Sunday, July 8, 2018

শ্রীরামচন্দ্র দত্ত

রামচন্দ্র দত্ত ১২৫৮ সালে কলিকাতার পূর্বভাগে নারিকেলডাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম নৃসিংহপ্রসাদ দত্ত, মাতার নাম তুলসীমণি। অল্প বয়সেই রামচন্দ্রের মাতৃবিয়োগ হয়। মাতৃহীন শিশুকে আত্মীয়েরা লালন-পালন করিতে থাকেন।

নৃসিংহপ্রসাদ প্রভূত ধনসম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। কিন্তু দৈবদুর্বিপাকে সে সকলই নষ্ট হইয়া যাওয়ায়, তিনি বিশ্বনাথ দত্তের (গ্রন্থকারের পিতার) শিমলার বাটীতে আসিয়া বাস করেন। নৃসিংহপ্রসাদ সম্পর্কে বিশ্বনাথ দত্তের সহধর্মিণী ভুবনেশ্বরী দেবীর দাদামহাশয় ছিলেন। বিশ্বনাথ ও তাঁহার সহধর্মিণী রামচন্দ্রকে আপনাদের ছেলের মতো মানুষ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের ছেলেমেয়েরাও রামচন্দ্রকে বড় ভাই-এর মতো দেখিতেন ও তাঁহাকে 'রামদাদা' বলিয়া ডাকিতেন। রামচন্দ্র গ্রন্থকারকে 'চনি' বলিয়া ডাকিতেন।

রামচন্দ্র ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল হইতে ডাক্তারি পাস করেন। পরে, তিনি বাংলা সরকারের রাসায়নিক পরীক্ষকের প্রধান সহকারী হইয়াছিলেন। অধ্যবসায়গুণে তিনি রসায়ন শাস্ত্রে সুনাম অর্জন করিয়াছিলেন। রসায়ন সম্বন্ধে ও অন্যান্য বিষয়ে তিনি কয়েকখানি গ্রন্থ ও প্রবন্ধাদিও রচনা করিয়াছিলেন। তিনি প্রভূত অর্থও উপার্জন করিয়াছিলেন।

রামচন্দ্র দয়া, পরোপকার প্রভৃতি বিবিধ সদ্গুণে ভূষিত ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে ও সংস্রবে রামচন্দ্রের ধর্মজীবনের গতি এক বিশিষ্ট ধারায় প্রবাহিত হয়। গুরুর প্রতি অব্যভিচারিণী ভক্তি তাঁহার ধর্মজীবনকে অপূর্ব-শ্রীমণ্ডিত করিয়া রাখিয়াছে। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নাম ও ভাব প্রচার-প্রচেষ্টায়, প্রথমকালে, রামচন্দ্রই ছিলেন অধিনায়ক।

১৩০৫ সালে রামচন্দ্র পরলোক গমন করেন।

Saturday, July 7, 2018

গ্রন্থপ্রসঙ্গে

সুধী পাঠকদের কাছে পূজনীয় গ্রন্থকার শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়ের পরিচয় দেওয়া অনাবশ্যক। এই গ্রন্থের সকল খুঁটিনাটি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলাও নিষ্প্রয়োজন; মাত্র দু-একটি বিষয়ে সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করি।

গ্রন্থকার যে উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গ্রন্থখানি লিখেছেন, তা তাঁর 'নিবেদন'-এ সুস্পষ্ট। গ্রন্থখানি জীবনী নয়, জীবনী-চিন্তন - সুপ্রাচীন গ্রন্থকারের শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে অনুধ্যান। এইজন্যে শ্রীরামকৃষ্ণের সকল জীবন-বৃত্তান্ত যে পরিজ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে প্রথমেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের বহু দিক বিভিন্ন মনীষী এর পূর্বে পর্যালোচনা করেছেন; কিন্তু তাঁর ক্রিয়াকলাপ ও মনোবৃত্তি ঠিক এ রকম দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন শাস্ত্রসহায়ে কেউ ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন কিনা জানি না। অন্যান্য বহু বিষয়েও গ্রন্থকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত যে সম্পূর্ণ পৃথক, তাও তীক্ষ্ণদর্শী পাঠকেরা লক্ষ্য করবেন।

বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয়, প্রচলিত বহু দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত স্বকীয় মতবাদসমূহের উপর ভিত্তি করে গ্রন্থকার শ্রীরামকৃষ্ণের ক্রিয়াকলাপ ও মনোবৃত্তি বিশ্লেষণ করেছেন। এ সকল বিভিন্ন দুরূহ মতবাদ সম্বন্ধে তাঁর কতকগুলি স্বতন্ত্র বিশদ গ্রন্থও আছে; কিন্তু বড়ই আক্ষেপের বিষয় যে, সেগুলির অধিকাংশই নানা কারণে আজও অপ্রকাশিত রয়েছে।1

আর একটি বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয়, গ্রন্থকার কোন বস্তু বা কোনো বিষয়ের নির্দিষ্ট সীমারেখা টানেননি এবং তাদের পারস্পরিক বিরোধের কথাও বলেন নি। প্রকৃত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকের মতো তিনি সকল বস্তু ও সকল বিষয়ের মধ্যে একটি প্রাণময় যোগসূত্র বার করার প্রয়াস পেয়ে এক মহামিলনের - পূর্ণতার বাণীই শুনিয়েছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী - শক্তির উৎস, তা কখনো রুদ্ধ হবার নয়; তাঁর বাণী - ব্রহ্মবীজ, তাও কখনো নষ্ট হবার নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী ও বাণী পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের মনীষীদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছে; তাঁর জীবনী ও বাণী মানব-জাতির সম্পদ। শ্রীরামকৃষ্ণের মতো একজন পুরুষের জীবনের প্রতিটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করার এবং তাঁর ক্রিয়াকলাপ ও মনোবৃত্তি বিশ্লেষণ ও সমীক্ষণ করার প্রয়োজনও তাই সমধিক। এজন্য গ্রন্থকার শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে তাঁর সঞ্চিত স্মৃতি - দৃষ্ট ঘটনা ও উপলব্ধ বিষয়সমূহের কিছু লিপিবদ্ধ করে সকলের বিশেষ কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। এ স্মৃতি-লেখার ঐতিহাসিক মূল্য তো আছেই, অধিকন্তু সত্যানুসন্ধিৎসু জনের কাছে এর সার্থকতা যথেষ্ট। আর বহুশাস্ত্রবিৎ বহুদর্শী গ্রন্থকার শ্রীরামকৃষ্ণের কল্যাণপ্রদ জীবনের বিশেষ একটি দিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পর্যালোচনা করে যে অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত করেছেন, এখন না হোক কালে নিশ্চয়ই তা দেশ-বিদেশের স্বাধীন চিন্তাশীল মনীষীদের গভীর ধ্যানের বিষয় হবে এবং তাঁদের এই ধ্যানপ্রসূত সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়ে ভবিষ্য মানব-সমাজ যে প্রভূত উপকৃত হবে তাও সুনিশ্চিত।

পরিশেষে, যাঁদের সাহচর্য ও সহানুভূতিতে, যুদ্ধের দরুন বর্তমান ওলটপালট অবস্থায় বহু অসুবিধার মধ্যেও, এই গ্রন্থ-সম্পাদন সম্ভব হয়েছে তাঁদের প্রত্যেকেরই প্রতি, কোনো রকম লৌকিকতা না করে আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ন্যস্ত কর্মভার সম্পাদনে, অনবধানতাবশতঃ যদি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে তো সে দোষ আমার; ক্ষমাশীল পাঠকদের কাছে সেজন্য মার্জনা ভিক্ষা করি।

শ্রীধীরেন্দ্রনাথ বসু
প্রথম সংস্করণ


1. বর্তমানে সেগুলি প্রকাশিত।

Friday, July 6, 2018

নিবেদন

বর্তমান সংস্করণটি পাঠকবর্গের পঠন-সুবিধার্থে ডি.টি.পি.-তে ছাপা হইল। মুদ্রাকর - শৈলী প্রেসের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাই। পাঠকবর্গের আগ্রহের জন্য গ্রন্থটির অষ্টম সংস্করণটি শীঘ্রই নিঃশেষিত হইবে আশা করি।

প্রকাশক
অষ্টম সংস্করণ

Thursday, July 5, 2018

কৃতজ্ঞতা

পূজনীয় শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়ের বহু অমূল্য পাণ্ডুলিপি এখনো অপ্রকাশিত রহিয়াছে। বর্তমান পুস্তকখানি সেগুলিরই অন্যতম। কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহৃদয় ব্যক্তির আগ্রহ ও সাহায্য ব্যতীত এই পুস্তকখানি আজ প্রকাশ করা কিছুতেই সম্ভবপর হইয়া উঠিত না। তন্মধ্যে, কলিকাতা কর্পোরেশনের ভূতপূর্ব কাউন্সিলর শ্রীরামচন্দ্র শেঠ, বি, এল, এবং প্রিয়ভাষী কর্মী ডাঃ শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র শেঠ মহাশয়দ্বয়ের পরমারাধ্যা মাতৃদেবী শ্রীমতী নন্দরাণী শেঠ মহাশয়া অর্থসাহায্য দ্বারা আমাদিগের এই পুস্তক প্রকাশনের ব্যয়ভার বহুল অংশে লাঘব করিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত, শ্রীবিধুভূষণ ঘোষাল, শ্রীশংকরপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীরমেশচন্দ্র মিত্র, শ্রীরবীন্দ্রনাথ মিত্র ও শ্রীযতিপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, বি, এ, কাব্যসাংখ্যতীর্থ, মহাশয়গণ পুস্তকের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত, প্রুফ-সংশোধন ও আনুষঙ্গিক কার্যে বহু অধ্যবসায় ও ধৈর্য অবলম্বনপূর্বক নানাভাবে সাহায্য করিয়াছেন। শ্রীশচীন্দ্রনাথ সিংহ, এম.এ, শিল্পী শ্রীনির্মলকুমার দে ও মনোরঞ্জন দাস মহাশয়গণ বিভিন্ন বিষয়ে অতি আন্তরিকভাবে সাহায্য করিয়াছেন।

এই পুস্তকে সন্নিবিষ্ট শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব ও শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দের ছবি দুইখানি আমরা 'উদ্বোধন' কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে এবং মহাত্মা রামচন্দ্র দত্তের ছবিখানি আমরা তাঁহার অন্যতম দৌহিত্র ডাঃ শ্রীসতীন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত হইয়াছি। পরবর্তী ছবিখানি সম্বন্ধে এ স্থলে উল্লেখযোগ্য যে, মূল ফোটোখানি সামান্যমাত্র পরিবর্তিতরূপে মুদ্রিত করা হইয়াছে। 'কিশোর বাংলা'-র কর্তৃপক্ষের নিকটে আমরা কয়েকটি বিষয়ে সাহায্যলাভ করিয়া উপকৃত হইয়াছি। ক্যালকাটা ইউনাইটেড প্রিন্টার্স লিমিটেডের সুযোগ্য ম্যানেজার শ্রীমণীন্দ্রনাথ দে মহাশয়ও তাঁহার পরামর্শ-সাহায্যাদি দ্বারা আমাদিগের যথেষ্ট উপকার করিয়াছেন। পরিশেষে, ইহা বিশেষরূপে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শ্রীধীরেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের সম্পাদন ও তত্ত্বাবধান ব্যতিরেকে এই পুস্তকখানি বর্তমানে সুন্দর করিয়া প্রকাশ করিবার প্রয়াস আমাদিগের পক্ষে মোটেই সহজ হইত না। ইঁহাদিগের প্রত্যেকের প্রতি এবং আরও যে-সকল শুভাকাঙ্ক্ষী ও সুধীজন অলক্ষ্যে থাকিয়া এই পুস্তক প্রকাশনে নানাভাবে সাহায্য করিয়াছেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেকের প্রতি, আমরা গুণমুগ্ধচিত্তে ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি। ইতি,

বিনীত
শ্রীপ্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়

প্রথম সংস্করণ
১২ ফাল্গুন শুক্রবার, ১৩৫০

Wednesday, July 4, 2018

নিবেদন

পরমহংস মশাই মাঝে মাঝে, বোধ হয় ১৮৮২ বা ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দের মধ্যভাগ হইতে ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যভাগ পর্যন্ত রামদাদার বাড়িতে আসিয়া অনেক কথাবার্তা কহিয়াছিলেন। আমি যদিও অনেক সময় সেখানে উপস্থিত থাকিতাম, কিন্তু তখন আমার বয়স অল্প হওয়ায়, সেই সকল কথার অর্থ বিশেষ বুঝিতে পারি নাই; আর অনেক দিনকার ঘটনা হওয়ায়, এখন সেই সকল কথাবার্তা বিশেষ কিছু স্মরণও নাই। বোধ হয়, অপরেও সেই সকল কথাবার্তা বিশেষ কিছু স্মরণ করিয়া রাখেন নাই বা সেই সম্বন্ধে বিশেষ কিছু লিখিয়া যান নাই। সেই সকল ঘটনার যে বিশেষ কোনো সার্থকতা আছে এবং পরে যে সেগুলির বিশেষ কোনো মূল্য হইবে, এ বিষয়ে তখন কেহ চিন্তাও করেন নাই। সকলেই এই সকল ঘটনা অতি সাধারণ ব্যাপার মনে করিতেন বলিয়া পরমহংস মশাই-এর কথাবার্তা বিশেষ মন দিয়া শুনেন নাই, বা বিশেষ কিছু লিখিয়া রাখেন নাই। এইজন্য, এ বিষয় অতি সামান্যভাবে যাহা আমার স্মরণ আছে, তাহা এ স্থলে বিবৃত করিতে চেষ্টা করিয়াছি; আর সেই সময় পরমহংস মশাই-এর যেরূপ ভাব-ভঙ্গী দেখিয়াছি এবং তাহা দেখিয়া আমার মনে যে প্রকার ভাবের উদয় হইত তাহা ব্যক্ত করিতে প্রয়াস পাইয়াছি। অনেক দিনকার পুরানো কথা হওয়ায়, প্রত্যেক বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে মনে আনিতে পারিতেছি না; তবে যেটুকু পারিতেছি ও ঠিক বলিয়া বোধ হইতেছে কেবল সেইটুকুই বিবৃত করিতেছি। ঠিক পর পর কোন্ দিন কি ঘটিয়াছিল এবং কথাবার্তাকালে পরমহংস মশাই বা অন্য কেহ ঠিক যে কি ভাষা ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহাও স্মৃতিতে আনিতে পারিতেছি না। এইজন্য বিবৃত ঘটনাগুলির আগু-পাছু হইয়া যাওয়া সম্ভব এবং কথাবার্তার ভাষাও বদলাইয়া যাওয়া সম্ভব। যে সকল ঘটনা আমি নিজ চক্ষে দেখি নাই, সেগুলি অপরের মুখে যেমন শুনিয়াছি, তেমন লিখিয়াছি; কিন্তু, সকল ক্ষেত্রে তাহাদের নাম উল্লেখ করা সম্ভব হয় নাই।

এই গ্রন্থের পূর্ব ভাগে, অন্যান্য বিষয়ের সহিত, পরমহংস মশাই-এর জীবনের কতকগুলি ঘটনা ও প্রক্রিয়ার বিষয় সন্নিবেশ করা হইয়াছে, কিন্তু সেগুলি বিশ্লেষণ করা হয় নাই। পরমহংস মশাই-এর ক্রিয়াকলাপ বিশ্লেষণ করিলে, তিনি যে এক অতীব মহান দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ছিলেন, তাহা বেশ স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়; কারণ, তিনি নিজ অনুভূত বহু নূতন দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক সত্যের জীবন্ত রূপ দিয়াছিলেন। পরমহংস মশাই-এর ক্রিয়াকলাপ অনুধাবন করিলে অনেক প্রকার নূতন দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মতের সাহায্যে তাহার কয়েকটি মাত্র অতি সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করিতে প্রয়াস পাইয়াছি, কারণ, সবগুলি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করিতে হইলে স্বতন্ত্রভাবে বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করা আবশ্যক। আমি যেগুলি বিশ্লেষণ করিয়াছি, সেগুলি গ্রন্থের উত্তর ভাগে লিপিবদ্ধ করিয়াছি। ইহাতে যদি ভ্রম হয়, তবে সে ত্রুটি আমার; কারণ আমার ক্ষুদ্র শক্তিতে ও সামান্য বুদ্ধিতে তাঁহার সম্বন্ধে অল্পমাত্র যাহা বুঝিয়াছি, তাহাই এ স্থলে প্রকাশ করিয়াছি।

পরমহংস মশাই-এর মতো আদর্শ পুরুষের বিষয় কোনো কিছু বলা অতীব দুরূহ। পরমহংস মশাই-এর যে বহুবিধ ভাব ও বহুবিধ শক্তি ছিল, আমরা সে সকল কিছুই নির্ণয় করিতে পারি নাই। ভক্তিমার্গের লোকেরা তাঁহাকে মহাভক্ত বলিতেন; জ্ঞানমার্গের লোকেরা তাঁহাকে মহাজ্ঞানী বলিতেন; দার্শনিকগণ তাঁহাকে দর্শনশাস্ত্রের প্রতিমূর্তি বলিতেন; বৈজ্ঞানিকগণ তাঁহাকে বিজ্ঞানশাস্ত্রের প্রমাণপুরুষ বলিতেন; এবং অন্যান্য মতাবলম্বীগণও তাঁহাকে নিজ নিজ মতের আদর্শপুরুষ বলিয়া গ্রহণ করিতেন। পরমহংস মশাই-এর বিষয় অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়াছে সত্য, কিন্তু আরো অধিকসংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশ করা আবশ্যক; কারণ, তাহা হইলে, তাঁহার জীবনী বিশদভাবে আলোচিত হইতে পারে এবং বিভিন্ন দিক হইতে তাঁহাকে বুঝিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে।

এই গ্রন্থ পাঠে যদি কাহারো কিছুমাত্র উপকার হয়, তাহা হইলে আমার শ্রম সার্থক হইল মনে করিব।

বিনীত,
শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্ত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথি
১২ ফাল্গুন, শুক্রবার, ১৩৫০
৩, গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রীট,
কলিকাতা - ৬

Monday, July 2, 2018

মহাপুরুষদিগের বাণী

মহাপুরুষদিগের বাণীসমূহ পর্যালোচনা করিলে, আমরা তিন শ্রেণীর বাণী দেখিতে পাই।

এক প্রকার বাণী হইল - বিধিমূলক। এই সকল সময়োপযোগী বিধি অবলম্বন ও প্রতিপালন করিলে, মানবের অশেষ হিতসাধন হইতে পারে। এইজন্য, তাঁহারা অনেকগুলি বিধি-বাক্যের নির্দেশ দিয়া যান।

অপর এক প্রকার বাণী হইল - নিষেধমূলক। সমাজে যে সকল দুর্নীতির প্রচলন রহিয়াছে এবং যে সকল কারণের জন্য সমাজে বিশৃঙ্খলতা আসিয়াছে ও মানব-মন নিম্নগামী হইয়াছে, সেই সকল দুর্নীতি দূর করিবার জন্য: মহাপুরুষগণ উপদেশচ্ছলে বাল্য-উপাখ্যান, রূপকথা প্রভৃতি দিয়া কতকগুলি নিষেধ-বাণী কহিয়া থাকেন। উচ্চমনা ধীশক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষগণ, মানব-জীবনের কদর্য ভাবসমূহ দেখিয়া ব্যথিত হইয়া, নানারূপ নিষেধ-বাণী কহিয়া যান। সেগুলি পালন করিলে ভবিষ্য-সমাজের মঙ্গল হইতে পারে।

বিধি-বাক্য ও নিষেধ-বাণী দুই-ই হইল স্থানীয় ও সাময়িক ব্যাপার। সমাজের দুর্নীতি তিরোহিত হইলে, এই সকল বিধি ও নিষেধ তত ফলদায়ক হয় না; এমন কি, কয়েক শত বৎসর পর, এই সকল বিধি ও নিষেধ, অল্প বা অধিক পরিমাণে, পরিবর্তন করিতে হয়। এই সকল বিধি ও নিষেধ চিরস্থায়ী - এ কথা কেহ যেন মনে না করেন। এ সকলই হইল দেশ-কাল ইত্যাদির অন্তর্গত; এইজন্য, ইহাদের কার্যকারিতা বা সার্থকতা মাত্র কিছুকালের জন্য থাকে। কিছুকাল পরে, ইহারা আপনা-আপনি নিষ্ফল হইয়া যায় এবং তখন, এই সকল বিধি ও নিষেধের পরিবর্তন নিতান্ত আবশ্যক হইয়া উঠে।

মহাপুরুষদিগের আর এক প্রকার বাণী আছে, যাহা শাশ্বত ও সার্বভৌম। এইরূপ বাণী Transcendentalism বা 'অনুত্তর সম্যক্ সম্বোধি'-র ভাব প্রকাশ করিয়া থাকে। বিধিমূলক ও নিষেধমূলক বাণীসমূহ ভবিষ্যতে যেরূপ লুপ্ত হইয়া যায়, এই নিত্য ও বিশ্বব্যাপী বাণীগুলি সেরূপ লুপ্ত হইয়া যায় না। এইগুলি চিরস্থায়ী ও কালজয়ী। এইজন্য, এইরূপ বাণী সর্ব স্থানে, সর্ব দেশে ও সর্ব জাতির ভিতর প্রযোজ্য।

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক পাঠ করিলে বেশ স্পষ্ট বুঝা যায় যে, চিন্তাশীল বুদ্ধদেব, সমাজে যে সকল দুর্নীতির আবির্ভাব হইয়াছিল, সে সকল দূরীকরণ করিবার জন্য কতকগুলি বিধিনিষেধ নির্ধারণ করিতেছেন। বুদ্ধদেবের যে বাণী - "জাতি, জরা, মৃত্যু নিরাকরণ করিব; অনুত্তর সম্যক্ সম্বোধি লাভ করিব", তা চিরন্তন। বুদ্ধদেবের 'দ্বাদশ নিদান'ও1 সনাতন।

প্রভু যীশুর বাণী বা উক্তি পাঠ করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, তিনি অনেক স্থানে সামাজিক প্রথা এবং অন্যান্য প্রথাসমূহ প্রবর্তন করিবার চেষ্টা করিতেছেন। যীশুর বাণী এবং ইহুদীদিগের ইতিহাস একত্র পাঠ করিলে বেশ স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইহুদী সমাজের কিরূপ অবস্থা ছিল এবং কিরূপ দূষণীয় আচার-পদ্ধতি ইহুদী সমাজে প্রচলিত ছিল। সেইজন্য, চিন্তাশীল যীশু এই সকল নিষেধ করিতেছেন।

মহাপণ্ডিত তীক্ষ্ণধী ও ওজস্বী পল2 যদিও জীবনের প্রথম অবস্থায় যীশুর সম্প্রদায়ের পরম বিরোধী ছিলেন এবং যীশুর অন্তেবাসীদিগকে নানা প্রকার নির্যাতন করিয়াছিলেন, কিন্তু দামাস্কাস যাত্রাকালে, যখন শূন্যপথে যীশুর দেখা পাইলেন, তখন হইতে তিনি যীশুর ভক্ত হইলেন। পল বিরক্ত হইয়া, স্থবির ও সংকীর্ণ ইহুদী সমাজ পরিত্যাগ করিয়া, গ্রীক ও রোমান সমাজের আচার-পদ্ধতি গ্রহণ করিয়া উদার ভাব প্রচার করিলেন, যাহাতে যীশুর ভাবসমূহ জগতের সর্বত্র প্রচারিত হইতে পারে। এইজন্য, জগতে খ্রীষ্টীয় ধর্মের এত প্রচার হইয়াছিল।

এই স্থানে ইহা জানা আবশ্যক যে, যীশুর নামে প্রচলিত গ্রন্থসমূহ পাঠ করিলে আমরা অনেক সময় সন্দিহান হইয়া থাকি যে, কোন্ ভাবটি যীশুর ছিল এবং কোন্ ভাবটিই বা পল-এর ভাবের ছায়া অনুযায়ী লিখিত হইয়াছে। কারণ পল-এর ভাব প্রচারিত হইয়া দৃঢ়ীভূত হইবার পর, যীশুর কয়েকখানি জীবনী লিখিত হয়। এইজন্য পল-প্রণোদিত যীশুর ভাবমাত্র আমরা গ্রন্থে পাই, কিন্তু যীশুর আসল ভাব যে কি ছিল, তাহা বুঝা যায় না।

যাহা হউক, সমাজকে পরিবর্ধিত করিতে হইলে কি উপায় অবলম্বন করিতে হইবে, সে বিষয় যীশু ও পল উভয়েই চিন্তা করিয়াছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীসমূহ বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলেও, আমরা এইরূপ তিন শ্রেণীর বাণী দেখিতে পাই। সমাজের দুর্নীতিসমূহ স্বচক্ষে দেখিয়া, বহু বৎসর ধরিয়া চিন্তা করিয়া তিনি কতকগুলি বিধি-নিষেধ নির্দেশ করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সমস্ত ভাবগুলি একসঙ্গে মিলাইলে সাধারণ লোকের পক্ষে তাহার তাৎপর্য বুঝিতে অসুবিধা হইতে পারে, এবং মনে চাঞ্চল্য আসিতে পারে; কারণ, সব ভাবগুলি, সকল সময়ে ও সকল দেশে প্রযোজ্য নয়। এইজন্য, স্বামী বিবেকানন্দ বহু বৎসর চিন্তা করিয়া আরো কতকগুলি বিধি-নিষেধ প্রণয়ন করিয়াছিলেন, এবং নিজের ধীশক্তি দিয়া অনেক প্রকার নতুন ভাব প্রচার করিয়াছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ কেন এইরূপ বিধি-নিষেধ নির্ধারণ করিলেন? পূর্বতন মহাপুরুষগণ যে ঠিক এইভাবে বিধি-নিষেধ করেন নাই এবং এইভাবে কথা বলেন নাই, ইহারই বা তাৎপর্য কি? - ইহার কারণ বুঝিতে হইলে, শ্রীরামকৃষ্ণের সময় কলিকাতার ও বাংলাদেশের সমাজের অবস্থা কিরূপ ছিল তাহার বিষয় কিছু জানা আবশ্যক। কেবল শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি ও বাণী পাঠ করিলেই সেগুলির সার্থকতা বুঝা যায় না। সমাজের অবস্থা অবগত না হইলে, চিন্তাশীল ব্যক্তির মনোভাব বুঝা সম্ভবপর নয়।

সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক কি? - সমাজ ব্যক্তি উৎপন্ন করিয়া থাকে; সমাজের নানা প্রকার চঞ্চল ভাব হইতে মহাপুরুষ আবির্ভূত হইয়া থাকেন। সমাজের ভাব চঞ্চল ও বিক্ষুব্ধ না হইলে, চিন্তাশীল ও ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি উদ্ভূত হইতে পারেন না। সমাজ আবশ্যক শক্তিপুঞ্জ কেন্দ্রীভূত করিলে, মহাপুরুষের অভ্যুত্থান হইয়া থাকে, এবং পরিশেষে, এই মহাপুরুষই সমাজকে পরিচালন করিয়া থাকেন। A great man is the outcome of revolution, fulfils the revolution and is the father of future ages - অর্থাৎ, মহাপুরুষ বিপ্লবের পরিণতি, বিপ্লবকে পূর্ণতা দান করেন, এবং ভবিষ্য যুগের স্রষ্টা।

সমাজ এবং ব্যক্তির মধ্যে ইহাই হইল পরস্পর সম্পর্ক।


1. ১. অধিবিদ্যা। ২. সংস্কার। ৩. বিজ্ঞান। ৪. নাম-রূপ। ৫. ষড়ায়তন। ৬. স্পর্শ। ৭. বেদনা। ৮. তৃষ্ণা। ৯. উপাদান। ১০. ভব। ১১. জাতি। ১২. জরা, মৃত্যু, দুঃখ, দৌর্মনস্য। পরস্পর পরস্পরের কারণ বলিয়া, এইগুলির নাম নিদান। বোধিবৃক্ষমূলে তপস্যাকালে বুদ্ধদেব সৃষ্টির আদিকারণ সম্বন্ধে পর্যালোচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার মতে, এই দ্বাদশ নিদান কার্য-কারণ তত্ত্বের বিষয় ও পরিণাম।

2. মহাত্মা পল-এর পূর্বকার নাম ছিল 'সল'। প্রথম জীবনে তিনি ঘোর খ্রীষ্ট-বিদ্বেষী ছিলেন। তিনি খ্রীষ্ট-অনুচরগণকে নির্যাতন করিবার মানসে দামাস্কাস-এর নিকট পৌঁছিলে, অকস্মাৎ, আকাশ হইতে তাঁহার চতুর্দিকে এক জ্যোতি দীপ্তি পাইল। সল ভূমিতে পড়িয়া যাইলেন এবং একটি বাণী শুনিতে পাইলেন - "সল, সল, তুমি আমাকে নির্যাতন করিতেছ কেন?" সল জিজ্ঞাসা করিলেন, "প্রভো, আপনি কে?" উত্তর হইল, "আমি সেই যীশু, তুমি যাহাকে নির্যাতন করিতেছ; কণ্টকের মুখে পদাঘাত করা তোমার পক্ষে দুষ্কর।" সল আশ্চর্যান্বিত হইয়া কম্পিতস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, "প্রভো, আপনার কি ইচ্ছা? আমি কি করিব?" প্রভু বলিলেন, "তুমি উঠিয়া শহরে যাও, যাহা করিতে হইবে, পরে জানিতে পারিবে।"

সল-এর সহগামীগণ কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া এবং এইরূপ কথাবার্তা শুনিয়া নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। সল ভূমি হইতে উঠিলেন এবং নেত্রদ্বয় উন্মীলন করিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। সহগামীগণ তাঁহার হাত ধরিয়া তাঁহাকে দামাস্কাস শহরে লইয়া যাইলেন। সল তিন দিন দৃষ্টিহীন অবস্থায় ছিলেন এবং কোনো কিছু আহার বা পান করেন নাই।

সল, পরে, খ্রীষ্ট-ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন এবং সেন্ট পল, অর্থাৎ, সাধু পল নামে পরিচিত হইয়াছিলেন।

Thursday, June 28, 2018

পুরাতন বাংলার সমাজ

পুরানো বাংলার সমাজের অবস্থা অতীব কদর্য ও জঘন্য হইলেও, আমি তাহার কিঞ্চিৎ আভাস দিতেছি। কারণ, সেই সময়কার সমাজের বিষয় অবগত হইলে, শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি ও বাণীসমূহের সার্থকতা বুঝা যাইবে এবং তাঁহার আবির্ভাবের কারণও বুঝা যাইবে।

আমরা যে সময় জন্মগ্রহণ করিয়াছি, সেই সময় পুরানো বাংলার অবসান হইতেছে এবং নূতন বাংলা উঠিতেছে। এইরূপ সামাজিক পরিবর্তনের সময়ে আমরা আসিয়াছি। আমরা সমাজের অতি জঘন্য অবস্থাতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, এবং স্বচক্ষে এমন অনেক বিষয় দেখিয়াছি, যাহা এখনকার সহিত তুলনা করিলে লোকে হাসিবে ও অবজ্ঞা করিবে। আর সমাজের এত দ্রুত পরিবর্তন হইতেছে যে, এখনকার লোকেরা সে-সকল কথা বিশ্বাস করিতেই পারিবে না।

কলিকাতার তখনকার সমাজ বুঝিতে হইলে, দীনবন্ধু মিত্র প্রণীত 'সধবার একাদশী' গ্রন্থখানি পাঠ করা আবশ্যক। ইহা পাঠ করিলে, শিক্ষিত ভদ্রলোকের ভিতর কিরূপ বিপর্যস্ত ভাব আসিয়াছিল, তাহা বেশ বুঝা যায়। তখনকার সমাজের অতি সুন্দর চিত্র ইহাতে আছে। অপর একখানি গ্রন্থ হইল, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রণীত 'চৈতন্য-লীলা'। ইহাতে জগাই ও মাধাই-এর যে অংশ আছে, তাহা গিরিশচন্দ্র কর্তৃক পর্যবেক্ষিত সমাজের প্রতিচিত্র। আমরাও ঠিক এইরূপ দেখিয়াছি। চৈতন্য-লীলাতে জগাই ও মাধাই-এর যে চরিত্র দেখানো হইয়াছে, তাহা অনেকাংশে গিরিশচন্দ্রের নিজ চরিত্রেরই রূপান্তর। জগাই ও মাধাই হইলেন গিরিশচন্দ্র স্বয়ং ও তাঁহার এক বন্ধু, নাম পরিবর্তিত মাত্র। গিরিশচন্দ্র প্রণীত 'সীতার বিবাহ' গ্রন্থে সমাজের আর একটি আলেখ্য পাওয়া যায়। আমরা ছেলেবেলায় কলিকাতার সমাজের অবস্থা যেরূপ দেখিয়াছি, তাহার নিখুঁত চিত্র ইহাতে পাওয়া যায়।

আলমবাজারের মঠে বড় ঘরটিতে, সন্ধ্যার পর, রাখাল মহারাজ1 ও আমি বসিয়া আছি; এমন সময়, * * মুখুজ্যে ও তাঁহার ছেলে আসিলেন। রাখাল মহারাজ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "তুমি তো আগে এত ষণ্ডা ছিলে, তবে এত পটকে গেলে কেন?" * * মুখুজ্যে তাঁহার ছেলের সম্মুখেই নিজ জীবনের পূর্ব কথার উল্লেখ করিয়া বলিলেন, "আর দাদা, ছ-ছ'টা ভৈরবীচক্রে রাতে ঘুরতুম। তখন দক্ষিণেশ্বরে, আলমবাজারে, অনেক ভৈরবীচক্রের আড্ডা ছিল। রাতে পাঁচ-ছ'টা চক্রে ঘুরলে, আর কি শরীর থাকে!" * * মুখুজ্যে তাহার পর অতি জঘন্য কথা বলিতে লাগিলেন, এত জঘন্য যে, তাহা শুনিয়া আমাদের ভিতর একটু ত্রাস আসিতে লাগিল। আমরা উভয়ে চঞ্চল ও উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলাম। কথা থামাইবার জন্য রাখাল মহারাজ বলিলেন, "মুখুজ্যে তোমার ছেলে বসে আছে, কি করছো?"

* * মুখুজ্যে ছেলের দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিলেন, "এ সব বাপের কথা - মহাভারতের কথা শুনতে কোনো দোষ নেই।"

শিমলা এবং কাঁসারীপাড়াতেও এইরূপ ভৈরবীচক্রের আড্ডা ছিল। আমরা ছেলেবেলায় এই সকল ভৈরবীচক্রের লোকদিগের চালের ধামা উল্টাইয়া দিয়াছি এবং অনেক মারপিটও করিয়াছি। আমরা নূতন কলিকাতার এক প্রকার প্রথম পর্যায়; এইজন্য, পুরানো হীন আচার-পদ্ধতিসমূহ এত ঘৃণা করিতাম ও ভৈরবীচক্রের লোকদিগকে মারপিট করিতাম। এইরূপ মার দেওয়াতে, ভৈরবীচক্রের দল প্রকাশ্যে কিছু কমিয়াছিল। বোষ্টমী নাম দিলে লোকে বিশেষ আপত্তি করিবে না, এইজন্য, পরে, এই ভৈরবীচক্রগুলি নাম পরিবর্তন করিয়া 'শচীমা-ভজা' দল বলিয়া আত্মপরিচয় দিত। এই সব আখড়াগুলিতে অতি বীভৎস কার্য হইত।

মাতালের কথা তো বলিবারই নয়। সেই সময় শিক্ষিত ভদ্রলোকদিগের ভিতর মদ খাওয়ার প্রথাটা খুব চলিয়াছিল। শিমলা ছিল 'অষ্ট-বসুর পাড়া',2 অর্থাৎ, বিখ্যাত মাতালের পাড়া। রাখাল3 ও আমরা সকলে, শনিবার সন্ধ্যার সময় লাঠিসোঁটা লইয়া তৈয়ার হইতাম, তাহার পর, মাতালদের ঠেঙানো শুরু হইত। রাস্তার দু-ধারে তখন পগার বা নর্দমা ছিল। দু-একটি ধাঙড়ে উহা পরিষ্কার করিত। সেই পগারের ভিতর মাতালদের শুইয়া থাকিবার জায়গা ছিল। রবিবার দিন মাতালেরা রাস্তার ধারের এই পগারে, পাঁকের ভিতর, মাথায় ধাঙড়দের ঝোড়া দিয়া বালিশ করিয়া শুইয়া থাকিত; সোমবার সকালে যে যার কাজে যাইত। তখন প্রচলিত কথাই ছিল:

"হায় রে মজা শনিবার
বড় মজার রবিবার!"

পাঁকে শুইয়া থাকিবার সময় যদি পাহারাওলা আসিত, তাহা হইলে ঐ ভদ্রলোক মাতালেরা বলিত, "বাবা, এ police jurisdiction নয় যে ধরবে, এ municipal jurisdiction" - অর্থাৎ এ (পগারটা) পুলিসের এলাকা নয় যে ধরবে, এ মিউনিসিপ্যাল এলাকা।

কাদামাটির কথা কিছু জানা আবশ্যক। দুর্গাপূজার নবমীর দিন, পাঁঠা বা মহিষ বলি দিয়া, তাহার মুণ্ডটি কাদা মাখাইয়া মাথায় করিয়া লইয়া, সকলে রাস্তায় বাহির হইত; আর বৃদ্ধ পিতামহ তাঁহার পৈতৃক খাতাখানি লইয়া অশ্লীল গান শুরু করিতেন, এবং তাঁহার পুত্রপৌত্রাদি সকলে সমস্বরে সেই গান গাহিতে থাকিত। এখন সে সকল কুৎসিত বিষয় স্মরণ করিলে গা শিহরিয়া উঠে! কিন্তু ইহাই ছিল তখনকার সমাজের প্রথা।

তাহার পর হইল, পাঁচালি ও তরজার গান। সে সকল গান অতি কদর্য ও অশ্লীল। কিন্তু তখনকার লোকেরা হাসিমুখে, আনন্দ করিয়া, সেই সকল গান শুনিত। এখন সে সকল গান গাহিলে, সম্ভবতঃ পুলিসে ধরিবে। কলিকাতার সমাজে তখন এত দূর অবনতি হইয়াছিল।

লোক মরিলে, কেহ তাহাকে দাহ করিতে যাইত না। এমন কি, যে বিবাহ করে নাই, সেও বলিয়া বসিত যে, তাহার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা, সেইজন্য সে মড়া ছুঁইবে না ও দাহ করিতে যাইতে পারিবে না। বাড়ির পাশে লোক মরিলে, মড়া উঠিত না। এমন কি জ্ঞাতি মরিলেও সহজে কেহ সঙ্গে যাইত না। যাহাকে সেবা ও শুশ্রূষার ভাব বলে, সে সব কিছুই ছিল না। কোনো রকমে নিজের জাত বাঁচাইলেই হইল। এ সব কথা সত্য, আমি স্বচক্ষে এ সব দেখিয়াছি।

সর্ব বিষয়ে প্রবঞ্চনা করা, মিথ্যা ব্যবহার করা, জালিয়াতি করা, বিধবাকে ঠকানো, প্রভৃতি ছিল বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। লোকের বিষয়-সম্পত্তি জাল করিয়া লওয়া, ঠকাইয়া লওয়া - এই সব ছিল বাহাদুরির কার্য। ইহা ব্যতীত লোকে যে আরো কত গর্হিত কার্য করিত, তাহা বলিবার নয়। সকল কথা এ স্থলে বলাও উচিত নয়।

মেয়েদের আট বৎসর হইতে নয় বৎসরের মধ্যে বিবাহ হইত। ছেলেদেরও বিবাহ হওয়া চাই-ই। ষোল-সতেরো বৎসরের ছেলে বিবাহ না করিলে জাত যাইবে, এমন কি যেন আকাশ ভাঙিয়া পড়িবে! আমার নিজের বেলায় ঠিক এইরূপ হইয়াছিল। আমি যখন সতেরো বৎসরে বিবাহ করিলাম না, তখন পাড়ায় এক মহা হুলুস্থুল পড়িয়া গেল। ভদ্রলোকেরা তো সেজন্য নিন্দা করিলেনই, এমন কি আমাদের বুড়ী কাদী হাড়িনী, যে আমাদের বাড়ির ময়লা পরিষ্কার করিত, সেও আসিয়া আমাকে ভর্ৎসনা করিয়া গেল। এখন কিন্তু শহরে হাজার হাজার ছেলে বিবাহ করিতেছে না। আর, এখন মেয়েরাও অবিবাহিতা থাকে। এখন মেয়েদের রাস্তায় বাহির হওয়া গা সওয়া হইয়া গিয়াছে। মেয়েরা তখন পালকি করিয়া রাস্তায় বাহির হইত; পালকির মাথায় ঘেরাটোপ দেওয়া থাকিত। গঙ্গাস্নান করিবার সময় বেহারারা পালকিখানি গঙ্গার জলের উপর ধরিত এবং পালকির নীচুকার বেতের ছাউনির ভিতর দিয়া জল ঢুকিলে মেয়েরা ভিতরে বসিয়া স্নান করিত।

বংশ ও জাত বিষয়ে অতি কঠোর নিয়ম ছিল। নিমন্ত্রণ ও আহার বিষয়েও ঘোর সমস্যা ছিল। নিমন্ত্রণ করিতে যাইলে, প্রথমে সাত পুরুষের পরিচয় দিতে হইত, তাহার পর, কে নিমন্ত্রণ করিতে আসিয়াছে, সে নিমন্ত্রণ করিবার উপযুক্ত কি না, তাহার মারফৎ নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা যাইতে পারে কি না, এবং যে নিমন্ত্রণ করিতে পাঠাইয়াছে, তাহার বাড়িতে খাওয়া যাইতে পারে কি না - এই সব বিষয় লইয়া মহা গণ্ডগোল হইত। আমি ছেলেবেলায় নিমন্ত্রণ করিতে গিয়া বৃদ্ধদের হাতে পড়িয়া কয়েক বার এইরূপ বিপন্ন হইয়াছিলাম; শেষে, রাগিয়া চলিয়া আসি।

ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ কখনো ভাগবতের কথা শুনিতে যাইতেন না; ইহাতে তাঁহার মানহানি হইত। ভাগবত গ্রন্থ তখন হাতে-লেখা পুঁথি ছিল। এমন কি, পুঁথির একখানি পাতা যদি দৈবাৎ খুলিয়া পড়িয়া যাইত তো, ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ চিমটা দিয়া ধরিয়া পাতাটা তুলিয়া রাখিতেন এবং ভাগবতের পাতা ছুঁইয়াছেন বলিয়া, হাত ধুইয়া, ইষ্টনাম জপ করিতেন। গোঁসাই-এর সহিত কোনো ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ এক পঙ্ক্তিতে আহার করিতেন না; কোনো শ্রাদ্ধবাড়িতে গোঁসাই-এর সহিত এক আসনে বসিতেন না। আবার, গোঁড়া বৈষ্ণবেরা দুর্গাঠাকুরকে বলিতেন, 'হাতিমুখোর মা'; বেলপাতাকে বলিতেন 'তেফর্কা পাতা'; কালীঠাকুরকে বলিতেন, 'মসী'। এইরূপ গোঁড়ামির অনেক পুরানো গল্প আছে।

অনেক সময় লোকেরা তখন ইংরাজী ও বাংলা মিশাইয়া কথা বলিত। বাংলায় চিঠি লেখা অতি অসভ্যতা বলিয়া বিবেচিত হইত। "সধবার একাদশী"-তে নিমচাঁদ তাই বলিতেছে: I read English, write English, talk English, speechify in English, think in English, dream in English... আর এক স্থানে নিমচাঁদ বলিতেছে: "তুমি পড়েছ দাতাকর্ণ, তোমার বাপ পড়েছে কাশীদাস। তোমার হাতে মেঘনাদ, কাঠুরের হাতে মাণিক - মাইকেল দাদা বাঙ্গলার মিল্টন॥"

প্রণাম করা ছিল কু-সংস্কারের বিষয়। কেহ বা ইংরাজীতে 'গুড মর্নিং' বলিয়া কার্য সমাধা করিত, কেহ বা বিশেষ ভদ্রতা অনুযায়ী ডান হাতের তর্জনীটি এক বার কপালে তুলিত, ইহাই ছিল তখনকার সভ্যতার পরিচয়। শ্রাদ্ধাদি করা হইল কু-সংস্কারের কার্য, ইহার কোন দরকার নাই! দেবদেবীর পূজা করাও যেন অতীব গর্হিত কার্য! ঠাকুর-দেবতার কথা শোনাও ছিল কু-সংস্কার! কালীপূজার সহিত ভৈরবীচক্রের বিশেষ সম্পর্ক ছিল, এইজন্য, কালীঠাকুর অনেকের কাছে বিশেষ করিয়া বর্জনীয় ছিল। আর, সরস্বতী ও কার্তিক পূজা ছিল বেশ্যাপল্লীর পূজা, ভদ্রলোকদিগের এই সকল পূজা করা ছিল অবিধেয়।

ধর্ম-উপদেষ্টা নামে, কথক ঠাকুর ও গাইন ঠাকুর কথকতা ও পালাগান করিত। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা তাহাদের কথকতা ও পালাগান শুনিতে যাইতেন; অন্যান্য ভদ্রলোকরা কখনো যাইতেন না। কথাবার্তার প্রচলিত মাত্রাই ছিল - 'এ যেন কথকের কথা', অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ধর্মগ্রন্থ যাহা কিছু ছিল এবং ধর্ম সম্বন্ধে যাহা কিছু শুনিতে পাইতাম, তাহা হইল - যীশুখ্রীষ্টের গল্পবিষয়ক। পাদরীরা, এই সুযোগে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ও বাজারে যাইয়া সকলকে যীশুর গল্প শুনাইত। বাঙালি পাদরীরা, হেদোর4 ধারে, কেষ্ট বন্দ্যোর5 গির্জার কোণটিতে, রবিবার সকালে যীশুখ্রীষ্টের কথা বলিত, আর হিন্দু দেবদেবীদিগকে গাল পাড়িত। দাদা6 একদিন বেলা নয়টার সময় ঐখান দিয়া আসিতেছিল। সে খানিকক্ষণ পাদরীদের বক্তৃতা শুনিয়া তাহাদের সহিত তর্ক-বিতর্ক করিয়া ঝগড়া শুরু করিল। ঝগড়াটা ক্রমে বাড়িয়া উঠিল। দুই দিকে বেশ দল পাকিল; এমন কি, মারামারি হইবার উপক্রম হইল। পরে, দুই দল ঠাণ্ডা হইলে, দাদা চলিয়া আসিল এবং দুই দলের লোকরাও রাগিয়া চলিয়া গেল।

এইরূপে খ্রীষ্টান পাদরীরা সকলকে খ্রীষ্টান করিবার জন্য বিশেষ প্রয়াস পাইতে লাগিল। ইংরেজ পাদরী ও সহকারী দেশীয় পাদরীর সংখ্যা খুব অধিক বাড়িয়া গিয়াছিল। তাহারা গলির মোড়ে মোড়ে, বাজারে ও নানা স্থানে যাইয়া হিন্দুধর্ম ও হিন্দু-সমাজের কুৎসা ও অসারতা প্রচার করিতে লাগিল। পাদরীরা বলিত যে, গঙ্গাস্নান করা কু-সংস্কার; তেল মাখিয়া স্নান করা কু-সংস্কার; দাড়ি কামানো কু-সংস্কার। - এইজন্য, আমরা দাড়ি কামাইতাম না। - তাহারা বলিত, হিন্দুদের যাহা কিছু আছে, তাহাই কু-সংস্কার; শুধু তাহারা যাহা বলিবে, তাহাই যুক্তিসঙ্গত। হিন্দুধর্ম মানেই হইল, কু-সংস্কার, হিন্দুধর্ম মানেই হইল, যাহা কিছু সব ভুল!

হিন্দুধর্ম যে কি, তাহা অনেকেই তখন বুঝিত না। হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কাহারো বিশেষ কিছু পড়া-শুনা ছিল না, এবং হিন্দুধর্মের বিষয় কোনো গ্রন্থও তখন পাওয়া যাইত না। এইজন্য, পাদরীদের কথার উত্তর দেওয়া দুঃসাধ্য ছিল। আবার, পাদরীরা ছিল ইংরেজ। পাদরীদের কিছু বলিলে, পাছে হাঙ্গামা হয়, সেইজন্য সাহস করিয়া কেহ বিশেষ কিছু বলিতে পারিত না। নরেন্দ্রনাথ যে সাহস করিয়া হেদোর ধারে পাদরীদের সহিত তর্ক-বিতর্ক করিয়াছিল, সেরূপ সকলে পারিত না। য়ুরোপীয় রাজনীতিক্ষেত্রে একটি উক্তি আছে: First send the missionaries, then send the merchants and last send the army. ইহার অর্থ এই যে, একটি দেশ জয় করিতে হইলে, প্রথমে ধর্ম-প্রচারকদিগকে পাঠাইবে, পরে বণিকদিগকে এবং সর্বশেষে সৈন্যদলকে পাঠাইবে। ভারতবর্ষেও ঠিক সেইরূপ হইয়াছিল। এইজন্য, পাদরীদিগকে আমরা সশঙ্কচিত্তে দেখিতাম; শ্রদ্ধা-ভক্তির কথা নয়, অতিশয় ভয় করিতাম; কারণ ভাবিতাম, তাহারা কখন কি বিপত্তি আনিয়া দিবে? গ্রাম্য ভাষায় তখন একটি কথা প্রচলিত ছিল:

'জাত মাল্লে পাদরী এসে
প্যাট্ মাল্লে নীল বাঁদরে।'

অর্থাৎ পাদরীরা আসিয়া জাত ও ধর্ম নষ্ট করিল, এবং নীলকরেরা উদরের অন্ন হরণ করিল।

শ্রীচৈতন্য ও বৈষ্ণব-ধর্মের বিষয় আমরা বিশেষ কিছু জানিতাম না। গীতা ও উপনিষদের নাম কেহ শুনে নাই। চণ্ডীপাঠ মাত্র কয়েকজন ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ করিতেন। ত্রৈলোক্য সান্যাল মশাই7 শ্রীচৈতন্যের বিষয় একটি গ্রন্থ8 লিখিয়াছিলেন। আমরা শ্রীচৈতন্য সম্বন্ধে প্রথম এই গ্রন্থ পাঠ করি। 'চৈতন্য-চরিতামৃত'9 নামে যে কোনো গ্রন্থ আছে এ বিষয় আমরা তখন কিছুই জানিতাম না। পাদরীরা বাইবেলগুলি বাড়ি বাড়ি দিয়া যাইত, সেইটাই আমাদের কতকটা পড়া ছিল মাত্র।

আবার, এক মত উঠিল কোঁতিষ্টদের। ইহাদের মত হইল যে, ঈশ্বরাদি কিছুই নাই। ইহাদের প্রত্যক্ষবাদী - Positivist বলা হইত। ব্রাহ্ম-ধর্ম তবু একটা ধর্মের ভিতর ছিল, কিন্তু প্রত্যক্ষবাদীরা সব উড়াইয়া দিত।

কলিকাতার যখন এইরূপ অবস্থা, তখন কেশববাবু10 বক্তৃতা দিতে লাগিলেন। কেশববাবুর বিষয় কিছু বলিতে হইলে ইহা প্রথমেই বলা আবশ্যক যে, তাঁহার চেহারা ও মুখশ্রী কার্যকারিতা বা সফলতা লাভে তাঁহাকে বারো আনা ভাগ সাহায্য করিত, এবং বাকি চার আনা ভাগ সাহায্য করিত তাঁহার বাক্যবিন্যাস। আলেখ্যে11 তাঁহার যে মূর্তি দেখা যায়, তাহা শুধু একভাব হইতে দেখানো হইয়াছে, কিন্তু কেশববাবুর জীবিত অবস্থায় চেহারা আরো সুন্দর ও মাধুর্যপূর্ণ ছিল। চোখের চাহনী ও মুখভঙ্গী - ভক্তি, ঈশ্বর-বিশ্বাস ও ওজস্বিতার ভাবে পরিপূর্ণ ছিল। কেশববাবুকে দেখিয়াছেন এমন কোনো লোক যদি আজও জীবিত থাকেন তো, তিনি নিশ্চয়ই বলিবেন যে, কেশববাবুর চেহারাতে একটি বিশেষ লাবণ্য বা মাধুর্য ছিল, এবং সাধারণ লোক হইতে তাঁহার চেহারার অনেক অংশে প্রভেদ ছিল।

পাদরীরা যেমন পাড়ায় পাড়ায় গিয়া বক্তৃতা দিত কেশববাবুও তেমনি পাড়ায় পাড়ায় গিয়া, মধ্যে মধ্যে সভা করিয়া, হিন্দুধর্ম প্রচার করিতে লাগিলেন। কেশববাবু প্রথম অবস্থায় ইংরাজীতে বক্তৃতা দিতেন, কিন্তু কিছু দিন পর হইতে বাংলায় বক্তৃতা দেওয়া আরম্ভ করিলেন। আমরা কেশববাবুর নিকট প্রথম বাংলায় বক্তৃতা শুনিয়াছিলাম; তাহা নিন্দনীয় নয়। শিমলাতে মনোমোহনদার12 এবং নন্দ চৌধুরীর বাড়িতে এক সময়ে তিনি সভা করিয়াছিলেন: সমস্ত দেশটা যাহাতে খ্রীষ্টান না হইয়া যায়, তাহার জন্য তিনি বিশেষ প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। প্রথম অবস্থায় তিনি খ্রীষ্টধর্ম ও হিন্দুধর্মের মাঝামাঝি একটি সেতু তৈয়ার করিতে চেষ্টা করিলেন। যীশুকে তিনি Oriental Christ - প্রাচ্যদেশীয় যীশু ও তপস্বী যীশু করিয়া দেখাইতে লাগিলেন। তিনি কতকগুলি বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতাগুলিতে তিনি এইরূপ মত প্রকাশ করিলেন যে, বিলাতী হ্যাট-কোট ত্যাগ করাইয়া দেশী যীশু করো এবং যীশুবিহীন যীশুর ধর্ম মানো। কেশববাবু হিন্দুধর্মের বিগ্রহ-পূজাদি ত্যাগ করিলেন, কিন্তু ভক্তির পথ অবলম্বন করিলেন। ইহাতে শিক্ষিত লোকের ভিতর খ্রীষ্টান হওয়া কিছু পরিমাণে কমিয়াছিল। ব্রাহ্মধর্মে কিছু পরিমাণ খ্রীষ্টধর্ম ও কিছু পরিমাণ হিন্দুধর্মের আচার-পদ্ধতি মিশানো ছিল। কেশববাবু তাঁহার ব্রাহ্ম মত প্রচার করিতে লাগিলেন। অধিকাংশ শিক্ষিত লোকই তখন প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কেশববাবুর দলে যাইতে লাগিলেন। আমরাও সমাজ-সংস্কার বিষয়ে তাঁহার অনুগত হইলাম। কেশববাবুর দলে যোগদান করায়, যদিও মদ খাওয়া ও অন্যান্য সামাজিক দুর্নীতি হইতে আমরা অন্য দিকে যাইলাম; কিন্তু এক দিকে নিরাকার ব্রহ্ম যে কি, তাহা কিছুই বুঝিতাম না, এবং অপর দিকে, ঠাকুর-দেবতা ও পুরানো আচার-পদ্ধতিও কিছু মানিতাম না।

সমাজের এইরূপ অবস্থাতে আমাদের শৈশবকাল কাটিয়াছিল। সমাজে তখন নাস্তিকতা ও বিশৃঙ্খলতার ভাব আসিয়াছিল। অনেক শিক্ষিত যুবক এইরূপ অনিশ্চিত অবস্থায় থাকিয়া, শেষে খ্রীষ্টান হইয়াছিল। কিন্তু আমরা অধিকাংশ যুবক খ্রীষ্টধর্ম পছন্দ করিতাম না ও হিন্দুধর্মও মানিতাম না। আমরা পুরানো কিছু মানিতাম না; নূতন যে কি করিতে হইবে, তাহাও জানিতাম না। আমরা কোনটা যে ধরিব, তাহা তখন স্থির করিতে পারিতেছিলাম না; মহা অশান্তির ভাব আসিল। যুবকদের মনে প্রচণ্ড আগুন জ্বলিল। কি করিতে হইবে; তাহা কেহই বুঝিতে পারিতেছিল না। পুরানো বাংলা তখন চলিয়া যাইতেছিল এবং নূতন বাংলা আসিতেছিল।

কেশববাবু বাংলাদেশে প্রথম নব ভাব জাগ্রত করিলেন। তিনি, 'ব্যান্ড অভ্ হোপ' (Band of Hope) নামে একটি দল গঠন করিলেন। দলের লোকেরা মদ খাইবে না; এমন কি, তামাকও খাইবে না। নরেন্দ্রনাথ এই ব্যান্ড অভ্ হোপ বা 'আশার দল'-এ নাম লিখাইয়াছিল। তবে, এই দলের ভিতর কলিকাতার যুবক তত বেশী ছিল না; পূর্ববঙ্গের অনেক লোক ছিল।

এক দিন নরেন্দ্রনাথ তামাক খাইতেছে, এমন সময়, প্রিয় মল্লিক নামে কেশববাবুর সমাজভুক্ত জনৈক যুবক আসিয়া বলিল "নরেন, তুমি কি করলে, তামাক খেলে?" - তামাক খাওয়াটা যেন একটা মহা গর্হিত কাজ! নরেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিল, "আরে, ব্যান্ড অভ্ হোপ-এর দলে থাকলেও তামাক খেতে দোষ নেই।" এই বলিয়া কথাটি ঠাট্টা করিয়া উড়াইয়া দিল।

এক দিকে যেমন মাতালের দল উঠিল, অপর দিকে তেমনি এই ব্যান্ড অভ্ হোপ-এর দল উঠিল। ব্যান্ড অভ্ হোপ-এর দলের কথা ছিল: Touch not, taste not, smell not, drink not anything that intoxicates the brain, - অর্থাৎ, যাহাতে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়, এমন কোনো জিনিস স্পর্শ, আস্বাদন, আঘ্রাণ বা পান করিও না। এইরূপ দুই দলে দ্বন্দ্ব চলিতে লাগিল।

কেশববাবু 'নব বৃন্দাবন'13 নামে একখানি নাটক প্রণয়ন করান। গ্রন্থখানি, সম্ভবতঃ মুদ্রিত হয় নাই; কারণ বাজারে আমরা কখনো উহা দেখি নাই। এই নব-বৃন্দাবন অভিনয়ে নরেন্দ্রনাথ কয়েক বার পাহাড়ী বাবার অংশ গ্রহণ করিয়াছিল। নরেন্দ্রনাথকে এক ব্যক্তি এক বার জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, "নরেন, পাহাড়ী বাবার ভূমিকায় কি করতে হয়?" নরেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিল, "চুপ করে বসে কেবল ধ্যান করতে হয়।"

যাহা হউক, নব-বৃন্দাবন অভিনয় কয়েক বৎসর বেশ একটা হুজুক আনিয়াছিল; তবে, এই অভিনয় কেশববাবুর সমাজভুক্তদিগের মধ্যে হইত, বাহিরে হইত না।

বিদ্যাসাগর মশাই14 বিধবা-বিবাহ প্রচলন করিলেন। কেশববাবু ব্রাহ্ম বিবাহ-বিধি অনুযায়ী অসবর্ণ-বিবাহ প্রচলন করিবার চেষ্টা করিলেন। কেশববাবু বালিকাদিগের জন্য বিদ্যালয়ও স্থাপন করিলেন; কারণ, এই সময় পাদরীরা দু-একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিল। সাধারণতঃ স্ত্রীলোকেরা ঘোমটা-ঘেরা ও টোপ-ঢাকা হইয়া বাহির হইত। সেই ভাবটা কেশববাবু দূর করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কেশববাবু স্ত্রীলোকদিগকে সমাজে15 বসিতে দিতেন, অর্থাৎ স্ত্রীলোকদিগের বাড়ির বাহির হওয়া সমর্থন করিতেন। কেশববাবু তখনকার সমাজের নানা প্রকার সংস্কার করিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। কিন্তু সেই সময় তাঁহার সংস্কার-প্রথা তত ফলদায়ক হয় নাই, কারণ, সমাজ তখন একেবারে পচিয়া গিয়াছিল।

পণ্ডিত গৌরগোবিন্দ রায় কেশববাবুর বিশেষ সহায় হইয়াছিলেন। তিনি ভাগবতের অতি সুন্দর ব্যাখ্যা করিতেন। সাধু অঘোরনাথ কেশববাবুর এক তাপস সহকারী ছিলেন। তিনি কয়েক বৎসর আমাদের সাত নম্বর রামতনু বসু গলির বাড়ি ভাড়া করিয়া বাস করিয়াছিলেন। এইজন্য, তাঁহাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানিতাম; তিনি যথার্থই একজন তাপস ছিলেন। প্রতাপ মজুমদার, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, উমেশ দত্ত, শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রভৃতি সকলে প্রথম অবস্থায় কেশববাবুর সংস্পর্শে আসিয়া নব ভাবে উদ্দীপ্ত হইয়াছিলেন। অবশেষে, শাস্ত্রী মশাই, গোঁসাইজী, উমেশ দত্ত, নগেন চট্টোপাধ্যায়, প্রভৃতি সকলে পৃথক হইয়া 'সাধারণ-সমাজ' স্থাপন করেন; কিন্তু তাহা হইলেও, কেশববাবুর প্রতি সকলের শ্রদ্ধা-ভক্তি পূর্বের ন্যায় অটল ছিল। আমরাও সকলে তাঁহাকে বিশেষ শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতাম।

সাধারণ-সমাজ গঠিত হইলে পর, আমরা সাধারণ-সমাজে যাইতে লাগিলাম। সেখানে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবনাথ শাস্ত্রী, নগেন চট্টোপাধ্যায়, উমেশ দত্ত, প্রভৃতি কয়েক জনের বক্তৃতা শুনিতাম। এইরূপে, ক্রমে যুবকদিগের ভিতর ব্রাহ্মধর্মের ভাব জাগিয়া উঠিল। পরে যাঁহারা পরমহংস মশাই16-এর কাছে গিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই প্রথমে সাধারণ-সমাজে যাতায়াত করিতেন।

যুবা শরৎ17 বিগ্রহপূজা বা মূর্তিপূজার বিশেষ বিরোধী ছিল। কারণ, তখন সে সাধারণ-সমাজে যাতায়াত করিত। বরানগর মঠে, এক দিন বিকালবেলা, আমার সঙ্গে তাহার এ বিষয়ে অনেক কথা হইয়াছিল।

বেলুড় মঠে, এক দিন সারদানন্দ আমায় বলিলেন, "আচ্ছা, মনে আছে তোমার, গোস্বামী মশাই করুণ স্বরে বলতেন - হে শ্রীহরি, হে শ্রীহরি, হে শ্রীহরি!" - গোস্বামী মশাই তিন বার তিন প্রকার কণ্ঠস্বর করিয়া অতি কাতর ও করুণভাবে বলিতেন, "হে শ্রীহরি, হে শ্রীহরি, হে শ্রীহরি!" সে বাণী শুনিলে হৃদয় জুড়াইত। সে কণ্ঠস্বর, সে শব্দ, সে বাণী এখনো প্রাণে লাগিয়া রহিয়াছে। আর কাহারো এমন কাতর ও করুণ কণ্ঠস্বর শুনি নাই।

তারকনাথও18 বিশেষরূপে ব্রাহ্ম-সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারকনাথ নিজ মনে সর্বদাই ব্রহ্ম-সঙ্গীত গাহিতে ভালবাসিত।

নরেন্দ্রনাথ ধ্রুপদ গান ভাল করিয়া শিখিলে পর, সাধারণ-সমাজে উপাসনার দিন, রাত্রে, মাঝে মাঝে, ধ্রুপদ গান গাহিত। ব্রহ্ম-সঙ্গীতেও সে অল্প বয়সে খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। সাধারণ-সমাজের কর্তৃপক্ষের সহিত নরেন্দ্রনাথের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী মশাই এক এক দিন সকালে আমাদের গৌরমোহন মুখার্জী ষ্ট্রীটের বাড়ির দরজায় আসিয়া আমায় ডাকিয়া বলিতেন, - তোমার দাদা, নরেনকে, এই সব কথা বলো, ওখানে যেতে বলো, ইত্যাদি। তিনি কয়েক বার আসিয়া আমাকে এইরূপ বলিয়া গিয়াছিলেন স্মরণ আছে।

এই সময়, নরেন্দ্রনাথ বিশেষ কিছু হিন্দু ধর্মগ্রন্থ না পাওয়ায়, হার্বার্ট স্পেনসার ও ষ্টুয়ার্ট মিল-এর গ্রন্থসমূহ অত্যধিক পাঠ করিতে লাগিল। নরেন্দ্রনাথ, স্পেনসার ও মিল-এর গ্রন্থ পাঠ করিয়া সকলের সহিত খুব তর্ক করিত। এমন কি, পাদরীদিগের সহিত সমানভাবে তর্ক করিত। Daredevilry - ডানপিটেমি করা ছিল শিমলার ছেলেদের বিশেষ spirit বা ধাত। তাহারা কাহাকেও ভয়-ডর করিত না, কাহারো খাতির রাখিত না, তেড়েফুঁড়ে মুখের উপর কথা বলিত।


1. স্বামী ব্রহ্মানন্দ।

2. শিমলা অঞ্চলে সম্ভ্রান্ত বসু মহাশয়গণ বাস করিতেন। বসু মহাশয়গণের আটজন একত্র নেশা করিতেন। একটি মাটির গামলাতে মদ ঢালিয়া, উহার চারিদিকে ঘেরিয়া বসিয়া, এই আটজন বন্ধু মুখে খাগড়ার নল দিয়া মদ টানিয়া পান করিতেন। মদের গামলাতে একটি গোলাপ ফুল দেওয়া থাকিত। যিনি ফুলটিকে নিজ নলের মুখে সকলের পূর্বে টানিয়া আনিতে পারিতেন, তিনিই এই পানমণ্ডলীর অধিপতি বা চক্রেশ্বর বলিয়া স্বীকৃত হইতেন।

3. শ্রীযুত রাখালচন্দ্র ঘোষ, পরবর্তী কালে, স্বামী ব্রহ্মানন্দ।

4. কর্নওয়ালিস স্কোয়ার (বর্তমান নাম - আজাদ হিন্দ্ বাগ)।

5. রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।

6. গ্রন্থকারের জ্যেষ্ঠ সহোদর শ্রীযুত নরেন্দ্রনাথ দত্ত, পরবর্তী কালে স্বামী বিবেকানন্দ।

7. শ্রীযুত ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল। চিরঞ্জীব শর্মা ও প্রেমদাস নামেও ইনি পরিচিত।

8. ভক্তিচৈতন্যচন্দ্রিকা।

9. শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত।

10. ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন।

11. কলিকাতার অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউট-এ রক্ষিত ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের তৈলচিত্র।

12. শ্রীযুত মনোমোহন মিত্র, শ্রীযুত রামচন্দ্র দত্তের মাসতুতো ভাই।

13. নাটকটির প্রকৃত রচয়িতা শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল।

14. পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

15. নব-বিধান-সমাজ।

16. শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের দেহধারণকালে তাঁহাকে সকলে 'পরমহংস মশাই' বলিতেন।

17. শ্রীযুত শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী, উত্তরকালে স্বামী সারদানন্দ।

18. শ্রীযুত তারকনাথ ঘোষাল, উত্তরকালে স্বামী শিবানন্দ।

Thursday, June 21, 2018

দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস

দক্ষিণেশ্বরে যে, 'পরমহংস' নামে একজন লোক আছেন, তিনি যে খুব উচ্চ অবস্থার লোক, অতি সাধু ও অমায়িক - যাহাকে বলে, 'বালক-স্বভাব', এই প্রকৃতির লোক - এ কথা কেশববাবুর বক্তৃতা হইতে লোকে জানিতে পারিল। কেশববাবু বলিলেন যে, এই পরমহংসের 'ট্রান্স' (Trance) হয়; যীশুরও এইরূপ ট্রান্স হইত। ট্রান্স কি এক নূতন শব্দ আমরা তাহার কিছু মানে জানিতাম না। সাধারণ লোকের ধারণা হইল যে দক্ষিণেশ্বরে পরমহংস নামে কে-একজন লোক থাকে, তাহার মিরগি হয়, কিন্তু হাত-পা খেঁচাখেঁচি করে না, আপনা-আপনি ভাল হয়, ডাক্তার দেখাইতে হয় না। সাধারণ লোকে ট্রান্স বলিতে এইরূপ বুঝিত। আবার শুনা গেল যে, সে লোকটি রাসমণিদের1 পূজারী; কালীপূজা করিয়া থাকে। লোকটার নাম আবার 'পরমহংস', - এ আবার কি কথা! লোকেরা অমনি হাসি ও ব্যঙ্গচ্ছলে পরমহংস-কে 'গ্রেট গূস' (Great goose) বলিতে লাগিল।

পরমহংস মশাই-এর প্রতি তখনকার লোকের প্রথমে এইরূপ কিঞ্চিৎ অবজ্ঞা বা অশ্রদ্ধার ভাব ছিল। আমরা তখন তাঁহাকে দেখি নাই, আর দেখিতে যাইবার ইচ্ছাও ছিল না। - কোথায়, কে একজন লোক আছে, তার মিরগি ব্যামো হয়, কি আর দেখবো! কেশববাবু বলিয়াছেন, লোকটি ভাল, এইজন্য তাহার বিষয় কিঞ্চিৎ জানিতে আগ্রহ ছিল মাত্র। দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের বিষয় এর বেশী কিছু আমাদের জানা ছিল না, এবং অন্য লোকেরাও জানিত না।

বোধ হয়, ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে রামদাদার বাড়িতে কলেরা হয়। তাহাতে, রামদাদার প্রথম মেয়েটি এবং দুইটি ভগিনী, সাত দিনের ভিতর মারা যায়। রামদাদা সেই সময় বড়ই অধীর হইয়া পড়িয়াছিলেন, এবং কোনো জায়গায় শান্তি পাইলেন না। অবশেষে, তিনি দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের নিকট যাইলেন। কেশববাবুর নিকট হইতে শুনিয়া পূর্বে তিনি দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের কাছে যাতায়াত করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু শ্রদ্ধা, ভক্তি করিয়া তাঁহার নিকট যাওয়া, এবং তাঁহার সহিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসা, এই হইল প্রথম। পরমহংস মশাই-এর সহিত রামদাদার কি কথাবার্তা হইয়াছিল, সে সব বিষয় আমার কিছু জানা নাই। তবে রামদাদা, পরমহংস মশাই-এর কাছে যাইয়া, অনেকটা শান্তি পাইলেন এবং স্থির-ধীর হইয়া কার্য করিতে লাগিলেন। মোট কথা, এই হইল আমাদের শিমলার লোকের পরমহংস মশাই-এর সহিত প্রথম ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ।

রামদাদা ডাক্তারি করিতেন। এইজন্য, তাঁহাকে লোকে 'রামডাক্তার' বলিয়া ডাকিত। রামদাদা কিছু দিন দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিবার পর, শিমলায় খবর রটিল যে রামডাক্তারের এক গুরু হইয়াছে, সে কৈবর্তদিগের পূজারী, দক্ষিণেশ্বরে থাকে। ইহাতে নানাপ্রকার কথাবার্তা উঠিল, কারণ, রামদাদারা হইলেন বৈষ্ণববংশীয়। রামদাদার পিতামহ, কুঞ্জবিহারী দত্ত গোঁসাই ছিলেন, এবং তাঁহার বহু শিষ্য ছিল। রামদাদা নিজের কুলগুরুর কাছে দীক্ষা না লইয়া, এক অজানা ব্যক্তির কাছে দীক্ষা লইয়াছেন, সে ব্যক্তি আবার কালীর উপাসক, শাক্ত! এইজন্য, অনেকেই তাঁহার উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। যাহা হউক, রামদাদা নিজের কুলগুরুর নিকট মন্ত্র না লইয়া পরমহংস মশাইকে গুরু বলিয়া স্বীকার করিলেন।

রামদাদা দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করায়, প্রথমে কিছু দিন সকলেই তাঁহাকে বিদ্রূপ করিতে লাগিল: এ আবার কি ঢঙ হ'ল, পরমহংসই বা কি? রামদাদা কিন্তু রবিবারে অবসর পাইলেই দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতে লাগিলেন। তিনি তাঁহার সমবয়সী বন্ধু ও পাড়ার লোক, সুরেশ মিত্তিরকে2 এই সকল কথা বলেন।

সুরেশ মিত্তির সওদাগরী অফিসের একজন বড় কর্মচারী ছিলেন। সুরেশ মিত্তিরদের বাড়ি আমাদের তিন নম্বর গৌরমোহন মুখার্জী ষ্ট্রীটের বাড়ি-সংলগ্ন ছিল। আমাদের বাড়ির পিছনে পুকুরের পাড় দিয়া তাঁহাদের বাড়ির ভিতর যাতায়াত করা যাইত তবে, তাঁহাদের বাড়ির সদর দরজা ভিন্ন রাস্তায় ছিল। এখন সে বাড়ি ভাঙিয়া রাস্তা হইয়াছে। সুরেশ মিত্তির শাক্ত ছিলেন, প্রথম অবস্থায় তিনি অতি দুর্ধর্ষ লোক ছিলেন। কেশববাবু যখন বিডন গার্ডেন-এ বক্তৃতা দিয়াছিলেন ও খোল বাজাইয়া নামকীর্তন করিয়াছিলেন, তখন সুরেশ মিত্তির ছুরি দিয়া খোলের চামড়া কাটিয়া দিয়াছিলেন।

রামদাদা সুরেশ মিত্তিরকে পরমহংস মশাই-এর কথা বলিলে, তিনি উপহাস করিয়া বলিলেন, "ওহে রাম, তোমার গুরু, পরমহংস যদি আমার কথার উত্তর দিতে পারে, তবে ভাল, নইলে তার কান মলে দিয়ে আসবো।" সুরেশ মিত্তির কান মলিয়া দিবেন, এই শর্তে দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছিলেন; কিন্তু পরমহংস মশাই-এর সহিত খানিকক্ষণ কথাবার্তা কহিবার পর তাঁহার প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, এবং তাহার পর হইতে তিনি পরমহংস মশাই-এর অন্তরঙ্গ হইয়াছিলেন।

কৈলাস ডাক্তারও3 আমাকে এক বার বলিয়াছিলেন যে, রামদাদা যখন তাঁহাকে এক বার কাশীপুরের বাগানে যাইয়া পরমহংস মশাইকে দেখিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন, তখন তিনি বলিয়াছিলেন, "রাম তোমার পরমহংস যদি ভাল লোক হয় তো ভাল, নইলে তার কান মলে দেবো।" এই কড়ারে, কৈলাসডাক্তার, রামদাদার সহিত কাশীপুরের বাগানে গিয়া, নীচে পুকুরের ধারে চাতালে বসিয়া থাকেন। তিনি বলিয়াছিলেন, "আরে প্রথমে গিয়ে দেখলুম যে নরেনটা বি.এ. পাশ করে একেবারে বখে গেছে, নীচেকার হলঘরে কতকগুলো ছোঁড়া নিয়ে এলোমেলো ভাবে বসে আছে, আর, রামের বাড়ির সেই চাকর ছোঁড়া লাটু4, সেটাও কাছে বসে আছে, আরে ছ্যা!" - তিনি বলিতে লাগিলেন, "পরমহংস মশাই-এর শরীর অসুস্থ ছিল, সেইজন্য লোক মারফৎ বলে পাঠালেন, যে, যে বাবুটি আমার কান মলে দেবেন বলেছেন, তাঁকে ওপরে নিয়ে এস। যে লোকটি ডাকতে এসেছিল, সে তো অবাক্ হয়ে খুঁজতে লাগলো, আর, কিছু ইতস্ততঃ করে ঐ কথাগুলি বলতে লাগলো।"

এই শুনিয়া, অপ্রতিভ হইয়া, কৈলাস ডাক্তার অবশেষে সসম্ভ্রমে উপরে যাইবার উদ্যোগ করিলেন এবং ভাবিতে লাগিলেন, "শিমলাতে ঘরের ভেতর বসে রামের সঙ্গে পরমহংসের বিষয় যে কথা হয়েছিল, কাশীপুরের বাগানে সে সংবাদ এখনি কি করে এল!" তিনি আশ্চর্যান্বিত হইয়া উপরে যাইয়া পরমহংস মশাই-এর পায়ের কাছে প্রণাম করিলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, অজান্তে কি ভুল কাজই না করিয়াছিলেন। সেই অবধি কৈলাস ডাক্তার পরমহংস মশাইকে গুরু বলিয়া মানিতেন এবং তাঁহার প্রতিকৃতি প্রণাম না করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইতেন না।

নরেন্দ্রনাথ ছিল শিমলার এক দুষ্টু ছেলে। বয়স অল্প হইলেও, সে খুব ধীশক্তিসম্পন্ন ছিল। সাধারণ-সমাজ, কেশববাবুর সমাজ, প্রভৃতি অনেক জায়গায় সে যাতায়াত করিত। পাড়ায় তাহার একটা বেশ নাম ছিল। সে ছিল পাড়ার ছেলেদের চাঁই বা সর্দার। পাড়ার সব ছেলে তার অনুগত ছিল। নরেন্দ্রনাথের পাড়ার ডাক-নাম ছিল 'বিলে'। কাশীর ৺বীরেশ্বরের পূজা করিয়া তাহার জন্ম হওয়ায়, তাহার নাম রাখা হইয়াছিল 'বীরেশ্বর' - ক্রমে, সংক্ষেপে তাহা 'বিলে' হইয়া যাইল। রামদাদা এক দিন বলিলেন, "বিলে, তুই তো এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াস, দক্ষিণেশ্বরে এক পরমহংস আছেন, দেখতে যাবি? চল্।" নরেন্দ্রনাথ অমনি বলিল, "সেটা তো মুক্খু, কী সে পেয়েছে, যে তার কাছে তা শুনতে যাব? আমি স্পেনসার, মিল, হ্যামিলটন, জন লক, প্রভৃতির এত দর্শনশাস্ত্র পড়লুম আমি কিছু বুঝি না, আর, একটা আকাট মুক্খু, কালীর পূজারী, কৈবর্তদের বামুন - সেইটার কাছে শিখতে যাব? সেটা জানে কি? কী জেনেছে, যে আমাকে শেখাতে পারে?" রামদাদা তথাপি নরেন্দ্রনাথকে পরমহংস মশাই-এর কাছে যাইবার জন্য অনেক অনুনয় করিয়া বলিতে লাগিলেন। অবশেষে নরেন্দ্রনাথ বলিল, "যদি সে রসগোল্লা খাওয়াতে পারে তো ভাল, নইলে কান মলে দেবো, আকাট মুক্খুটাকে সিধে করে দেবো।" - তখনকার দিনে 'কান মলে দেবো' বলাটাই যেন অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়া কথা বলিবার ধারা ছিল।

নরেন্দ্রনাথ পরে এক দিন দক্ষিণেশ্বরে পরমহংস মশাই-এর কাছে গিয়াছিল। নরেন্দ্রনাথকে দেখিয়া পরমহংস মশাই জোড়হাত করিয়া অনেক স্তবস্তুতি করিয়াছিলেন। আর এক দিন নাকি, পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথকে স্পর্শ করিতেই সে অর্ধজ্ঞানশূন্য হইয়া যাইয়া বলিয়াছিল, "তুমি আমায় কি করলে, আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমার যে বাপ-মা আছে! আমি যে উকিল হবো!" - ইহা আমার শুনা-কথা, আমি সে সময়ে উপস্থিত ছিলাম না, এইজন্য ঠিকভাবে বলিতে পারিতেছি না। আমি এ বিষয়ে স্বামী সারদানন্দের কাছে শুনিয়াছিলাম; রামদাদার কাছেও কিছু কিছু শুনিয়াছিলাম।

পূর্বে, মাত্র রামদাদা দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতেন, কিন্তু এখন পাড়ার সুরেশ মিত্তির ও নরেন্দ্রনাথও দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতে লাগিলেন। রামদাদা এখন একটু জোর পাইলেন যে, পাড়ার কেহ আর বিদ্রূপ ও আপত্তি করিবে না। শিমলার সুরেশ মিত্তির ও নরেন্দ্রনাথ পরমহংস মশাই-এর অনুরক্ত হইলে, শিমলার লোকের মনের ভাব অনেক বদলাইল; কারণ, এই দুই ব্যক্তিই ছিলেন শিমলার যুবকদের সর্দার। এইজন্য, রামদাদা এই ভাবিয়া মহা আনন্দিত হইলেন যে, তাঁহার কার্য সফল হইয়াছে।


1. রাণী রাসমণি।

2. শ্রীযুত সুরেন্দ্রনাথ মিত্র ইঁহার নাম, পাড়ার লোকে 'সুরেশ মিত্তির' বলিয়া ডাকিতেন। শুনা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণদেবও ইঁহাকে আদর করিয়া 'সুরেশ' বলিয়া ডাকিতেন।

3. ডাক্তার স্যার কৈলাসচন্দ্র বসু।

4. শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র দত্তের যুবক-ভৃত্য; উত্তরকালে স্বামী অদ্ভুতানন্দ।

Saturday, June 16, 2018

রামদাদার বাড়িতে

রামদাদাদের পূর্বকার বাড়ি ছিল কলিকাতার পূর্ব প্রান্তে, নারিকেলডাঙ্গায়। এই বাড়ি নষ্ট হইয়া যায়। রামদাদা শিমলায় বাড়ি তৈয়ার করিয়াছিলেন। বাড়ির ঠিকানা ছিল - এগারো নম্বর মধু রায় লেন। এই লেন বা গলিটি ছোট; পূর্ব-পশ্চিম বরাবর। এই বাড়িতেই পরমহংস মশাই সর্বদা আসিতেন। বাড়িটি গলির দক্ষিণ দিকে। বাড়িটির সদর দরজা ছিল উত্তরমুখো। দক্ষিণমুখো হইয়া সদর দরজায় ঢুকিতে, ডান দিক হইতে পশ্চিম দিকের দেওয়াল পর্যন্ত, বাহিরে একটি সরু ও লম্বা রক ছিল। দরজায় ঢুকিয়া সম্মুখে, একটা পথ বা দালান বা একটা বড় ঘরের মাপের মতো জায়গা; এবং ডান ধারে, অর্থাৎ, পশ্চিম দিকে, তিনটি দরজাওয়ালা একটি বৈঠকখানা। এই ঘরটির উত্তর দিকে, অর্থাৎ রাস্তার দিকে, লোহার গরাদেওয়ালা দুইটি জানালা; এবং দক্ষিণ দিকে, গরাদেওয়ালা অনুরূপ দুইটি জানালা ছিল। পশ্চিম দিকের দেওয়ালের মাঝখানে সার্শিদেওয়া তাক; এবং তাহার দুই পাশে দুইটি খালি ফোকর, অর্থাৎ তাহাতে তাক ছিল না। সদর দরজার সম্মুখের পথটি বা দালানটি দিয়া দক্ষিণ দিকে বা ভিতর দিকে যাইলে, ছোট একটি দালান। দালানটি হইল পূর্ব-পশ্চিমমুখো বা বরাবর। দালানের দক্ষিণ দিকে, ছোট একটুখানি উঠান। উঠানটির বাঁ-দিকে বা পূর্ব দিকে, দুইটি থামওয়ালা একটুখানি দালান; এবং ঠিক দক্ষিণ দিকে, একটি লম্বা ঘর। উঠানের ডান দিকে বা পশ্চিম দিকের দেওয়ালের কাছে, উপরে উঠিবার সিঁড়ি। সিঁড়িটিতে দক্ষিণমুখো হইয়া উঠিতে হইত। সিঁড়ি দিয়া উঠিতে বাঁ-দিকে বা মাঝের চাতালের দক্ষিণ দিকে একটি কুঠরি বা ছোট ঘর। এই ঘরটিতে শিবানন্দ স্বামী কিছুকাল তপস্যা করিয়াছিলেন। তাহার পর, সিঁড়িটি ধরিয়া ঘুরিয়া গিয়া দোতলায় উত্তরমুখো হইয়া উঠিলে, প্রথমে, সম্মুখে একটি কল-ঘর; এবং পূর্ব দিকে মুখ করিলে, একটি লম্বা দালান। দালানটির উত্তর দিকে, নীচুকার বৈঠকখানা ও সদর দরজার দালানের রুজু, দুইটি ঘর। বাড়ির উপরে, দোতালায়, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে, আরো দুইটি ঘর ছিল; এবং নীচুকার পূর্ব দিকের বর্ণিত ছোট দালানের উপরেও আর একটি ঘর ছিল। দোতালার সিঁড়িটি আবার ঘুরিয়া গিয়া তেতলার ছাদে উঠিয়াছে। এই হইল রামদাদার বাড়ির মোটামুটি বর্ণনা। ইহা হইল ১৮৮২ বা ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের কথা।

বোধ হয়, এই বৎসরেরই গরমিকালে, বৈকালবেলায়, পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে আসিলেন। দিনটি শনিবার কি রবিবার হইবে। আমি সন্ধ্যার সময় যাইলাম। যাইয়া বৈঠকখানার তৃতীয় দরজাটির সম্মুখে, অর্থাৎ দক্ষিণ দেওয়ালের নিকট যে দরজাটি তাহার সম্মুখে বসিলাম। ঘরটিতে প্রায় পনেরো হইতে বিশ জন লোক বসিয়াছিল, এবং বাহিরে দালানটিতেও প্রায় ততগুলি লোক ছিল। বোধ হয় মোট লোকসংখ্যা চল্লিশ হইতে পঞ্চাশ হইবে। পূর্বেই বলিয়াছি, তখনকার দিনে প্রণাম করিবার প্রথা উঠিয়া গিয়াছিল। এইজন্য তখনকার রীতি অনুযায়ী প্রণাম না করিয়া দরজার নিকটে চুপ করিয়া বসিলাম; কেহ প্রণাম করিত না, আমিও করিলাম না। দাদা পূর্বেই আসিয়াছিল; বৈঠকখানাতে তিনখানি তক্তাপোশ পাতা ছিল, তাহার উপর শতরঞ্জি ও জাজিম বিছানো এবং কয়েকটি তাকিয়া ছিল। তামাকের কোন বন্দোবস্ত ছিল না; কারণ রামদাদার হাঁপানি ব্যামো থাকায় তামাকের ধোঁয়াতে হাঁপানি বাড়িত। ঘরটির কড়ি-কাঠ হইতে, কাঁচের বাটির মতো দেখিতে, দুইটি গ্যাসের বাতি জ্বলিতেছে। পরমহংস মশাই পশ্চিম দিকের আলমারির বা সার্শি-দেওয়া তাকের কাছে বসিয়া আছেন, পিছনে একটি তাকিয়া। দেবেন মজুমদার মশাই1 তৃতীয় দরজার মাঝখানটিতে বসিয়াছেন; তাঁহার পরনের কাপড়খানি বেশ ফরসা ও কোঁচানো; হাঁটুর উপর কাপড়খানি রাখিয়াছেন; আর কোঁচানো উড়ুনিখানিও দু-ভাঁজ করিয়া দুই হাঁটুর উপর রাখিয়াছেন; গায়ে পিরান নাই, গলায় পইতা। দেবেন মজুমদার মশাই বরাবর আমাদের বাড়িতে আসিতেন, এইজন্য বহুকাল হইতে তিনি আমাদের পরিচিত ছিলেন। পাড়ার বৃদ্ধ কালীপদ সরকার মশাই-ও ঘরে বসিয়াছিলেন। বাকি আর সকলে অন্য জায়গার লোক ছিলেন, তাঁহাদের চিনিতাম না। সুরেশ মিত্তির প্রণাম করিয়া অস্থির হইয়া পায়চারি করিতেছেন, যেন ভাবে ও আনন্দে স্থির হইয়া বসিবার সামর্থ্যও নাই। রামদাদা এদিক-সেদিক করিতেছেন। গরমিকাল; ঘরটির ভিতরে গরম ছিল, এইজন্য দাদা রাস্তার ধারের রকটিতে বসিল। রাখাল লাজুক ছিল, সে ঘরের ভিতর না ঢুকিয়া এদিক-ওদিক কোথায় রহিল। রামদাদার মাসতুতো ভাই, মনোমোহনদাদা (রাখালের নিজ শ্যালক) ঘরের ভিতর চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন।

আমার প্রথম এইরূপ মনে হইল - দক্ষিণেশ্বর থেকে এই যে লোকটি এসেছে, একেই কি বলে 'পরমহংস'? দেখিলাম লোকটির চেহারাতে কোন বৈশিষ্ট্য নাই, চেহারা সাধারণ পাড়াগেঁয়ে লোকের মতো; বর্ণ খুব কালো নয়, তবে, কলিকাতার সাধারণ লোকের বর্ণ হইতে কিছু মলিন। গালে একটু একটু দাড়ি আছে, কপচানো দাড়ি। চোখ দুটি ছোট - যাহাকে বলে, 'হাতি চোখ'। চোখের পাতা অনবরত মিটমিট করিতেছে, যেন অধিক পরিমাণে চোখ নড়িতেছে। ঠোঁট দুটি পাতলা নয়। নীচুকার ঠোঁট একটু পুরু। ঠোঁট দুটির মধ্য হইতে, উপরকার দাঁতের সারির মাঝের কয়েকটি দাঁত একটু বাহির হইয়া রহিয়াছে। গায়ে জামা ছিল; তাহার আস্তিনটা কনুই ও কব্জির মাঝ বরাবর আসিয়াছে। খানিকক্ষণ পরে, জামা খুলিয়া পাশে রাখিয়া দিল এবং কোঁচার কাপড়টি লম্বা করিয়া বাঁ কাঁধে দিল। ঘরটি বেশ গরম হইয়াছিল। একজন লোক বড় এড়ানী পাখা অর্থাৎ বড় পাখা লইয়া পিছন দিক হইতে বাতাস করিতে লাগিল। কথাবার্তার ভাষা কলিকাতার শিক্ষিত সমাজের ভাষার মতো নয়, অতি গ্রাম্য ভাষা, এমন কি, কলিকাতা শহরের রুচিবিগর্হিত। কথাগুলি একটু তোতলার মতো। রাঢ়দেশীয় লোকের মতো উচ্চারণ; ন এর জায়গায় ল উচ্চারণ করিতেছে, যেমন, 'লরেনকে বললুম', ইত্যাদি। সম্মুখে একটি রঙিন বটুয়া রহিয়াছে, তাহার মধ্যে কি মশলা আছে; মাঝে মাঝে একটু মশলা লইয়া মুখে দিতেছে।

আমাদের বয়স তখন অল্প এবং আমরা শিক্ষিত সমাজে পরিবর্ধিত; এইজন্য, ভাষা ও উচ্চারণ শুনিয়া পরমহংস মশাই-এর প্রতি মনে একটি অবজ্ঞার ভাব আসিল - এই লোকটাকে রামদাদা কেন এত সম্মান ও শ্রদ্ধা-ভক্তি করেন? চুপ করিয়া বসিয়া সব দেখিতে লাগিলাম। মনে মনে আবার ভাবিতে লাগিলাম - কেন রামদাদা এই লোকটাকে এত সম্মান করেন; দুর্ধর্ষ সুরেশ মিত্তির এবং বুদ্ধিমান নরেন্দ্রনাথই বা কেন কয়েক বার এর কাছে গেছেন? লোকটার কি ব্যাপার? - দেখিলাম, ঘরে অনেকে বসিয়া আছেন, কিন্তু দুই-একটি বৃদ্ধ একটি বা দুইটি প্রশ্ন করিলেন মাত্র; আর কেহ কিছু কথা কহিলেন না। লোকটি আপনি কথা কহিতেছে ও মাঝে মাঝে শ্যামা-বিষয়ক গান গাহিতেছে; কখনো বা বৈষ্ণবদিগের গানও গাহিতেছে। সকল লোক নীরব হইয়া রহিয়াছে। আর একটি বিষয় দেখিলাম যে সাধারণতঃ, কথকতা শুনিতে যাইলে মনে অন্য এক প্রকার ভাবের উদয় হয় - একটু হাসি-কৌতুকের ভাব থাকে; সাধারণ-সমাজে যাইলে মনটা উসখুস করে এবং একটু গান শুনিবার ইচ্ছা থাকে বা কখন চলিয়া আসিব - এই ভাবনা হয়; ঠিক মন বসে না, যেন আধা-বৈঠকখানা ও আধা-ঠাকুরবাড়ি ভাব। কিন্তু এখানে প্রথম দেখিলাম যে, সেরূপ ভাব আসিল না; অন্য প্রকার একটি ভাব আসিতে লাগিল, ত্রাসও নয়, উদ্বেগও নয়; কিন্তু ইচ্ছা হইল চুপ করিয়া বসিয়া থাকি। কেহই কোনো কথা কহিতেছে না; লোকটি যখন নিজে ইচ্ছা করিয়া কথা কহিতেছে তখনই কথা হইতেছে মাত্র। গ্যাসের বাতি দুটির সোঁ-সোঁ করিয়া আওয়াজ হইতেছে। ঘর একেবারে নিস্তব্ধ, যেন ঘরে একেবারে মানুষ নাই।

খুব স্থির হইয়া দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম লোকটি পাড়াগেঁয়ে অশিক্ষিত; মাঝে মাঝে অসভ্য ভাষায় কথা কহিতেছে। কিন্তু লোকটি পাগলও নয়, যে নিতান্ত এলোমেলো ভাব। আফিমখোরের ভাবও নয় যে নিঝুম হইয়া আছে। পাগল হইলে এলোমেলো ভাব হয়, বড় হাত-পা নাড়ে, মাথা নাড়ে; এ লোক সেরূপ নয়। আবার যে বালকের ভাব, সে রকমও তো নয়; কারণ ছোট ছেলেদের ভিতর নিরবচ্ছিন্নতার, অর্থাৎ Continuance-এর ভাবটি থাকে না। আবার যে সাধারণ লোক, তাহাও তো দেখিতেছি না। তীক্ষ্ণবুদ্ধি-সম্পন্ন যে লোক - নানা বিষয়ে বেশ পরামর্শ দিতে পারে, তাহাও তো দেখিতেছি না। তর্ক, যুক্তি ও নানা রকম দার্শনিক মত, যাহা আমরা সর্বদা শুনিতাম, এ ব্যক্তি তো সেরকম কিছু কথা বলিতেছে না। দেখিলাম লোকটি হড়বড় করিয়াও কথা বলিতেছে না বা যাহাকে বলে 'প্রগল্ভ', তাহাও তো নয়! কলিকাতায় যেমন বক্তৃতা শুনিতাম, বক্তা অনর্গল কথা বলিয়া যাইতেছে, এ লোকটি তো তেমনও কিছু বলিতেছে না। পণ্ডিতগিরি ফলানো বা গুরুগিরি করাও তো নাই। - লোকটি যেন তাহার মনটিকে উচ্চ স্তর হইতে নামাইয়া আনিয়া কথা কহিতেছে; আর না হইলে এক দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিয়াছে। কেহই তাহার সহিত তর্ক-যুক্তি করিতেছে না। কেহই প্রশ্ন করিতেছে না, বা করিবারও কাহারো ইচ্ছা নাই। লোকটি যা বলিতেছে, তাহাই সকলে স্থির হইয়া শুনিতেছে। সকলেই তাহার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে যে, সে কখন কি বলিবে।

আর একটি বিষয় দেখিলাম যে, শ্যামা-বিষয়ক বা বৈষ্ণবদিগের গান তো চলিত গান, এ সকল বহুবার শুনিয়াছি, নূতনত্ব কিছুই নাই; কিন্তু এই লোকটি যখন, মাঝে মাঝে, সেই সকল চলিত গানই গাহিতেছে, তখন মনে অন্য এক প্রকার ভাব আসিতেছে, সে যেন অন্য এক ভাবে গানটিকে দেখাইতেছে। মাঝে মাঝে, সে যেন স্থির হইয়া যাইতেছে; আবার, যেন গলা শুকাইয়া যাইতেছে বলিয়া, বটুয়া হইতে একটু একটু মশলা লইয়া মুখে দিতেছে। কথাবার্তা যাহা বলিতেছে, তাহা মনে রাখা যাইতেছে না। কিন্তু কথাগুলি যে ঠিক, সত্য - এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই হইতেছে না। তর্ক করিবার ইচ্ছা হইতেছে না, কথাগুলি যে নিশ্চিত ও নির্দ্বন্দ্ব - এই ভাবটি যেন ভিতরে আসিতেছে। শব্দ ও ভাব এত তাড়াতাড়ি আসিতেছে যে, কথাগুলি মনে রাখিবার সুবিধা হইতেছে না এবং সময়ও পাওয়া যাইতেছে না। কথাগুলি শুনিবার বিষয়; কিন্তু তাহার অর্থ জানি না, তাৎপর্যও কিছু বুঝি না।

সকলেই যেন এক প্রকার ভাবে অভিভূত হইয়া পড়িল। বেশ একটু ঘোরপানা আচ্ছন্ন ভাব আসিতে লাগিল। অন্য কোনো বিষয়: ক্ষুধা পাইয়াছে; তৃষ্ণা পাইয়াছে, জলপান করিব; বা অধিক রাত্রি হইয়াছে, বাড়ি ফিরিয়া যাইব - এ সকল কোনো চিন্তাই মনে আসিতেছিল না। সকলে স্থির ও নিঝুম হইয়া বসিয়া রহিল। খানিকক্ষণ পরে দেখি যে, লোকটি কথা কহিতে কহিতে স্থির হইয়া গেল। ডান হাতের মাঝের আঙুল তিনটি বাঁকিয়া গেল। হাত দুটি সিধা ও শক্ত হইয়া গেল। মিরগি হওয়া আমরা ঢের দেখিয়াছি, কিন্তু এ তো তা নয়। আমরা সকলে তাহার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলাম। মিরগি হইলে, মুখে চোখে জল দিতে হয়, বাতাস করিতে হয়; একে তো সেরূপ করিতে হইতেছে না। এই নূতন ব্যাপার দেখিয়া আমরা কিছুই বুঝিতে পারিতেছিলাম না। এই মাত্র বিশেষভাবে বুঝিলাম যে, মনটাকে উপর হইতে নামাইয়া আনিয়া লোকটি কথা কহিতেছে, এবং আমাদের মনকে যেন আঠা দিয়া জুড়িয়া উপর দিকে লইয়া যাইতেছে। দেখিলাম যে, লোকটির প্রতি একটা টান আসিল। এ টান - ভালবাসা বা স্নেহ-মমতা নয়। কারণ, এগুলি নিম্ন স্তরের লোকের প্রতি হয়। শ্রদ্ধা-ভক্তিও নয়; তাহা হইলে উচ্চ-নীচ জ্ঞান থাকে ও ভয় থাকে। এ টান ভিতরের; লোকটির কাছে থাকিতেই ভাল লাগিতেছে।

আমাদের বাড়ি তখন বড়মানুষের বাড়ি, পাড়ার সকল লোকের বসিবার জায়গা। এইজন্য, আমরা বহু প্রকার লোক দেখিতে পাইতাম; বহু প্রকার লোকের সঙ্গে আমরা মিশিতাম। কিন্তু দেখিলাম যে, এই লোকটিকে কোনো বিশেষ থাকের বা শ্রেণীর ভিতর ফেলা যাইতেছে না। সকল শ্রেণীর হইতে পৃথক, অথচ যেন কিছু সম্পর্ক আছে। আমাদের তখন বয়স অল্প; এইজন্য, প্রথমটায় সব গোল হইয়া গিয়াছিল।

আমরা যখন ছাদে খাইতে যাইলাম, তখন দেখিলাম যে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ সকলেই একসঙ্গে বসিয়া খাইতেছে; অন্য পাড়ার দু-পাঁচ জন লোকও তাহার ভিতর আছেন। অবশ্য, নিরামিষ রান্না - লুচি-তরকারি ইত্যাদি হইয়াছিল। তখনকার দিনে সকল জাতের সঙ্গে একত্র খাওয়ার প্রথা ছিল না। তখন বাড়িতে যাইয়া নিমন্ত্রণ করিয়া আসিবার প্রথা ছিল; কিন্তু দেখিলাম যে, এখানে সকলে অ-নিমন্ত্রিতভাবে খাইতেছেন। 'ইয়ার' লইয়া হাসি-তামাসা করিয়া যে খাওয়া, তাহা নয়। যজ্ঞিবাড়ির যে খাওয়া, তাহাও নয়। যজ্ঞিবাড়িতে খাইলে অনেক সময় একটা বেগারঠেলার খাওয়ার ভাব থাকে। যজ্ঞিবাড়ির বেগারঠেলার খাওয়াতে ও এ খাওয়াতে অনেক তফাৎ বোধ হইল। এখানে যেন সকলেই শ্রদ্ধা-ভক্তি করিয়া খাইতেছেন, কেহই অবজ্ঞার ভাবে খাইতেছেন না। যে সকল লোক একসঙ্গে খাইতেছিলেন, তাঁহাদের পরস্পরের ভিতর একটি টান দেখা গেল; যেন নিজের লোক বলিয়া একটি ভাব আসিল।

আহারাদি করিয়া আমরা সকলে নীচে নামিয়া আসিলাম। পরমহংস মশাই, রাত্রি আন্দাজ এগারোটার সময়, গাড়ি করিয়া চলিয়া গেলেন। আমরাও চলিয়া আসিলাম। দেখিলাম, প্রায় তিন দিন কি রকম একটি ঘোর ঘোর নেশা রহিল। যেমন সকলে সাধারণ কাজ করিয়া থাকে, তাহাও করিতেছি, কিন্তু মনটা যেন পৃথক হইয়া রহিয়াছে, সব জিনিসের সহিত মাখামাখি হইয়া থাকিতেছে না, মনটা যেন সব জিনিস হইতে তফাৎ থাকিতেছে, বেশি মেশামেশি করিতে চাহিতেছে না। পরমহংস মশাই চলিয়া গেলেন, কিন্তু তাঁহার প্রতি ভিতর হইতে একটি টান রহিয়া গেল; সেটা যে অন্য প্রকারের জিনিস, তাহা আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম। এই হইল প্রথম দিনকার দর্শনের কথা।


1. শ্রীযুত দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার।

Tuesday, June 12, 2018

লোকের মনোভাব পরিবর্তন

পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে এইরূপ বারকতক আসা-যাওয়া করাতে, পাড়ার লোকের তাঁহার প্রতি আর বিদ্বেষভাব কিছু রহিল না, কেহ উপহাসও করিত না। সকলেই তাঁহাকে একটু শ্রদ্ধার চোখে দেখিতে লাগিল। এখন হইতে জনসমাগমও কিছু অধিক হইতে লাগিল। তবে একটি বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় ছিল এই যে, এই ব্যাপারে কাহাকেও গিয়া নিমন্ত্রণ করা হইত না। সামাজিক কোনো কার্যে যেমন বাড়িতে গিয়া নিমন্ত্রণ করিতে হইত, তেমন করিতে হইত না। কেবল এই কথা বলিলেই হইত যে, অমুক দিন পরমহংস মশাই রামডাক্তারের বাড়িতে আসিবেন; তাহা হইলেই যাঁহারা পরমহংস মশাইকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতেন, তাঁহারা সকলেই সন্ধ্যার সময় সেখানে যাইতেন। ক্রমে, চল্লিশ-পঞ্চাশ জন লোক হইতে এক শত বা দেড় শত লোক হইতে লাগিল।

এই সময় পাড়ার মহেন্দ্র গোসাঁই পরমহংস মশাই-এর সহিত এক দিন দেখা করিতে আসিলেন। তিনি পাড়ার প্রধান লোক ও গোস্বামী; এইজন্য, বৈঠকখানার দক্ষিণ দিকের জানালা দুইটির মাঝখানে, পরমহংস মশাই-এর ডান ধারে, একখানি আসন পাতিয়া তাঁহার বসিবার স্থান করিয়া দেওয়া হইল। পাড়ার মহেন্দ্র গোসাঁই আসিলেন, কিন্তু, কোনো ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ আসিতেন না; ইহা আমি বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিয়াছিলাম। পরমহংস মশাই ছিলেন মাড়েদের ঠাকুরবাড়ির পূজারী - মাহিষ্যদের পূজারী, তাহার উপর গলায় পইতা ছিল না; এইজন্য ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণেরা তাঁহাকে প্রণাম করিতে রাজী ছিলেন না, আর এই কারণেই, ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণেরা তাঁহার কাছে আসিতেন না। দক্ষিণেশ্বর ব্রাহ্মণপ্রধান গ্রাম। সেখানকার ব্রাহ্মণেরাও পরমহংস মশাইকে সেরূপ শ্রদ্ধার চোখে দেখিতেন না। কেবল যোগেন চৌধুরী1 একাই পরমহংস মশাই-এর নিকট আসিতেন। তখনকার দিনে জাত লইয়া এক ফেসাদ ছিল।


1. শ্রীযুত যোগীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী, উত্তরকালে স্বামী যোগানন্দ।

Monday, June 11, 2018

বৈঠকখানায় বসিবার ব্যবস্থা

প্রথমে পরমহংস মশাই সাধারণ লোকের মতো তক্তাপোশের উপর জাজিমে বসিতেন; কিন্তু তিনি কয়েক বার আসিবার পর তাঁহার বসিবার জন্য একখানি বিলাতী গালিচা হইল একটি তাকিয়াও হইল। এই গালিচাখানিতে শুধু তিনিই বসিতেন, অপর কেহ বসিত না; তাকিয়াটিও অপর কেহ ব্যবহার করিত না। তিনি আসিয়া চলিয়া যাইলে এগুলি আলাদা করিয়া তুলিয়া রাখা হইত। একটি কাঁচের গেলাসও হইল; সেইটিতে জল দিয়া তাঁহার ডান হাতের কাছে বটুয়ার নিকট রাখা হইত। গরমিকাল এইজন্য পিছন হইতে একখানি এড়ানী পাখা দিয়া পরমহংস মশাইকে বাতাস করা হইত। ঘরের ভিতর যে যাহার নিজ নিজ স্থানে আসিয়া বসিতেন। লোকসংখ্যা অধিক হওয়ায় কেহ ঘরের সম্মুখে দালানে বেঞ্চি পাতিয়া কেহ বা রাস্তার ধারে রকটিতে অথবা রাস্তায় বেঞ্চি পাতিয়া বসিতেন; কারণ সকলের বসিবার জায়গা ঘরটির ভিতর হইত না।

ক্রমে ক্রমে স্ত্রীলোকেরাও পরমহংস মশাইকে দেখিতে আসিতে লাগিলেন। আমার মা-ও যাইতেন। বৈঠকখানার দক্ষিণ দিকে যে ছোট দালানটি ছিল সেইখানে মেয়েরা বসিতেন। মেয়েদের সংখ্যা তিরিশ চল্লিশ হইত; মেয়েরা যেদিকে বসিতেন, সেদিকে আলো দেওয়া হইত না। মাঝখানকার জানালা দুটির কবাট খোলা থাকিত, এবং পরমহংস মশাই-এর বসিবার জায়গা একটু জানালার দিক অর্থাৎ দক্ষিণ-পশ্চিম দিক করিয়া হইত। এইরূপ ব্যবস্থায়, স্ত্রীলোকেরা পরমহংস মশাইকে দেখিতে পাইতেন ও তাঁহার সকল কথা শুনিতে পাইতেন; কিন্তু সেখানে আলো না দেওয়ায়, ঘরের ভিতর হইতে কেহ মেয়েদের দেখিতে পাইত না। এই ছিল বসিবার বন্দোবস্ত। চিক বা পর্দা দিবার আবশ্যক হইত না।

রামদাদার অসুখের জন্য তামাকের কোনো বন্দোবস্ত ছিল না, তাহা পূর্বে বলিয়াছি। তামাক খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকার আরো একটি কারণ ছিল, পরমহংস মশাই-এর সম্মুখে কেহ তামাক খাইত না। পান দেওয়ারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না; কারণ এখন যেমন বাড়িতে অভ্যাগত আসিলে পান দেওয়া হয়, তখন তেমন পান দেওয়ার রীতিই ছিল না।

Saturday, June 9, 2018

কীর্তনগায়ক যুবক

পরমহংস মশাই কিছু দিন আসিতে থাকিলে পর, রামদাদা একটি কীর্তনগায়ক ছেলেকে ভাড়া করিয়া লইয়া আসিলেন। ছেলেটির বয়স আঠারো কি উনিশ বৎসর হইবে। বাহিরের কোনো গ্রামের ছেলে, কলিকাতার নয়। ছেলেটি কোমরে চাদর বাঁধিয়া হাত নাড়িয়া নাড়িয়া কি এক দূতীসংবাদ গাহিল। আমরা কলিকাতার লোক; এ রকম গান করিলে ঠাট্টা করিতাম ও ঘৃণা করিতাম। আমাদের এ সব গান ভাল লাগিত না। আর জোয়ান বেটাছেলে হইয়া মেয়েলি ঢঙে হাত নাড়া, আমরা কলিকাতার লোক হইয়া বড় দূষণীয় মনে করিতাম। আমার মনে হইল - এ ছোঁড়া পড়াশুনা করে না, কেবল মেয়েদের মতো হাত নেড়ে গান করে। এইজন্য আমি তাহার উপর বিরক্ত হইলাম, কারণ কলিকাতায় তখন জিম্ন্যাস্টিক করা ও কুস্তি করাই ছিল প্রথা। জোয়ান ছেলের মেয়েলি ঢঙে হাত নাড়া ও সখী-সংবাদ গান করা অতি হাস্যকর বলিয়া মনে হইল; কিন্তু দেখিলাম কেহ কিছু বলিল না। অনেকক্ষণ কীর্তন হইবার পর পরমহংস মশাই উপরে আহার করিতে যাইলেন, এবং কিছু পরে আমরাও ছাদের উপর আহার করিতে যাইলাম।

আহার করিয়া আমরা নীচে নামিয়া আসিলে অনেকেই তখন চলিয়া যাইতে লাগিলেন। পরমহংস মশাই-এর গাড়ি আসিতে দেরি ছিল, এইজন্য বাহিরের ঘরটিতে বসিয়া তিনি সেই কীর্তনগায়ক ছেলেটিকে, কি করিয়া হাত নাড়িতে হয়, কোমর বাঁকাইয়া দাঁড়াইতে হয়, প্রভৃতি শিখাইতেছিলেন। ছেলেটিও দু-চার বার কস্ত করিয়া তাহা অভ্যাস করিতে লাগিল। আমি দরজার কাছে তক্তাপোশে বসিয়া এ সকল দেখিতেছিলাম ও মনে মনে হাসিতেছিলাম।

সেই কীর্তনগায়ক ছেলেটির নাম জানি না, এবং তাহাকে আর কখনো দেখিয়াছি কিনা তাহাও স্মরণ নাই।

ভাগবত-আলোচনা

পাড়ার মহেন্দ্র গোসাঁই, মাঝে মাঝে, পরমহংস মশাই-এর সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেন। মহেন্দ্র গোসাঁই-এর সহিত তাঁহার ভাগবত ও ভক্তি বিষয়ে নানারূপ আলোচনা হইত। মহেন্দ্র গোসাঁই তাঁহার কথাবার্তায় পরম আনন্দ অনুভব করিতেন। এক দিনকার কথা আমার একটু মাত্র মনে আছে। যেন এই ভাবের একটি কথা উঠিল - ভক্তি বড়, কি মুক্তি বড়? পরমহংস মশাই বলিলেন, "মুক্তি দিতে নারাজ নই, ভক্তি দিতে নারি।" তবে, সে সময় কথাবার্তা বিশেষ কিছু বুঝিতে পারি নাই। এইজন্য, স্পষ্টভাবে কিছু মনে নাই।

দেখিলাম, ভক্তির কথা উঠিলে পরমহংস মশাই পুরামাত্রায় বৈষ্ণব ভক্ত হইতেন, আবার যখন শ্যামা-বিষয়ক গান করিতেন তখন ঠিক সেই ভাবে তন্ময় হইয়া যাইতেন।

আহারের সময়

পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে আসিবেন জানিতে পারিলেই আমি সেখানে গিয়া উপস্থিত হইতাম। এক দিন, শনিবার সন্ধ্যার সময় পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে আসিয়াছিলেন। আমি কাপড়-চোপড় পরিয়া রামদাদার বাড়িতে যাইলাম। সকাল হইতে আমার খুব আমাশা হইয়াছিল সেইজন্য কিছুই খাই নাই; সাগু-বার্লিও নয়। ছাদে খাইতে যাইলাম, তখনো পেটে বড় যন্ত্রণা হইতেছিল। একখানি মাত্র পটল-ভাজা দিয়া গরম লুচি আকণ্ঠ খাইলাম, জল খাই নাই। কিন্তু তাহাতেই আমার আমাশা ভাল হইয়া গেল। পরে এক সময় বলরামবাবুকে1 এই কথা বলায়, তিনি বলিয়াছিলেন, "এই ঠিক ওষুধ, গরম লুচি হ'চ্ছে আমাশার ওষুধ। তুমি অজান্তে ঠিক ওষুধ খেয়েছিলে।"

আহার করিবার সময় পরমহংস মশাই উপরে যাইতেন। নীচের সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া, দোতলায় পূর্ব-পশ্চিমমুখো যে দালানটি ছিল, সেখানে তাঁহার জন্য একটি আসন পাতা হইত। তিনি একলা বসিয়া আহার করিতেন, পঙ্ক্তির ভিতর বসিতেন না। সাদা পাথরের থালা ও গেলাসে তিনি কিছু আহার করিতেন। এই থালা ও গেলাস ইত্যাদি অপর কেহ ব্যবহার করিত না। সাধারণ লোক তেতলার ছাদে আহার করিত। দালানটি দিয়া তেতলায় যাইবার সিঁড়ি। ঠাঁই ও পরিবেশন করিবার জন্য লোকে এই দালান দিয়া উপরে যাতায়াত করিত। আহারের সময় ছাদের প্রায় সবটা ভরিয়া যাইত - আন্দাজ শ-দেড়েক লোক ছাদে একবারে বসিতে পারিত।

এক দিন দেখিলাম যে, পরমহংস মশাই দালানের মাঝখানটিতে বসিয়া আহার করিতেছেন, আর ভিন্ন ভিন্ন বাড়ির মেয়েরা আসিয়া তাঁহার বাঁ-দিকে ও সম্মুখে বসিয়া আছেন; কাহারো মাথায় ঘোমটা নাই; সকলের মুখ খোলা। তখনকার দিনে মুখের ঘোমটা খুলিয়া কোনো স্ত্রীলোকই পুরুষমানুষের সম্মুখে যাইতেন না। স্ত্রীলোকেরা সর্বদাই ঘোমটা দিয়া থাকিতেন। কিন্তু, আমি বিস্মিত হইয়া দেখিতে লাগিলাম যে, ভিন্ন বাড়ির ভিন্ন বয়স্কা স্ত্রীলোকেরা পরমহংস মশাই-এর কাছে মুখের কাপড় খুলিয়া বসিয়া আছেন, কোনো দ্বিধা বা সংকোচ করিতেছেন না; এমন কি, যে সকল যুবা পুরুষ উপরে পরিবেশন করিতে যাইতেছে, তাহারাও মাঝে মাঝে, দু-এক মিনিট দাঁড়াইয়া, পরমহংস মশাইকে দেখিয়া যাইতেছে। স্ত্রীলোকদিগের ভিতর সব বয়সেরই মেয়ে ছিল, কিন্তু অপরিচিত পুরুষদের দেখিয়া কেহই দ্বিধা বা সংকোচ করিল না; পুরুষরাও স্ত্রীলোকদের দেখিয়া দ্বিধা বা সংকোচ করিল না। পরমহংস মশাই তখন হাঁটু দুটি উঁচু করিয়া আসনখানির উপর বসিয়া কি আহার করিতেছিলেন।

কী আশ্চর্য ভাব! কাহারো মনে দ্বিধা বা সংকোচ নাই, লজ্জা বা কোনো প্রকার দৈহিক ভাব একেবারেই নাই। সকলেই পরমহংস মশাই-এর মুখের দিকে চাহিয়া আছেন, দেহজ্ঞান একেবারেই নাই। কে বা স্ত্রী কে বা পুরুষ - এ সব চিন্তা কাহারো নাই, যেন অন্য এক রাজ্যে সকলে রহিয়াছেন। অথচ সকলেই পরস্পর অচেনা।

এক বার যীশু Mount of Olives বা জলপাই পাহাড়ে মার্থা ও মেরী নামে দুই ভগিনীর বাড়িতে গিয়াছিলেন। মার্থা যীশুর সেবার জন্য বড়ই ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন, কিন্তু মেরী যীশুর পায়ের কাছে বসিয়া বিভোর হইয়া তাঁহার কথাবার্তা শুনিতে লাগিলেন। মার্থা আসিয়া যীশুর কাছে অভিযোগ করিলেন, "আপনি কি দেখছেন না, মেরী আমায় কাজে একলা ফেলে এসেছে? ওকে আমায় একটু সাহায্য করতে বলুন!" যীশু মার্থার দিকে মুখ ফিরাইয়া উত্তর করিলেন, "মার্থা, মার্থা তুমি বহু বিষয়ে উদ্বিগ্ন, বহু বিষয়ে ব্যস্ত। একটি জিনিস দরকারী এবং মেরী তা পাবার জন্য মনস্থ করেছে, যা তার কাছ থেকে অপহৃত হবে না।" - অর্থাৎ মেরী যে যীশুর কথা নিবিষ্টমনে শুনিতেছিলেন, তাহা অনেক উচ্চ স্তরের বিষয়, আহারাদি অনেক নিম্ন স্তরের কার্য।

আমি জেরুসালেম-এ অবস্থানকালে জলপাই পাহাড়ের এই স্থানটিতে সর্বদাই যাইতাম। এখন গ্রামটির নাম হইয়াছে এল' অ্যাজারিএ বা লাজারিএ, অর্থাৎ, লাজারস-এর গ্রাম। মার্থা ও মেরীর ভাই-এর নাম ছিল লাজারস। এই গ্রামটির প্রাচীন নাম ছিল বেথানী।

গৌতম কৃচ্ছ্রসাধন ত্যাগ করিবার সঙ্কল্প করিয়া উরুবিল্বে বা বুদ্ধগয়ায় যখন এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ভিক্ষা গ্রহণ করিতে সম্মত হইলেন, তখন নন্দা আর বালা নামে ব্রাহ্মণের দুইটি কন্যকা, দুগ্ধ-মধু ইত্যাদি দিয়া কিছু আহার্য প্রস্তুত করিয়া আনিয়া সন্ন্যাসী গৌতমকে দিবার প্রয়াস পাইল। অনন্তর, সেবায় পরিতুষ্ট হইয়া গৌতম তাহাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। তাহাতে কন্যকা দুইটি এই আশীর্বাদ প্রার্থনা করিল, যেন শুদ্ধোদন রাজার পুত্র সিদ্ধার্থের সহিত তাহাদের বিবাহ হয় কারণ তাহারা শুনিয়াছিল যে, সিদ্ধার্থ অতি সুপুরুষ। গৌতম তাহাদের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, "ভগিনীদ্বয়, আমিই সেই শুদ্ধোদন রাজার পুত্র, সিদ্ধার্থ। আমি তো আর দারপরিগ্রহ করিব না।" কন্যকাদ্বয়, নন্দা ও বালা, তাহাতে কিছু অপ্রতিভ হইয়া মাথা হেঁট করিয়া রহিল। কিন্তু তাপস গৌতমের স্নিগ্ধ ও গম্ভীর ভাব দেখিয়া তাহাদের লজ্জা ও দ্বিধা বা সংকোচের ভাব চলিয়া যাইল। উভয়ে শান্তভাবে বলিল, "আপনি আশীর্বাদ করুন, আপনি সিদ্ধ হইলে যেন আমরা আপনার শিষ্যা হইতে পারি।"

দেখিয়াছি, পরমহংস মশাই-এর গা হইতে কি একটা আভা বাহির হইত, তাহাতে কাহারো দেহজ্ঞান বা অন্য কোনো ভাব থাকিত না; মন যেন দেহ ছাড়িয়া অপর কোন্ এক রাজ্যে চলিয়া যাইত, হাত-পা অজ্ঞাতসারে কাজ করিত মাত্র। যুবকেরা, পরিবেশন করিতে হয় সেইজন্যেই করিত, কিন্তু তাহাদের মনটা পরমহংস মশাই-এর কাছে পড়িয়া থাকিত। মেয়েদেরও ঠিক এই ভাবটি হইত। যাহাকে বলে - মুহূর্তের মধ্যে বিদেহ হইয়া যাওয়া, পরমহংস মশাই চকিতের ভিতর তাহা করিয়া দিতেন। এই ব্যাপারটি আমি ভাষা দিয়া বর্ণনা করিতে পারিলাম না। এ বিষয়ে চিন্তা করিলে কিছু মাত্র বুঝা যাইতে পারে। ইহা তর্ক-যুক্তির কথা নয়, গভীর ধ্যানের বিষয়। এইটি আমি বহুবার লক্ষ্য করিয়াছি।


1. শ্রীযুক্ত বলরাম বসু।

Tuesday, June 5, 2018

ছাপ মেরো না

যুবা শশী1 যখন রামদাদার বাড়িতে আসিতে লাগিল, বোধ হয় তখন সে 'সেকেন্ড ইয়ার ক্লাস' এ পড়ে। দেখিতে কৃশ, রং ফরসা। গালে কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো কিছু দাড়ি, লম্বা দাড়ি নয়। যুবা শশীকে দেখিতাম যে, নিবিষ্টমনে কান খাড়া করিয়া পরমহংস মশাই-এর পিছনে ডান দিকে বসিত। যদিও সে মনোযোগ দিয়া ঐ সকল কথা শুনিত তবুও সে কিছু লিখিয়া রাখে নাই।

পরমহংস মশাই-এর আসিবার কিছু দিন পরে, ***মশাইকে রামদাদার বাড়িতে আসিতে দেখিলাম। পরমহংস মশাই-এর বাঁ-হাতের পিছন দিকটায়, দেওয়ালের আলমারির কাছে তিনি চুপটি করিয়া বসিয়া থাকিতেন এবং একমনে পরমহংস মশাই কি বলিতেছেন, তাহাই শুনিতে চেষ্টা করিতেন। সুরেশ মিত্তির তাঁহাকে বলিতেন, "কি ***, নোট করবে নাকি?"

পরমহংস মশাইকে এরূপ সময় দু-এক বার বলিতে শুনিয়াছি, "এ সকল কথায় ছাপ মেরো না।" তবে, তিনি কাহার উদ্দেশ্যে এবং কী অর্থে এই কথা বলিতেন, তাহা বলিতে পারি না। হয়তো, ইহার অর্থ এই হইতে পারে যে, এ সকল উচ্চ অঙ্গের কথা, এ সকল কথাকে ভাষায় প্রকাশ করিলে, ইহার ভাব বিকৃত হইয়া যাইবে, কিম্বা হাট-বাজারে এই সকল কথা দিও না, কারণ সাধারণ লোকে এই সকল উচ্চ অঙ্গের কথা বুঝিতে পারিবে না। অপর অর্থ এই হইতে পারে যে, এই সকল কথা ছাপাইয়া পয়সা করিও না; কারণ ব্রহ্মবাণী বেচিয়া পয়সা করা এবং নিজের স্বার্থের জন্য তাহা ব্যবহার করা দূষণীয়। ব্রহ্মবাণী কখনো স্বার্থের জন্য ব্যবহার করিতে নাই, - অযাচিতভাবে ইহা পাইয়াছ অযাচিতভাবে ইহা বিতরণ করিবে - এই হইল সনাতন প্রথা।


1. শ্রীযুত শশীভূষণ চক্রবর্তী, পরে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ।

যুবা শশীর আক্ষেপ

পরমহংস মশাই-এর ডান হাতের কাছে যে জলের গেলাসটি থাকিত, সমাধি ভাঙিবার পর তাহা হইতে এক ঢোক জল খাইতেন। সমাধি ভাঙিলে, একটু জল খাইবার জন্য তিনি যখন হাত বাড়াইয়া দিতেন, তখন যুবা শশী সেই জলের গেলাসটি আগাইয়া দিত। এক দিন, ঘটনাক্রমে, সেই জলের গেলাসে তাহার পা ঠেকিয়া গিয়াছিল। জল বদলাইবার সময়ও ছিল না, অগত্যা সেই জলের গেলাসটিই পরমহংস মশাই-এর হাতে আগাইয়া দিতে হইল। পরমহংস মশাই সেই জলই পান করিলেন। যুবা শশীর মনে এই আক্ষেপ চিরকাল ছিল যে, সে জানিয়া শুনিয়া পরমহংস মশাইকে ঐ জল দিয়াছিল। যুবা শশী আক্ষেপ করিয়া অনেক সময় এ বিষয় উল্লেখ করিত। অবশ্য এইরূপ হইবার কারণ এই যে, ঐ জলের গেলাসটি তাহাকে চকিতের ভিতর আগাইয়া দিতে হইত, বোধ হয় এক সেকেন্ডের মধ্যে ঐ কাজ করিতে হইত।

কী সাজাবি আমায়

পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে আসিলে সুরেশ মিত্তির আনন্দে বিভোর হইয়া অনবরত পায়চারি করিতেন এবং সকল লোকের তত্ত্বাবধান করিতেন। তিনি ভাবে এত মাতোয়ারা হইয়া পড়িতেন যে, কখনো ঘরটির ভিতর বসিতে পারিতেন না।

গরমিকালে, এক দিন সুরেশ মিত্তির ফরমাশ দিয়া একটি অতি সুন্দর বেলফুলের গ'ড়ে মালা আনাইয়াছিলেন। মালাটি বেশ বড়; এত বড় যে, গলায় দিয়া দাঁড়াইলে মালাটি জাজিমের উপর পড়িয়া আরো খানিকটা বেশী থাকে। মালাটি নীচের দিকে কতকগুলি ফুল দিয়া একটি তোড়ার মতো করা - ফুলের থোব্না, আর মালার মাঝে মাঝে রঙিন ফুল ও জরি দেওয়া তবক। মালাটি যতদূর সম্ভব উৎকৃষ্ট। সুরেশ মিত্তির আনন্দে বড় অধীর হইয়া উঠিয়াছেন। তিনি একটি রূপার বাটিতে গোলাপজল ঢালিয়া বাঁ-হাতে লইয়াছেন, ডান হাতে একটি রূপার ঝাঁজরিওয়ালা পিচকারি, চোঙামুখো নয়। রূপার পিচকারিটি দুই আঙুল দিয়া ধরিবার জন্য দুটি আঙটা বা কড়া আছে, এবং পিচকারির ডাঁটিটি বুড়ো আঙুল দিয়া তুলিবার জন্যও একটি আঙটা বা কড়া আছে। সুরেশ মিত্তির পিচকারি দিয়া সকলের মাথায় গোলাপজল দিতেছেন। তাহার পর, ঐ মালাটি লইয়া পরমহংস মশাই-এর গলায় পরাইয়া দিয়া পায়ের কাছে প্রণাম করিলেন। পরমহংস মশাই দাঁড়াইয়া উঠিলেন। মালাটি তক্তাপোশের উপর জাজিমে ঠেকিয়া লুটাইতে লাগিল। পরমহংস মশাই-এর সমাধি-অবস্থা আসিতে লাগিল। কখনো বা তিনি ডান হাতের আঙুল দিয়া নিজের শরীরের দিকে দেখাইতে লাগিলেন, কখনো বা উপর দিকে নির্দেশ করিতে লাগিলেন, ও মৃদু মৃদু স্বরে এই গানটি গাহিতে শুরু করিলেন:

"আর কী সাজাবি আমায়
জগত-চন্দ্র-হার আমি পরেছি গলায় * *।"

গানটি গাহিয়া নানা প্রকার হাতের ভঙ্গী করিয়া উপরের দিকে দেখাইতে লাগিলেন। ঠিক যেন এই ভাবটি তখন প্রকাশ হইতে লাগিল - কি একটা ফুলের মালা গলায় পরাচ্ছ; আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র সব তো আমার গলায় হারের মতো রয়েছে। অর্থাৎ এই ক্ষুদ্র দেহটির ভিতর এক বিরাট পুরুষ রহিয়াছেন; চন্দ্রাদি গ্রহসমূহ তাঁহার গলার হারের মতো; তিনি আরো ঊর্ধ্বের লোক - তিনি বিরাট, অসীম, অনন্ত ও মহান। এই ক্ষুদ্র দেহটিতে একটি ক্ষুদ্র মালা পরাইয়া কী-বা আশ্চর্য কাজ করিতেছে।

গানটি তিনবার বলিয়াই তিনি সমাধিস্থ হইয়া যাইলেন। কিন্তু, তাঁহার কণ্ঠস্বর এত করুণ ও হৃদয়গ্রাহী হইয়াছিল যে, সেই কণ্ঠস্বর এখনো আমার কানে লাগিয়া রহিয়াছে। তিনি যেন হাত নাড়িয়া বলিতেছেন: জগৎ তুচ্ছ; জগতের এই জিনিস দিয়ে আমায় কী সাজাবে? অনন্ত, অনন্ত সব গ্রহ-তারা, আমি তো সর্বদাই সেই সকল প'রে থাকি। তার চেয়ে আমার মাথা আরো উপরে।

এই বিষয়টি আমার ভাষায় প্রকাশ করিবার শক্তি নাই। মুখের ভাব হাতের ভঙ্গী ও কণ্ঠের স্বর দিয়া তিনি এমন একটি ভাব ব্যক্ত করিয়াছিলেন যে, অসীম অনন্তের ভাবটি স্পষ্ট প্রকাশ পাইয়াছিল। 'শব্দ' হইতে মনকে 'শক্তি'-তে লইয়া যাওয়া ইহাকেই বলে। আমরা তো প্রথমে ফুলের মালা দেখিয়াই খুব আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলাম; কিন্তু এই গানটি বা নাদব্রহ্ম শুনিয়া মন অন্য প্রকার হইয়া গিয়াছিল।

Saturday, June 2, 2018

কীর্তন ও নৃত্যে

অনেক সময় বৈঠকখানায় কথাবার্তা শেষ হইলে পরমহংস মশাই দক্ষিণ দিকের ছোট উঠানটিতে গিয়া কীর্তন করিতেন। এই সময় দেখিতাম যে, পরমহংস মশাই তাঁহার কোঁচার কাপড়টি ফেটি করিয়া কোমরে বাঁধিতেন, অর্থাৎ কোঁচার কাপড়টি কোমরে দিয়া একটি গাঁট-বাঁধা করিতেন। জামাটি গায়ে থাকিত। অন্য সময় তিনি কখনো কাপড়টি কোঁচা দিয়া রাখিতেন, কখনো বা কোঁচাটি খুলিয়া লম্বা চাদরের মতো করিয়া কাঁধে ফেলিতেন। তিনি উঠানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণটিতে উত্তর দিকে মুখ করিয়া দাঁড়াইতেন। রামদাদা প্রায়ই তাঁহার ডান হাতের কাছে দাঁড়াইতেন। মনোমোহনদাদা বাঁ-হাতের কাছে দাঁড়াইতেন। অপর সকল ব্যক্তি মাঝে খানিকটা ফাঁক রাখিয়া পূর্ব দিকে ও উত্তর দিকে দাঁড়াইয়া থাকিতেন। নরেন্দ্রনাথ ও অঘোর ভাদুড়ী (ডাক্তার বিহারী ভাদুড়ীর জ্যেষ্ঠ পুত্র), ইহারা দুই জন উত্তর দিকের দেওয়ালের কাছে দাঁড়াইয়া থাকিত। নরেন্দ্রনাথ সেই সময় চোখ বুজাইয়া ধ্যানের ভাবে থাকিত। যুবা রাখাল বড় লাজুক ছিল এইজন্য সে ভিড়ের ভিতর পিছনে লুকাইয়া থাকিত কখনো সম্মুখে যাইত না। কখনো কখনো রামদাদার অপর এক মাসতুতো ভাই নৃত্যগোপালদাদাও1 কীর্তনে থাকিতেন।

রামদাদা ও মনোমোহনদাদা প্রথমে কীর্তনের গান আরম্ভ করিতেন। কীর্তনে খোল-খত্তাল বাজিত না। এক দিনকার কীর্তনের গান একটু স্মরণ আছে। গানটি হইল:

"হরি বলে আমার গৌর নাচে,
নাচে রে গৌরাঙ্গ আমার হেমগিরির মাঝে * *।"

এইটুকু আমার স্মরণ আছে আর কিছু স্মরণ নাই। রামদাদা ও মনোমোহনদাদা কীর্তনের গান আরম্ভ করিলে, পরমহংস মশাই মৃদুস্বরে সামান্য কীর্তন গাহিতেন এবং মাঝে মাঝে করতালি দিতেন। তাহার পর তাঁহার ভাবাবেশ হইত, একেবারে বিভোর হইয়া যাইতেন, তখন ঘাড় একটু ডান দিকে বাঁকিয়া যাইত, চোখ নিমীলিত হইত। তিনি তখন হাত দুটি সম্মুখের দিকে লম্বা করিয়া প্রসারিত করিতেন এবং ভাবের আবেশে সম্মুখের দিকে কয়েক হাত অগ্রসর হইয়া যাইতেন ও আবার পিছন দিকে ফিরিয়া আসিতেন। এইরূপ ভাবাবেশে যখন তিনি সম্মুখে ও পিছনে চলাচল করিতেন, তখন কেবল রামদাদা ও মনোমোহনদাদা কীর্তন করিতে করিতে ঠিক সঙ্গে সঙ্গে চলিতেন। এই নৃত্যের সময় পরমহংস মশাই-এর মুখ দিয়া কোনো কথা বাহির হইত না। তিনি তখন একেবারে ভাবে বিভোর হইয়া যাইতেন, ঘাড়টি বাঁকাইয়া অতি গম্ভীর মুখ করিয়া সম্মুখে ও পিছনে কেবল যাওয়া-আসা করিতেন। রামদাদা ও মনোমোহনদাদা বা অপর কেহই কীর্তনে নৃত্য করিতেন না। সুরেশ মিত্তিরকে কখনো কীর্তনে নৃত্য করিতে দেখি নাই। তিনি চশমাটি চোখে দিয়া পূর্ব দিকের ছোট দালানটির এক ধারে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতেন, কখনো বা দুই হাতে সামান্যভাবে একটু করতালি দিতেন। মাস্টারমশাইকে কীর্তনে নৃত্য করিতে দেখি নাই। অপর সকলেও স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতেন। এইরূপ, মিনিট আট-দশ চলাচল করিয়া পরমহংস মশাই স্থির হইয়া যাইতেন, আর যেন কিছু বাহ্যজ্ঞান থাকিত না। সেই সময়, রামদাদা ও মনোমোহনদাদা তাঁহাকে পরিক্রম করিয়া করতালি দিয়া কীর্তন করিয়া বেড়াইতেন। পরমহংস মশাই-এর দেহ সেই সময় নিশ্চল ও নিস্পন্দ হইয়া যাইত। এইরূপ খানিকক্ষণ থাকিবার পর আবার তিনি প্রকৃতিস্থ হইতেন। প্রায় আধ ঘণ্টা কাল কীর্তন হইবার পর, সকলে পুনরায় বাহিরের ঘরটিতে আসিয়া বসিলে আহারাদির উদ্যোগ হইত। ছোট উঠানটিতে বহুবার পরমহংস মশাই-এর কীর্তন হইয়াছিল, তবে সব বারই প্রায় এইরূপ এক প্রথা অনুযায়ী।


1. শ্রীযুত নৃত্যগোপাল বসু, পরে স্বামী জ্ঞানানন্দ অবধূত।

পায়ে প্রণাম

গরমিকাল, এক দিন সকলের আহার হইয়া গিয়াছে, মুখ ধুইতে সকলে নীচে চলিয়া যাইল। পরমহংস মশাই উপরকার ছাদে যাইলেন; গায়ে ছোট আস্তিনওয়ালা একটি জামা, পায়ে বার্নিশ করা চটি-জুতা। পান খাইয়াছিলেন; ঠোঁট মুছিলেন। পূর্ব দিকের পাঁচিলে ঠেস দিয়া দাঁড়াইলেন! দাদা আমাকে ডাকিয়া পরমহংস মশাই-এর কাছে লইয়া গেল। আমি তাঁহার পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া প্রণাম করিলাম। তখনকার দিনে পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া প্রণাম করার প্রথা একেবারেই উঠিয়া গিয়াছিল। বোধ হয় পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া এই আমার প্রথম প্রণাম করা। পরমহংস মশাই দেওয়ালে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া আমার সঙ্গে অতি স্নেহের সহিত অনেক কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। দাদাও দাঁড়াইয়া রহিল। আমিও পরমহংস মশাই-এর কাছে দাঁড়াইয়া রহিলাম। তিনি আমাকে খুব আশীর্বাদ করিলেন। ভিড় কমিয়া যাইলে আমি নীচে নামিয়া আসিলাম।

Thursday, May 31, 2018

আকর্ষণী শক্তি

নীচুকার বৈঠকখানায় বসিয়া থাকিবার সময় হউক, উঠানে কীর্তন করিবার সময় হউক, বা খাওয়ার সময়ই হউক পরমহংস মশাই-এর একটি অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি দেখিতে পাইতাম। পরমহংস মশাইকে স্থির হইয়া দেখা - ইহাই যেন আমাদের প্রধান কাজ ছিল। তাঁহার কথাবার্তা অনেক সময় আমাদের মনে থাকিত না। দেখিতাম এই তো সামান্য একজন পাড়াগেঁয়ে লোক আর আমরা কলিকাতার শিক্ষিত লোক সেই পাড়াগেঁয়ে লোকের কাছে বসিয়া আছি। আমাদের অনেকের মনে এরূপ ভাবও ছিল যে, আমরা কলিকাতার শিক্ষিত বড়ঘরের ছেলে কেবল রামডাক্তারের খাতিরে বা তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য তাঁহার গুরু - এই সামান্য লোকটাকে দেখিতে আসিয়াছি। কিন্তু দেখিতাম যে, পরমহংস মশাই-এর শরীর হইতে কি একটি আভা (Effluvium) বা শক্তি বাহির হইত। শক্তি বা আভা কেন্দ্র হইতে বাহির হইয়া সমস্ত ঘরটি ভরিয়া ফেলিত, তাহার পর সম্মুখের দালানটি ভরিয়া দিত। এমন কি সেই আভা বা শক্তি জানালার গরাদের মধ্য দিয়া বাহির হইয়া গিয়া রাস্তায় যেন ঢেউ খেলিত। আমি অনেক সময় এইটি দেখিতে পাইতাম। সেই সময়কার অনেকেই ইহা বিশেষ করিয়া দেখিয়াছেন এবং এ বিষয়ে কথাবার্তাও হইত। প্রথম যেন কি একটি শক্তি বা আভা আসিয়া ত্বক স্পর্শ করিত। ক্রমে সেই শক্তিটি মাংসের ভিতর ঢুকিতে শুরু করিত এবং তাহার পর ধীরে ধীরে, হৃদয়ের কাছে আসিতে থাকিত, ইহা বেশ অনুভব করা যাইত। তখন নিজের অন্তরস্থিত শক্তি বা ব্যক্তিত্বের সহিত বাহ্যিক এই শক্তির প্রবল দ্বন্দ্ব চলিত। অবশেষে বাহ্যিক শক্তি অভ্যন্তরীণ শক্তিকে পরাভূত করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিত; তাহার পর ব্যক্তিত্ব বা নিজের কোনো একটি শক্তি বা ক্ষমতা - এ সব কিছুই থাকিত না। কী যেন একটি শক্তিতে আচ্ছন্ন হইয়া যাইতাম! নিজের স্বাভাবিক যে সকল চিন্তা, ঘর-বাড়ির চিন্তা - এই সকল কিছুই থাকিত না। মন যেন কোথায় চলিয়া যাইত। দেহ ছাড়িয়া মনটা বা ভিতরটা যেন অন্য এক রাজ্যে চলিয়া যাইত। কাহারই বা দেহ, কাহারই বা মন; কাহারই বা বাসনা, কাহারই বা সংকল্প! জগৎ ও জগতের ক্রিয়াসমূহ দূরে পড়িয়া রহিয়াছে - একটা ছবির মতো। জগতের জন্য আকাঙ্ক্ষা, মায়া-মমতা কিছুই নাই; এমন কি নিজের হাত-পা দেহ যে আছে সে বোধও থাকিত না। বিদেহ বা অশরীরী অবস্থা যেন হইয়া যাইত। চিন্তা, বাসনা ও তর্ক-যুক্তি অতি তুচ্ছ বলিয়া বোধ হইত। এমন কি জপ-ধ্যানও যাহাকে ভগবৎ-লাভ বা সত্যলাভের অতি শ্রেষ্ঠ উপায় বলা হইয়া থাকে, তাহাও বন্ধন বলিয়া মনে হইত। শ্রদ্ধেয় নাগ মশাই1 একবার বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মশাইকে বলিয়াছিলেন, "এখানে2 এসেছ, চোখ বুজে বসে আছ কেন? দেখতে এসেছ, চোখ খুলে দেখ।" কথাটি অতি সত্য। জপ-ধ্যানও সেখানে বন্ধন বা অন্তরায় হইয়া যাইত। এইরূপ অশরীরী ভাব সকলের ভিতর তিন দিন পর্যন্ত থাকিত; ঠিক হিসাব মতো বলিলে, আড়াই দিন থাকিত। জগৎটাকে যেন দেখা যাইতেছে - পূর্বের ঘর-দুয়ার ইত্যাদি সব-কিছুই, কিন্তু অ-সংলগ্নভাবে। যাহা করিবার হাত-পায়ে তাহা করা যাইতেছে, কাজে কোন ভুল হইতেছে না, কিন্তু মনটা যেন অন্য স্তরে চলিয়া গিয়াছে। তাহার পর ধীরে ধীরে, এই শক্তিটি চলিয়া যাইত এবং স্বাভাবিক অবস্থায় আসিয়া যে-যাহার কাজ করিত।

একটি বিষয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, এক জন আর এক জনের গায়ের উপর কি যেন একটি আভা রহিয়াছে দেখিতে পাইত। এই আভা থাকার দরুন পরস্পরের মধ্যে একটি অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি আসিয়াছিল। ইহা ভালবাসা নয়; ভালবাসা ইহার কাছে অতি তুচ্ছ জিনিস। পরমহংস মশাই-এর প্রতি যেমন একটি আন্তরিক আকর্ষণ হইয়াছিল, পরস্পরের প্রতিও সেইরূপ আকর্ষণ হইয়াছিল। এইজন্য, পরমহংস মশাই-এর একটি আত্মগোষ্ঠী গড়িয়া উঠিয়াছিল; আর, এইজন্যই বাহিরের লোকেরা তাঁহার কাছে যাইতে তত ইচ্ছা করিত না। পরস্পরের সহিত না দেখা হইলে বড় কষ্ট বোধ হইত। দুই-তিন জন একসঙ্গে বসিয়া পরমহংস মশাই-এর সম্বন্ধে কথাবার্তা কহাই বড় আনন্দের বিষয় ছিল। রাস্তায় পরস্পরে দেখা হইলেই পরমহংস মশাই-এর কথাই হইত; সংসারের কথাবার্তা হইত না! অফিস হইতে আসিয়া মুখ-হাত-পা না ধুইয়াই দুই-তিন জনে বসিয়া বিভোর হইয়া পরমহংস মশাই-এর বিষয় কথাবার্তা কহিত। অন্য কোনো কথা, সামাজিকতা বা পূর্ব বন্ধুদিগের সহিত মেলামেশা - এ সব আর ভাল লাগিত না। নিজেরা যেন অন্য এক রাজ্যের লোক। বাহিরের জগতের দিকে মন রাখিবার আর কাহারো ক্ষমতা রহিল না। পরস্পরে বসিয়া যে কথাবার্তা হইত তাহার অন্য কিছু উদ্দেশ্য আছে বলিয়া কেহই জানিত না; কেবল পরমহংস মশাই-এর সম্বন্ধে কথাবার্তা কহাই উদ্দেশ্য। এইরূপ কথাবার্তা কহিতে কহিতে রাত্রি অধিক হইয়া যাইত; কিন্তু একে অপরকে ছাড়িতে পারিত না। রাত্রিতে একজন অপরকে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতে যাইত, আবার সে ব্যক্তি নিজ বাড়ির দরজা হইতে ফিরিয়া তাহাকে পৌঁছাইয়া দিতে আসিত। এইরূপ অধিক রাত্রি বা প্রায় সমস্ত রাত্রি পর্যন্ত উভয়ে পায়চারি করিত; কেহ কাহাকেও ছাড়িয়া যাইতে পারিত না। প্রত্যেক লোক বোধ করিত যে, পরমহংস-মশাই-মিশ্রিত-আঠা লাগানো রহিয়াছে বলিয়া কেহ কাহাকেও ছাড়িয়া যাইতে পারিতেছে না। এ বিষয় কাহারো সন্দেহ করিবার কিছুই নাই; ইহা আমরা স্পষ্ট অনুভব করিয়াছি।

এইরূপ আচ্ছন্নভাবে থাকিতে কাজ-কর্মের কোনো ব্যাঘাত হইত না, বরং অল্প সময়ের মধ্যে নির্ভুল কাজ হইত। ইহাকে উদ্ভ্রান্ত হওয়া বলা যায় না; অজ্ঞাতসারে ভাব-সমাধি হওয়া বলা যায়। জপ-ধ্যান করিয়া যেরূপ উচ্চ অবস্থায় উঠা যায়, অজ্ঞাতসারে তাহাই হইত। পরমহংস মশাই যে কিরূপ ও কত দূর তাঁহার সূক্ষ্ম বা কারণ শরীর বিকিরণ করিতে পারিতেন, ইহা তাহারই নিদর্শন। অবশ্য ইহা জানিতে হইবে যে সব সময় তিনি নিজ দেহ হইতে এই শক্তি বাহির করিতেন না। কারণ অধিকাংশ সময়েই তিনি সাধারণ লোকের মতো সাধারণভাবেই থাকিতেন; সাধারণ লোক হইতে মাত্র কিছু তফাৎ এই যা। কিন্তু তিনি নিজে যখন উচ্চ স্তরে উঠিতেন এবং যখন তিনি ইচ্ছা করিতেন তখন তাঁহার দেহ হইতে এই আভা বা শক্তি বাহির হইত।

বৌদ্ধ গ্রন্থে এইরূপ উচ্চ অবস্থায় অবস্থিতিকে, আনন্দময় লোকে অবস্থান বলা হইয়াছে; ইহা ভাবলোক ও জ্ঞানলোকে অবস্থানের বহু ঊর্ধ্বে বা উচ্চে। এই অবস্থাটি পাওয়া অতীব দুর্লভ। বোধ হয় সাধারণ লোক নিজের চেষ্টায় এই অবস্থা জীবনে দু-চার বার পাইতে পারে মাত্র। কিন্তু পরমহংস মশাই-এর শরীর হইতে যখন এই শক্তি বাহির হইত তখন সকলে অযাচিতভাবে এই অতীব দুর্লভ অবস্থা লাভ করিত। নরেন্দ্রনাথ যখন দক্ষিণেশ্বরে প্রথম গিয়াছিল, তখন পরমহংস মশাই হঠাৎ এই শক্তি নরেন্দ্রনাথের উপর প্রক্ষেপ করিয়া ছিলেন। নরেন্দ্রনাথের ভিতরটা তখন দেহ ছাড়িয়া যেন কোথায় উঠিয়া যাইতে লাগিল। রামদাদার বাড়িতে পরমহংস মশাই-এর এই ভাব বিকাশ বা শক্তি বিকাশ, যাহাকে বলে চকিতের ভিতর বিদেহ বা অশরীরী করিয়া দেওয়া, অনেক সময় অনুভব করিতাম। পরমহংস মশাইকে দেখিয়াছেন এমন লোক যদি আজও জীবিত থাকেন তো তাঁহারা এ বিষয়টি স্মরণ করিতে ও অনুভব করিতে পারিবেন।

স্যামুএল বিল-এর গ্রন্থে আছে যে, এক দিন প্রাতঃকালে গৌতম রাজগৃহে যাইয়া পথে ভিক্ষা করিতে লাগিলেন। গৌতমকে দেখিয়া আশ-পাশের লোকজন সকলেই অবাক হইয়া গেল; তাহারা নিজ নিজ কাজ-কর্ম ভুলিয়া গিয়া পরস্পর পরস্পরের প্রতি চাওয়া চাহি করিতে লাগিল। দাঁড়িপাল্লা লইয়া যাহারা জিনিস বিক্রয় করিতেছিল, পাল্লাটি তাহাদের হাতেই স্থির হইয়া রহিল; যাহারা পয়সা গণিয়া লইতেছিল, পয়সা তাহাদের হাতেই রহিয়া গেল; যাহারা মদ্যপান করিতেছিল, তাহাদের পাত্র হাতেই অচল হইয়া রহিল। স্ত্রীলোকেরা দরজার ফাঁক দিয়া, জানালা হইতে উঁকি মারিয়া, কেহ বা বারাণ্ডা হইতে, কেহ বা ছাদ হইতে এই অজ্ঞাত লোকটির দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চাহিয়া রহিল; কেহ কেহ বলিতে লাগিল ইনি নিশ্চয় দেবরাজ। কেহ বলিল, ইনি শত্রু, নরকায় ধারণ করিয়া পৃথ্বীতলে ভ্রমণ করিতেছেন; কেহ কেহ বা - সূর্যদেব, চন্দ্রদেব ইত্যাদি আখ্যা দিল। ওদিকে রাজা সেনিয় বিম্বিসার3 তোরণ হইতে অনিমেষ নেত্রে যুবা সন্ন্যাসীকে দেখিতে দেখিতে মনে নানা চিন্তা করিতে লাগিলেন।

এই যেমন একটি আকর্ষণী শক্তির উপাখ্যান আছে, পরমহংস মশাইকে আমরাও ঠিক এইরূপ দেখিয়াছিলাম। গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধ, চৈতন্য প্রভৃতি মহাপুরুষদিগের এইরূপ আকর্ষণী শক্তি ছিল। একটি উক্তি আছে: There is a divinity that hedges round a saint, অর্থাৎ সিদ্ধ মহাপুরুষদিগকে একটি দেবশক্তি আবরিত করিয়া রাখে। অপর মহাপুরুষগণের বিষয় গ্রন্থে পড়িয়াছি মাত্র, কিন্তু পরমহংস মশাই-এর জীবনে ইহা আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। দু-একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করিতেছি।

তখনকার দিনে এত ডাক্তারখানা ছিল না। শিমলা অঞ্চলে 'বাঘওয়ালা ডাক্তারখানা'-ই4 এক প্রধান ডাক্তারখানা ছিল। এক ব্যক্তির বাইশ বৎসরের একটি ছেলের টাইফয়েড অসুখ করিয়াছিল। টাইফয়েড রোগে তখন লোকে বড়-একটা বাঁচিত না; লোকটি প্রেসক্রিপসন লইয়া, হন্তদন্ত হইয়া, ডাক্তারখানায় ওষুধ আনিতে যাইতেছিল। লোকটিকে দেখিতে কালোপানা; দোহারা, লম্বা-চওড়া চেহারা; বয়স, পঁয়তাল্লিশ কি পঞ্চাশ হইবে। লোকটি আমাদের পাড়ার নয়। আমরা তাহাকে চিনিতাম, কিন্তু তাহার সহিত আমাদের আলাপ-পরিচয় ছিল না। বোধ হয় তাহার বাড়ি ছিল জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। সড়ক দিয়া যাইলে ওষুধ আনিতে অনেক দেরি হইবে সেইজন্য সে সিংহীদের পুকুর-পাড় দিয়া, রামদাদার বাড়ির সম্মুখের গলি দিয়া তাড়াতাড়ি যাইতেছিল। রামদাদার বাড়ির দরজায় আসিয়া সে দেখিল যে, রাস্তায় বেঞ্চি পাতিয়া অনেক ভদ্রলোক বসিয়া আছেন, যেন বাড়িতে লোকজন খাওয়ানো হইবে। ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া লোকটি জিজ্ঞাসা করিল, "আজ এখানে কি গো?" উপস্থিত এক জন বলিলেন, "এখানে দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস মশাই এসেছেন।" লোকটি বলিল, "কোনটি?" তখন তাহাকে বলা হইল যে, গালিচার উপর যিনি বসিয়া আছেন তিনিই হইতেছেন দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস মশাই। লোকটি রাস্তা হইতে জানালার গরাদের ভিতর দিয়া খানিকক্ষণ উঁকি মারিয়া দেখিল। ঠিক সেই সময় পরমহংস মশাই-এর গা হইতে আকর্ষণী শক্তি বাহির হওয়াতে যেমনই তাহা অচেনা লোকটির গায়ে লাগিল, অমনি সে অভিভূত হইয়া পড়িল। ভিতরে বসিবার আর জায়গা ছিল না, কাজেই, সেই লোকটি বাহিরে বসিয়া রহিল। তাহার পর সকলে যখন তেতলায় খাইতে গেল সেও দ্বিধা না করিয়া খাইতে গেল। আহার করিয়া সকলে নামিয়া আসিল। রাত্রে যখন পরমহংস মশাই ফিরিয়া গেলেন এবং সকলে যে যার বাড়িতে যাইতে লাগিল, তখন তাহার হুঁশ হইল যে, রাত্রি এগারোটা সাড়ে-এগারোটা বাজিয়া গিয়াছে, তাহাকে ওষুধ আনিতে যাইতে হইবে, ডাক্তারখানা হয়তো বন্ধ হইয়া গিয়াছে, বাড়ির লোকেরাই বা কি ভাবিবে!

পাড়ার একটি যুবক মদ-ভাঙ খাইয়া বেড়াইত। সে ওভারসীয়ার-এর কাজ করিত। নগদ টাকা যাহা পাইত তাহাতে সে মদ খাইত। রামদাদা এক দিন তাহাকে বলিয়াছিলেন, "আরে, তুই তো মদ খেয়ে বেড়াস, তোর চাট জোটে কি?" সে মাতাল লোক সরলপ্রাণে বলিল, "রামদাদা, বলতে কি চাটের পয়সা জোটে না, শুধু মদ খেয়ে বেড়াই।" রামদাদা উপহাসের ছলে তাহাকে বলিলেন, "তুই আজ সন্ধ্যের সময় আসিস। তোকে লুচি-আলুর দমের চাট খাওয়াবো।" মাতাল এই শুনিয়া তো ভারি খুশি। কাছেই তাহার বাড়ি। সন্ধ্যার সময় আসিয়া বাহিরের বেঞ্চির কাছটিতে বসিয়া রহিল এবং খাতিরে, ঘরের ভিতর গিয়া পরমহংস মশাইকে একটা প্রণামও করিয়া আসিল; আর ক্রমাগত বকিতে লাগিল, "লুচি আলুর দমের চাট কখন দেবে? লুচি আলুর দমের চাট কখন দেবে?" তাহার পর সকলের সঙ্গে সেও উপরে গিয়া খাইয়া আসিল। কিন্তু, সে এমন চাট খাইয়া আসিল যে, চিরজীবনের মত চাট খাইল! সে যে সময় আসিয়াছিল, সেই সময় পরমহংস মশাই-এর দেহ হইতে আকর্ষণী শক্তিটি বাহির হইয়াছিল। শক্তিটি তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। পরে সে ক্রমাগত খবর লইত "পরমহংস মশাই আবার কবে আসবেন?" যদিও তাহার মদ খাওয়ার অভ্যাসটা কিছু দিন রহিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তাহার ভিতরটা বদলাইয়া যাইতে লাগিল।

এই লোকটি নাগপুরে পরে চাকরি করিতে গিয়াছিল। কয়েক বৎসর সে শিমলায় ছিল না। এক বার নাগপুর হইতে ফিরিয়া আসিয়া সে দেখিল যে, পাড়ায় পুরানো লোক আর বড় কেহ নাই, অনেকেই মারা গিয়াছে। সে তাহার আত্মীয়দের সহিত দেখা করিয়া আসিয়া সকাল বিকাল আমার কাছে বসিয়া থাকিত আর বলিত, "ভাই, তাঁর কথা বল, আর জগতে কিছু ভাল লাগে না। আমি মাতাল লোক ছিলুম, লুচি আলুরদমের চাট খেতে গিয়েছিলুম; কিন্তু তিনি কী করে দিলেন? তাঁকে ছাড়া আর কিছু মনে আসে না! হায়, এমন অমূল্য রতন হাতে পেয়ে তখন কিছু বুঝি নি, লুচি আলুর দমই শ্রেষ্ঠ মনে করেছিলুম!"

এই লোকটির নাম বিহারী ঘোষ। পরে সে নাকি নাগপুরে একটি ঠাকুরঘর করিয়াছিল।


1. শ্রীযুত দুর্গাচরণ নাগ।

2. শ্রীরামকৃষ্ণ সমীপে।

3. 'বিম্বিসার' পালি সাহিত্যে - 'সেনিয় বিম্বিসার', এবং জৈন আগম গ্রন্থে - 'সেনিয়' (শ্রেণিক) অথবা 'ভিম্ভসার' (= বিম্বসার) নামে সুপরিচিত। অশ্বঘোষের 'বুদ্ধচরিত'-এ তিনি 'শ্রেণ্য বিম্বিসার' নামে অভিহিত হইয়াছেন। তাঁহার শ্বেত পতাকা ছিল বলিয়া পালি 'থেরগাথা' নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে তিনি 'পণ্ডরকেতু' (= পাণ্ডরকেতু শ্বেতকেতু) আখ্যায় ভূষিত হইয়াছেন।
পালি অর্থকথাকারগণের মতে - (১) 'সেনিয়' বিম্বিসারের খ্যাতি মাত্র; (২) বিম্বিসার সেনিয়-গোত্রীয়; অথবা (৩) তাঁহার বৃহৎ সৈন্যবল ছিল বলিয়া তাঁহাকে সেনিয় আখ্যা প্রদত্ত হয়। কিন্তু সংস্কৃত শ্রেণ্য বা 'শ্রেণিক' পদ হইতে এরূপ কোনো কল্পনা সিদ্ধ হয় না।
বিম্বিসার নামের ব্যুৎপত্তি সম্বন্ধেও চারি প্রকার মত বৌদ্ধ সাহিত্যে দৃষ্ট হয়: (১) 'বিম্বি' অর্থে সোনা, এবং তাঁহার দেহকান্তি সোনার ন্যায় দীপ্তিমান ছিল বলিয়া তাঁহার নাম হয় বিম্বিসার; (২) মাতার নাম 'বিম্বী', এবং বিম্বীর সার বা হৃদয়ের ধন বলিয়া তাঁহার নামকরণ হয় বিম্বিসার, অথচ তাঁহার পূর্ব ব্যক্তিগত নাম ছিল 'মহাপদ্ম' (রকহিল প্রণীত 'লাইফ অভ্ দি বুদ্ধ' দ্রঃ); (৩) তিনি দেখিতে 'বিম্ব' বা উদীয়মান সূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান ছিলেন, ইহাই তাঁহার বিম্বিসার নামের বিশেষত্ব; এবং (৪) বিম্বিসার একটি অর্থহীন ব্যক্তিগত নাম মাত্র।
অমরকোষের মতে, 'বিম্ব' শব্দে সূর্যের দেহ অথবা চন্দ্রের দেহ বুঝায়। বিম্বিসার নামের পূর্বোক্ত তৃতীয় ব্যুৎপত্তি গ্রহণ করিলে, বিম্বিসারের পরিবর্তে বিম্বসার নামই সার্থক হয়। এক্ষেত্রে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে, রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত 'ললিত-বিস্তর' গ্রন্থে বিম্বিসার এবং বিম্বসার - উভয়বিধ পাঠই পাওয়া যায়। বলা অনাবশ্যক যে, জৈন ভিম্বসার আখ্যা বিম্বসার নামেরই পরিপোষক। জৈন ভাষ্যকারগণের মতে, 'ভাসস্ত দীপ্যমান' অর্থে ভিম্ভসার।


4. এই ডাক্তারখানায় একটি পূরিত ব্যাঘ্র (Stuffed tiger) থাকিত এইজন্য সাধারণে ইহাকে বাঘওয়ালা ডাক্তারখানা বলিত।

Sunday, May 27, 2018

ভাগবত-কথা প্রসঙ্গে

রামদাদার বাড়িতে কয়েক মাস ভাগবত পাঠ হইয়াছিল। রামদাদা ভাগবত কথা সাঙ্গের পর, একদিন উৎসব করিয়াছিলেন। সময়টা বোধ হয় বর্ষার শেষে এক শনিবারে। প্রথম অবস্থায় রামদাদার মাহিনা অল্প ছিল। এই উৎসবের সময় রামদাদার দুই শত টাকা মাহিনা হইয়াছিল। উৎসবে বেশ লোক হইয়াছিল। পরমহংস মশাই বেলা সাড়ে তিনটা কি চারটার সময় রামদাদার বাড়িতে আসিলেন। তিনি দক্ষিণ দিকের উঠানটির পূর্ব দিকের ছোট দালানটিতে গালিচার উপর বসিলেন। উঠানে জাজিম পাতিয়া দেওয়া হইয়াছিল। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মশাই আসিয়া জাজিমের উপর বসিলেন। তাঁহার পরনে সাদা ধুতি; গায়ে একটি সাদা পিরান ও একখানি উড়ুনি। তখন তাঁহার জোয়ান বয়স, চল্লিশ কি বেয়াল্লিশ বৎসর হইবে। তিনি তখন নব বিধান হইতে সাধারণ সমাজে চলিয়া আসিয়াছেন। সুরেশ মিত্তির অফিস হইতে তাড়াতাড়ি আসিয়া পরমহংস মশাইকে দেখিতে আসিলেন। পরমহংস মশাই ও গোস্বামী মশাই নানা প্রকার কথা কহিতে লাগিলেন। কি কথা হইয়াছিল, আমার কিছুই স্মরণ নাই। তবে এইমাত্র স্মৃতি আছে যে, সকলেই যেন মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া পরমহংস মশাই-এর কথা শুনিতে লাগিলেন। তর্কবিতর্ক বা বাদানুবাদ কিছুই ছিল না; সকলেই একমনে তাঁহার কথা শুনিতে লাগিলেন। দেখিলাম যে, কী একটি শক্তি আসিয়া সকলকে অভিভূত করিয়া অন্যত্র লইয়া যাইতে লাগিল।

আমি বার বার এই কথাই বলিতেছি যে, পরমহংস মশাই-এর কথাবার্তা অপেক্ষা তাঁহার ভিতর হইতে যে একটি শক্তি বাহির হইত, তাহা অনেক উচ্চ স্তরের বস্তু। অল্প সময়ের ভিতর, ভাষা, শব্দ, উপস্থিত ব্যক্তি ও স্থান - এই সকল চিন্তা দূর হইয়া যাইত; মনটা যেন অন্য কোথায় চলিয়া যাইত, ঠিক যেন তিনি কেন্দ্র বা বিন্দু এবং শ্রোতৃবর্গ পরিধি। এইজন্য তাঁহার কথাবার্তা তত কিছু মনে থাকিত না, মাত্র একটি আনন্দের স্মৃতি থাকিত। ইহা চাপল্যের ভাব নয় বা উল্লাসের ভাবও নয়; অতি গম্ভীর, স্নিগ্ধ ও প্রাণস্পর্শী একটি ভাব বা শক্তি, যাহা তিনি ইচ্ছামাত্র নিজ দেহ হইতে বিকিরণ করিতে পারিতেন। এই ভাব বা শক্তির তুলনায় আনুষঙ্গিক ব্যাপারসমূহ অতি তুচ্ছ।

দেখিয়াছি যে, সাধারণ অবস্থায় পরমহংস মশাই একটি পাড়াগেঁয়ে অশিক্ষিত ব্যক্তির মতো। কথাবার্তার ভাষা কলিকাতার মতো নয়, পাড়াগেঁয়ে লোকের মতো এমন কি, দূষণীয়। কলিকাতার শিক্ষিত সমাজে বিগর্হিত অনেক শব্দ তিনি ব্যবহার করিতেন এবং তাঁহার আচার-ব্যবহারেও শিক্ষিত সমাজের বিগর্হিত ভাব বিদ্যমান থাকিত। মনে হইত, একটা বোকা-হাবা লোক, জগতের কিছুই বোঝে না। কিন্তু তিনি যখন মনটা উপরে তুলিতেন, তাহার খানিকক্ষণ পরে, তাঁহার মুখের ভাব, কণ্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গী ও চেহারা এমন পরিবর্তিত হইয়া যাইত ও তাঁহার শরীর হইতে এমন একটি শক্তি বাহির হইত যে, বেশ স্পষ্ট অনুভব করা যাইত - সকলে এক অতি মহান পুরুষের কাছে বসিয়া আছি। নিজেদের অপেক্ষা তিনি যে কত উচ্চ স্তরের লোক, তাহা কিছুই নির্ণয় করা যাইত না। তিনি যে ধীশক্তিসম্পন্ন এক অদ্ভুত পণ্ডিত পুরুষ - ইহা নয়; ইহারও উচ্চে - প্রচলিত সকল প্রকার ভাব ও চিন্তার বহু উচ্চে তিনি উঠিতেন; অন্য এক প্রকার লোক তিনি হইয়া যাইতেন। জগৎকে বা সৃষ্টিকে তিনি যে এক নূতন দিক হইতে দেখিতেছেন, এবং যাহা দেখিতেছেন, তাহা যে নিশ্চিত ও দৃঢ়, ইহা বেশ স্পষ্ট বুঝা যাইত। বলা বাহুল্য, তাঁহার চিন্তাশক্তি ও অপরের চিন্তাশক্তির মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। সাধারণ লোক পুস্তকাদি পড়িয়া থাকে ও তর্ক-যুক্তি ইত্যাদি দিয়া সাধারণভাবে চিন্তা করে এবং কথায় মারপ্যাঁচ করিয়া থাকে। ইহাতে শ্রোতার বা প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরক্তিভাব আসে। ইহাই হইল সাধারণ লোকের কথাবার্তা কহিবার তাৎপর্য। কিন্তু দেখিতাম যে, পরমহংস মশাই অ-চিন্তিতভাবে জগতের ব্যাপারসমূহ অন্য দিক হইতে দেখিতেন, যাহা পূর্বে কাহারো দৃষ্টিগোচর হয় নাই। জগতের নানা সম্পর্ক, চিন্তা, ভাব ও কারণ - এই সকল তিনি নূতন ধরনে দেখিতেন, এবং সেইগুলি তিনি শ্রোতাদের বুঝাইয়া দিতেন! শুধু বুঝাইয়া দিতেন তাহা নয়, স্পষ্ট ধারণা করাইয়া দিতেন, এবং সেগুলি যে সত্য, তাহা বিনা তর্ক-যুক্তিতে প্রমাণ করাইয়া দিতেন, ভাবগুলি ঠিক যেন রূপ ধারণ করিত। সকলে যে এক অতীন্দ্রিয় অবস্থা লাভ করিত ইহা বেশ অনুভব করিতে পারিত। তিনি যেন নিজের শক্তি দিয়া সকলের মনকে ভিতর হইতে কাড়িয়া লইয়া যাইতেন এবং জগৎটাকে এক নূতন দিক হইতে দেখাইতেন। এই ভাবটি আমি সর্বদাই অনুভব করিতাম। এইজন্য কথাবার্তা বা আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহে কখনো মন দিতে পারিতাম না। বহু কষ্টে ধ্যান-জপে যে অবস্থা পাওয়া যায় তাহা যেন তাঁহার পক্ষে নিম্ন স্তরের ক্ষেত্র বা স্বাভাবিক অবস্থা ছিল। এইজন্য তিনি সর্বদাই বলিতেন "অখণ্ড সচ্চিদানন্দ"। খণ্ড বা বিচ্ছিন্নভাবে কিছুই নাই, সমস্তই একীভূত।

Thursday, May 24, 2018

পরমহংস মশাই

পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে আসিলে প্রথমে যেমন জন চল্লিশ লোক হইত এবং রামদাদা তাঁহাকে বাড়িতে লইয়া আসার জন্য সশঙ্ক থাকিতেন, পাছে কেহ তাঁহাকে অবজ্ঞা বা উপহাস করে - ক্রমে ক্রমে সেই ভাব চলিয়া যাইল। পরমহংস মশাইকে সকল লোকে শ্রদ্ধা করুক বা না করুক, তাঁহার প্রতি বিদ্বেষভাব তাহাদের আর রহিল না। লোকসংখ্যা আরো বাড়িতে লাগিল; পঞ্চাশ হইতে এক শ', দেড় শ', এমন কি তিন শ' পর্যন্ত লোক আসিতে লাগিল। ধীরে ধীরে, অনেকেই তাঁহাকে একটু শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতে লাগিল, এবং তাঁহাকে 'দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস' বা 'রামডাক্তারের গুরু' না বলিয়া, 'পরমহংস মশাই' বলিতে লাগিল। এমন কি পরমহংস মশাইকে যে ব্যক্তি বিশেষ শ্রদ্ধা-ভক্তি করিত না, তাহার কাছেও যদি কেহ পরমহংস মশাই-এর সম্বন্ধে বিদ্রূপ করিত, তাহা হইলে সে চটিয়া যাইত। ব্রাহ্মণেরা প্রথমে প্রকাশ্যে তাঁহার প্রতি অবজ্ঞাভাব দেখাইতেন; ক্রমে তাঁহারা প্রকাশ্যে আর সেরূপ ভাব দেখাইতেন না; তবে সমাজের ভয়ে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতেন না। কারণ ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ হইয়া তাঁহারা কৈবর্তদের পূজারীর সহিত কিরূপে একত্র বসিবেন ও তাঁহাকে প্রণাম করিবেন। এই ছিল তাঁহাদের মনের ভাব।

পরমহংস মশাই-এর প্রতি পাড়ার সকল লোকের পূর্বকার ভাব চলিয়া গিয়া, বেশ একটি শ্রদ্ধার ভাব আসিতে লাগিল। তিনি যেন পাড়ার লোক, নিজেদের লোক ও সকলের শ্রদ্ধেয়, আর তাঁহার কাছে যাঁহারা যাইতেন, তাঁহারা সকলেই যে স্বগোষ্ঠীর লোক, এই ভাবটিও ধীরে ধীরে আসিতে লাগিল। এই স্বগোষ্ঠীর ভিতর বা আপনা-আপনির ভিতর পরস্পরের বাড়িতে খাওয়া চলিত। জাতাজাতির গোঁড়ামি আপনা-আপনির ভিতর কমিয়া যাইল। গোষ্ঠীর লোকের মধ্যে আর একটি ভাব আসিল - যে ব্যক্তি পরমহংস মশাই-এর কাছে যায়, তাহাকে বিশ্বাস করা যাইতে পারে। অজ্ঞাতসারে একটি সঙ্ঘ গড়িয়া উঠিতে লাগিল। পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে আসিলে যাঁহারা সর্বদা সেখানে আসিতেন তাঁহারা তাঁহাকে বেশ শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতে লাগিলেন। শ্রদ্ধা-ভক্তি যাঁহারা করিতেন না বা কোনো প্রকার চঞ্চলভাবের কথা কহিতেন, তাঁহাদের কাছ হইতে এই গোষ্ঠীর লোকেরা একটু তফাৎ থাকিতে লাগিলেন; এবং যাঁহারা শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতেন, তাঁহাদের সহিত বসিয়া কথাবার্তা কহিতেন। পরমহংস মশাইকে যাঁহারা রামদাদার বাড়িতে দেখিতে আসিতেন, তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে বেশ একটি টানও আসিতে লাগিল। এমন একটি টান আসিল যে, পরস্পরকে দেখিতে বা পরমহংস মশাই-এর সম্বন্ধে দুটো কথা কহিতে সকলেই যেন আনন্দ পাইত। স্বগোষ্ঠীর সকলের মধ্যে পরমহংস মশাই-এর বিষয় কথাবার্তা হইত এবং তিনি যে কথা বলিতেন, সেই কথাটির কি অর্থ ও কি তাৎপর্য - এই সকল বিষয় আলোচনা হইত। অপর কোনো কথাই সেই সময় হইত না; বা কেহ অন্য কোন কথা কহিতে পছন্দও করিত না। মোট কথা তাঁহার নাম, তাঁহার প্রসঙ্গ, তাঁহার বাসস্থান, তাঁহার প্রিয় ব্যক্তি - এ সকলই যেন মধুর বলিয়া বোধ হইত। ইহা বিশেষরূপে লক্ষ্য করিতাম যে, পণ্ডিত-মূর্খ, ধনী-দরিদ্র, এ সকল ভাব কিছুই থাকিত না। পরমহংস মশাই এত উচ্চ অবস্থা হইতে কথা কহিতেন যে, পণ্ডিত - মূর্খ হইত, মূর্খ - পণ্ডিত হইত, ধনী - গরিব হইত এবং গরিব - ধনী হইত। এইজন্যই পুনঃপুনঃ বলিতেছি যে, তাঁহার ভিতর হইতে কী একটি শক্তি বাহির হইয়া সকলকে অভিভূত করিয়া ফেলিত, সকলের মধ্যে এক নূতন প্রাণের সৃষ্টি করিত এবং সকলের চিন্তাধারা ও ভাবস্রোত অন্য প্রকার করিয়া দিত; এমন কি, নবীনতা ও প্রবীণতার পার্থক্যবোধও কিছু থাকিত না; যেন অশ্বত্থ গাছ ও দূর্বাঘাস একই হইয়া যাইত।

Wednesday, May 23, 2018

গঙ্গার ঘাটে কেশববাবুর বক্তৃতা

হৃদু মুখুজ্যের1 কাছে এক দিন শুনিয়াছিলাম যে, গরমিকালে, এক দিন শনিবারে কেশববাবু ষ্টীমার করিয়া স-দলবলে দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছিলেন। তিনি তো এত জনসমাগম হইয়াছে দেখিয়া, খুব আনন্দিত হইলেন। তাহার পর তিনি অনুনয় করায়, কেশববাবু গঙ্গার ধারে বড় ঘাটটিতে গিয়া, গঙ্গার দিকে মুখ করিয়া, বক্তৃতা দিতে লাগিলেন। হৃদু মুখুজ্যে বলিয়াছিলেন, "কেশববাবুর কী বক্তৃতার ক্ষমতা, মুখ দিয়ে যেন মল্লিকে ফুল বেরুতে লাগলো! অনর্গল তিনি বলতে লাগলেন। কেশববাবু টাউন হলে লিক্চার দিয়ে থাকেন, সে তো কখনো শোনা হয় নি; সেজন্য, কেশববাবুর লিক্চার শোনবার এত আগ্রহ হয়েছিল।"

পরমহংস মশাইও বক্তৃতা শুনিতেছিলেন, কিন্তু খানিকক্ষণ পরেই তিনি বিরক্ত হইয়া নিজের ঘরে চলিয়া যাইলেন। পরমহংস মশাইকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া কেশববাবু ভাবিলেন যে তাহা হইলে বোধ হয় বক্তৃতায় কোনো ত্রুটি হইয়াছে। কিন্তু অন্যান্য শ্রোতারা বলিতে লাগিল, "লোকটা অশিক্ষিত; মুক্খু, কোনো-কিছু বোঝে না, তাই চলে গেল।"

কেশববাবু বক্তৃতা শেষ করিয়া পরমহংস মশাই-এর কাছে আসিলেন। সেখানে কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় কেশববাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, "মশাই, কি ত্রুটি হয়েছে?" পরমহংস মশাই বলিলেন, "তুমি বলিলে: ভগবান, তুমি সমীরণ দিয়েছ, তরু-গুল্ম দিয়েছ। - এ সকল তো বিভূতির কথা। এ সব নিয়ে কথা কইবার দরকার কি? যদি এ সব বিভূতি তিনি নাই দিতেন, তা হলেও কি তিনি ভগবান হতেন না? বড়মানুষ হলেই কি তাঁকে বাপ বলবে; যদি তিনি গরিব হতেন, তা হলে কি তাঁকে বাপ বলবে না?" এইরূপ, 'গুণ' ও 'বস্তু'-র কথা, বিভূতি বা ঐশ্বর্যের অতীত হইলেন 'ব্রহ্ম', - এই সকল কথা হইতে লাগিল।

পর দিন রবিবার শিমলাতে এই কথাটি রটিয়া যাইল। তখন এত খবরের কাগজ ছিল না, সকল সংবাদ মুখে মুখে আসিত। বেলা নয়টা হইতে অনেক লোক গৌরমোহন মুখার্জী ষ্ট্রীটে আসিয়া জমা হইতে লাগিল, আর উন্মত্ত হইয়া এই কথা বলাবলি করিতে লাগিল; কারণ এই ভাবের কথা তখন কাহারো জানা ছিল না। আমাদের তখনকার সমস্ত সঞ্চিত জ্ঞান ছিল - কথকের মুখে কিছু কথা শুনিয়া, আর বাইবেলের কথা শুনিয়া; ইহার বাহিরের কিছু কথা আমাদের জানা ছিল না, কেহ ভাবেও নাই। বিভূতি ও ঐশ্বর্যের উপর যে কিছু আছে, তখনকার দিনে এ কথাটি নূতন কথা। অবশ্য কেহই তখনো পর্যন্ত ইহার বিশেষ তাৎপর্য বুঝিতে পারে নাই; তবে সকলেই কেবল বলিতে লাগিল, "বড়মানুষ হলেই কি বাপ হবে, আর গরিব হলে কি বাপ হবে না?" কথাটি নূতন হওয়ায় শিমলাতে লোকের ভিতর এইরূপ উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল। এখনকার দিনে এরূপ কথা খুব বড় কথা নয় কিন্তু তখনকার দিনে, ইহা অতি আশ্চর্যের কথা। আর সেই সঙ্গে একটি কথা উঠিল, "দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস মশাই কেশব সেনের মাথা ভেঙে দিয়েছেন। কেশববাবু আর মাথা তুলে কথা কইতে পারেন না।" বেলা এগারোটা সাড়ে-এগারোটা পর্যন্ত লোকেরা রাস্তায় জটলা করিয়া মত্ত হইয়া এই সকল কথাই বার বার বলাবলি করিতে লাগিল। রবিবারের সকালবেলা বলিয়া জটলা কিছু বেশি হইয়াছিল, বিশ-পঁচিশ জন লোক হইবে। শিমলার লোকেরা কিছু দিন পূর্বে যে ব্যক্তিকে অবজ্ঞা করিত, অশিক্ষিত ও বিকৃতমস্তিষ্ক বলিয়া উপহাস করিত, এখন তাঁহারই এই সব কথা শুনিয়া তাহারা স্তম্ভিত হইয়া গেল। পরমহংস মশাইকে যাহারা উপেক্ষা করিত এবং সামান্য লোক বলিয়া শ্রদ্ধা করিত না, তাহারা সেদিন হইতে পরমহংস মশাই-এর প্রতি নিজেদের মনের ভাবগতিক ফিরাইল। কেশববাবুর যে একচ্ছত্র প্রতিপত্তি ছিল, তাহার কিঞ্চিৎ হ্রাস হইল। এই দিন হইতে পরমহংস মশাই-এর প্রতি শিমলার লোকের একটু বিশেষ শ্রদ্ধা আসিল এবং তিনি একজন বিশিষ্ট লোক বলিয়া পরিগণিত হইতে লাগিলেন।


1. শ্রীযুত হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায়, শ্রীরামকৃষ্ণের ভাগিনেয়।

Monday, May 21, 2018

পরমহংস মশাই-এর প্রভাবে সমাজ

পূর্বে তরকারিতে নুন দেওয়া হইত না। আলুনি তরকারি হইত এবং পাতে পাতে নুন দেওয়া হইত। কিন্তু রামদাদার বাড়িতে নুন দেওয়া তরকারি চলিত এবং সকল শ্রেণীর ও সকল বর্ণের লোকই একসঙ্গে আহার করিত। অপর স্থানে লুচি ও নিরামিষ তরকারি হইলেও সকলে একসঙ্গে আহার করিত না। কিন্তু, রামদাদার বাড়িতে যখন পরমহংস মশাই আসিতেন তখন সকল বর্ণের লোকেই একসঙ্গে আহার করিতে বসিত। তখনকার দিনে এইটি বড় নূতন ব্যাপার; কারণ তখনকার দিনে খাওয়া-দাওয়া একটা বিষম সমস্যার বিষয় ছিল। সামাজিক ব্যাপারে এ সব কিছু চলিত না। এ বিষয়ে পরমহংস মশাই এক বার বলিয়াছিলেন যে, ভক্তের ভিতর জাত নাই; যাহারা ভক্ত তাহারা একসঙ্গে আহার করিতে পারে।

আরো দেখিতাম যে নিমন্ত্রণ না করিলেও অনেকে আসিতেন ও আগ্রহ করিয়া আহার করিয়া যাইতেন; এমন কি, বৃদ্ধ লোকেরাও পরমহংস মশাই আসিবেন শুনিলে, তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিয়া আহারও করিয়া যাইতেন। পরমহংস মশাই-এর এমন একটি আকর্ষণী শক্তি ছিল যে, অনিমন্ত্রিত হইয়াও কেহ দ্বিধা না করিয়া সকল লোকের সহিত একসঙ্গে আহার করিত। অন্য প্রকার আহার না করিলেও লুচি-তরকারি খাইত। এইরূপ খাওয়া শিমলাতে তো ছিলই না এমন কি কলিকাতার অন্য কোনো স্থানেও ছিল না। কলিকাতায়, তখনকার দিনে, ইহাতে একটা মহা হই-চই পড়িয়া গিয়াছিল।

এইরূপে ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে পরমহংস মশাই তাঁহার কাজ করিতে লাগিলেন, কোনো তর্ক-যুক্তি বা হুকুম চালাইয়া নয়, কিন্তু তিনি সকলের মন এত উচ্চ স্তরে তুলিয়া দিতেন যে, সামাজিক বন্ধন, খুঁটিনাটি - এ সব কিছুই মনে থাকিত না। এক অসীম, অনন্ত, মহা উচ্চ স্থানে তিনি মনটাকে তুলিয়া দিতেন যেখানে এরূপ সামাজিক ভাব কিছু থাকিত না; গোঁড়ামির ভাব একেবারেই থাকিত না।

আমরা প্রণাম করার প্রথাকে কু-সংস্কার বলিয়া উঠাইয়া দিয়াছিলাম। আমরা বলিতাম, "ওটা ডৌলের প্রথা, ওটার কোনো আবশ্যক নেই।" পরমহংস মশাই-এর সংস্পর্শে আসিয়া আমরা পরস্পরকে দুই হাত তুলিয়া প্রণাম করিতে শিখিলাম। প্রথম প্রথম প্রকাশ্যে যদিও ঐভাবে প্রণাম করিতে বাধ বাধ ঠেকিত, কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা পরস্পরকে প্রণাম করিতে শিখিলাম। পরমহংস মশাই নিজে প্রণাম করিয়া সকলকে প্রণাম করিতে শিখাইলেন। এই বিষয়ে শ্রদ্ধেয় গিরিশবাবুর উপাখ্যানটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

গিরিশবাবু এক দিন বৈকালবেলা বাগবাজার বোসপাড়ার গলির মোড়ে রকের উপর বসিয়াছিলেন এমন সময় পরমহংস মশাই গাড়ি করিয়া সেখান দিয়া যাইতেছিলেন। গিরিশবাবু তাঁহাকে দেখিয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া প্রণাম করিবার পূর্বেই পরমহংস মশাই তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। গিরিশবাবু আবার প্রণাম করিতে যাইলে পরমহংস মশাই পুনরায় তাঁহার পূর্বে প্রণাম করিলেন। বারংবার এইরূপ করায়, গিরিশবাবু প্রণাম করিতে ক্ষান্ত হইলেন। পরমহংস মশাই কিন্তু নিবৃত্ত না হইয়া, তাহার পরেও গিরিশবাবুকে প্রণাম করিলেন। গিরিশবাবু তখন মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, "দক্ষিণেশ্বরের পাগলা বামুনটার সঙ্গে আর প্রণাম করা চলে না। ওটা পাগলা বামুন, ওর ঘাড় ব্যথা হয় না।"

এই ঘটনাটি উল্লেখ করিবার সময় গিরিশবাবু বলিয়াছিলেন, "রাম অবতারে ধনুর্বাণ নিয়ে জগৎ-জয় হয়েছিল, কৃষ্ণ অবতারে বাঁশির ধ্বনিতে জগৎ-জয় হয়েছিল, কিন্তু রামকৃষ্ণ অবতারে প্রণাম অস্ত্র দিয়ে জগৎ-জয় হবে।"

কথাপ্রসঙ্গে এক স্থানে উল্লেখ করিয়াছি যে, পূর্বে লোক-জন মরিলে সহজে কেহ শবদাহ করিতে যাইত না। সকলেই দরজা বন্ধ করিয়া ঘুমাইত। ডাকিলে কেহ সাড়া দিত না। সে এক বীভৎস ব্যাপার! নরেন্দ্রনাথ এই সময় অনেক শব কাঁধে লইয়া দাহ করিতে গিয়াছিল; কিন্তু সে এই কাজ ঠিক যে পরমহংস মশাই-এর প্রভাবে করিয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না। বাবা ইহাতে রাগ করিতেন। কতিপয় সঙ্গী লইয়াও নরেন্দ্রনাথ এইরূপ শবদাহ সমাধা করিত। বলিবামাত্রই, নরেন্দ্রনাথ ও তাহার কতিপয় সঙ্গী ভিন্ন বর্ণের লোকের শব দাহ করিতে যাইত। বিপন্নের সেবা করাই ছিল এইরূপ কাজ করার প্রধান উদ্দেশ্য। এইরূপ সামান্য শুরু হইতেই লোকের ভিতর ভাব বদলাইতে লাগিল। জাতাজাতির কঠোরতা এই সময় হইতেই কিঞ্চিৎ কমিতে লাগিল। নরেন্দ্রনাথ হইল শিমলার এক বড়ঘরের ছেলে, যুবকদিগের অধিনেতা, এইজন্য নরেন্দ্রনাথের উপর কেহ কথা কহিতে বিশেষ সাহস করিত না। এই সকল বিষয় এখন অতি তুচ্ছ বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু তখনকার দিনে এই সকল ব্যাপার অতি গুরুতর বলিয়া বিবেচিত হইত।

যাহা হউক, এইরূপ অনেকগুলি নূতন ভাব বা নূতন প্রথা অজ্ঞাতসারে আমাদের ভিতর আসিতে লাগিল। কিন্তু তখনো আমরা প্রচলিত ভাবসমূহের ভিতরেই ছিলাম। এখন ইহা শুনিলে অবশ্য অনেকেই হাসিবেন কিন্তু আমি পুরানো কলিকাতার সমাজের কথা বলিতেছি এবং এখনকার সমাজ কি করিয়া পরমহংস মশাই-এর প্রভাবে পরিবর্তিত হইয়াছে, তাহার কথাই বলিতেছি। পরমহংস মশাই ভালবাসা দিয়া অজ্ঞাতসারে সমাজে এক চেতনা আনিয়া দিয়াছিলেন, তখন ইহা কাহারো চোখে ঠেকে নাই। অপরে তর্ক-যুক্তি ও বক্তৃতা দিয়া যে সকল সামাজিক প্রথা বা আচার-ব্যবহার পরিবর্তন করিতে পারেন নাই, পরমহংস মশাই ধীরে ধীরে, নিজ প্রভাব দিয়া সেই সকল প্রথা বা আচার-ব্যবহার অনেক পরিমাণে পরিবর্তন করিয়াছিলেন, অথচ যাঁহারা গোঁড়া লোক ছিলেন, তাঁহারাও ইহার বিরুদ্ধে কিছু বলিতে পারেন নাই।

Saturday, May 19, 2018

প্রচারকার্যে রামদাদা

পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে মাঝে মাঝে আসিলে, সেখানে সকলে সমবেত হইতেন। অতি প্রথম সময়ে কিরূপ অবস্থা ছিল, তাহা বলিবার জন্য এই সকল সামান্য কথার উল্লেখ করিতেছি। কারণ সাধারণ লোক উৎসবাদি করার জন্য তখন বিদ্রূপ ও উপহাস করিত; কিন্তু এই সকল বিদ্রূপাদি সত্ত্বেও, রামদাদা পরমহংস মশাইকে বাড়িতে আনিয়া উৎসবাদি করিতেন। তিনি অপরের বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা - এ সব কিছুতেই দৃকপাত করিতেন না। প্রথম অবস্থায় রামদাদাকে অনেক বাধা-বিঘ্নের ভিতর দিয়া পরমহংস মশাই-এর সহিত মেলামেশা করিতে হইয়াছিল ও তাঁহাকে শিমলাতে আনিতে হইয়াছিল, যাহা করিতে অপর কেহ সাহস করেন নাই। এইজন্য, সকলেই রামদাদার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকিবেন। রামদাদাই নির্ভীক হইয়া প্রথমে এই সকল কাজ করিয়াছিলেন; ক্রমে, অপর সকলে এই সকল কাজে তাঁহার সহিত যোগ দিয়াছিলেন।

রামদাদা সকল আলাপী লোকের বাড়িতে যাইয়া পরমহংস মশাই-এর কথা বলিয়া বেড়াইতে শুরু করিলেন, এবং তাঁহার ভাব ও ক্রিয়াকলাপ সকলকে বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। রামদাদা হইলেন পরমহংস মশাই-এর প্রচারকার্যের এক বিশেষ মুখপাত্র। এমন কি, কথা উঠিয়াছিল, 'রাম যে রকম করে ঢাক পিটিয়ে বেড়াচ্ছে, এ রকম করলে তাঁর দেহ থাকবে না; আর অত উচ্চ জিনিসকে হাটে-বাজারে দিলে লোক নিতে পারবে না।' কিন্তু রামদাদা এ সকল কথায় ভীত না হইয়া সকলকে পরমহংস মশাই-এর কথা বুঝাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন এবং মাঝে মাঝে সঙ্গীদের লইয়া দক্ষিণেশ্বরে যাইতে লাগিলেন। প্রথমকালে, রামদাদা পরমহংস মশাই-এর সর্বব্যাপী ভাবটি প্রচার করিবার একজন প্রধান উদ্যোগী ছিলেন।