হৃদয়ে বা হৃৎপিণ্ডে থাকে, ইত্যাদি বহুবিধ মত আছে। কিন্তু স্নায়ু-বিজ্ঞান দিয়া পর্যালোচনা করিলে বেশ দেখা যায় যে, প্রত্যেক স্নায়ুর ভিতরেই প্রক্রিয়া হইতেছে। যেমন, ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্নার (বামে ইড়া, দক্ষিণে পিঙ্গলা ও মেরুদণ্ডমধ্যে সুষুম্না) প্রক্রিয়া হইয়া থাকে, তেমনি অন্যান্য প্রত্যেক স্নায়ুরও প্রক্রিয়া হইয়া থাকে। স্থূল-স্নায়ু দিয়া শক্তি সঞ্চালিত হইলে স্থূল বা নিম্ন চিন্তা হয় এবং সূক্ষ্ম বা উচ্চতর স্নায়ু দিয়া শক্তি সঞ্চালিত হইলে, উচ্চতর চিন্তা হইয়া থাকে। এইজন্য স্নায়ুপুঞ্জকে স্থূল, সূক্ষ্ম, প্রভৃতি নানা প্রকারে বিভক্ত করা হইয়াছে।
এই সকল বিষয়ে বিশেষভাবে পরিজ্ঞাত হইলে স্পষ্ট বুঝা যায় A mind everywhere, the mind nowhere. অর্থাৎ মন সাধারণভাবে দেহের সর্বস্থানে পরিব্যাপ্ত; কোনো বিশেষ স্থানে ইহার অবস্থিতি নাই। এইজন্য আঙুলের অগ্রভাগেও মন আছে; এবং যদি অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুকে প্রবুদ্ধ বা জাগ্রত করা যায়, তাহা হইলে আঙুলের অগ্রভাগ দিয়াও জপ বা চিন্তা করা যাইতে পারে। স্নায়ুবিজ্ঞানের এই মত প্রচলিত য়ুরোপীয় দার্শনিক মত হইতে স্বতন্ত্র। এইজন্যই, স্বামীজী গম্ভীরভাবে বলিয়াছিলেন, "I meditated even on the tips of my fingers. - আমি আঙুলের অগ্রভাগ দিয়াও জপ করিয়াছি।" পরমহংস মশাই যে অজপা জপের কথা বলিয়াছিলেন, ইহা তাহাই। অতি গভীর স্তরের সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহ সঞ্জীবিত করিতে পারিলে, শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়া জপ বা চিন্তা করিতে পারা যায়। রাজযোগ জগৎকে এই নূতন ভাব দিতেছে। এই সকল গভীর চিন্তা করিবার বিষয়; শব্দ-বিন্যাস বা তর্ক-যুক্তির বিষয় নহে।
এখন প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, আমরা কি প্রকারে চিন্তা করিয়া থাকি? - নিম্ন স্তরে বা সাধারণ অবস্থায় আমরা স্থূল-স্নায়ু দিয়া চিন্তা করি এবং মস্তিষ্কে সেই শক্তি প্রধাবিত হওয়ায়, অল্পক্ষণের ভিতর শ্রান্ত হইয়া পড়ি এবং মস্তিষ্কের ভিতর নানা প্রকার যন্ত্রণা আসিয়া থাকে। ইহা হইল, প্রচলিত প্রথায় চিন্তা করা। মস্তিষ্কের পরমাণুসমূহ বা 'গ্যাংগ্লিয়নিক সেল'-সমূহ যাহা দেখিতে গুগলি বা বাংলা পাঁচের মতো, ধূসর বর্ণ, সেগুলি নষ্ট হইয়া যায়। স্থূল-স্নায়ুর পরমাণুসকল ক্ষয় হইয়া যাওয়ায়, আমাদিগকে বহির্দেশ হইতে পুষ্টিকর ও উত্তেজক আহারসামগ্রী শরীরের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিতে হয়। এই সকল বাহ্যিক পরমাণু - আহার্য, জল ও বায়ু, এই তিন বস্তুর পরমাণুসকল শরীরের বিনষ্ট পরমাণুসকলের স্থান পুনরায় অধিকার করে। পূর্ব পরমাণুসকল নষ্ট হইয়া অনবরত প্রস্রাব হয়; কখনো বা গায়ে ঘাম হয় এবং কখনো কখনো মুখ দিয়াও লালা নির্গত হয়। আহার্য বস্তু বা সংরক্ষণশীল (Preservative) এবং রক্ষণশীল (Protective) পদার্থসমূহের পরমাণুসকল নষ্ট পরমাণুসমূহের স্থান অধিকার করিয়া শরীরকে সমভাবে ও সতেজভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় রাখিয়া দেয়। স্থূল-স্নায়ু দিয়া চিন্তা করায় এইরূপই হইয়া থাকে।
আর এক প্রকার চিন্তাধারা আছে। মন বা চিৎ-শক্তি যখন সূক্ষ্ম স্নায়ুতে যায় এবং সূক্ষ্ম-স্নায়ু হইতে কারণ-স্নায়ুতে প্রধাবিত হয়, তখন উহা স্থূল-স্নায়ুর আবরণী হইতে সম্পূর্ণ পৃথক হইয়া যায়। স্থূল-স্নায়ুপুঞ্জ কেবল আবরণস্বরূপ হইয়া থাকে বা বাহ্যিক রক্ষণশীল আয়তনস্বরূপ প্রতীয়মান হয়, অভ্যন্তরস্থিত সূক্ষ্ম স্নায়ুপুঞ্জ বা কারণ-স্নায়ুপুঞ্জ, স্থূল-স্নায়ুপুঞ্জ হইতে একেবারেই দ্বিধাবিভক্ত হইয়া যায় - এক স্তরের স্নায়ুপুঞ্জ অপর স্তরের স্নায়ুপুঞ্জের সহিত সংলগ্নও বটে আবার অসংলগ্নও বটে, ঠিক যেন একটি সূক্ষ্ম ব্যক্তি মাংস বা স্নায়ুর আবরণীর ভিতর বাস করিতেছে।
পরমহংস মশাই এ বিষয়ে উদাহরণ দিতেন; যেমন সুপারি শুকাইয়া যাইলে উপরকার খোলাটার ভিতরে তাহা থাকে, ঝনঝন করিয়া আওয়াজ হয়। সুপারিটিকে রক্ষার জন্য উপরকার খোলাটির আবশ্যক আছে।
আর একটি উদাহরণ তিনি দিতেন: যেমন চাল ও চালের তুষ। উপরকার খোলা বা তুষ বা আবরণী না থাকিলে ভিতরকার চালটি থাকিতে পারে না। উপরকার তুষটি থাকায় ভিতরকার চালটি রক্ষা পাইতেছে এবং যদিও তুষ হইতেই প্রথম অবস্থায় চালের উৎপত্তি হইয়াছে, কিন্তু ধানটি পাকিয়া গেলে তুষ ও চাল আলাদা হয়। তুষটি চালের সংলগ্নও বটে অসংলগ্নও বটে। উদাহরণ দুইটি, অতি সুন্দর।
চিৎ-শক্তি যখন সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে যায়, তখন বাহ্যিক স্থূল-স্নায়ুসকল নিমিত্তমাত্র হইয়া থাকে। স্থূল অবস্থায় মস্তিষ্ক, হাত, পা, আঙুল প্রভৃতি পৃথক ও স্বতন্ত্র সংজ্ঞায় অভিহিত হয় কারণ, স্থূল-স্নায়ুসকল ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পরিবর্ধিত হইয়াছে এবং ভিন্ন প্রকারে সক্রিয় হইয়া থাকে। কিন্তু সূক্ষ্ম বা কারণ অবস্থায় এইরূপ কোনো পার্থক্য থাকে না। মস্তিষ্কের ভিতর যে সকল সূক্ষ্ম স্নায়ু আছে, আঙুলের অগ্রভাগেও সেই সকল সূক্ষ্ম-স্নায়ু আছে - সর্বত্রই এক প্রকার সূক্ষ্ম-স্নায়ু।
সাধারণভাবে চিন্তা করিতে হইলে স্থূল-স্নায়ু দিয়া চিন্তা করা আবশ্যক, কারণ তখন আমরা খণ্ড বা বিচ্ছিন্ন ভাবে চিন্তা করি। বিশ্লিষ্ট ভাবে চিন্তা করা হইল স্থূল-স্নায়ুর প্রক্রিয়া; এইজন্য আমরা সাধারণতঃ মস্তিষ্ক দিয়া চিন্তা করি, হাত-পা ইত্যাদি দিয়া চিন্তা করি না। কিন্তু সূক্ষ্ম স্নায়ু বা কারণ-স্নায়ুতে যাইলে, প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভিতর সমভাবে সূক্ষ্ম-স্নায়ু থাকায়, চিৎ-শক্তির প্রবাহ সর্বত্র সমভাবে হইয়া থাকে। এইজন্য বলা হয় - Think not through your brain but through your nerves. Bring down the ideas to your nerves. Be saturated with the ideas. - অর্থাৎ স্নায়ু দিয়া চিন্তা করিবে; মস্তিষ্ক দিয়া চিন্তা করিবেনা বা ভাবসকলকে স্নায়ুর ভিতর আনয়ন করো; ভাবে তন্ময় হইয়া যাও।
এইরূপ সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে অবস্থান করার নাম হইল বিদেহ-অবস্থা বা জীবন্মুক্ত-অবস্থা। স্থূল-স্নায়ুতে থাকিলে যেমন ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি প্রভৃতি হইয়া থাকে, কারণ স্থূল পরমাণুপুঞ্জ নষ্ট হওয়ায় সেগুলির স্থান পরিপূর্ণ করিবার জন্য বাহ্যিক উপকরণের আবশ্যক হয়, সূক্ষ্ম স্নায়ুতে যাইলে তেমন ক্লান্তি ইত্যাদি কিছু থাকে না, স্নায়ু-প্রক্রিয়া অন্য প্রকার হয়। এইজন্য পরমহংস মশাই নানা শ্রেণীর লোকের সহিত নানা বিষয়ে নিরন্তর কথা কহিয়া যাইতে পারিতেন। শ্রোতারা ক্লান্ত হইতেন, কিন্তু তাঁহার কোনো ক্লান্তি বা বৈষম্য হইত না। বিদেহ-অবস্থা বা জীবন্মুক্ত-অবস্থা কাহাকে বলে, সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে অবস্থান যে কি ব্যাপার, পরমহংস মশাই-এর বিষয় বিশেষভাবে চিন্তা করিলে তাহা বুঝিতে পারা যায়। তিনি যে কতদূর সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে উঠিতেন, তাহা সাধারণ অবস্থায় বুঝা যাইতে পারে না। তিনি দেহের ভিতর থাকিতেন, কিন্তু দেহ তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারিত না।
স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে বলিয়াছিলেন, "প্রথম মনে করো, নিজেই সম্মুখে বসিয়া আছ - নিজেকে দুই ভাগ করিয়া দেখিবার চেষ্টা করিতেছ, নিজেই যেন নিজের প্রতীক, নিজেই নিজের দর্পণস্বরূপ হইয়াছ।" প্রথম, চরণ হইতে দেখিতে আরম্ভ করিতে হয়, তাহার পর, ক্রমে ক্রমে, বক্ষঃস্থল, হস্ত ও গ্রীবায় চিত্তবৃত্তি সংযোগ করিতে হয়; অবশেষে, মুখ ও চক্ষুতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতে হয়। এইরূপ করিলে, অতি সূক্ষ্ম স্নায়ুতে চিত্তবৃত্তি প্রধাবিত হয় এবং স্থূল দেহজ্ঞান বিলুপ্ত হইয়া অশরীরী অবস্থা বা বিদেহ-অবস্থা লাভ হয়।
অপর একটি কথা স্বামীজী বলিয়াছিলেন, "ভাবিবে যে নিজে মরিয়া পড়িয়া আছ, আর নিজেই দাঁড়াইয়া তাহা দেখিতেছ। শববাহকেরা তোমার মৃতদেহটি লইয়া যাইল; দেহটিকে চিতায় স্থাপন করিয়া অগ্নিসংযোগ করিয়া তাহারা দাঁড়াইয়া আছে; মৃতদেহ ভস্ম হইয়া যাইল; - নিজেই তাহা দেখিতেছ। এইরূপ ধ্যান করিলে সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে বা বিদেহ-অবস্থায় উপনীত হওয়া যাইতে পারে।"