Saturday, April 28, 2018

প্রদর্শিকা

'অব্যক্ত' বা 'অখণ্ড' শক্তি মানুষের বোধের অতীত। অখণ্ড শক্তির বিষয় আমরা চিন্তা করিতে পারি না, কিন্তু তাহার সহিত একীভূত হইয়া যাইতে পারি। অব্যক্ত বা অখণ্ড শক্তিকে আমরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া থাকি কারণ মানুষের চিত্তে এইরূপ তিন অবস্থা হয়। অবশ্য ইহা আমাদের কল্পনা মাত্র। অখণ্ড শক্তির নিম্ন-স্তর হইল শক্তির সাম্য-অবস্থা - Equilibrium state of Energy। সাম্য অবস্থার নিম্ন-স্তর হইল চঞ্চল অবস্থা - Active state of Energy। চঞ্চল অবস্থা হইতে পার্থক্য দেখাইবার জন্য সাম্য অবস্থা বলা হয়; যেন চঞ্চল অবস্থা ধীরে ধীরে উপশান্ত হইয়া অখণ্ড-ভাব আসিবার উপক্রম হইতেছে। অখণ্ড ও খণ্ড - এই দুই ভাগের মধ্যবর্তী অবস্থাকে সাম্য-অবস্থা বলা হয়। সাম্য-অবস্থা পর্যন্ত এক প্রকার চিন্তাশক্তি থাকে; তাহার পর চিন্তাশক্তি বিলুপ্ত হয়। 'চিন্তা' হইল বিভিন্ন কম্পন বা প্রকম্পনের পরিমাণ, দ্বিধাবিভক্ত বা নানা খণ্ডে বিভক্ত এবং দেশ-কাল-নিমিত্তের অন্তর্ভুক্ত। এইজন্য চিন্তা সেখানে চলিতে পারে না।

শক্তির চঞ্চল বা সক্রিয় অবস্থা হইতেই শক্তির বিষয় আমাদের কিঞ্চিৎ বোধগম্য হয়। এই সক্রিয় শক্তি বহু ভাগে বিভক্ত হইয়া যায়, যেন এক-একটি যতি বা রেখা বা সূত্র প্রধাবিত হইতেছে। শক্তি যখন সক্রিয় বা চঞ্চল-ভাবে থাকে, তখন ইহার প্রধাবমান অবস্থা হইতে স্পন্দন উদ্ভূত হয়। এই স্পন্দন হইতে 'গুণ' উদ্ভূত হয়; এবং গুণ, দুই-এর অধিক বিন্দুতে বা ক্ষেত্রে সমাহিত হইলেই 'রূপ' বা 'অবয়ব' বা 'পরমাণু' সৃষ্টি হয়, ইহাকে রূপ বা অবয়বের অবস্থা বা পরমাণুর অবস্থা বলা হয়। একরৈখিক বা একমাত্রিক পরমাণু আমাদের চিন্তার অতীত। দুই-রেখা-যুক্ত বা দুইমাত্রাবিশিষ্ট পরমাণুও আমাদের চিন্তার অতীত। তিন রেখা বা তিন মাত্রাযুক্ত পরমাণুই আমাদের চিন্তার গোচর, কিন্তু ইহা আমরা দেখিতে পাই না। এইজন্য এই পরমাণুকে 'চিৎ-জড়-গ্রন্থি' বলা হয়। ইহা একভাবে হইল 'চিৎ', অপরভাবে হইল 'জড়'। অবয়ব আছে, এইজন্য 'জড়' বলা হইল কিন্তু অবয়ব দেখিতে পাওয়া যায় না, কেবল চিন্তাশক্তির অধীন, এইজন্য ইহাকে বলা হইল 'চিৎ'।

এইরূপে সক্রিয় শক্তি বহু ভাগে বিভক্ত হইয়া স্পন্দিত হওয়ায় পরমাণু উৎপন্ন হয়। পরমাণু হইল a bit of Energy enveloped with Energy and is propelled by Energy, অর্থাৎ পরমাণু - শক্তির এক কণা, শক্তির দ্বারা আবরিত এবং শক্তির দ্বারা প্রধাবিত। অর্থাৎ 'জড়' ও 'চেতন' একই বস্তু, কেবল প্রক্রিয়া ও বিকাশের তারতম্যে ভিন্ন বলিয়া মনে হয়। য়ুরোপীয় দার্শনিক মতে 'জড়' এক বস্তু এবং 'চেতনা' বা 'শক্তি' অপর এক বস্তু। কিন্তু এ স্থলে দেখা যাইতেছে যে 'চেতন' বা 'শক্তি' ও 'জড়' একেরই নামান্তর, কোনো প্রভেদ নাই। একটি হইল পরিদৃশ্যমান, অপরটি হইল অতীন্দ্রিয়গ্রাহ্য, এই মাত্র প্রভেদ।

প্রকম্পনই হইল সৃষ্টির আদি কারণ।

প্রত্যেক পরমাণুর অবিরত কম্পন বা প্রকম্পন হইতেছে। 'দেহ' হইল প্রকম্পমান পরমাণুর স্রোত; উহা বহির্দেশ হইতে বহু ছিদ্র দিয়া এক কেন্দ্রে আগমন করিতেছে, এবং বহু ছিদ্র দিয়া অপসারিত হইতেছে। প্রত্যেক পরমাণু নূতনভাবে আসিতেছে এবং পুরাতন সকল পরমাণুই পরিবর্তিত হইতেছে। অনবরত এই পরিবর্তনের মধ্যে যাহাই স্থিত, তাহাকেই 'দেহ' বলিয়া থাকি।

পরমাণুপুঞ্জ একত্রিত হইয়া এক রেখায় অবস্থান করিলে তাহাকে 'স্নায়ু' বলা হয়। খড়ের আঁটি যেমন একত্রীভূত করিয়া রাখা হয়, স্নায়ুপুঞ্জ ঠিক সেইরূপ অবস্থান করে। স্নায়ুপুঞ্জকে স্তরে স্তরে বিভক্ত করা যাইতে পারে; যেমন, স্থূল-স্নায়ু, সূক্ষ্ম-স্নায়ু, কারণ-স্নায়ু, মহাকারণ-স্নায়ু প্রভৃতি অনেক প্রকার। স্থূল-স্নায়ু, অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ু হইতে ক্রমে ক্রমে ঘনীভূত হইয়া উদ্ভূত হয়।

প্রত্যেক স্নায়ু এক এক প্রকার উদ্দেশ্যে বা এক এক প্রকার ক্রিয়ার জন্য গুণবিশিষ্ট হইয়াছে। দুই গুণ বা দুই ক্রিয়া এক স্নায়ুতে হইতে পারে না।

স্নায়ু হইল অন্তঃশূন্য। অন্তঃশূন্য হইলেও কিন্তু শূন্য স্থানে অতিসূক্ষ্ম পরমাণুসমূহের প্রকম্পন বা ধ্বংসন হওয়ার জন্য উহাদিগের অন্তর্নিহিত শক্তি বিকাশ পায়। এক বা বহু স্নায়ু হইতে এইরূপ শক্তিরেখা বহির্গত বা সঞ্চালিত হওয়ায়, একটি স্রোত বা প্রবাহ সৃষ্টি হয়। এই স্রোত বা প্রবাহ হইল 'মন'।

ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রমতে 'মন' ছয়টি স্তরে বিভক্ত। ইহাদিগকে 'লোক' বলা হয়। ইহাদের মধ্যে প্রথম পাঁচটি, যথা - কামলোক, রূপলোক, ভাবলোক, জ্ঞানলোক ও আনন্দলোক। সর্বোচ্চ স্তর হইল 'অনুত্তর সম্যক্ সম্বোধি' বা 'পূর্ণ পরাজ্ঞান'-এর অবস্থা।

আমরা মনকে যে প্রকার স্নায়ু - স্থূল, সূক্ষ্ম, অতিসূক্ষ্ম, কারণ, মহাকারণ প্রভৃতির ভিতর দিয়া প্রধাবিত করিতে সমর্থ হই, অব্যক্ত বা অখণ্ড শক্তিকেও ঠিক সেইরূপ আখ্যা দিয়া থাকি বা বর্ণনা করিয়া থাকি। সেইজন্য যাহা অখণ্ড, তাহাও পরিশেষে খণ্ড বা জড়বৎ বলিয়া পরিদৃশ্যমান হয়; আর এইজন্য বিভিন্ন ব্যক্তির চিন্তাধারা ও মনোবৃত্তির মধ্যে এত তারতম্য দৃষ্ট হইয়া থাকে।

স্নায়ুর স্পন্দনের অতীত যে কি আছে বা কি অবস্থা, তাহা আমাদের বোধগম্য বা ধারণা হইতে পারে না; কারণ আমাদের সমস্ত জ্ঞান ইন্দ্রিয়গোচর বা অতীন্দ্রিয় যাহাই হউক না কেন, কোনো-না-কোনো স্নায়ু-প্রকম্পন দ্বারা উপলব্ধ হয়। যিনি যে পরিমাণে মনকে সূক্ষ্ম স্নায়ুর ভিতর দিয়া প্রধাবিত করিতে পারিবেন বা সূক্ষ্ম-স্নায়ু জাগ্রত করিতে পারিবেন, তিনি সেই পরিমাণে বিশাল ভাব উপলব্ধি করিতে পারিবেন। যিনি যে পরিমাণে মনকে স্থূল-স্নায়ু দিয়া প্রধাবিত করিবেন বা স্থূল-স্নায়ুতে অবস্থান করিবেন অর্থাৎ মনকে স্থূল-স্নায়ুতে রাখিবেন, তিনি সেই পরিমাণেই বিচ্ছিন্ন ও নিকৃষ্ট ভাবে জগৎকে দেখিতে থাকিবেন। এই সকল কারণে মনকে 'উচ্চ' বা 'নীচ' শব্দে বিভক্ত করা হয়।

মোট কথা, চেষ্টা বা শক্তি নিয়োগ, চলিত কথায় যাহাকে 'সাধনা' বলা হয়, তাহার দ্বারা যিনি যত স্নায়ু জীবিত বা সজীব করিতে পারিবেন বা রুদ্ধ স্নায়ুমুখসমূহ উদ্ঘাটন করিতে পারিবেন এবং উহাদিগের অভ্যন্তরস্থিত নালীর ভিতর দিয়া অতিসূক্ষ্ম পরমাণুসমূহের সাহায্যে শক্তি প্রধাবিত করিতে পারিবেন তাঁহার মনোবৃত্তি বা মনের পরিধি সেই প্রকার হইবে।

এই কয়েকটি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মত স্মরণ রাখিয়া পরমহংস মশাই-এর ক্রিয়াকলাপ অনুশীলন করিলে, আমরা তাঁহাকে এক আশ্চর্য ব্যক্তিরূপে দেখিতে পাই।

Thursday, April 26, 2018

ব্যক্ত ও অব্যক্তের সন্ধিস্থলে

সাধারণতঃ লোকে স্থূল-স্নায়ুপুঞ্জে অবস্থান করে এবং দৈনন্দিন কার্য করিয়া থাকে। এই অবস্থায় সাধারণ লোক ও একজন বিশিষ্ট লোকের মধ্যে কোনো-ই পার্থক্য থাকে না। সাধারণ লোক স্থূল-স্নায়ুস্তর হইতে অন্য স্তরে যাইতে পারে না। কিন্তু মহাপুরুষেরা ইচ্ছা করিলে স্থূল-স্নায়ু বা স্থূল-শরীর হইতে সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা সূক্ষ্ম-শরীরে যাইতে পারেন; এমন কি তাঁহারা সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা সূক্ষ্ম-শরীর হইতে, কারণ-স্নায়ু বা কারণ-শরীরে যাইতে পারেন; কারণ-শরীর হইতে মহাকারণ এবং মহাকারণ হইতে মহাব্যোমেও যাইতে পারেন। সাধারণ লোক স্থূল অবস্থা হইতে আর ঊর্ধ্বগামী হইতে পারেন না। ইহাই হইল সাধারণ লোক ও মহাপুরুষদিগের মধ্যে পার্থক্যের কারণ।

পরমহংস মশাই যখন স্থূল-শরীরে থাকিতেন তখন তাঁহাকে একজন সাধারণ লোকের মতো দেখা যাইত। লক্ষ্য করিতাম তাঁহার কথাবার্তা কিছু জড়ানো তোতলার মতো। অল্প-বয়স্ক বালকেরা সেই সকল কথাবার্তা শুনিয়া হাসিয়া ফেলিত। দেখিতাম যে, তিনি পাড়াগেঁয়ে ভাষায় নানা প্রকার হাসি-কৌতুক করিতেছেন, যাহা কলিকাতার শিক্ষিত সমাজের রুচি-বিগর্হিত। এইজন্য অনেক শিক্ষিত লোক তাঁহাকে উপহাস ও অবজ্ঞা করিত। কিন্তু, এই পাড়াগেঁয়ে লোকই সহসা তাঁহার মনোবৃত্তি পরিবর্তন করিয়া অপর এক রূপ ধারণ করিতে পারিতেন এবং তখন তিনি যে কত উচ্চে উঠিতেন তাহা বুঝিতে পারা যাইত না। সাধারণ অবস্থা হইতে অতি দ্রুতবেগে তাঁহার বিবর্তন হইত। একজন অশিক্ষিত পাড়াগেঁয়ে লোক সহসা কিরূপ হইয়া যাইতে লাগিল। হাতের আঙুলের ও পেশীর স্নায়ুসকল স্থির ও নিশ্চল হইল; চোখের পাতা নিস্পন্দ; দৃষ্টি - একাগ্র, স্থির; মুখের স্নায়ুসকল - দৃঢ়, গম্ভীর ও আজ্ঞাপ্রদ এবং আরো অনেক প্রকার উচ্চ ভাব যেন একসঙ্গে বিকাশ পাইতে লাগিল! একেবারে যেন স্বতন্ত্র ব্যক্তি, পূর্ব ব্যক্তি হইতে অসীম পার্থক্য! এই সময় তাঁহার মুখ দেখিবার জন্য প্রয়াস পাইতাম। কিন্তু অনেক সময় মুখের আভা সহ্য করিতে পারা যাইত না।

দেখিতাম যে, এইরূপ স্থির ও সমাধিস্থ হইয়া যাইবার পূর্বে বা পরে, কি একটি একমাত্রাযুক্ত বা একযতিযুক্ত অস্ফুট শব্দ তিনি উচ্চারণ করিতেন, তাহা কিছু বুঝা যাইত না। এই এক অক্ষরের শব্দ উচ্চারণ করিতে করিতে তিনি স্থির হইয়া যাইতেন; আবার কখনো বা নিশ্চল অবস্থা হইতে সচল অবস্থায় আসিবার সময় এইরূপ শব্দ উচ্চারণ করিতেন। এক অক্ষরের এই শব্দ অস্ফুটভাবে উচ্চারণ করিতে করিতে, ধীরে ধীরে দেহের ভিতর মন আনিতেন। এই সময় দেখিতাম, হাত-পা যেমন পূর্বে স্থির হইয়া গিয়াছিল, এখন সে ভাবটি কাটিয়া গিয়া আঙ্গুলগুলি নরম হইল এবং ডান হাতের কাছে জলের গেলাসটি হইতে একটু জল খাইলেন - ধীরে ধীরে মন যেন দেহে নামিয়া আসিতে লাগিল। তাহার পর অনেক পরিমাণে সাধারণভাবে কথা কহিতে লাগিলেন কিন্তু তখনো অনেকটা ঘোর ঘোর ভাব থাকিত। ক্রমে ক্রমে কয়েক মিনিট পরে, বেশ সাধারণ লোকের মতো হইতেন।

পরমহংস মশাই-এর এই ভাবটি বা অবস্থাটি আমি অনেক বার দেখিয়াছি। এইজন্য বিষয়টি বিশেষ করিয়া এই স্থলে উল্লেখ করিলাম। অপর যাঁহারা ইহা দেখিয়াছেন এবং এখনো জীবিত আছেন, তাঁহারাও এ বিষয় বেশ স্মরণ করিতে পারিবেন। তাঁহার সেই সময়কার মুখের ভাব দেখিয়া বেশ বুঝা যাইত যে, তিনি যেন কি একটি আশ্চর্য, অদ্ভুত ও নূতন জিনিস দেখিয়া সকলকে বলিতেছেন, "শীগ্গির শীগ্গির আয়, এই জিনিস দেখিবি আয়!" এইরূপ ভাব প্রকাশ করিতে করিতেই তাঁহার স্থূল-স্নায়ুর বা প্রাথমিক সূক্ষ্ম-স্নায়ুর ক্রিয়াসমূহ বন্ধ হইয়া যাইত, চিন্তাস্রোত বা বিকাশভাব একেবারে স্তম্ভিত হইয়া যাইত; কেবল মহাকারণ বা অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুর প্রক্রিয়া এবং চিত্ত-আকাশ ও চিৎ-আকাশের বিভিন্ন স্তরের প্রক্রিয়া চলিত। এইজন্য কণ্ঠ দিয়া এই একমাত্রাযুক্ত অস্ফুট ধ্বনি বাহির হইত। এই ধ্বনি প্রচলিত কোনো শব্দের মতো নয় আর ভাষা দিয়া যত না হউক কণ্ঠের স্বর, মুখের কান্তি ও আভা দিয়া, তিনি সেটি কিছু বিকাশ করিবার চেষ্টা করিতেন। এইটি অতি বিশেষ করিয়া চিন্তা করিবার বিষয়। স্বামীজী তাঁহার একটি গীতে এই অবস্থার বিষয় বর্ণনা করিয়াছেন:

"অস্ফুট মন-আকাশে, জগৎ-সংসার ভাসে,
ওঠে ভাসে ডোবে পুনঃ অহং-স্রোতে নিরন্তর।"

ইহা হইল অতি উচ্চ অবস্থার কথা। ইহা হইল 'বাণী'। ব্যক্ত ও অব্যক্তের সন্ধিস্থলে যাওয়া-আসা করিবার সময় এইরূপ বাণী নির্গত হইয়া থাকে। পরমহংস মশাই যখন নির্বিকল্প সমাধিতে যাইতেন, বা নির্বিকল্প সমাধি হইতে নামিতেন, ঠিক সেই সময় এইরূপ একটি বাণী তাঁহার কণ্ঠ হইতে নির্গত হইত। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের জীবনেও এইরূপ ভাবের কথা উল্লেখ আছে। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ও পরমহংস মশাই-এর জীবনে এই ভাবটি দেখিতে পাই। অপর কোনো মহাপুরুষের জীবনে ঠিক এইরূপ ভাবের বিষয় উল্লেখ আছে বলিয়া জানি না।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, মহাপুরুষদিগের যে-সকল উক্তি সাধারণতঃ লিপিবদ্ধ হইয়া ধর্মগ্রন্থরূপে জগতে প্রচলিত হয়, তাহা বিশেষ করিয়া অনুধাবন করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, এক চিন্তা হইতে অপর এক চিন্তার মধ্যে একটি ফাঁক রহিয়া গিয়াছে; দার্শনিক প্রথা অনুযায়ী ধারাবাহিকরূপে তাহা লিখিত হয় নাই। ইহার কারণ এই যে, মহাপুরুষেরা যে সকল উচ্চ চিন্তা করিয়াছিলেন, সেখানে ভাষা চলে না। অপর দিকে উচ্চ অবস্থায় আরোহণকালে বা উচ্চ অবস্থা হইতে অবরোহণকালে, শক্তির সন্ধিস্থলে, তাঁহাদের কণ্ঠ হইতে যে একযতিযুক্ত গভীর ভাবব্যঞ্জক অস্ফুট শব্দ নির্গত হইয়াছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রোতারা তাহার অর্থ বুঝিতে পারেন নাই বা বুঝিবার শক্তিও সকলের ছিল না। এইজন্য অপ্রয়োজনীয় বোধে তাহা পরিত্যক্ত হইয়াছে।

তাহার পর হইল মহাপুরুষগণ-কর্তৃক উক্ত - দার্শনিক মত। দার্শনিক মত হইল অতীব জটিল এবং উপলব্ধির বিষয়। মাত্র এক বা দুই ব্যক্তির জন্য তাহা কথিত হয়, সাধারণ লোকের নিকট দৈনন্দিন কার্যের বিধিনিষেধই হইল ধর্মের চরম অবস্থা বা পরাকাষ্ঠা - Summum bonum of religion। মহাপুরুষদিগের মনস্তত্ত্ব অনুধাবন করিলে দেখা যায় যে, বিধি-নিষেধ হইল ধর্ম-জীবনে অতি তুচ্ছ বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, মহাপুরুষদিগের কণ্ঠ হইতে নিঃসৃত অস্ফুট শব্দ বা বাণী এবং তাঁহাদিগের উক্ত দার্শনিক মত বিলুপ্ত হইয়া যায় এবং যাহা অতি অকিঞ্চিৎকর বিষয় - বিধি-নিষেধ, তাহাই লিপিবদ্ধ হইয়া জগতে ধর্মগ্রন্থ বলিয়া প্রচলিত হয়। এইরূপ গ্রন্থে কোনটি মেধ্য কোনটি অমেধ্য, মাত্র ইহাই বিচার করা হয়। অবশ্য এই সকল ব্যাপার অনিবার্য ও চিরকালই থাকিবে। দার্শনিকগণ ও বৈজ্ঞানিকগণ কিন্তু এই বিধি-নিষেধের মোহে পড়েন না।

Monday, April 23, 2018

দ্রুত চিন্তাস্রোতে

চোখ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় - নরনেত্র, ঋষিনেত্র ও দেবনেত্র। নরনেত্র হইল - সাধারণতঃ যে সকল চোখ দেখা যায়। এইরূপ চোখের দৃষ্টিতে সাধারণ ভাব থাকে। ঋষিনেত্রের দৃষ্টিতে ব্যক্ত হইতে অব্যক্তে যাওয়ার ভাব প্রকাশ পায়। দেবনেত্রের দৃষ্টিতে অব্যক্ত হইতে ব্যক্তে আসার ভাবটি প্রকাশ পায়। শিবের নেত্র হইল ঋষিনেত্র। দুর্গার নেত্র হইল দেবনেত্র। চলিত কথায়, দেবনেত্রকে শঙ্খ, পদ্ম ও মীন নেত্র বলা হয়। শঙ্খনেত্র হইল শঙ্খকে লম্বাদিকে দুই ভাগ করিলে যেরূপ দেখিতে হয় সেইরূপ। পদ্মনেত্র হইল, পদ্মফুলের পাপড়ির মতো দেখিতে। মীননেত্র হইল দুইটি মাছ যেন মুখোমুখি হইবার চেষ্টা করিতেছে। বাংলাদেশের বিগ্রহে, বিশেষতঃ স্ত্রীবিগ্রহে, পদ্মনেত্র প্রযুক্ত হয়; কখনো বা শঙ্খনেত্র প্রযুক্ত হয়। রাজযোগের ভাষায়, শঙ্খনেত্রের দৃষ্টি হইল নাসিকার অগ্রভাগে; পদ্মনেত্রের দৃষ্টি হইল নাসিকার মূলে; মীননেত্রের দৃষ্টি হইল ভ্রূর মধ্যে। এ সকলই দেবনেত্রের লক্ষণ, অর্থাৎ যেন অব্যক্তকে ব্যক্ত করিতেছে।

নরেন্দ্রনাথের নানারূপ ভাবের সময় যাঁহারা চোখের দৃষ্টি নিরীক্ষণ করিয়াছেন, তাঁহারা দেবনেত্র সম্বন্ধে ভাল বুঝিতে পারিবেন। নরেন্দ্রনাথের চোখের দৃষ্টি সাধারণ অবস্থায় ঋষিনেত্রের দৃষ্টির মতো ছিল। শিবনেত্র যে কত প্রকার হয়, ব্যক্ত হইতে অব্যক্তে চলিয়া যাইবার কালে চোখের দৃষ্টি যে কত প্রকার হয়, নরেন্দ্রনাথের চোখের দৃষ্টি দেখিয়া তাহার আভাস পাওয়া যাইত। দেহ ও দেহজ্ঞান ত্যাগ করিয়া সমাধিস্থ অবস্থায় যাইলে, চোখের দৃষ্টি কিরূপ হয়, নরেন্দ্রনাথের চোখে তাহা বিশেষরূপে পরিস্ফুট হইত। মহাশক্তিপূর্ণ, আজ্ঞাপ্রদ, স্তব্ধকারী ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, দূরত্ব ও প্রতিবন্ধসমূহ ভেদ করিয়া যেন অগ্রগামী হইতেছে। এইজন্য বক্তৃতাকালে তাঁহার চোখের দৃষ্টিতেই অনেকে জড়সড় হইয়া যাইত, তিনি যেন অধিনেতা বা অধিনায়করূপে জগৎকে আদেশ করিতেছেন; প্রখর দৃষ্টি, দুর্দমনীয় তেজ - বাধা-বিঘ্ন কিছুই গ্রাহ্য করিতেছেন না; সমস্ত জগৎকে তিনি চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া যেন নূতনভাবে গঠন করিবেন - ঠিক এই ভাবটি তাঁহার চোখের দৃষ্টিতে প্রকাশ পাইত।

পরমহংস মশাই-এর দৃষ্টি ছিল শান্ত স্নিগ্ধ, কিন্তু অতি উচ্চ মার্গের। কত উচ্চ মার্গের বা উচ্চ অবস্থার, কোন্ স্তরের ও কিরূপ তাহার ভাব, তাহা কিছুতে বুঝিতে পারিতাম না কিন্তু দেখিতাম যে, তাঁহার কাছে যাইতে বা তাঁহার চরণ স্পর্শ করিতে কাহারো সাহস হইত না। রামদাদার বাড়িতে বা শিমলাতে যখন তিনি আসিতেন তখন কাহাকেও তাঁহার চরণ স্পর্শ করিতে দেখিয়াছি বলিয়া আমার স্মরণ হয় না। তাঁহাকে ভাল লাগিত, দেখিতে ইচ্ছা করিত কিন্তু একটু তফাৎ হইতে। তিনি যখন ঘরে বসিয়া থাকিতেন তখন একঘর লোক থাকিত; কিন্তু কোনো প্রকার চপল ভাব প্রকাশ পাইত না, এমন কি, কোনো ব্যক্তি অঙ্গসঞ্চালন পর্যন্তও করিত না। কোন্ এক স্নিগ্ধ, অসীম ব্যোমে তিনি সকলের মনকে লইয়া যাইতেন, তাহার কিছুই বুঝা যাইত না। প্রশ্ন করা তো দূরের কথা, এমন কি কেহ মাথা বা ঘাড় নাড়িতেও পারিত না। এইজন্য পরমহংস মশাই-এর চোখের দৃষ্টি যে কত প্রকার হইত, তাহা সেই সময় ঠিক বুঝিতে পারিতাম না, কিন্তু সাধারণ লোকের দৃষ্টি হইতে উহার যে সম্পূর্ণ পৃথক ভাব - অন্তর্দৃষ্টি, এইটাই দেখিতাম। কেহ যেন ইহা সাধারণ লোকের দৃষ্টির সহিত তুলনা না করেন। দেহ ছাড়িয়া মন যখন অন্য স্থানে চলিয়া যাইতেছে, তখন যেমন দৃষ্টি হয়, ঠিক সেইরূপ দৃষ্টি হইয়া চোখের তারা অন্য প্রকার হইয়া যাইত। যে অবস্থায় তাঁহার মন থাকিত, সেই অনুযায়ী তাঁহার চোখের দৃষ্টি ও তারা পরিবর্তিত হইয়া যাইত।

পরমহংস মশাই-এর চোখ মিটমিট করার কারণ বুঝিতে হইলে বলিতে হইবে, তাঁহার চিন্তাস্রোত ও চিন্তাধারা এত দ্রুতবেগে চলিত যে, দেহের সমস্ত স্নায়ু নানাভাবে স্পন্দিত হইত; এই স্রোত বা ধারা প্রকাশ বা বিকাশের নিমিত্ত চোখের পাতা অনবরত পড়িত। স্নায়ুদৌর্বল্য হইলে চোখ মিটমিট করে এবং একরকম ব্যামোও আছে তাহাতে চোখ মিটমিট করে; ইহা সেরূপ নয়। দেখিতাম যে, প্রথমে তিনি অতি সাধারণ লোকের মতো বসিয়া আছেন ও কথা কহিতেছেন; কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই যখন কথাটি জমিয়া যাইল এবং উচ্চ দিকে কথা চলিল, তখন সহসা তাঁহার কণ্ঠের স্বর, মুখের ভঙ্গী ও চোখের দৃষ্টির পরিবর্তন হইতে লাগিল।

ইহা যে কিরূপ অবস্থা বা কত উচ্চ দিকে যাইত, তাহা কিছুই বলিতে পারা যায় না। তবে দেখিতাম যে, পূর্বে যিনি সাধারণ ব্যক্তির মতো ছিলেন, সহসা তিনি পরিবর্তিত হইয়া অপর এক ব্যক্তি হইলেন। এইরূপ দ্রুত চিন্তাস্রোতে সমস্ত সূক্ষ্ম-স্নায়ু প্রকম্পমান হওয়ায় চোখের পাতা অনবরত নড়িত এবং পরে স্থির হইয়া যাইত। তখন আর চোখের পাতা পড়িত না, চোখের চাহনি অন্য প্রকার হইয়া যাইত - স্থির ও নিশ্চল। ইহা বর্ণনা করা কাহারো সাধ্য নয়। আমি এ স্থলে কিছু আভাস দিতে প্রয়াস পাইলাম মাত্র। রাজযোগের চরম অবস্থায় পৌঁছিলে এইরূপ হইয়া থাকে।

Sunday, April 15, 2018

সবিকল্প সমাধিতে

রামদাদার বাড়ির উঠানে পরমহংস মশাই-এর কীর্তনকালে, রামদাদা ও মনোমোহনদাদা অঙ্গসঞ্চালন করিয়া ও ভজনগান করিয়া ভাবকে প্রবুদ্ধ করিবার ও মনকে ঊর্ধ্বে তুলিবার চেষ্টা করিতেন। শারীরিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে তাঁহারা মনকে ভাবরাজ্যে বা ভাবলোকে তুলিবার প্রয়াস পাইতেন। ইহাই সাধারণ কীর্তনের প্রথা। কিন্তু পরমহংস মশাই-এর কীর্তনের মধ্যে অন্য এক প্রকার ভাব দেখিতাম। ভাবের আধিক্য হওয়ায় তাঁহার অঙ্গসঞ্চালন হইত; ভাবরাশি তাঁহার স্নায়ুপুঞ্জকে পরিপূর্ণ করিত। দেহ ভাবরাশির শক্তি ধারণ করিতে পারিত না বলিয়া, কখনো বা অঙ্গসঞ্চালন হইত, কখনো বা দেহ নিস্পন্দ হইয়া যাইত। সেই সময় তাঁহার মুখ হইতে এক প্রকার আভা বাহির হইত। মুখের শ্রী যেন দেখিতে ইচ্ছা করিত কিন্তু তাহা এত গম্ভীর, উচ্চ ও অসাধারণ যে, তাহা অনেকক্ষণ দেখিতেও পারা যাইত না। সেই সময় কেহ তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারিত না বা তাঁহার কাছেও অগ্রসর হইতে পারিত না। দেখিতাম যে, তিনি কীর্তনের সময় ভাবলোকের বিষয় শব্দ না দিয়া অঙ্গসঞ্চালন করিয়া প্রকাশ করিতে প্রয়াস পাইতেন। ভাবসকল যেন পুঞ্জীভূত ও জীবন্ত হইয়া তাঁহার দেহ বা সূক্ষ্ম-স্নায়ুপুঞ্জের ভিতর প্রবেশ করিত এবং সেইজন্য তাঁহার অঙ্গসঞ্চালন হইত। অঙ্গসঞ্চালন দ্বারা যে মনের উচ্চতর ভাব প্রকাশ করা যায়, তাহা এই প্রথম দেখিয়াছিলাম। গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যেরও ঠিক এইরূপ হইত।

সাধারণ লোকের কীর্তন হইল 'গতি' হইতে 'ভাব'-এ - From Motion to Ideas. পরমহংস মশাই-এর কীর্তন হইল ভাব হইতে গতিতে - From Ideas to Motion. এইজন্য সাধারণ লোকের কীর্তন ও নৃত্যের সহিত তাঁহার কীর্তন ও নৃত্যের বিশেষ পার্থক্য আছে। সাধারণ লোকের নৃত্য হইল 'নরনৃত্য'। পরমহংস মশাই-এর নৃত্য হইল 'দেবনৃত্য', যাহাকে চলিত কথায় বলে 'শিবনৃত্য'। ইহার সহিত চপল ভাবের কোন সংস্রব নাই। ইহা হইল অতি উচ্চমার্গে অবস্থানের কথা বা উচ্চ অবস্থার কথা। এই নৃত্য দেখিতে দেখিতে সকলেই নিশ্চল ও বিভোর হইয়া যাইত, যেন, সকলের মনকে তিনি একেবারে ভাবলোকে লইয়া যাইতেন। অত লোক থাকিলেও কেহই কথাবার্তা বা নড়াচড়া করিতে পারিত না; সকলেই যেন নির্বাক, নিস্পন্দ পুত্তলিকার ন্যায় স্থির হইয়া থাকিত, সকলেই অভিভূত ও তন্ময় হইয়া পড়িত, সকলেরই মন তখন উচ্চ স্তরে চলিয়া যাইত। সাধারণ কীর্তনে চপল ভাব থাকে ও মনের গতি চঞ্চল হয় কিন্তু এই কীর্তনে সকলেই যেন স্থির হইয়া যাইত। চাঞ্চল্যের ভিতর - স্থির ভাব, স্পন্দনের ভিতর - নিস্পন্দ ভাব!

এই সময় পরমহংস মশাই-এর দেহ হইতে যেন আর একটি ভাবদেহ বিকাশ পাইত। ইহা যে কত উচ্চ অবস্থার বিষয়, তাহা কেহ নির্ণয় করিতে পারিত না; কিন্তু ইহা যে অতি উচ্চ অবস্থার বিষয় - এইটা সকলেই অনুভব করিত। পরমহংস মশাই যেন ভাবমূর্তি ধারণ করিতেন এবং স্বয়ং চাপ-জমাট ভাবমূর্তি হইয়া সকলের ভিতর অল্পবিস্তর সেই ভাব উদ্বোধিত করিয়া দিতেন। জীবন্ত ভাব কাহাকে বলে, আর কি করিয়া তাহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, তাহাই দেখিতাম। কীর্তনেও যে গভীর ধ্যান হয়, এইটি সর্বদাই অনুভব করিতাম। এইজন্য কীর্তনের সময়, কি গীত বা ভজন-গান হইত, গানের ভাষাই বা কি, তাহা কাহারো স্মরণ থাকিত না বা আনুষঙ্গিক অন্য কোনো ব্যাপারের বিষয়ও মনে থাকিত না। সকলের দৃষ্টি পরমহংস মশাই-এর প্রতি নিবদ্ধ থাকিত। পরমহংস মশাই কিরূপে স্তরে স্তরে নরকায় হইতে দেবদেহে যাইতেন এবং কিরূপে এই দেহের প্রক্রিয়া হয় বা শক্তি-বিকিরণ হয়, তাহাই সকলে লক্ষ্য করিতাম। বেশ স্পষ্ট দেখিতাম যে, সাধারণ মানুষের অবস্থা হইতে কয়েক মিনিটের ভিতর তিনি অপর এক ভাব ধারণ করিয়া অন্য এক ব্যক্তি হইয়া যাইতেন। মানুষের দেহের ভিতর হইতে ভাবদেহ বা দেবদেহ উদ্বুদ্ধ হইত; সর্বত্রই যেন এক মহাশক্তি বা স্পন্দন বিকীর্ণ হইত।

একটি বিষয় আমি বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিতাম যে, কীর্তনকালে পরমহংস মশাই-এর পদসঞ্চালন প্রথম যে পরিধির ভিতর হইত, তাহার পর উহা এক ইঞ্চি আগেও যাইত না বা পিছনেও যাইত না, ঠিক যেন কাঁটায় কাঁটায় মাপ করিয়া তাঁহার পদসঞ্চালন হইত।

বরাহনগর মঠে নরেন্দ্রনাথের এইরূপ পদসঞ্চালন দেখিয়াছিলাম। কোনো কার্যবশতঃ নরেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিবার জন্য আমি একদিন বিকালবেলা প্রায় চারটার সময় বরাহনগর মঠে যাই। গিয়া দেখিলাম যে, বাহিরের বারাণ্ডাতে নরেন্দ্রনাথ অনবরত পায়চারি করিতেছেন, - চক্ষু স্থির, দৃষ্টি উপরের দিকে, কোনো হুঁস নাই, যেন দেহ হইতে মন অনেকক্ষণ বাহির হইয়া গিয়াছে; অভ্যাসবশতঃ পা আপনিই চলিতেছে, নিয়মিত স্থানের মধ্যে পদবিক্ষেপ হইতেছে, একটুও এদিক-ওদিক হইতেছে না। এরূপ দেখিয়া আমার ভয় হইল। ভিতরকার দালানে গিয়া দেখিলাম সেখানে রাখাল মহারাজ, নিরঞ্জন মহারাজ1, শরৎ মহারাজ2 ও আর সকলে রহিয়াছেন। সকলেই মহা উদ্বিগ্ন, কি করিবেন যেন স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। নরেন্দ্রনাথ নাকি দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর হইতে এইরূপভাবেই পায়চারি করিতেছেন এবং কয়েক দিন ধরিয়া তিনি নাকি অনবরত জপ-ধ্যান করিতেছিলেন ও সবিকল্প-নির্বিকল্প সমাধি ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথাবার্তা ও আলোচনায় মগ্ন ছিলেন। রাখাল মহারাজ আমাকে একান্ত কাতরভাবে অনুনয় করিয়া বলিলেন, "ভাই, আমরা কেউ এগুতে সাহস পাচ্ছি না, তুমি সুমুখে গিয়ে খুব চেঁচামেচি করে নরেনের মনকে নামিয়ে আনো।" এই বলিয়া রাখাল মহারাজ আমাকে খুব অনুনয় করিতে লাগিলেন। এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিল তখনো নরেন্দ্রনাথের কোনো হুঁশ নাই, অগত্যা আমি খুব চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলাম। অনেকক্ষণ ধরিয়া ডাকিতে ডাকিতে ক্রমে তাহার পদবিক্ষেপ-গতি স্থগিত হইয়া আসিল। ধীরে ধীরে তার মন দেহে ফিরিয়া আসিল। অন্য কোনো সময় নরেন্দ্রনাথের এইরূপ অবস্থা হইয়াছিল কিনা আমার জানা নাই।

বৌদ্ধ গ্রন্থে আছে যে, ভগবান বুদ্ধদেব সিদ্ধ হইয়া সাত দিন এবং সাত রাত্রি একস্থানে পদসঞ্চালন করিয়াছিলেন, তাহার পর তাঁহার দেহ শ্রান্ত হইয়া ভূমিতে পড়িয়া যায়। ইহাকে 'চঙ্ক্রমণ' বলে। চঙ্ক্রমণ অর্থে পায়চারি করা বুঝায়। চলিত বাংলায় ইহাকে 'চানকানো' বলে। বুদ্ধদেবের চঙ্ক্রমণের স্থানে বুদ্ধগয়ার মন্দিরে একটি লম্বা পিল্পা গাঁথা আছে। বৌদ্ধ গ্রন্থে বলা হইয়াছে যে, বুদ্ধদেবের এক একটি পদবিক্ষেপে এক একটি পদ্মফুল ফুটিয়া উঠিয়াছিল। 'পদ্ম' অর্থে 'ধর্ম' বুঝায়। এইজন্য পরবর্তী কালে ভক্তেরা ইহার নানারূপ অলৌকিক ব্যাখ্যা করিয়াছেন। কিন্তু স্নায়ুবিজ্ঞান ও রাজযোগে ইহাকে এক প্রকার সবিকল্প সমাধি বলা হয়।

এইরূপ সবিকল্প সমাধির লক্ষণ হইল যে পদবিক্ষেপের পরিমাপ প্রথম বারে যতখানি হয়, পরে তাহা অতিক্রম করিয়া এক ইঞ্চিও আগুপাছু হয় না। এইরূপ অবস্থায় সর্বত্রই সাম্যস্পন্দন হইয়া থাকে। শরীরের স্নায়ুপুঞ্জের যেরূপ স্পন্দন হয়, পদবিক্ষেপেও সেইরূপ স্পন্দন হইয়া থাকে। আর একটি লক্ষণ হইল যে, চোখের দৃষ্টি অন্য প্রকার হইয়া যায়। চোখের তারা এমন অবস্থায় আসে যে, তাহাতে দৃষ্টি অন্তর্মুখী হইয়া যায়। এই অবস্থায় মন বা চিন্তাশক্তি শরীরের বিভিন্ন স্থূল-স্নায়ুপুঞ্জ স্তরে স্তরে ত্যাগ করিয়া, অতি সূক্ষ্মস্নায়ু বা সূক্ষ্মতম স্নায়ুতে চলিয়া যায়। এইজন্য স্থূল-স্নায়ু বা বিকাশমুখী স্নায়ুর কোনো প্রক্রিয়া থাকে না; কেবল প্রথম অবস্থায় যেরূপভাবে পদসঞ্চালন বা দেহের ক্রিয়াদি হয়, তাহাই থাকিয়া যায় - যাহাকে Initial impetus বা প্রাথমিক আবেগ বা শক্তি-প্রয়োগ করা বলা হয়, সেইটুকুই থাকিয়া যায়।

পরমহংস মশাই-এর কীর্তনও ঠিক এইরূপ। ইহা সাধারণ কীর্তনের মতো নহে - সকলে মিলিয়া উল্লম্ফন, আবর্তন, হস্তাদি সঞ্চালন, প্রভৃতি ব্যাপার নহে। এই কীর্তনকালে, উপস্থিত সকল লোকই দূরে দাঁড়াইয়া দেখিত মাত্র। এই কীর্তন হইল - সবিকল্প সমাধি। এই সময় পরমহংস মশাই-এর ঘাড় ডান দিকে একটু বাঁকিয়া যাইত এবং তিনি হাত দুইটি সম্মুখে প্রসারিত করিয়া সুমুখ ও পিছনে চলাচল করিয়া স্থির হইয়া এক স্থানে দাঁড়াইয়া থাকিতেন, একেবারে নিস্পন্দ ও নিশ্চল! সবিকল্প সমাধি হইতে তিনি নির্বিকল্প সমাধিতে যাইতেন। সাধারণ ভাষায় ইহাই হইল পরমহংস মশাই-এর কীর্তন। কিন্তু ইহা সাধারণ কীর্তন নহে, ইহা এক স্বতন্ত্র ব্যাপার।

পরমহংস মশাই-এর এই কীর্তনের ব্যাপার লইয়া অনেক কথা বলা যাইতে পারে। কিন্তু ইহা কেবল বলিবার বা পড়িবার বিষয় নয়, চিন্তা বা ধ্যান করিবার বিষয়। এই কীর্তন সম্বন্ধে কিছু বুঝিতে হইলে, প্রত্যেককেই ইহা নিজে চিন্তা বা ধ্যান করিয়া উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিতে হইবে, কারণ ইহা ভাষার ব্যাপার নয়।


1. স্বামী নিরঞ্জনানন্দ।

2. স্বামী সারদানন্দ।

সাম্যস্পন্দনে

উচ্চ অবস্থার বা জীবন্মুক্ত পুরুষদিগের একটি বিশেষ লক্ষণ হইল যে, তাঁহাদিগের কণ্ঠস্বরে সাম্যস্পন্দন - Rhythmical vibration থাকে। প্রথমতঃ দেখা যায় যে, সাধক অনবরত অভ্যাস, সাধনা বা তপস্যা দ্বারা অসামঞ্জস্য ভাব পরিত্যাগ করিয়া সামঞ্জস্য বা সাম্য ভাবে উপনীত হইবার প্রয়াস পাইতেছেন। মানুষের সাধারণ অবস্থা হইল - দ্বন্দ্ব অবস্থা। ইহা হইল, 'বিপরীত গতিবাদ'-এর (Law of Opposite Current-এর) কথা। সাধনা বা তপস্যা হইল - নির্দ্বন্দ্ব অবস্থায় যাওয়া। নিম্ন অবস্থায় প্রত্যেক পরমাণু, প্রত্যেক শক্তিরেখা বা গতি ও প্রত্যেক ভাব পরস্পর বিরোধী হইয়া থাকে। কিন্তু উচ্চ অবস্থায় এ সকলই সাম্যভাবে আসিয়া থাকে। সাধারণ অবস্থায় পরমাণুসকল বা স্নায়ুপুঞ্জ দ্বন্দ্ব অবস্থায় প্রকম্পিত বা সঞ্চালিত হইতেছে। এই সকল কারণে চিত্তে নানা প্রকার বিক্ষুব্ধ ভাব আসিয়া থাকে। যখন যে স্নায়ু প্রবল হইতেছে, তখন চিত্তের বৃত্তিও তাহার অনুযায়ী হইতেছে। এইজন্য স্নায়ুপুঞ্জে বা দেহে নানা প্রকার শ্রান্তি ক্লান্তি প্রভৃতি বিকৃত গতির শক্তি বিকাশ পায়। কিন্তু চিত্ত বা চিৎ-শক্তি স্থূল-স্নায়ু হইতে যেরূপ সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে প্রবাহিত হয়, ধীরে ধীরে সেইরূপ সাম্য-অবস্থা প্রকাশ পাইতে থাকে। পরিশেষে সাধক যখন অল্পক্ষণের জন্যই হউক বা অধিকক্ষণের জন্যই হউক পূর্ণমাত্রায় সেই সাম্য-অবস্থায় উপনীত হইয়া থাকেন, তখন তিনি এক স্বতন্ত্র পুরুষ হইয়া যান।

পরমাণুপুঞ্জ বা স্নায়ুপুঞ্জ অ-সাম্যভাবে স্পন্দিত হওয়ায় শরীরে এক প্রকার দাহকারী উত্তাপ অনুভূত হয়, ত্বক যেন অগ্নিশিখায় দগ্ধ হইতেছে বলিয়া বোধ হয়। ক্রমে যে পরিমাণে সাম্য-অবস্থা আসিতে থাকে, সেই পরিমাণে উত্তাপ ত্বক হইতে নিম্ন বা গভীর স্তরের স্নায়ুতে প্রবেশ করে এবং ত্বক-সংলগ্ন স্নায়ুপুঞ্জ শীতল হইয়া যায়; এমন কি, রক্তসঞ্চালন ধীরে ধীরে কমিয়া যাইয়া নাড়ীর গতি পঁয়তাল্লিশ-বেয়াল্লিশ মাত্রা হইয়া যায়। কখনো বা দেখা যায় যে, নাড়ীর বেগ এরূপ কমিয়া গিয়াছে যে, গতি নাই বলিলেই হয়; অর্থাৎ নাড়ী নিষ্ক্রিয় হইয়া শরীরের উত্তাপ শীতল হইয়া যায়। ঠাণ্ডা বা গরম এই দুইটি অবস্থা হইল একই বস্তুর বিভিন্ন প্রকার বিকাশ; কিন্তু শীতল বা স্নিগ্ধ হইল অন্য এক প্রকার অবস্থা। বাহিরের বায়ু অগ্নির ন্যায় উত্তপ্ত হইয়া প্রবাহিত হইলেও স্নিগ্ধ স্নায়ুতে কোনো ক্রিয়া করিতে পারে না, অর্থাৎ গরম বা কষ্ট কিছুই অনুভূত হয় না বা ব্যথিত করিতে পারে না।

আর একটি বিষয় দেখা যায় যে, পরমাণুপুঞ্জ সাম্যভাবে স্পন্দিত হওয়ায় গায়ের বর্ণ অন্যবিধ হইয়া উজ্জ্বল ভাব প্রকাশ পায়। গায়ের চর্ম বন্ধুর ও কর্কশ না হইয়া মসৃণ অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং এক প্রকার স্বচ্ছ আভা প্রকাশ করে। বর্ণ বা রং দিয়া বিচার করিলেও সাম্যস্পন্দনের তারতম্য বেশ বুঝা যায়। এইজন্য সাধকের গায়ের বর্ণ সাধারণ লোকের গায়ের বর্ণ অপেক্ষা উজ্জ্বল হইয়া থাকে; শ্বাসপ্রশ্বাসও সাম্যভাবে হইয়া থাকে, চোখের দৃষ্টি কর্কশ বা রূঢ় না হইয়া, স্নিগ্ধ বা মধুর হইয়া যায়। সাম্যস্পন্দন হইতে উদ্ভূত শক্তি বা আভ্যন্তর চিন্তা চোখ দিয়া বিকাশ পাইয়া থাকে। হাত ও আঙুলের সঞ্চালন মধুর হয় ও আকর্ষণী শক্তিতে পরিপূর্ণ হয়। কণ্ঠস্বরেও এক মাধুর্যপূর্ণ স্নিগ্ধ ভাব ও আকর্ষণী শক্তি বিকাশ পায়। ইহাই হইল সাম্যস্পন্দনের বহির্বিকাশ। চিৎ-শক্তি যেরূপ সূক্ষ্ম স্নায়ু দিয়া পরিচালিত হইবে, সাম্যস্পন্দন-প্রসূত শক্তিরও সেইরূপ বিকাশ হইবে। যাহা 'খণ্ড', তাহা ত্যাগ করিয়া, যাহা 'অখণ্ড', তাহার চিন্তা করিলেই এই ভাব আসিয়া থাকে।

'পিথাগোরিঅ্যান'-দিগের মত হইল যে, সৃষ্টি সাম্যস্পন্দন হইতে উদ্ভূত হইয়াছে; পরে সৃষ্টি অ-সাম্য বা দ্বন্দ্ব অবস্থায় উপনীত হওয়ায় জগতের দুঃখ-কষ্ট বা নানারূপ বিকৃত ভাব উদ্ভূত হইয়াছে; এবং পরিশেষে সৃষ্টি সাম্যস্পন্দনে বা সাম্য-অবস্থায় উপস্থিত হইবে। তাঁহারা ইহাই সৃষ্টি ও দুঃখ-কষ্টের কারণ বলিয়া নির্ণয় করেন। সাম্যস্পন্দনে পরিসমাপ্ত হওয়াকে শান্ত নির্দ্বন্দ্ব বা দ্বন্দ্বাতীত অবস্থা বলা হয়, যাহাকে চলিত কথায় বলে - শান্তি পাওয়া। এই সাম্যস্পন্দন একটি স্বতন্ত্র বিষয়। দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিকদিগের ইহা একটি বিশেষ মত।

সাম্যস্পন্দন যখন কণ্ঠ দিয়া বিকাশ পায়, তখন তাহাকে 'নাদ' বলে। নাদ-ই হইল ব্রহ্ম। স্বামীজীর কণ্ঠ হইতে আমি কয়েক বার এই নাদ নির্গত হইতে শুনিয়াছি। একটি ঘটনার বিষয় এখানে বিশেষ করিয়া উল্লেখ করিতেছি।

লন্ডনে রাত্রিতে রাজযোগের বক্তৃতা হইতেছিল। বক্তৃতা সমাপ্ত হইল। ঘরের মেঝেতে গালিচা ও নরম স্প্রিং-এর সব চেয়ার পাতা। দেড় শত হইতে দুই শত বিশিষ্ট ঘরের স্ত্রী-পুরুষ ভাল ভাল পোষাক পরিয়া তাহার উপর বসিয়া বক্তৃতা শুনিতেছিল। ইংরাজীতে বক্তৃতা হইতেছিল। সকলে একমনে নিবিষ্টচিত্তে তাহা শুনিতেছিলেন। স্বামীজী সাধারণভাবে বক্তৃতা দিয়া যাইতেছিলেন। মুখের ভাব তখন সাধারণ ছিল। সহসা তাঁহার মুখের সাধারণ ভাব বদলাইয়া স্নিগ্ধ অথচ দুষ্প্রেক্ষ্য ভাব হইয়া গেল। চোখের দৃষ্টি অন্য প্রকার হইল। তিনি হাত দুটি তুলিয়া যেন আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। হঠাৎ যেন তাঁহার দেহ হইতে এক নূতন ব্যক্তি আবির্ভূত হইল। অল্পক্ষণ বিরামের পর তাঁহার কণ্ঠ হইতে সাম্যস্পন্দনযুক্ত নাদ নিঃসৃত হইতে লাগিল। সংস্কৃতে তিনি স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করিতে লাগিলেন:

"মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্নঃ সন্ত্বোষধীঃ॥
মধু নক্তমুতোষসো মধুমৎ পার্থিবং রজঃ।
মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা॥
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাঁ অস্তু সূর্যঃ।
মাধ্বীর্গাবো ভবন্তু নঃ॥"1

এক একবার একটি শব্দ করিয়া বিস্ফারিত নেত্রে ঊর্ধ্বদিকে কি যেন প্রত্যক্ষ করিয়া ক্ষণকাল নিস্তব্ধ হইয়া, বিভোর হইয়া যাইতে লাগিলেন ও পুনরায় বলিতে লাগিলেন। এইরূপে স্বস্তিবাচনটি উচ্চারণ করিতে অনেকক্ষণ সময় লাগিল; স্বামীজীর সমস্ত স্নায়ুপুঞ্জ একেবারেই পরিবর্তিত হইয়া গেল। নূতন এক প্রকারের মানুষ তিনি যেন হইয়া গেলেন। তিনি যেন জগতের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। এমন কি যেন সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রস্বরূপ বা কেন্দ্রীয় শক্তিস্বরূপ হইলেন; ঠিক যেন সেই অশরীরী সাম্যস্পন্দন-কেন্দ্র হইতে এই সৃষ্টি উদ্ভূত হইয়াছে! দেহজ্ঞান বা খণ্ডজ্ঞানের ভাব তখন তাঁহার কিছুই ছিল না। দেশ, কাল ও নিমিত্তের অতীতে তিনি চলিয়া গিয়াছিলেন। স্বস্তিবাচনটি সংস্কৃত ভাষায় উচ্চারিত হইতেছিল, এবং কেহই তাহার অর্থ জানিতেন না। কিন্তু যেমনই স্বস্তিবাচনটি বা নাদটি স্বামীজীর কণ্ঠ হইতে নিঃসৃত হইতে লাগিল অমনি চকিতের ভিতর সকলেই অভিভূত হইয়া নিজ নিজ চেয়ার পিছনের দিকে সরাইয়া দিলেন এবং জানু পাতিয়া বসিয়া মাথা নীচু করিয়া দু-হাত জোড় করিয়া আশীর্বাদ লইতে লাগিলেন। সকলেই নিস্তব্ধ, যেন স্বামীজী ব্যতীত ঘরে আর দ্বিতীয় ব্যক্তি কেহ ছিলেন না। সূক্তের অর্থাৎ শ্লোকের প্রত্যেক শব্দ, মাত্রা, যতি ও ছন্দ সমস্তই স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইতেছিল। নাদ বা সাম্যস্পন্দন ঠিক যেন ঘরের হাওয়ার ভিতর দুলিয়া দুলিয়া ফিরিতে লাগিল। ইহা এত আশ্চর্য বিষয় ও এত উচ্চ অবস্থার কথা যে ভাষা দিয়া বর্ণনা করা যায় না। ইহা হইল প্রত্যক্ষ বা জীবন্ত শক্তি। কেহই স্বস্তিবাচনটির অর্থ জানিতেন না; কিন্তু নাদ বা সাম্যস্পন্দনের এমনই প্রভাব বা শক্তি, যেন শ্রোতৃবৃন্দকে বা দেহগুলিকে বলিল, "উচ্চ আসনে বসিয়া থাকিবার সময় নয়, সকলে এই বাণীর কাছে নত হও, মাথা নত করিয়া থাক।" নাদ যেন সহসা দেহগুলিকে উলটাইয়া ফেলিয়া দিল। স্বামীজীর পূর্ব অবস্থা আর ছিল না - স্বতন্ত্র ব্যক্তি, স্বতন্ত্র দৃষ্টি, স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর! তাহার পর চিত্ত নামিয়া আসিলে, তিনি সাধারণভাবে ইংরাজীতে স্বস্তিবাচনটির অর্থ বুঝাইয়া দিলেন - Blissful is the air. Blissful is the water of the river ইত্যাদি।

ইহাকেই বলে 'নাদব্রহ্ম' বা 'সাম্যস্পন্দন'। পরমহংস মশাই-এর ভিতর এই ভাবটি অনেকবার দেখিয়াছি। উচ্চ অবস্থার সাধক বা সিদ্ধ পুরুষগণের ইহা একটি বিশেষ লক্ষণ।


1. মধুবাতা ঋতায়তে (মধুর বাতাস বহিতেছে); মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ (সিন্ধুসকল অর্থাৎ নদীসকল মধু ক্ষরণ করিতেছে); মাধ্বীঃ নঃ সন্তু ওষধীঃ (আমাদের ওষধীলতাসকল মধুময়ী, অর্থাৎ অমৃতস্রাবিণী হউক)।
মধু নক্তম্ উত উষসঃ (রাত্রিসকল এবং প্রভাতসকল মধুময় হউক); মধুমৎ পার্থিবং রজঃ (পৃথিবীস্থ ধূলিকণাসকলও যেন মধুময় হয়); মধু দ্যৌঃ অস্তু নঃ পিতা (হে পিতঃ, আমাদের আকাশ মধুস্রাবী হউক; কিংবা আমাদের স্বর্গস্থিত পিতৃপুরুষগণ মধুময়, অর্থাৎ আনন্দময় হউন)।
মধুমান্ নঃ বনস্পতিঃ (আমাদের বৃক্ষ মধুমান্ অর্থাৎ মধুর ফলপ্রসবী হউক); মধুমান্ অস্তু সূর্যঃ (সূর্য মধুর কিরণবর্ষী হউক); মাধ্বীঃ গাবঃ ভবন্তু নঃ (আমাদের গাভীসকল মধুস্রাবিণী হউক)।
বৈদিক ভাষা সংস্কৃত ভাষা হইতে কিঞ্চিৎ পৃথক্।

Friday, April 6, 2018

নির্বিকল্প সমাধিতে

দেখিতাম যে, পরমহংস মশাই সাধারণভাবে কথা কহিতেছেন, সহসা তাঁহার দেহের পরিবর্তন হইয়া যাইল! এই পরিবর্তন এত দ্রুত গতিতে হইত যে, শ্রোতৃগণ বা দর্শকগণ সেই গতির অনুসরণ করিতে পারিত না। অবশেষে তিনি স্থির ও নিষ্ক্রিয় হইয়া যাইলেন; হাতের নাড়ীর চলাচল বন্ধ হইয়া যাইল; হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হইল এবং শ্বাসও স্তম্ভিত হইয়া যাইল! এইরূপ অবস্থা বহু বার দেখিয়াছি। এমন কি একজন ডাক্তার পরমহংস মশাই-এর চোখে আঙুল দিয়া দেখিয়াছিলেন যে তাহাতে সংজ্ঞা বা বেদনা হয় কিনা। অবশ্য সেই অবিবেচক ডাক্তারকে সকলে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন।

য়ুরোপীয় শারীরবিজ্ঞানে বলা হয় যে, হৃৎপিণ্ড, শ্বাসযন্ত্র প্রভৃতি হইল স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র - Automatic organ. অর্থাৎ ইচ্ছা করিয়া ইহাদিগের গতিরোধ করা যায় না। কিন্তু এ স্থলে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে যে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রও স্তম্ভিত হইয়া যাইতেছে; কোনো ক্রিয়াই থাকিতেছে না।

পরমহংস মশাই-এর এইরূপ নিস্পন্দ অবস্থা বা সমাধি উপর্যুপরি হইত; ইহার কারণ নির্দেশ করিতে হইলে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মত অনুযায়ী বলিতে হয় যে, স্থূল-স্নায়ু-প্রক্রিয়া এক প্রকার এবং তাহার অভ্যন্তরস্থিত সূক্ষ্ম-স্নায়ুর প্রক্রিয়া আর এক প্রকার বা ঠিক বিপরীত প্রকার। ইহাই হইল বিপরীত গতিবাদের নিয়ম। স্থূল-স্নায়ুর যেমন বহির্মুখী বিকাশ হইবে, সূক্ষ্ম-স্নায়ুরও সেইরূপ অন্তর্মুখী বিকাশ হইবে; কিন্তু এই বিকাশ স্থূল-স্নায়ুর বিকাশের নিয়ম অনুযায়ী হয় না। এইরূপ ক্রমে, অতিসূক্ষ্ম-স্নায়ুর বা মহাকারণ-স্নায়ুর প্রক্রিয়া হইবে। এই অবস্থায় বহির্মুখী বা অন্তর্মুখী বলিয়া কোনো পার্থক্যদ্যোতক শব্দ প্রযোজ্য হয় না। কারণ, স্নায়ু দিয়া যে শক্তি প্রধাবিত হয় তাহাকে 'মন' বলে; এবং ভিন্ন ভিন্ন স্তরের স্নায়ু দিয়া যেরূপ শক্তি প্রধাবিত হইবে মন, চিন্তাশক্তি, দর্শন, জ্ঞান বা উপলব্ধি, সেইরূপ বিভিন্ন প্রকারের হইবে।

লন্ডনে রাত্রে বক্তৃতাকালে স্বামীজী একবার 'সমাধি'-র বিষয় বলিতে বলিতে নিজে সমাধিস্থ হইয়া যাইলেন। গুডউইন1 টেবিলে বসিয়া 'ক্ষিপ্রলিপি'-তে সকল কথা লিখিতেছিল। সে সহসা কাগজ ফেলিয়া দিয়া সম্মুখে আসিয়া স্বামীজীকে দেখিতে লাগিল। শ্রোতৃবৃন্দও তাঁহাদের চেয়ার ফেলিয়া স্বামীজীর কাছে গিয়া দেখিতে লাগিলেন। স্বামীজীর কোন শ্বাসও নাই, কোন স্পন্দনও নাই; নিস্পন্দ পুত্তলিকার মতো তিনি দাঁড়াইয়া আছেন। কয়েক মিনিট পর পুনরায় শ্বাস ফেলিয়া, যেখান পর্যন্ত বক্তৃতা হইয়াছিল ঠিক তাহার পরের ছত্র হইতে বক্তৃতা দিয়া যাইতে লাগিলেন; ভাব, ভাষা ও ব্যাকরণের কোনোই ত্রুটি হইল না। স্বামীজীর এইরূপ সমাধি-অবস্থা দেখিয়া দর্শকবৃন্দ অতিশয় আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলেন।

স্নায়ু-বিজ্ঞান হইল রাজযোগের অন্তর্গত। কিন্তু হঠযোগীরাও এই স্নায়ু-বিজ্ঞানের বহু প্রকার প্রক্রিয়া জানেন। কলিকাতার উপকণ্ঠে ভূকৈলাস রাজবাটীতে এক হঠযোগীকে দেখা গিয়াছিল। তিনি ভূগর্ভে এক মন্দিরের ভিতর বহু কাল যাবৎ, সম্ভবতঃ কয়েক শত বৎসর উপবিষ্ট ছিলেন। যখন পোর্ট ক্যানিং-এর রেলপথ খুঁড়িতে খুঁড়িতে সেই মন্দির বাহির হয়, তখন সেইখানে এই হঠযোগীকে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়। দেখিলে বয়স অনুমান বত্রিশ বৎসর বলিয়া বোধ হইত। কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো দাড়ি ছিল। এই হঠযোগীর গায়ে আগুন পুরিয়া দেওয়াতেও তাঁহার কোনো সংজ্ঞা হয় নাই। এই হঠযোগীর ব্যাপার কলিকাতার তখনকার অনেকেই জানিতেন। আমাদের বাড়ির সকলে এই হঠযোগীকে দেখিতে যাইতেন, কিন্তু আমার তখন অল্প বয়স বলিয়া তাঁহারা আমাকে লইয়া যাইতেন না।

অপর একটি উদাহরণ এ স্থলে দেওয়া যাইতে পারে - বাবা হরিদাসের কথা। বাবা হরিদাস হঠযোগী ছিলেন। একবার তিনি মহারাজ রঞ্জিৎ সিং-এর রাজ্যে উপস্থিত হন। কোনো ব্যক্তি তাঁহার যৌগিক প্রক্রিয়ায় সন্দেহ প্রকাশ করায় বাবা হরিদাস, মহারাজ রঞ্জিত সিং-এর আদেশক্রমে যোগসাধনায় প্রবৃত্ত হন। তিনি দেহের সমস্ত ক্রিয়া বন্ধ করিয়া দিলেন। তখন বাবা হরিদাসকে পাথরের সিন্দুকের ভিতর পুরিয়া ভূগর্ভে প্রোথিত করা হইল এবং তাহার উপর গম বোনা হইল। গম পাকিলে কাটিয়া লওয়া হইল। তাহার পর, সিন্দুক উঠানো হইল। খুলিয়া দেখা গেল যে বাবা হরিদাস পূর্বের মতো শায়িত অবস্থায় রহিয়াছেন। তিনি উঠিয়া সাধারণ লোকের মতো কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। অনুমান করা যাইতে পারে যে তিনি প্রায় ছয় মাস কাল ঐরূপ প্রোথিত অবস্থায় ছিলেন।

কয়েক বৎসর পূর্বে, কলিকাতায় কয়েক জন হঠযোগী অল্পবিস্তর হঠযোগের প্রক্রিয়া দেখাইয়াছেন। হঠযোগীরা বলিয়া থাকেন যে, পুরুষাঙ্গ পর্যন্ত অভ্যন্তরস্থ করা যাইতে পারে।

যাহা হোক এখানে হঠযোগীদিগের কথা বলা উদ্দেশ্য নয়, স্নায়ু-বিজ্ঞানের কথা বলাই উদ্দেশ্য। পরমহংস মশাই কঠোর তপস্যা করিয়া স্নায়ুসমূহ এরূপ সঞ্চালিত করিতে পারিতেন যে, নিজে ইচ্ছামতো স্নায়ুর গতি ও প্রক্রিয়া পরিবর্তন করিতে সমর্থ হইতেন। এইজন্য তিনি যখন অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে চলিয়া যাইতেন, মহাকারণ বা মহাব্যোমে যাইতেন, তখন স্থূল-স্নায়ুর কোনরূপ প্রক্রিয়াই থাকিত না এবং দেহস্থিত যন্ত্রাদিরও কোনো ক্রিয়া হইত না। এইজন্য তিনি নিস্পন্দ হইয়া যাইতেন বা সমাধিস্থ হইয়া পড়িতেন।


1. শ্রীযুত জে. জে. গুডউইন, স্বামী বিবেকানন্দের পরম অনুরক্ত য়ুরোপীয় শিষ্য।

Thursday, April 5, 2018

বিভ্রান্ত অবস্থায়

পরমহংস মশাই-এর এক প্রকার বিভ্রান্ত অবস্থা অনেক বার দেখিয়াছি। ইহা সাধারণ বিভ্রান্তচিত্ততা নহে কিন্তু অতি উচ্চ অবস্থা। এত সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে তাঁহার চিৎ-শক্তি যাইত যে, সেখান হইতে স্থূল-স্নায়ুতে সেই শক্তিকে ফিরাইয়া আনা কষ্টকর। এইজন্য এইরূপ বিভ্রান্ত অবস্থা হইত। চিৎ-শক্তি যখন অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে গমন করিয়া স্থূল-স্নায়ুর দিকে নামিতে থাকে, তখন উহা কোন শ্রেণীর স্নায়ুর ভিতর প্রধাবিত হইবে, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া, হয়ত কর্ণ দিয়া দেখিবার প্রয়াস পায়, চক্ষু দিয়া শুনিবার প্রয়াস পায়। মস্তিষ্কে দৃষ্টি ও শ্রবণের স্নায়ুকেন্দ্র পরস্পর সন্নিকট ও সংশ্লিষ্ট এইজন্য, শক্তি এক কেন্দ্র হইতে অপর কেন্দ্রে চলিয়া যায়; তাহার পর কিঞ্চিৎ বিরামের পর, অভীষ্ট স্নায়ুতে শক্তি প্রধাবিত হয়। সমাধি অবস্থার পর যখন স্থূল দেহে চিৎ-শক্তি প্রত্যাবর্তন করে তখন ঠিক এইরূপ হইয়া থাকে।

ভাব দর্শনে

দর্শনশাস্ত্রের বা রাজযোগের সূত্র হইতেছে - The first impression of truth comes in the form of pictures অর্থাৎ 'সত্য' প্রথমে চিত্ররূপে সম্মুখে আসিয়া থাকে।

পরমহংস মশাই যখন মনকে অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে লইয়া যাইতেন, তখন তাঁহার নিকট জগৎ অন্যরূপে প্রতীয়মান হইত। এইজন্য অতি জটিল প্রশ্ন করিলেও তিনি নূতন সত্য বা ভাব সম্বন্ধে অনবরত বলিয়া যাইতেন। এ বিষয়ে একটি গল্প বলিতেছি। গল্পটি আমি চুনীলাল বসুর1 কাছে শুনিয়াছিলাম।

একবার শিখ সেপাইরা পরমহংস মশাইকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, "মশাই, আমরা সিপাইগিরি করি, মারপিট করাই আমাদের ব্যবসা, সরকারী হুকুমে আমাদের যাকে গুলি মারতে বলবে, তাকেই মারতে হবে। এরূপ অবস্থায় আমরা সংসারে কি রকমে থাকবো?" পরমহংস মশাই এই প্রশ্নটির বিষয় চিন্তা করিতেই দেখিতে পাইলেন যে, সম্মুখে একটি ঢেঁকি আসিয়া ধান ভানিতে লাগিল। পরমহংস মশাই সেপাইদের বলিলেন, "দেখ, ঢেঁকি যেন অনেক মাথা নাড়ে অনেক উঁচু-নীচু ওঠে, গড়ের ভিতর অনেক ধান ভানে, অনেক কাজ করে, কিন্তু দু-পাশের দুটো কাঠি দুটো খোঁটাতে আটকানো থাকে, তাতে কোনো ব্যতিক্রম হয় না - ঠিক এইভাবে মন রেখে কাজ করো।" এই উদাহরণ শুনিয়া শিখেরা খুব আনন্দ করিতে লাগিল। তাহারা বলিল যে এইরূপ উদাহরণ তাহারা কখনো শুনে নাই।

চিন্তা বা তর্ক-যুক্তি স্থূল অবস্থায় আবশ্যক হয়। একটি মন বলিতেছে - 'হ্যাঁ', অর্থাৎ সম্মতি দিতেছে। আর একটি মন বলিতেছে - 'না', অর্থাৎ আপত্তি তুলিতেছে। ইহা হইল দ্বন্দ্ব অবস্থা। এরূপ স্থলে তর্ক-যুক্তির আবশ্যক হয় কারণ, অনিশ্চিত ভাব বা সন্দেহ রহিয়াছে। এইরূপ অবস্থায় কখনই কোনো নির্ধারিত মীমাংসা হয় না। স্থূল-স্নায়ুর প্রক্রিয়ায় অনিশ্চিত ভাব থাকায় সন্দেহ ও দ্বিধা আসিয়া থাকে। ইহাই হইল তর্ক-যুক্তির কারণ। তর্ক-যুক্তি হইল নিম্নস্তরের বিষয়। কিন্তু সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা কারণ-স্নায়ু দিয়া চিৎ-শক্তি প্রধাবিত হইলে ভাবসকল বিগ্রহ বা মূর্তি ধারণ করিয়া সম্মুখে দাঁড়ায়। ইহা হইল 'ভাব-দর্শন' বা Visualisation of ideas।

পরমহংস মশাই-এর কথায় তর্ক-যুক্তি থাকিত না। তিনি স্পষ্টরূপে সকল ভাবই দেখিতেন এবং দৃষ্ট ভাবসমূহ ভাষা দিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিতেন, কিন্তু অনেক সময় ভাবগুলি এত সূক্ষ্ম কারণ বা মহাকারণ-স্নায়ুর অভ্যন্তরস্থিত শক্তি হইতে প্রতিবিম্বিত হইত যে, তিনি নিজে সেগুলি স্পষ্ট দেখিতে পাইতেন, কিন্তু তাহা বিকাশ করিতে পারিতেন না।

সাধারণতঃ লোকে প্রথমে গ্রন্থাদি পাঠ করে, তাহার পর তর্ক-যুক্তি করে, অবশেষে মীমাংসায় আসিয়া থাকে এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতি বা দর্শন করিতে প্রয়াস পায়। প্রচলিতরূপে তর্ক-যুক্তি করিয়াই সাধারণত লোকে ক্ষান্ত হয় এবং মনে করে যে, এইরূপ করায় একটি বড় কাজ হইল। কিন্তু দর্শনের কাছে এই সকল তর্ক-যুক্তি বালকোচিত চাপল্যের মতো বোধ হয়। Philosophy বা 'জ্ঞান-লিপ্সা' হইল গ্রীকদিগের ব্যবহৃত শব্দ। ভারতীয়দিগের ব্যবহৃত শব্দ হইল - 'দর্শন', অর্থাৎ যাহা স্পষ্ট দেখা যায়। এইজন্য কতকগুলি গ্রন্থ পাঠ করিলেই বা তর্ক-যুক্তি করিলেই 'দর্শন' হয় না, বা 'দার্শনিক'-ও হওয়া যায় না। ভাবসমূহকে যিনি স্পষ্ট দেখেন, তিনিই 'দার্শনিক'। পরমহংস মশাই ছিলেন অতি উচ্চ অবস্থার দার্শনিক।


1. অপর নাম নারায়ণ।

গুণাতীত অবস্থায়

'গুণ' আর 'বস্তু' কি? - গুণ হইল যার হ্রাস ও বৃদ্ধি হয়। এইজন্য ইহা পরিবর্তনশীল ও অস্থায়ী। বস্তু হইল, যাহার হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। এইজন্য ইহা অপরিবর্তনশীল, নিত্য, শাশ্বত বা সনাতন। আমাদের যাহা কিছু 'জ্ঞান', তাহা শুধু গুণ সম্বন্ধে হইয়া থাকে। গুণের অপর অংশ হইল জ্ঞান। কিন্তু গুণের অতীত এক অবস্থা আছে। এই অবস্থাকে পরমহংস মশাই 'বি-জ্ঞান'-এর অবস্থা বলিতেন। এই অবস্থায় 'অতীন্দ্রিয় জ্ঞান' আসিয়া থাকে। সাধারণ লোকের জ্ঞান হইল - গুণ সম্বন্ধে; গুণাতীত অবস্থা সাধারণ লোকের উপলব্ধি হয় না।

গ্রন্থাদি পাঠ, তর্ক-যুক্তি প্রভৃতি দিয়া যে জ্ঞানলাভ হয়, তাহাকে 'গুণবর্ধক জ্ঞান' বলে। জগতের চক্ষে গুণবর্ধক জ্ঞানই প্রধান বিষয়; আর এইজন্যই তর্ক-বিতর্ক, দ্বন্দ্ব প্রভৃতি হইয়া থাকে। কিন্তু অতীন্দ্রিয় অবস্থায় বা কারণ-শরীরে মনকে লইয়া যাইলে 'গুণাতীত জ্ঞান' প্রতীয়মান হয়। এই গুণাতীত জ্ঞানের কাছে গুণবর্ধক জ্ঞান অতি সামান্য বিষয়। সাধারণ লোকে গুণবর্ধক জ্ঞান দিয়াই পরমহংস মশাই-এর সহিত তর্ক-বিতর্ক করিতে যাইত এবং মনে করিত যে, পরমহংস মশাই একজন নিরক্ষর ব্যক্তি, তাঁহাকে দুইটা প্রচলিত তর্কযুক্তি দিয়া শীঘ্রই অভিভূত করা যাইবে। কিন্তু কারণ-শরীরে মনকে লইয়া যাইতে পারিলে যে গুণাতীত জ্ঞান আসিয়া থাকে, তাহা অনেকের জানা ছিল না। এইজন্য জগৎকে যে অন্যভাবে দেখা যায়, তাহা অতি অল্প সময়ের ভিতরই পরমহংস মশাই প্রতিদ্বন্দ্বীকে বুঝাইয়া দিতেন। তিনি তর্ক-যুক্তি করিতেন না। তর্ক-যুক্তির উৎপত্তি হয় সন্দেহ হইতে এবং সন্দেহেই উহার সমাপ্তি হয়। কিন্তু তিনি কারণ-শরীরে মনকে লইয়া যাওয়ায় ভাবগুলিকে প্রত্যক্ষ দর্শন করিতেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বীকেও তাহা দেখাইয়া দিতেন। ইহাই ছিল তাঁহার এক অতীব আশ্চর্য শক্তি।

Wednesday, April 4, 2018

শব্দ, ভাব ও শক্তিতে

পরমহংস মশাই-এর সমস্ত কথা কেহই মনে রাখিতে পারেন নাই, রাখা সম্ভবও নয়। কারণ প্রথমে তিনি ভাষা ও শব্দ দিয়া একটি উপাখ্যান বলিতে আরম্ভ করিতেন; উপাখ্যানটি বলিবার অল্পক্ষণ পরেই, উহার ভিতর যে ভাবটি আছে, সেইটি তিনি স্বয়ং হইয়া যাইতেন বা উহার রূপ পরিগ্রহ করিতেন। তিনি যে সকল কথা বলিতেন, তাহা ঠিক যেন একটি জীবন্ত ভাব হইয়া সকলের সম্মুখে আসিতে থাকিত। তখন অনুভব করিতাম যে, ভাবও খণ্ড ও তুচ্ছ জিনিস। ভাবেরও বহু ঊর্ধ্বে, শক্তিতে, সকলের মনকে তিনি লইয়া যাইতেন। সে সময়ে কাহারো আর চিন্তা, তর্ক, যুক্তি, সন্দেহ, দ্বিধা, প্রভৃতি মনের ক্রিয়াসমূহ থাকিত না। সকলেই নিঝুম, নির্বাক্ ও নীরব, যেন ভিন্ন জগতে ভিন্ন ক্ষেত্রে চলিয়া যাইত। 'হাঁ' বা 'না' বলিয়া কোনো শব্দও থাকিত না। সব এক হইয়া যাইত। সকলকে এক অসীম অনন্ত শক্তিতে তিনি লইয়া যাইতেন, যাহাকে বলে - মনটাকে সবিকল্প সমাধিতে লইয়া যাওয়া। শব্দ ও ভাব, পর পর অতিক্রম করিয়া, তিনি এক অসীম শক্তির সহিত মিশিয়া সমাধিস্থ হইয়া যাইতেন। এইজন্য তাঁহার ভাষা, শব্দ ও উপাখ্যান তত মনে রাখা যাইত না।

দেখিয়াছি যে স্বামী বিবেকানন্দও লন্ডনে বক্তৃতাকালে প্রথমে একটি উপাখ্যান শুরু করিতেন; কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই, উপাখ্যানের ভিতর যে ভাবটি থাকিত, তাহা জাগ্রত করিতেন, অবশেষে এক মহান শক্তিতে সকলের মনকে লইয়া যাইতেন। এইজন্য বক্তৃতার তর্ক-যুক্তির দিকে কাহারো দৃষ্টি থাকিত না এবং তাঁহার সকল কথাও কাহারো মনে থাকিত না।

শক্তি-সঞ্চারণকারী এইরূপ ব্যক্তি যে কত উচ্চ অবস্থার মহাপুরুষ বা এই শক্তিকেন্দ্র বা উৎসক্ষেত্র যে কত উচ্চ, তাহা অনুমান করা যায় মাত্র, কিন্তু মাপকাঠি দিয়া পরিমাপ করা যায় না। মাপকাঠি দিয়া সাধারণ লোকের মনের অবস্থা পরিমাপ করা যায়, কিন্তু এত উচ্চ অবস্থার মহাপুরুষের মনের অবস্থার বিষয় কোনো মাপকাঠি দিয়া পরিমাপ করা যায় না। কারণ এইরূপ অবস্থায় তাঁহার মনের সকল প্রকার ক্রিয়াই একেবারে চলিয়া যায়। এইজন্য শক্তিকেন্দ্র বা উৎসক্ষেত্র যে কত ঊর্ধ্বে, তাহা কেহ নির্ণয় করিতে সমর্থ হয় না।

'ভাব' আর 'শক্তি' একই - এই যে দার্শনিক মত, এই তথ্যটি পরমহংস মশাই-এর জীবন দেখিয়া বুঝিতে পারা যায়। জগতে ইহা একটি নূতন ব্যাপার।

বিদেহ অবস্থায়

আমি নিরঞ্জন মহারাজের কাছে শুনিয়াছিলাম যে, তিনি প্রথম অবস্থায় অফিসে চাকরি করিতেন। তিনি কয়েক বার দক্ষিণেশ্বরে যাইয়া পরমহংস মশাই-এর সহিত সাক্ষাৎ করেন। একদিন পরমহংস মশাই তাঁহার জিহ্বায় কি লিখিয়া দিয়া জপ করিতে বলেন। তখন তাঁহার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হইল না। পরে বাড়ি আসিলে তিনি দেখেন যে দেহের অভ্যন্তরে অনবরত জপ চলিতেছে। ঘরে প্রদীপ নিবাইয়া চোখ বন্ধ করিয়া শুইলেও চোখের উপর যেন জ্যোতির্বিন্দুসমূহ নড়িতেছে। স্নান-আহার, কাজ-কর্ম করা, প্রভৃতি সকল অবস্থার মধ্যেই জপ চলিতেছে। এইরূপ জপ তিন দিন তিন রাত্রি হইতে লাগিল। তিনি জপ-ধ্যানে অনভ্যস্ত ছিলেন, এইজন্য ভয় পাইয়া মনে করিলেন যে, মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়াছে। অবশেষে তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাইয়া পরমহংস মশাইকে বলিলেন, "মশাই এ কি করেছেন? আমি যে ঘুমুতে পারি না, অন্য কোনো চিন্তা করতে পারি না।" পরমহংস মশাই সেই শক্তি তুলিয়া লইয়া হাসিয়া বলিলেন, "একে বলে - অজপা জপ।"

এই 'অজপা জপ' কি? - প্রথমতঃ সাধক জিহ্বা দিয়া জপ করে, তাহার পর মন দিয়া জপ করে। ইহা হইল সাধারণভাবে জপ করা বা জপ করিবার চলিত প্রথা। কিন্তু মন বা চিৎ-শক্তি যখন খুব গভীর স্নায়ুতে চলিয়া যায়, তখন প্রথম যে শক্তি প্রয়োগ করা হইয়াছিল বা যে Impetus দেওয়া হইয়াছিল, সেই প্রথম পরিচালিত বা প্রধাবিত শক্তি, নিজ শক্তিবলে উদ্বুদ্ধ হইয়া অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে নিরন্তর সমভাবে প্রধাবিত হয়। এইরূপ অবস্থায়, বাহ্যিক স্নায়ু বা বাহ্যিক মন, অবস্থা অনুযায়ী সাময়িকভাবে নানা কার্য করিয়া থাকে; কিন্তু আভ্যন্তরীণ স্নায়ু বা আভ্যন্তরীণ মনও ভিন্ন গতিতে ভিন্ন চিন্তা ও ভিন্ন ক্রিয়া করিয়া থাকে। ইহা হইল মনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা - Bifurcation of mind।

স্বামীজী লন্ডনে রাজযোগের বক্তৃতাকালে এই বিষয়ে অনেক কথা বলিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন যে, এই অবস্থায় স্থূল-স্নায়ুক্রিয়া এক প্রকার হইবে এবং অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুক্রিয়া আর এক প্রকার হইবে; অর্থাৎ সাময়িকভাবে নিজেকে বিদেহ হইয়া যাইতে হয়। এই অবস্থায় সূক্ষ্ম-মন বা সূক্ষ্ম-স্নায়ুপ্রসূত শক্তি স্থির দ্রষ্টারূপে অবস্থান করে। এইজন্য তখন সূক্ষ্ম-মন জগৎকে অন্য প্রকারে দেখে বা ভাবলোকে অবস্থান করিয়া ভাবসমূহকে প্রত্যক্ষ দর্শন করে।

এই দর্শন হইল - স্থির, নিশ্চল ও গম্ভীর। অপর কথায় ইহাকে বিভোর বা তন্ময় অবস্থা বলা হইয়া থাকে। উদ্ভ্রান্ত অবস্থা ইহা নয়। উদ্ভ্রান্ত-চিত্ততা হইল বিকৃত অবস্থা - স্থূল-স্নায়ুর গতিরোধ হওয়ায় চিৎ-শক্তি বিভিন্ন শাখায় ও বিভিন্ন স্রোতে প্রধাবিত হইয়া থাকে; ইহা হইল স্নায়ুদৌর্বল্যের চিহ্ন। কিন্তু মনকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া চিন্তাস্রোতকে জাগ্রত করা বা বিদেহ হওয়া হইল অতি উচ্চ অবস্থার কথা। মন যখন দ্বিধাবিভক্ত হয়, তখন জগতের সম্পর্কসমূহ স্থূল-স্নায়ু দিয়া পূর্বে যেরূপ পরিলক্ষিত হইয়াছিল, সেইরূপ হয় না; তখন নূতন ভাব ও নূতন চিন্তা আসিয়া থাকে এবং জগতের বস্তুসমূহের মধ্যে নূতন প্রকার সম্পর্ক স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। ইহা হইতে আরও সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে মনকে তুলিলে, বাহ্যিক বিকাশ করিবার শক্তি বা স্থূল-স্নায়ুপ্রক্রিয়াসমূহ ক্রমশঃ নিষ্ক্রিয় হইয়া অবশেষে, বিলুপ্ত হইয়া যায়; তখন খণ্ড চিন্তাশক্তি বা খণ্ড রূপসমূহ বিলুপ্ত হইয়া একীভূত হইয়া যায়।

স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে এক রাত্রে বলিয়াছিলেন, "I meditated even on the tips of my fingers." - অর্থাৎ আমি আঙুলের অগ্রভাগ দিয়াও জপ করিয়াছি। সাধারণ লোকে মনে করিবে যে, জপ জিহ্বা দিয়া হয়, মন দিয়া হয়, কিন্তু আঙুলের অগ্রভাগ দিয়া জপ হয় - ইহা কিরূপে সম্ভব?

এই বিষয়টি বুঝিতে হইলে বহুবিধ দার্শনিক মত ও প্রক্রিয়া জানা আবশ্যক। প্রথম প্রশ্ন হইল, 'মন' কাহাকে বলে? - য়ুরোপীয় দর্শনশাস্ত্রে 'মন' যে কি বস্তু বা পদার্থ, তাহা কিছু নির্ণয় করা হয় নাই। এজন্য বিভিন্ন য়ুরোপীয় দার্শনিকগণ নিজ নিজ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী নিজ নিজ মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু স্নায়ু-বিজ্ঞান অনুযায়ী চিন্তা করিলে ইহা বলিতে পারা যায় - Nerves are supposed to be hollow canals and the finest atomic particles inside the hollow canals, by constant oscillation or combustion, give out the imbedded energy, which in its onward course, forms a current called 'mind'. - অর্থাৎ, স্নায়ুসমূহ ফাঁপা বা শূন্যগর্ভ বলিয়া বিবেচিত। কিন্তু একেবারে শূন্যভাব প্রকৃতির বিরোধী; এইজন্য এই স্নায়ু বা নালীসমূহের ভিতর পরমাণুসমূহ - অণু, দ্ব্যণুক ও ত্রসরেণুসকল অবস্থান করে। কিন্তু, পরমাণু কখনো স্থির, নিশ্চল ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকিতে পারে না, এইজন্য উহা নিরন্তর স্পন্দিত হইতেছে। পরমাণুর এই স্পন্দনজনিত হউক, বা দহনজনিত হউক - উহার অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ হইয়া থাকে। পরমাণুপ্রসূত এইরূপ শক্তিধারা এক বা ততোধিক সূক্ষ্ম স্নায়ুপুঞ্জ দিয়া সঞ্চালিত ও প্রধাবিত হইলে সমষ্টিভাবে এক শক্তিরেখা উদ্ভূত হয়। ইহাকেই 'মন' বলা হয়। রাজযোগে চিত্তকে মন-উপাদান - Mind stuff বলা হইতেছে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হইল, মনের অবস্থান কোথায়? প্রাচীন য়ুরোপীয় মত হইল, মন মস্তিষ্কে থাকে। কাহারো মতে, হৃদয়ে বা হৃৎপিণ্ডে থাকে, ইত্যাদি বহুবিধ মত আছে। কিন্তু স্নায়ু-বিজ্ঞান দিয়া পর্যালোচনা করিলে বেশ দেখা যায় যে, প্রত্যেক স্নায়ুর ভিতরেই প্রক্রিয়া হইতেছে। যেমন, ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্নার (বামে ইড়া, দক্ষিণে পিঙ্গলা ও মেরুদণ্ডমধ্যে সুষুম্না) প্রক্রিয়া হইয়া থাকে, তেমনি অন্যান্য প্রত্যেক স্নায়ুরও প্রক্রিয়া হইয়া থাকে। স্থূল-স্নায়ু দিয়া শক্তি সঞ্চালিত হইলে স্থূল বা নিম্ন চিন্তা হয় এবং সূক্ষ্ম বা উচ্চতর স্নায়ু দিয়া শক্তি সঞ্চালিত হইলে, উচ্চতর চিন্তা হইয়া থাকে। এইজন্য স্নায়ুপুঞ্জকে স্থূল, সূক্ষ্ম, প্রভৃতি নানা প্রকারে বিভক্ত করা হইয়াছে।

এই সকল বিষয়ে বিশেষভাবে পরিজ্ঞাত হইলে স্পষ্ট বুঝা যায় A mind everywhere, the mind nowhere. অর্থাৎ মন সাধারণভাবে দেহের সর্বস্থানে পরিব্যাপ্ত; কোনো বিশেষ স্থানে ইহার অবস্থিতি নাই। এইজন্য আঙুলের অগ্রভাগেও মন আছে; এবং যদি অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুকে প্রবুদ্ধ বা জাগ্রত করা যায়, তাহা হইলে আঙুলের অগ্রভাগ দিয়াও জপ বা চিন্তা করা যাইতে পারে। স্নায়ুবিজ্ঞানের এই মত প্রচলিত য়ুরোপীয় দার্শনিক মত হইতে স্বতন্ত্র। এইজন্যই, স্বামীজী গম্ভীরভাবে বলিয়াছিলেন, "I meditated even on the tips of my fingers. - আমি আঙুলের অগ্রভাগ দিয়াও জপ করিয়াছি।" পরমহংস মশাই যে অজপা জপের কথা বলিয়াছিলেন, ইহা তাহাই। অতি গভীর স্তরের সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহ সঞ্জীবিত করিতে পারিলে, শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়া জপ বা চিন্তা করিতে পারা যায়। রাজযোগ জগৎকে এই নূতন ভাব দিতেছে। এই সকল গভীর চিন্তা করিবার বিষয়; শব্দ-বিন্যাস বা তর্ক-যুক্তির বিষয় নহে।

এখন প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, আমরা কি প্রকারে চিন্তা করিয়া থাকি? - নিম্ন স্তরে বা সাধারণ অবস্থায় আমরা স্থূল-স্নায়ু দিয়া চিন্তা করি এবং মস্তিষ্কে সেই শক্তি প্রধাবিত হওয়ায়, অল্পক্ষণের ভিতর শ্রান্ত হইয়া পড়ি এবং মস্তিষ্কের ভিতর নানা প্রকার যন্ত্রণা আসিয়া থাকে। ইহা হইল, প্রচলিত প্রথায় চিন্তা করা। মস্তিষ্কের পরমাণুসমূহ বা 'গ্যাংগ্লিয়নিক সেল'-সমূহ যাহা দেখিতে গুগলি বা বাংলা পাঁচের মতো, ধূসর বর্ণ, সেগুলি নষ্ট হইয়া যায়। স্থূল-স্নায়ুর পরমাণুসকল ক্ষয় হইয়া যাওয়ায়, আমাদিগকে বহির্দেশ হইতে পুষ্টিকর ও উত্তেজক আহারসামগ্রী শরীরের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিতে হয়। এই সকল বাহ্যিক পরমাণু - আহার্য, জল ও বায়ু, এই তিন বস্তুর পরমাণুসকল শরীরের বিনষ্ট পরমাণুসকলের স্থান পুনরায় অধিকার করে। পূর্ব পরমাণুসকল নষ্ট হইয়া অনবরত প্রস্রাব হয়; কখনো বা গায়ে ঘাম হয় এবং কখনো কখনো মুখ দিয়াও লালা নির্গত হয়। আহার্য বস্তু বা সংরক্ষণশীল (Preservative) এবং রক্ষণশীল (Protective) পদার্থসমূহের পরমাণুসকল নষ্ট পরমাণুসমূহের স্থান অধিকার করিয়া শরীরকে সমভাবে ও সতেজভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় রাখিয়া দেয়। স্থূল-স্নায়ু দিয়া চিন্তা করায় এইরূপই হইয়া থাকে।

আর এক প্রকার চিন্তাধারা আছে। মন বা চিৎ-শক্তি যখন সূক্ষ্ম স্নায়ুতে যায় এবং সূক্ষ্ম-স্নায়ু হইতে কারণ-স্নায়ুতে প্রধাবিত হয়, তখন উহা স্থূল-স্নায়ুর আবরণী হইতে সম্পূর্ণ পৃথক হইয়া যায়। স্থূল-স্নায়ুপুঞ্জ কেবল আবরণস্বরূপ হইয়া থাকে বা বাহ্যিক রক্ষণশীল আয়তনস্বরূপ প্রতীয়মান হয়, অভ্যন্তরস্থিত সূক্ষ্ম স্নায়ুপুঞ্জ বা কারণ-স্নায়ুপুঞ্জ, স্থূল-স্নায়ুপুঞ্জ হইতে একেবারেই দ্বিধাবিভক্ত হইয়া যায় - এক স্তরের স্নায়ুপুঞ্জ অপর স্তরের স্নায়ুপুঞ্জের সহিত সংলগ্নও বটে আবার অসংলগ্নও বটে, ঠিক যেন একটি সূক্ষ্ম ব্যক্তি মাংস বা স্নায়ুর আবরণীর ভিতর বাস করিতেছে।

পরমহংস মশাই এ বিষয়ে উদাহরণ দিতেন; যেমন সুপারি শুকাইয়া যাইলে উপরকার খোলাটার ভিতরে তাহা থাকে, ঝনঝন করিয়া আওয়াজ হয়। সুপারিটিকে রক্ষার জন্য উপরকার খোলাটির আবশ্যক আছে।

আর একটি উদাহরণ তিনি দিতেন: যেমন চাল ও চালের তুষ। উপরকার খোলা বা তুষ বা আবরণী না থাকিলে ভিতরকার চালটি থাকিতে পারে না। উপরকার তুষটি থাকায় ভিতরকার চালটি রক্ষা পাইতেছে এবং যদিও তুষ হইতেই প্রথম অবস্থায় চালের উৎপত্তি হইয়াছে, কিন্তু ধানটি পাকিয়া গেলে তুষ ও চাল আলাদা হয়। তুষটি চালের সংলগ্নও বটে অসংলগ্নও বটে। উদাহরণ দুইটি, অতি সুন্দর।

চিৎ-শক্তি যখন সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে যায়, তখন বাহ্যিক স্থূল-স্নায়ুসকল নিমিত্তমাত্র হইয়া থাকে। স্থূল অবস্থায় মস্তিষ্ক, হাত, পা, আঙুল প্রভৃতি পৃথক ও স্বতন্ত্র সংজ্ঞায় অভিহিত হয় কারণ, স্থূল-স্নায়ুসকল ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পরিবর্ধিত হইয়াছে এবং ভিন্ন প্রকারে সক্রিয় হইয়া থাকে। কিন্তু সূক্ষ্ম বা কারণ অবস্থায় এইরূপ কোনো পার্থক্য থাকে না। মস্তিষ্কের ভিতর যে সকল সূক্ষ্ম স্নায়ু আছে, আঙুলের অগ্রভাগেও সেই সকল সূক্ষ্ম-স্নায়ু আছে - সর্বত্রই এক প্রকার সূক্ষ্ম-স্নায়ু।

সাধারণভাবে চিন্তা করিতে হইলে স্থূল-স্নায়ু দিয়া চিন্তা করা আবশ্যক, কারণ তখন আমরা খণ্ড বা বিচ্ছিন্ন ভাবে চিন্তা করি। বিশ্লিষ্ট ভাবে চিন্তা করা হইল স্থূল-স্নায়ুর প্রক্রিয়া; এইজন্য আমরা সাধারণতঃ মস্তিষ্ক দিয়া চিন্তা করি, হাত-পা ইত্যাদি দিয়া চিন্তা করি না। কিন্তু সূক্ষ্ম স্নায়ু বা কারণ-স্নায়ুতে যাইলে, প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভিতর সমভাবে সূক্ষ্ম-স্নায়ু থাকায়, চিৎ-শক্তির প্রবাহ সর্বত্র সমভাবে হইয়া থাকে। এইজন্য বলা হয় - Think not through your brain but through your nerves. Bring down the ideas to your nerves. Be saturated with the ideas. - অর্থাৎ স্নায়ু দিয়া চিন্তা করিবে; মস্তিষ্ক দিয়া চিন্তা করিবেনা বা ভাবসকলকে স্নায়ুর ভিতর আনয়ন করো; ভাবে তন্ময় হইয়া যাও।

এইরূপ সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে অবস্থান করার নাম হইল বিদেহ-অবস্থা বা জীবন্মুক্ত-অবস্থা। স্থূল-স্নায়ুতে থাকিলে যেমন ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি প্রভৃতি হইয়া থাকে, কারণ স্থূল পরমাণুপুঞ্জ নষ্ট হওয়ায় সেগুলির স্থান পরিপূর্ণ করিবার জন্য বাহ্যিক উপকরণের আবশ্যক হয়, সূক্ষ্ম স্নায়ুতে যাইলে তেমন ক্লান্তি ইত্যাদি কিছু থাকে না, স্নায়ু-প্রক্রিয়া অন্য প্রকার হয়। এইজন্য পরমহংস মশাই নানা শ্রেণীর লোকের সহিত নানা বিষয়ে নিরন্তর কথা কহিয়া যাইতে পারিতেন। শ্রোতারা ক্লান্ত হইতেন, কিন্তু তাঁহার কোনো ক্লান্তি বা বৈষম্য হইত না। বিদেহ-অবস্থা বা জীবন্মুক্ত-অবস্থা কাহাকে বলে, সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে অবস্থান যে কি ব্যাপার, পরমহংস মশাই-এর বিষয় বিশেষভাবে চিন্তা করিলে তাহা বুঝিতে পারা যায়। তিনি যে কতদূর সূক্ষ্ম বা কারণ-স্নায়ুতে উঠিতেন, তাহা সাধারণ অবস্থায় বুঝা যাইতে পারে না। তিনি দেহের ভিতর থাকিতেন, কিন্তু দেহ তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারিত না।

স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে বলিয়াছিলেন, "প্রথম মনে করো, নিজেই সম্মুখে বসিয়া আছ - নিজেকে দুই ভাগ করিয়া দেখিবার চেষ্টা করিতেছ, নিজেই যেন নিজের প্রতীক, নিজেই নিজের দর্পণস্বরূপ হইয়াছ।" প্রথম, চরণ হইতে দেখিতে আরম্ভ করিতে হয়, তাহার পর, ক্রমে ক্রমে, বক্ষঃস্থল, হস্ত ও গ্রীবায় চিত্তবৃত্তি সংযোগ করিতে হয়; অবশেষে, মুখ ও চক্ষুতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতে হয়। এইরূপ করিলে, অতি সূক্ষ্ম স্নায়ুতে চিত্তবৃত্তি প্রধাবিত হয় এবং স্থূল দেহজ্ঞান বিলুপ্ত হইয়া অশরীরী অবস্থা বা বিদেহ-অবস্থা লাভ হয়।

অপর একটি কথা স্বামীজী বলিয়াছিলেন, "ভাবিবে যে নিজে মরিয়া পড়িয়া আছ, আর নিজেই দাঁড়াইয়া তাহা দেখিতেছ। শববাহকেরা তোমার মৃতদেহটি লইয়া যাইল; দেহটিকে চিতায় স্থাপন করিয়া অগ্নিসংযোগ করিয়া তাহারা দাঁড়াইয়া আছে; মৃতদেহ ভস্ম হইয়া যাইল; - নিজেই তাহা দেখিতেছ। এইরূপ ধ্যান করিলে সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে বা বিদেহ-অবস্থায় উপনীত হওয়া যাইতে পারে।"

Tuesday, April 3, 2018

দূর হইতে দর্শনে ও শ্রবণে

পরমহংস মশাই-এর দূর হইতে দর্শন, শ্রবণ প্রভৃতি করিবার শক্তি প্রবল ছিল। তাঁহার এই শক্তি অনেকেই দেখিয়াছেন। এ বিষয়ে অনেক উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু এ স্থলে দু-একটি মাত্র উল্লেখ করিতেছি।

স্বামী সারদানন্দের নিকটে শুনিয়াছিলাম যে, শ্যামপুকুরে অবস্থানকালে পরমহংস মশাই নাকি একটি জ্যোতি বা আলোক-রেখা দ্বারা সুরেশ মিত্তিরের বাড়ি দুর্গাপূজা দেখিয়াছিলেন।

পরমহংস মশাই যে আমার মা'র জন্য গরদের কাপড় ও মিছরির থালা পাঠাইয়াছিলেন, তাহাও এ স্থলে উল্লেখযোগ্য।

সাধারণতঃ, আমরা কতিপয় স্থূল-স্নায়ু দিয়া দর্শন ও শ্রবণ করিয়া থাকি। ইহাই হইল সাধারণভাবে দর্শন ও শ্রবণ করিবার উপায়। এইজন্য বিশেষভাবে কোনো বস্তুকে দর্শন করিতে হইলে চোখে জোর দিতে হয়, তাহা হইলে বস্তু কিঞ্চিৎ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। আরো বিশেষ করিয়া নিরীক্ষণ করিতে হইলে, আমরা যে পরিমাণে চোখের স্নায়ুতে শক্তি প্রয়োগ করি, দৃষ্টিও সেই পরিমাণে অধিক হইয়া থাকে। এ সকলই হইল স্থূল-স্নায়ুপ্রক্রিয়া। কিন্তু যদি অভ্যাস করিয়া অর্থাৎ জপ-ধ্যান ইত্যাদি প্রক্রিয়া দ্বারা মুমূর্ষু বা সুষুপ্ত সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহকে সঞ্জীবিত বা জাগ্রত করিতে পারা যায়, তাহা হইলে যে পরিমাণে সূক্ষ্ম-স্নায়ুসমূহ জাগ্রত হইবে, স্নায়ুপ্রধাবিত শক্তিও সেই পরিমাণে দূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইবে। কারণ নিয়ম হইতেছে: সমজাতীয় স্পন্দন সমজাতীয় স্পন্দনকে আকর্ষণ করিয়া থাকে - Similar vibration catches similar vibration. বস্তুর ত্বক-শক্তি বা Peripheral energy যে প্রকারে স্পন্দিত হইতেছে, চোখের স্থূল-স্নায়ুসমূহও সেই প্রকারে স্পন্দিত হইতেছে। সেইজন্য চোখের স্নায়ুর স্থূল-স্পন্দন দ্রব্যের স্থূল-স্পন্দনকে আকর্ষণ করিতেছে বা উহার সহিত একীভূত হইয়া যাইতেছে। কিন্তু সূক্ষ্ম-স্নায়ু বা অতিসূক্ষ্ম-স্নায়ু যখন প্রকম্পিত হয়, তখন তাহা হইতে প্রসূত সূক্ষ্ম-স্পন্দন বা অতিসূক্ষ্ম-স্পন্দন বা শক্তি বস্তুস্থিত সূক্ষ্ম বা অতিসূক্ষ্ম পরমাণু-স্পন্দনকে আকর্ষণ করে অর্থাৎ উভয় স্পন্দন সমজাতীয় ও সমগুণান্বিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ও একীভূত হইয়া যায়। এইরূপ সূক্ষ্ম-স্নায়ুপ্রসূত যে স্পন্দন, তাহা দেশ, কাল ও নিমিত্তের অতীত। এইজন্য দূর হইতে দর্শন, দূর হইতে শ্রবণ প্রভৃতি হইয়া থাকে। ইহা অলৌকিক বা আজগুবী নয়। এইরূপে যে পরিমাণে সূক্ষ্ম-স্নায়ুকে জাগ্রত করিতে পারা যাইবে এবং তাহার ভিতর সূক্ষ্ম শক্তি প্রধাবিত করা যাইতে পারিবে, পরিদৃশ্যমান জগৎও সেই পরিমাণে অন্য প্রকার দেখিতে হইবে। ক্রমে সূক্ষ্মতম স্নায়ুতে যাইলে 'বাহ্যিক' বা 'আভ্যন্তরীণ' বলিয়া কোনো শব্দই থাকে না, সব একীভূত হইয়া যায়। দর্শনশাস্ত্র, বিজ্ঞানশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্র - এই তিন শাস্ত্রই এক হইয়া যায়, প্রক্রিয়া ও প্রয়োগের তারতম্য থাকে মাত্র।

স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে এক দিন রাত্রে রাজযোগের এই অংশটি ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। তিনি শ্রোতৃবৃন্দকে বলিলেন, "যার যা প্রশ্ন বা মনের কথা আছে, লিখে নিজের ইজেরের পকেটের ভেতর রেখে দিন। আমি সকলের মনের কথা বলে দিচ্ছি।" সকলে সেইরূপই করিলেন। অনেকের প্রশ্ন তিনি হুবহু বলিয়া দিতে লাগিলেন। তিনি বক্তৃতাকালে বলিয়াছিলেন যে, যাহার যে ইন্দ্রিয় যে পরিমাণে সবল, তাহার শক্তি-বিকাশ প্রথম সেই ইন্দ্রিয় দিয়া হইবে এবং পরিশেষে - অপর সকল ইন্দ্রিয় দিয়া বিকাশ পাইবে। যাহার দৃষ্টিবিষয়ক স্নায়ুপুঞ্জ - Optical nerves সবল, তাহার এই শক্তি বা সূক্ষ্ম-স্নায়ুবিকাশ প্রথম চক্ষু দিয়া হইবে; যাহার কর্ণবিষয়ক স্নায়ুপুঞ্জ - Auricular nerves সতেজ, তাহার সূক্ষ্ম-স্নায়ুপ্রক্রিয়া প্রথম কর্ণেই হইবে; যাহার ঘ্রাণবিষয়ক স্নায়ুপুঞ্জ - Olfactory nerves প্রবল, তাহার সূক্ষ্ম-স্নায়ুপ্রক্রিয়া প্রথম নাসিকা দিয়া হইবে।

পরমহংস মশাই-এর ও স্বামীজীর এইরূপ শক্তিবিকাশ বহু বার দেখিয়াছি। দর্শনশাস্ত্র বা বিজ্ঞানশাস্ত্র প্রত্যেক ব্যাপারেরই কারণ অনুসন্ধান করিয়া থাকে এবং যত দূর সম্ভব কারণ-নির্দেশ করিবার চেষ্টা করিয়া থাকে। এই সকল ব্যাপারের কারণ সম্বন্ধে যাহা বুঝিয়াছি, তাহার আভাস এই স্থলে দিলাম।

Monday, April 2, 2018

পূর্বস্মৃতি জাগরণে

পরমহংস মশাই পূর্বতন ঘটনাসমূহ এমন কি বাল্যকালের সকল ঘটনাও স্পষ্ট বলিয়া যাইতেন এবং সে সকলই ঠিক হইত। স্বামীজীরও এই শক্তি আমি দেখিয়াছি। ব্রহ্মানন্দের ভিতরেও অনেক পরিমাণে এই শক্তির বিকাশ পাইয়াছিল।

এই স্থানে 'সংজ্ঞাক্ষেত্র' সম্বন্ধে কিছু জানা আবশ্যক। সংজ্ঞাক্ষেত্রকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম হইল - 'সাধারণ-সংজ্ঞাক্ষেত্র', Conscious plane; দ্বিতীয় হইল - 'অধস্তন-সংজ্ঞাক্ষেত্র', Sub-conscious plane; তৃতীয় বা ঊর্ধ্বতম অবস্থা হইল - 'অতীন্দ্রিয়-সংজ্ঞাক্ষেত্র', Superconscious plane.

পরিদৃশ্যমান বাহ্যিক বস্তুসমূহ 'গুণ'-সমষ্টিতে আবৃত। গুণ হইল পরমাণুর বিভিন্ন প্রকার স্পন্দন। কত প্রকার যে গুণ বা স্পন্দন আছে, তাহা নির্ণয় করা যায় না। এক এক প্রকার স্পন্দন নির্ণয় করাকে, এক এক প্রকার গুণ আবিষ্কার করা বলে। আমরা সব সময় সকল গুণ বুঝিতে পারি না। দেহের স্নায়ুর স্পন্দন যে প্রকার হইবে, বাহ্যিক বস্তুর স্পন্দনও সেই প্রকার বুঝা যাইবে। কিন্তু, দেহের স্পন্দন যদি বাহ্যিক স্পন্দন হইতে উচ্চমাত্রায় বা অধোমাত্রায় হয়, তাহা হইলে সেই প্রকম্পন দিয়া বাহ্যিক স্পন্দন বুঝিতে পারা যায় না; অপর স্তরের স্নায়ু-প্রকম্পন আশ্রয় করিতে হয়। এইরূপে আমরা বহুবিধ প্রকম্পন উপলব্ধি করিতে পারি। এই হইল নিয়ম যাহাতে আমাদের বাহ্যিক বস্তুর জ্ঞান উপলব্ধি হয়। কিন্তু অতি সূক্ষ্ম-স্নায়ুতে যাইতে, 'বাহ্যিক' ও 'আভ্যন্তরীণ' উভয় জগৎই একীভূত হইয়া যায়। মাত্র স্থূল-স্নায়ুর প্রকম্পনের জন্যই আমরা জগৎকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ বলিয়া দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া থাকি।

স্থূল-স্নায়ুর প্রক্রিয়া যদি নিষ্ক্রিয় হইয়া যায়, তাহা হইলেও সংজ্ঞাক্ষেত্র থাকে; যেমন অজ্ঞান অবস্থায়, বা হঠযোগীদের ভূমধ্যে প্রোথিত করিয়া রাখিলেও সংজ্ঞাক্ষেত্র ঠিক থাকে, মৃত হইয়া যায় না। 'মৃত্যু' হইল - যেখানে সংজ্ঞাক্ষেত্র নষ্ট হইয়া গিয়াছে। আমরা প্রত্যহ বহুবিধ বস্তুর সম্পর্কে আসিয়া থাকি এবং জীবনের বহু সময় এই সব বস্তু দর্শন করি। এইরূপ এক চিত্রের উপর অপর এক চিত্র অনবরত সংস্থাপিত হওয়ায়, পূর্বতন চিত্র বা জ্ঞান, অধস্তন-সংজ্ঞাক্ষেত্রে চলিয়া যায়। এইজন্য সাধারণতঃ আমাদের পূর্ব ঘটনা বা ঘটনাসমূহের জ্ঞান থাকে না। সাধারণভাবে ইহাকে 'বিস্মৃতি' বলা হয়। সাধারণ-সংজ্ঞাক্ষেত্রে অবস্থান করিলে বর্তমান অবস্থার সকল কথা বলা যায়, কিন্তু পূর্বতন ঘটনাসমূহের বিস্মরণ হইয়া থাকে বা অস্পষ্টভাবে স্মরণ থাকে; এই হইল সাধারণ নিয়ম। কিন্তু এক সময়ে বাহ্যিক বস্তুর প্রকম্পনে স্নায়ুর প্রকম্পন সংযুক্ত হওয়ায় যে জ্ঞান উপলব্ধি হয়, তাহা একেবারে বিনষ্ট হয় না; তাহা অন্তরতর প্রদেশে সংস্থাপিত ও সংরক্ষিত হইয়া থাকে। যদি প্রয়াস করিয়া উপযুক্ত উদ্দীপক বা উদ্বোধক ভাব বা কারণ (Fit stimulus বা Suggestive idea) দিয়া সুষুপ্ত স্নায়ুকে বা স্নায়ুপুঞ্জকে সঞ্জীবিত করা যায়, তাহা হইলে পুনরায় সমস্ত ঘটনাবলী পারম্পর্য অনুযায়ী উদ্দীপিত করা যাইতে পারে। বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া দিয়া যদি পূর্বতন মৃতপ্রায় বা সুষুপ্ত স্নায়ুকে বা স্নায়ুপুঞ্জকে পুনরায় জাগ্রত বা জীবিত করা যায়, তাহা হইলে প্রাক্তন সমস্ত বস্তু বা ঘটনা বর্তমানে পরিলক্ষিত হয়। দেশ ও কাল এইরূপ স্থলে বিলুপ্ত হয় এবং এই কারণে, 'অতীত' বলিয়া কোন শব্দ থাকে না, মাত্র 'বর্তমান' এই সংজ্ঞা প্রতীয়মান হয়। কিন্তু পূর্বতন স্নায়ু যদি দূষিত বা নষ্ট হইয়া যায়, তাহা হইলে আর পূর্বস্মৃতি জাগ্রত হয় না। স্নায়ু যে প্রকার প্রকম্পিত হইয়া বাহ্যিক বস্তুর প্রকম্পনকে ধারণ করিয়াছিল বা তাহার সহিত প্রকম্পন সংযোজিত করিয়াছিল, সেই প্রকার পূর্বস্মৃতি জাগ্রত হইয়া থাকে; ধারণকালে যদি অস্পষ্ট ভাব থাকে, তাহা হইলে অস্পষ্ট চিত্র উঠিবে। এইরূপে স্পন্দন যেরূপে সংযুক্ত হইবে, সেইরূপ স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ভাবে অতীত চিত্র পুনরায় উদ্দীপ্ত হইবে। 'স্মৃতি' বা Memory ইহাকেই বলা হয়। পূর্ব ঘটনাসমূহকে সঞ্জীবিত করিবার এক উপায় - পূর্বতন স্নায়ু বা স্নায়ুপুঞ্জ সঞ্জীবিত করা। ইহাকে 'বিপর্যস্ত বা পশ্চাদ্মুখী ধ্যান' বলে।

স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে বলিয়াছিলেন, "পূর্ব দিনের সমস্ত ঘটনা চিন্তা করো; পূর্ব বৎসর কি ঘটিয়াছিল তাহা চিন্তা করো। তাহার পর বাল্যকালে কি করিয়াছিলে চিন্তা করো; তাহার পর ক্রমান্বয়ে পূর্বতন ঘটনাসমূহ চিন্তা করো। তাহা হইলে ক্রমে ক্রমে পূর্বতন সকল ঘটনা স্মৃতিতে আসিবে।" আর একটি কথা তিনি বলিয়াছিলেন, "গ্রন্থে আছে যে, যদি কেহ পূর্বতন চিন্তা বা পশ্চাদ্গামী মনোবৃত্তিকে আরো অধিক দূর লইয়া যাইতে পারে, তাহা হইলে ভ্রূণ-অবস্থায় সে কিরূপ ছিল তাহাও প্রতীয়মান হইবে; কারণ ভ্রূণ-অবস্থাতেও স্নায়ু আছে ও স্নায়ুর প্রক্রিয়া থাকে। আমি শৈশবকালের অবস্থা অনেক অংশে জাগ্রত করিতে পারি। বুদ্ধদেব জাতক গ্রন্থে বলিয়াছেন যে, তিনি পূর্বজন্মের অনেক কথা স্মরণ করিতে পারিয়াছিলেন।"

কয়েক বৎসর পূর্বে আগ্রা ও মথুরায় সাবিত্রী নামে এক জাতিস্মর বালিকার কথা শুনা গিয়াছিল। মথুরায় একটি ব্রাহ্মণীর মৃত্যু হয়। সে স্বামী-পুত্র রাখিয়া মারা যায়। পরে আগ্রায় তাহার জন্ম হয় এবং তখন তাহার নাম হয় সাবিত্রী। সাবিত্রীর বয়স যখন আট-নয় বৎসর তখন সে তাহার নূতন পিতামাতাকে পূর্বজন্মের সকল কথা বলিতে লাগিল। সাবিত্রীর কথা শুনিয়া তাহার পিতা মথুরায় লোক পাঠাইয়া অনুসন্ধান করিয়া দেখিল যে, সকলই ঠিক মিলিয়া যাইতেছে। সাবিত্রী তাহার স্বামী ও পুত্রকে দেখিতে যাইবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিলে তাহার পিতা আরো কয়েকটি লোক সঙ্গে লইয়া ট্রেনে করিয়া মথুরায় চলিল। আগ্রার ভাষা হইতে মথুরার ভাষার কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে। ট্রেনখানি মথুরা ষ্টেশনের নিকট আসিলে সাবিত্রী চিৎকার করিয়া মথুরার ভাষায় বলিতে লাগিল, "মথুরা আ গয়ী, মথুরা আ গয়ী!" সাবিত্রী তাহার পর গাড়ি-ভাড়া করিয়া পিতাকে লইয়া যেন পূর্বপরিচিত রাস্তা দিয়া নিজে মথুরার বাড়িতে আসিল। বাড়িতে ঢুকিয়া বলিল, "এখানে পাতকুয়ো ছিল, কি হল?" স্বামী উত্তর করিল, "পাতকুয়োর মুখে পাথর দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে।" তাহার পর, শয়ন-ঘরে যাইয়া বাক্স দেখাইয়া বলিল, "বাক্সের ভেতর আমার গয়না ছিল, খোলো দেখি।" স্বামী পুনরায় বিবাহ করিয়া সেই সকল অলংকার নূতন স্ত্রীকে দিয়াছিল। তাহার পর সে বলিল, "একটা ঘটির ভেতর করে দেওয়ালের মধ্যে টাকা রেখে গেছি, খোঁড়ো।" দেওয়াল খোঁড়া হইলে টাকা বাহির হইল। তাহার পর, সে তাহার কি অসুখ হইয়াছিল, অসুখের সময় কোন ডাক্তার তাহাকে দেখিয়াছিল, কবে সে মারা গিয়াছিল - প্রভৃতি সকলই বলিল। মথুরায় মৃত্যুর সময় ও আগ্রায় জন্মের সময় দুই-ই মিলিয়া যাইল।

সাবিত্রী তাহার পর তাহার মা-ভাইদের সঙ্গে দেখা করিতে যাইল। নিজেই রাস্তা দেখাইয়া চলিল। সেখানে যাইয়া বাপ, মা, ভাই প্রভৃতি সকলের পায়ে প্রণাম করিল। সাবিত্রী প্রত্যেকের নাম বলিয়া দিতে লাগিল। স্বামী ও শ্বশুরের নাম অপরের কানে বলিল। সাবিত্রীর বাপ-মা কাঁদিতে লাগিল।

মথুরার উকিল-ডাক্তার প্রভৃতি সকলে সভা করিয়া সাবিত্রীকে তাহার পূর্বজন্মের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, সকলই মিলিয়া গেল। অবশেষে, পাছে অতিশয় ক্লান্ত হইয়া মেয়েটির মৃত্যু হয়, এইজন্য তাহার নূতন পিতা তাহাকে লইয়া আগ্রায় ফিরিয়া গেল।

স্নায়ু-বিজ্ঞান অনুযায়ী, স্থূল দেহ নাশ হইলেও সূক্ষ্ম দেহ বা সূক্ষ্ম স্নায়ু সমভাবে থাকে। হিন্দুদিগের যে শ্রাদ্ধক্রিয়া, তাহা হইল এই সূক্ষ্ম শরীরের উদ্দেশে শ্রদ্ধা-নিবেদন। কখনো কখনো এই সূক্ষ্ম স্নায়ু বা সূক্ষ্ম শরীর স্থূল দেহ দিয়া বিকাশ পায়। ইহাকে 'জাতিস্মর হওয়া' বলে। যতদূর জানা গিয়াছে, জাতিস্মর হইলে বেশি দিন শরীর থাকে না।

দেখা যায় যে, সাবিত্রীর সাময়িকভাবে পূর্বতন স্নায়ু সঞ্জীবিত হইয়াছিল মাত্র। কিন্তু জাতিস্মর হওয়া যে সম্ভব, ইহা হইতে তাহা বেশ বুঝা যায়। এই বিষয়ে য়ুরোপীয় দার্শনিকগণ কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা করিতে পারেন নাই।

Sunday, April 1, 2018

স্ত্রীভাবে

পরমহংস মশাই যখন স্ত্রীলোকদিগের নিকট বসিতেন তখন একেবারে স্ত্রীভাবাপন্ন হইয়া যাইতেন। স্ত্রীলোকেরা সেই সময় মনে করিতেন যে, তাঁহারা একজন গিন্নীবান্নি স্ত্রীলোকের কাছে বসিয়া আছেন। অল্পবয়স্কা স্ত্রীলোকেরা মনে করিতেন যে, তাঁহারা একজন প্রবীণা স্ত্রীলোকের কাছে বসিয়া আছেন। এইজন্য স্ত্রীলোকদিগের দ্বিধা বা সংকোচের ভাব থাকিত না। একজন পুরুষমানুষের কাছে বসিয়া আছেন - এ ভাব তাঁহাদের মনে হইত না।

পরমহংস মশাই সাধনকালে 'সখীভাব' লইয়া বা স্ত্রীভাবাপন্ন হইয়া সাধন করিয়াছিলেন। তিনি যে স্ত্রীভাবাপন্ন হইতে পারিতেন, এ বিষয়ে অনেক উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। এ স্থলে একটি উদাহরণ দিতেছি:

দক্ষিণেশ্বরে এক বার থিয়েটারের অনেকগুলি অভিনেত্রী গিয়াছিল। তাহারা পরমহংস মশাইকে 'সীতা' ও 'সাবিত্রী' অভিনয় করিয়া দেখাইল। পরমহংস মশাই তাহাদিগকে কীর্তনগায়িকাদের দূতীসংবাদ ইত্যাদি অভিনয় করিয়া দেখাইলেন। কীর্তনগায়িকারা অভিনয়কালে কি করিয়া তাহাদের বড় নথটি উঠাইয়া পানের পিচ ফেলে, কি করিয়া হাত নাড়ে, কি করিয়া গলা ও মাথা নাড়ে - তিনি তাহা অবিকল দেখাইতে লাগিলেন। অভিনেত্রীরা ইহাতে আশ্চর্য হইয়া বলিল, "ইনি সাধু হয়ে কি করে এত মেয়েলি ঢং জানেন!" এখন প্রশ্ন হইতেছে যে পুরুষমানুষ হইয়া তিনি কি করিয়া এইরূপ অবিকল স্ত্রীভাব বিকাশ করিতে পারিতেন, যাহাতে স্ত্রীলোকদেরও ধাঁধা লাগিত।

ইহা জানা আবশ্যক যে, মানুষের দেহ দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হইল - পুরুষ-স্নায়ু ও পুরুষ-যন্ত্রাদি; অপরটি হইল - স্ত্রী-স্নায়ু ও স্ত্রী-যন্ত্রাদি। একটি হইল প্রকাশিত, আর একটি হইল সুষুপ্ত। একটি হইল মুখ্য, আর একটি হইল গৌণ। পুরুষের ভিতর পুরুষ-স্নায়ু ও পুরুষ-যন্ত্রাদি বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরে স্ত্রী-স্নায়ু ও স্ত্রী-যন্ত্রাদি বিদ্যমান। স্ত্রীলোকের ভিতরও স্ত্রী-স্নায়ু ও স্ত্রী-যন্ত্রাদি হইল বাহ্যিক, এবং অভ্যন্তরে পুরুষ-স্নায়ু ও পুরুষ-যন্ত্রাদি বিদ্যমান। স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে কখনো কখনো দেখা যায় যে, পুরুষ-অবয়বাদি উপরে এবং স্ত্রী-অবয়বাদি অভ্যন্তরে। আবার কখনো কখনো দেখা যায় যে, প্রকাশ্যে স্ত্রী-অবয়ব উপরে রহিয়াছে বটে, কিন্তু অভ্যন্তরে পুরুষ-স্নায়ু প্রবল।

দেখা গিয়াছে, গর্ভ-অবস্থায় বা ভ্রূণ-অবস্থায় দুইটি যমজ শিশু একত্র সংযুক্ত হওয়ায় পুরুষ-অবয়ব বা স্ত্রী-অবয়ব উপরে বা ভিতরে বিদ্যমান থাকে। কখনো কখনো এরূপও দেখা গিয়াছে যে, একই পুরুষের দেহে সমস্ত পুরুষ ও স্ত্রী-চিহ্ন - দাড়ি, স্তন প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে বিদ্যমান, কিন্তু জিজ্ঞাসা করিলে সে ব্যক্তি বলিয়াছে যে, সে পুরুষমানুষ। যাঁহারা এই বিষয়ে গবেষণা করেন, তাঁহারা ইহা বিশেষরূপে জানেন। এইরূপও দেখা গিয়াছে যে, সতেরো-আঠারো বৎসর বয়স্ক যুবা পুরুষের স্তন অল্পপরিমাণে স্ফীত হইয়া তাহা হইতে দুগ্ধ নির্গত হইতেছে। এই যুবকের এইরূপ অবস্থা প্রায় এক বৎসর বা দেড় বৎসর কাল ছিল; তাহার পর, আবার সাধারণ অবস্থা ফিরিয়া আসিল।

এইরূপ নানা উদাহরণ দ্বারা বেশ স্পষ্ট বুঝা যায় যে, একই দেহের ভিতর পুরুষ-স্নায়ু ও স্ত্রী-স্নায়ু বা পুরুষ-যন্ত্রাদি ও স্ত্রী-যন্ত্রাদি থাকেই; কেবল, একটি মুখ্য ও অপরটি গৌণ। এই সকল হইল জীববিদ্যার আলোচনার বিষয়। এইজন্য এ স্থলে ইহার বিষয় আর বিশেষ করিয়া বলিবার আবশ্যক নাই।

সাধারণ লোক অতি অল্পসংখ্যক স্নায়ুমাত্র জাগ্রত করিতে পারে এবং সেইগুলি দিয়া দৈনন্দিন নিয়মিত কার্য করিয়া থাকে। অপর যে বহুসংখ্যক স্নায়ু সুষুপ্ত আছে, সে বিষয়ে তাহাদের কোনো সংজ্ঞা নাই। কিন্তু দেখা যায় যে পরমহংস মশাই বর্তমান যুগে সকল লোক অপেক্ষা অতি সুষুপ্ত স্নায়ুসমূহ জাগ্রত করিয়াছিলেন এবং বহু প্রকার স্নায়ু-প্রক্রিয়া দেখাইয়াছিলেন। সাধারণ লোক বা অভিনেতারা যদিও স্ত্রীভাব দেখাইবার চেষ্টা করে, কিন্তু তাহা আনুমানিক অনুকরণ মাত্র। পুরুষ-স্নায়ু দিয়া স্ত্রীভাব বিকাশ করা যায় না। পরমহংস মশাই পুরুষ-স্নায়ু ও স্ত্রী-স্নায়ু সমভাবে জাগ্রত করিতে পারিতেন। তিনি উভয়বিধ স্নায়ু দিয়াই ভাব বা শক্তি বিকাশ করিতেন:

"একা সাজে পুরুষ-প্রকৃতি;
বিপরীত রতি * * *।"

বহুবিধ চিন্তা ও অতি কঠোর তপস্যা করিয়া পরমহংস মশাই পুরুষ-দেহে সমস্ত সুষুপ্ত স্ত্রী-স্নায়ু জাগ্রত করিয়াছিলেন। সাধারণ লোকের ভিতর এইরূপ দেখা যায় না। কেবল মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের বিষয় উল্লেখ আছে যে, তিনি ইচ্ছা করিলে স্ত্রীভাব জাগ্রত করিতে পারিতেন। তিনি যখন শ্রীরাধার ভাব বিকাশ করিতেন, তখন অবিকল শ্রীরাধার ভাব বিকাশ করিতেন, তখন অবিকল শ্রীরাধার মতো হইয়া যাইতেন - অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ভাবভঙ্গী প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ে বিরহ-বিধুরা শ্রীরাধার মতো হইয়া যাইতেন। পুরুষ-স্নায়ু ও স্ত্রী-স্নায়ু সমভাবে জাগ্রত করিয়া উভয় শ্রেণীর স্নায়ু হইতেই ভাব ও শক্তি বিকাশ করিতে পারিতেন বলিয়া মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যকে লোকে বলিত, 'বহির্রাধা, অন্তঃকৃষ্ণঃ'।

পরমহংস মশাই-এর এইরূপ স্নায়ু-পরিবর্তন সকলেই দেখিয়াছেন। যেরূপ শ্রেণীর লোক তাঁহার সহিত কথাবার্তা কহিতেন, অতি অল্পকালমধ্যেই তিনি সেইরূপ হইয়া যাইতে পারিতেন। তিনি তাঁহার সমস্ত স্নায়ুপুঞ্জ নূতন প্রকারে সামঞ্জস্য করিয়া উপস্থিত ব্যক্তির সহিত কথাবার্তা কহিতেন। এইজন্য তিনি স্ত্রীলোকের সহিত স্ত্রীলোক, বালকের সহিত বালক, যুবকের সহিত যুবক, পণ্ডিতের সহিত পণ্ডিত, ভক্তের সহিত ভক্ত, জ্ঞানীর সহিত জ্ঞানী এবং রসিকের সহিত রসিক হইতে পারিতেন। এই সকল হইল তাঁহার সম্বন্ধে বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিবার বিষয়। A great man is one who can transform himself into various forms according to circumstances - যিনি পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুযায়ী নিজেকে সম্পূর্ণরূপে রূপান্তরিত করিতে পারেন, তিনিই মহাপুরুষ।

যীশুর সম্বন্ধেও এইরূপ অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে। তিনিও এইরূপ স্নায়ু-পরিবর্তন করিয়া বালকের কাছে বালকের মতো হইতেন, স্ত্রী-ভক্তদের কাছে স্ত্রীলোকের মতো হইতেন, এবং অন্যান্য লোকদিগের কাছে অন্যান্য রূপ হইতেন। বাইবেল-এ এই ভাবটিকে Transfiguration বা আকার পরিবর্তন বলা হইয়াছে। এমন কি, এইরূপ প্রবাদ আছে যে, যীশুর বিষয় চিন্তা করিয়া সমাধিস্থ হওয়ায় সেণ্ট্ ফ্রান্সিস্ অভ্ অ্যাসিসি-র দেহে, যীশুর হাত দুইটিতে যে পেরেক মারা হইয়াছিল এবং পাঁজরায় যে বর্শার আঘাত করা হইয়াছিল, সেই সকল ক্ষতচিহ্ন বিকাশ পাইয়াছিল। এ সব বিষয় অনেক কিছু বলা যাইতে পারে। বিষয়টি অতি জটিল।

স্বামীজী লন্ডনে বক্তৃতাকালে এক দিন বলিয়াছিলেন যে, আচার্য শঙ্কর তাঁহার শিষ্যমণ্ডলী লইয়া এক স্থানে যাইতেছিলেন। সম্মুখে একটি পাহাড়। পাহাড়টি ঘুরিয়া যাইলে বিলম্ব হইবে। শঙ্কর শিষ্যদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "পাহাড় ঘুরিয়া যাইবে, না পাহাড় ভেদ করিয়া যাইবে?" শিষ্যেরা এ কথার অর্থ বুঝিতে পারিল না। তাহারা পাহাড় ঘুরিয়া যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিল। শঙ্কর তাহাদের সেইরূপ অনুমতি দিলেন; কিন্তু তিনি নিজে ঐ পথ দিয়া যাইলেন না। শিষ্যেরা বহুক্ষণ পরে গন্তব্যস্থানে আসিয়া দেখেন যে, আচার্য শঙ্কর অনেক পূর্বেই সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

এই উপাখ্যানটি তুলিয়া স্বামীজী বুঝাইতে লাগিলেন, "মন বা চিৎ-শক্তি যখন উচ্চ স্তরে যায়, তখন শরীরের পরমাণুসমূহ - জড় বা ভৌতিক বিন্দুসকল তাহার আজ্ঞাধীন হইয়া থাকে। সাধারণ অবস্থায়, জড় পরমাণুসকল চিৎ-শক্তিকে পরিচালিত ও সংযমিত করিতেছে; কিন্তু চিৎ-শক্তি যখন জড়-শক্তির প্রভাব হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া নিজ তেজঃপূর্ণ ভাবে উপনীত হইয়া বহু উচ্চ অবস্থায় উঠে, তখন জড় পরমাণুসকল তাহার আজ্ঞাবহ হইয়া থাকে। এইজন্য শঙ্কর জড় পরমাণুসমূহকে বিশ্লেষ করিয়া চিৎ-শক্তি ও কারণ-শরীর লইয়া গন্তব্যস্থানে যাইলেন এবং পরে জড় পরমাণুসকলকে পুনরায় সংগঠন করিয়া দেহ ধারণ করিলেন। শঙ্কর বা তাঁহার মতো উচ্চ অবস্থাপন্ন অন্যান্য মহাপুরুষেরা নিজেদের দেহ এইরূপ ইচ্ছামতো পরিবর্তন করিতে পারেন।"

যীশুর উপাখ্যান তুলিয়া স্বামীজী বলিয়াছিলেন, "যীশুর মৃত্যুর পর তাঁহার শিষ্যেরা তাঁহাকে কয়েক বার দর্শন করিয়াছিলেন। এমন কি স্পষ্টভাবে তাঁহার হাত-পা ইত্যাদি স্পর্শ করিয়াছিলেন। ইহার কারণ এই যে, যীশুর স্থূল শরীরের যে জড় পরমাণুসমূহ, তাহাই কেবল বিচ্ছিন্ন ও বিশ্লিষ্ট হইয়াছিল, কিন্তু তাঁহার কারণ-শরীর ও চিৎ-শক্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। এইজন্য যীশু মৃত্যুর পরও কয়েক বার পরমাণুসমষ্টি সংযোজিত করিয়া স্থূল দেহে আবির্ভূত হইয়াছিলেন এবং মৃত্যুকালে তাঁহার দেহে যে পেরেক ও বর্শার চিহ্ন ছিল, তাহাও তখন স্পষ্টভাবে দেখা গিয়াছিল।" যীশু যে নিজের দেহ পরিবর্তন করিয়া অপর এক জ্যোতির্ময় দেহ ধারণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার দেহ হইতে যে এক সময় মহাজ্যোতি বিনিঃসৃত হইয়াছিল - এ বিষয়ে স্বামীজী দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির সাহায্যে বেশ বুঝাইয়াছিলেন।

লন্ডনে বক্তৃতাকালে স্বামীজীর যে সব ফোটো লওয়া হইত, সেই সকল ফোটো নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলে বেশ বুঝা যায় যে, একই চেয়ারে বসিয়া ও একই পোষাক পরিয়া ছয়-সাত রকমের চেহারা তোলা হইয়াছে। স্বামীজী যেমন মনের ভাব পরিবর্তন করিয়াছেন, ফোটোতেও সেইরূপ চেহারার পরিবর্তন হইয়াছে। স্টার্ডি1 সেই ফোটোগুলি আনিলে দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলাম।

কিন্তু স্বামীজীকে কখনো স্ত্রীভাবাপন্ন হইতে দেখিয়াছি বলিয়া আমার স্মরণ হয় না। স্বামীজী রুদ্রের অংশে জন্মিয়াছিলেন। রুদ্রের ভাব বা ক্ষাত্রশক্তি তাঁহার মধ্যে প্রবল ছিল। এইজন্য তাঁহার মধ্যে মৃদুভাবের তত স্ফূরণ পাইত না। বুদ্ধদেবের ভিতরও স্ত্রীভাবের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। কারণ, বুদ্ধদেবও রুদ্রের অংশে জন্মিয়াছিলেন এবং তাঁহার ভিতর রুদ্রের ভাব ছিল।

এ ক্ষেত্রে জানা আবশ্যক যে, মনকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে: ক্রিয়াশীল মন ও নিশ্চেষ্ট মন - Active mind ও Passive mind. একটির বৃত্তি হইল নিজের ব্যক্তিত্ব বা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিয়া চলা, অপরটির বৃত্তি হইল পরের অনুকরণ করিয়া চলা। এইজন্য, ইহা বিশেষ করিয়া জানা আবশ্যক যে, পরমহংস মশাই যদিও স্নায়ুপুঞ্জ পরিবর্তন করিয়া বিভিন্ন অবয়বসমূহের বহু প্রকার ভাব দেখাইতেন, কিন্তু তিনি কখনো নিজের ব্যক্তিত্ব লোপ করিতেন না। এইটি হইল তাঁহার বিশেষত্ব। অধিকাংশ সময় সাধারণ লোক ভাবপরিবর্তন করিতে গিয়া, নিজ ভাব হারাইয়া ফেলে এবং অপরের ভাব সহ্য করিতে না পারিয়া শেষে, অপরের ভাবপ্লাবনে ভাসিয়া যায়। সকল মহাপুরুষদিগের জীবনী পাঠ করিলেই দেখা যায় যে, তাঁহারা পূর্বতন মহাপুরুষদিগের খুব সম্মান করিয়া চলিতেছেন, খুব শ্রদ্ধাপূর্ণ হইয়া তাঁহাদের বিষয় কথা কহিতেছেন, কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্ব কখনো ক্ষুণ্ণ বা লোপ করিতেছেন না। মহাপুরুষদিগের মনোবৃত্তি সাধারণ লোকের মনোবৃত্তি হইতে এইরূপ অন্য প্রকার হইয়া থাকে।

যাহা হউক, পরমহংস মশাই ও শ্রীচৈতন্যের ভিতর স্ত্রীভাবটি বেশ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হইত। এ স্থলে ভালমন্দের কোনো বিচার হইতেছে না, মাত্র সুষুপ্ত স্নায়ুকে তাঁহারা যে কিরূপে জাগ্রত করিয়াছিলেন, তাহাই দেখানো উদ্দেশ্য। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মত বিশেষরূপে জানা থাকিলে, কিরূপে পরমহংস মশাই-এর ইচ্ছামতো দেহ ও স্নায়ু পরিবর্তিত হইত এবং কিরূপেই বা তাঁহার ভাব ও চিন্তাধারা উঠিত তাহা বেশ স্পষ্ট বুঝা যায়। পরমহংস মশাই অপরের অনুকরণ করিয়া কতকগুলি ভাব জগৎকে দেন নাই; তিনি অনেক প্রকার নূতন ভাব উদ্ভূত করিয়া জগৎকে দিয়াছেন।


1. শ্রীযুত ই. টি. স্টার্ডি, স্বামী বিবেকানন্দের য়ুরোপীয় শিষ্য।